– কেমন বুঝছেন ডাক্তারবাবু?  অচিন সুস্থ হয়ে যাবে তো ?

– দেখো, শরীরের অবস্থা এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে, এই অবস্থা থেকে সুস্থ হয়ে উঠবে, তা কিন্তু সত্যিই জোর দিয়ে বলা মুশকিল। ব্লাড পুশ করার পর খুব বেশি হলে সাতদিন পর্যন্ত একটু ভালো থাকছে। তারপর আবার শরীরটা খারাপ হতেই থাকছে। আবার সারা শরীরে সেই অসহ্য যন্ত্রনা শুরু হচ্ছে | যন্ত্রণার রকম এমনই যে সহ্য করাও কষ্টকর হয়ে পড়ে। অল্প বয়স, তাই এখনও পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এতগুলো কেমো নেবার পরেও অবস্থার উন্নতির কোনো লক্ষনই দেখতে পাচ্ছি না। সত্যি বলতে কি আমি এখন কোনো আশার বাণী আর শোনাতে পারছি না, ভরসাও দিতে পারছি না।

– ডাক্তারবাবু, আপনাকে তো আগেই বলেছি অচিনের সম্বন্ধে। কতটা দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছে ও। পড়াশোনাটা শিখে সবে চাকুরীতে জয়েন করেছিল। মাথা তুলে একটু দাঁড়ানোর চেষ্টা করার সাথে সাথেই ধরলো এই কালরোগে । ব্লাড ক্যান্সার। কতদিন হয়ে গেলো এইভাবে হাসপাতালে পড়ে রয়েছে। কত বোতল ব্লাড যে এ পর্যন্ত শরীরে পুশ করা হয়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তার ওপর এতগুলো কেমো দিতে হয়েছে। আরও কতগুলো দিতে হবে কে জানে। সে যাই হোক, তাতেও যদি সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে সংসারের হালটা একটু ধরতে পারে – এমতাবস্থায় তার থেকে ভালো আর কিছুই হতে পারে না। কিন্তু ডাক্তারবাবু, যেখানে আপনিই আর কোনো সাহস দিতে পারছেন না, আমরা সেখানে আশার আলোটাকে আর কিভাবে জ্বালিয়ে রাখবো। সত্যিই কি ডাক্তারবাবু, আর কিছুই করা যাবে না ?  দেখুন না আরো কিছুদিন চেষ্টা করে, যদি ভালো হয়ে যেতে পারে, যদি সুস্থ হয়ে যায়।

– আমিও তো মনেপ্রাণে সেটাই চাইছি, অচিন যেন ভালো হয়ে যায়। তবে, ভালো হয়ে যাবেই এই কথাটা আমি জোর দিয়ে বলতেই পারছি না। বরং দিনে দিনে শরীরের অবস্থা আরো খারাপের দিকেই যাচ্ছে। আমি তো চিন্তায় পড়েছি এই ভেবে যে, আর কটা কেমো নেবার ক্ষমতা দেখাতে পারবে। আমার এখন কি মনে হচ্ছে জানো ওর এই অবস্থা থেকে স্বয়ং ভগবানও ওকে আর ফেরাতে পারবেন না। তবুও বলবো, ভগবানে বিশ্বাস রাখো। ভালো হলে ভগবানের অসীম কৃপাতেই ভালো হয়ে উঠবে।

                      *                    *                    *                    *                    *

অচিন মানে অচিন্ত্য, আমার মাসতুতো ভাই। অজ পাড়াগাঁয়ে থাকে। বাবা, মা ছাড়াও আরো চারটি ভাইবোন আছে। মেসোমশাই এ বাড়ি সে বাড়ি পূজার্চনা করে যেটুকু রোজগার করতে পারেন, তাতেই সংসারটা চলে যায় কোনোমতে। অল্প কিছু জমি জায়গা আছে। না, চাষের জমি নয়। আম, কাঁঠাল, পেয়ারা আর কলাগাছের সমাহার থাকলেও সে জমি থেকে উপার্জনের আশাটা না রাখাই ভালো। সংসারের এই অবস্থায়, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা শেখানো বা স্কুলে পাঠানোর চিন্তা করাটা বাতুলতা মাত্র। তাই তাদের পড়াশোনা করাটা আর হয়ে উঠছে না। সারাদিন এ বাগান সে বাগান ঘুরে রান্নার দুটো কাঠ জোগাড় করতেই সময় পার হয়ে যায় | শৈশবও পার হয়ে গেছে খাবারের ইচ্ছেটা আরো বাড়িয়ে দিয়ে। গোয়ালে যে দুটো গরু আছে, তাদেরও তো দেখাশোনা করতে হয়। ঘাস, বিচালি জোগাড় করে, সেগুলো ঠিকমতো কেটেকুটে তাদের খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হয়। দুটোকে মাঠেঘাটেও ঘুরিয়ে আনতে হয়। গোয়াল ঘর পরিষ্কার করতে হয়, গোবর থেকে ঘুঁটে বানানোও তো কাজের মধ্যেই পড়ে। জ্বালানির সমস্যাটাও তো কিছুটা মেটে। ঘর সংলগ্ন যে একফালি জমি রয়েছে, সেখানে লঙ্কা, করলা, বেগুন, লাউ, কুমড়ো ইত্যাদি সব সবজি ফলাতে পারলেও তো সেটা সংসারের কাজেই লাগে। ফলে পড়াশোনা করার আর সময় কোথায়। কিন্তু এতো কিছু করেও তো সংসারের কোনো সুরাহা হচ্ছে না। আসলে হাতে কাঁচা পয়সা না থাকলে কিছুই করার উপায় থাকে না। উপার্জনের রাস্তা তো শুধু মেসোর পূজার্চনা করার মাধ্যমে। তাও তো নমাসে, ছমাসে এক আধটা। তার ওপর মেসো, মানে অচিনের বাবা, ইদানিং চোখে ভালো দেখতে পাচ্ছেন না, অসুবিধা হচ্ছে খুব। চোখটা দেখানোরও প্রয়োজন। কিন্তু টাকা লাগবে তো। যে ভাবে সংসার চলছে তাতে তো আর চোখের চিকিৎসা করানোর মতো বিলাসিতাও করা যায় না। তাই যেমন চলছে চলুক, যতদিন এইভাবে চালানো যায় আর কি। এইভাবে তো আর জমি জায়গা বিহীন হয়ে সংসার কে টেনে টেনে চালানো যায় না। ঘরের জন্য মাঠঘাট থেকে যদি শাকসবজি তুলে আনা যায় , পুকুরে ছিপ ফেলে যদি দু চারটে মাছ ধরে আনা যায় আর রথীন খুড়োর দোকান থেকে যদি ধার করেও কিছুটা চাল আনতে পারা যায়, তবে তো অন্ততঃ একবেলা খাওয়ার ব্যবস্থাটাও হয়ে যায়। তবে রথীন খুড়ো কি আর প্রত্যেক দিন ধারে চাল দিতে চাইবে। না দিলে বলবো, বাবার সামনেই একটা বাড়িতে পুজো আছে, সেখান থেকে তো কিছু পাবেই, তখন না হয় দামটা দিয়ে দেব। রথীন খুড়ো ভালো মানুষ। একথা শুনলেই নিশ্চয়ই আর ধারে চাল দিতে না করবেন না। সংসারের দৈন্যতা অচিন এখন একটু একটু অনুভব করতে শিখেছে। কষ্ট তো হয় ঠিকই, কিন্তু অল্প বয়স তো, তাই রাগটাই হয় বেশি। এইভাবে কি সারা জীবন কাটানো সম্ভব ? নিজেকেই প্রশ্ন করে অচিন। কিছু তো একটা করতেই হবে।

অনেক চেষ্টা করে অবশেষে অচিন একটা কাজের ব্যবস্থা করে উঠতে পারলো। দয়ানন্দ বাবু এ গ্রামেরই একজন পয়সাওয়ালা লোক। অনেকটা জায়গা জুড়ে একটা বিরাট রাজপ্রাসাদের মতো পাকাবাড়ি তৈরি করে নিয়েছেন বসবাসের জন্য। পাকাবাড়ির অনেক সুবিধা। এ তো আমাদের মাটির ঘরের মতো নয় যে একটু জোরে ঝড়বৃষ্টি হলেই খড়ের ছাদ উড়ে গিয়ে মাথার ওপরের আচ্ছাদনটাই ফাঁকা করে দেবে, বা ঘরের দেয়াল একেবারে তাসের ঘরের মতো হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে। অচিনের মাথায় এই ধরণের ভাবনা গুলো এসে ভিড় করতে থাকে। দয়ানন্দ বাবু এতো জমি জায়গা করে নিয়েছেন যে সারা বছর তাদের খাদ্যের কোনো অভাব হয় না। ঘরেই ভর্তি থাকে চাল, ডাল, তেল, গুড়ের মতো নিত্য প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিস। যাই হোক, অতশত চিন্তা করে কি হবে। পয়সা থাকলে পয়সা বাড়ানোর পন্থাও খুঁজে পাওয়া যায় আর পাকা বাড়িও বানিয়ে নেওয়া যায়। আমাদের তো কিছুই নেই, তাই অন্যের পয়সার ওপর ঈর্ষা থাকলেও মনের ভাবে সেটা যেন প্রকাশ না পেয়ে যায়। অন্যের সচ্ছলতার উৎসের খোঁজে না গিয়ে নিজেদের সংসারটাকে কিভাবে সচ্ছল রাখা যায় সেদিকটা নিয়ে এবার একটু ভাবার সময় এসে গিয়েছে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। একদিন হঠাতই অচিন সোজা চলে গেলো দয়ানন্দ বাবুর বাড়িতে, তার সাথে দেখা করবে বলে। দয়ানন্দ বাবু অচিনকে ভালোই চেনেন ঠাকুরমশাই এর ছেলে বলে। অচিনের বাবা দয়ানন্দ বাবুর বাড়িতে পুজোর কাজে এসে থাকেন। দয়ানন্দ বাবুর সাথে দেখা করেই একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেবার জন্য সরাসরি আবদার করে বসলো। নিজেদের দৈন্যতার কথাও শোনাতে থাকলো দয়ানন্দ বাবুকে। অচিন পড়াশোনা করে কিনা জিজ্ঞাসা করাতে সে জানালো যে গাঁয়ের স্কুলটাতে সে পড়তে যায়। কিন্তু সেখানে পড়াশোনার চাইতে খেলাধুলাই বেশি হয়। আসলে ছাত্র ছাত্রী অনেক আর শিক্ষক মাত্র দুজন। এতগুলো ছেলেমেয়েকে দুজন শিক্ষকের পক্ষে সামলানো সত্যিই মুশকিল | তাই কিছু ছাত্র ছাত্রী যখন পড়াশোনা করে বাকিদের তখন খেলতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অনেকে আছে যারা সারাদিনই খেলার সুযোগটাই নিয়ে নেয়, পড়তে আসেই না। তাছাড়া বই, খাতা পত্তরও তো সবার কাছে নেই যে পড়াশোনায় মন বসাতে পারবে। স্কুল থেকে যে দু চারটে বই এর ব্যবস্থা করে দিতে পেরেছে, ওই পর্যন্তই। নতুন বই পত্তর কেনবার কথা এই হতদরিদ্র গ্রামের মানুষগুলো চিন্তাতেই আনতে পারে না। সংসার চালানোর পয়সার ব্যবস্থাই করে উঠতে পারছে না, তো সেখানে বই পত্তর কেনার কোনো প্রশ্নই আসে না। যাই হোক, দয়ানন্দ বাবুকে নিজেদের দুঃখের কথা শুনিয়ে, অনেক অনুনয় বিনয় করে, অবশেষে একটা কাজ জোগাড় করে নিতে পারলো অচিন। দূরের মাঠে দয়ানন্দ বাবুর যে জমি গুলো আছে, যেখানে ধান চাষটা খুব ভালো মাত্রায় হয়, সেখানে সারাদিন পাহারা দিতে হবে, যেন কোনো পাখি বা ইঁদুরে ফসল নষ্ট করতে না পারে। বিনিময়ে দিনে দশটা করে টাকা পাবে। তবে হ্যাঁ, কাজ করলে তবেই টাকা পাবে, যেদিন আসতে পারবে না সেদিন কোনো টাকাও পাবে না। আনন্দে উদ্বেল হয়ে লাফাতে লাফাতে বাড়ি ফিরলো অচিন।

আমরা থাকি কলকাতায়। বাবা সামান্য একটা চাকুরী করেন। তাতেই সংসার চালিয়েও ছেলেদের পড়াশোনা শেখানোর অদম্য ইচ্ছেটাকে হারিয়ে যেতে দেন নি। তিন ছেলেকেই ভর্তি করিয়েছিলেন স্কুলে। ছেলেরাও বোধহয় বাবার কষ্টটাকে সামনে থেকে দেখতে পেয়েছিলো, উপলব্ধি করতে পেরেছিলো দৈন্যতাকে। তাই একান্তভাবেই পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেছিল। স্কুলের গন্ডি পার হয়ে কলেজে পড়ার সৌভাগ্যও এসে গেলো তাদের। স্কুলে ভালো পড়াশোনা এবং ভালো ফলাফল করার জন্যই শিক্ষকদের প্রিয় ছাত্র হয়ে উঠতে কোনো অসুবিধা হয় নি। সব শিক্ষকই জানতো, চিনতো এবং ভালোবাসতো । তাই যে দিন, স্কুলে এসে অংকের স্যারের সাথে দেখা করে জানালাম অচিনের কথা, তাদের দুর্দশা আর পড়াশোনা শিখতে না পাড়ার কথা, আর অনুনয় করলাম স্কুলে ভর্তি করিয়ে নেবার জন্য সেদিন সমস্ত কথা শোনার পর স্যারেরও মনটা একটু বিষণ্ণ হয়ে গেলো বলেই মনে হলো| বললেন, সবই তো বুঝলাম। কিন্তু ওকে তো ভর্তির পরীক্ষায় বসতেই হবে। পরীক্ষাটা দিক, তারপরে দেখি, আমি যদি কিছু করতে পারি। স্যারের কাছ থেকে আশ্বাসজনক কথা শুনতে পেয়েই অচিনকে নিয়ে এলাম কলকাতায়। কি রকম কি পরীক্ষা দিয়েছিলো জানিনা, তবে আমার মনে হয় স্যারের অশেষ অনুকম্পাতেই স্কুলে ভর্তির ছাড়পত্র পেয়ে গেলো অচিন। তবে স্যারের একটা শর্ততে রাজি হতেই হলো। বললেন, ‘শুধু ভর্তি করে দিলেই তো আর হবে না। ওর পড়াশোনার দিকে আমাদের নজর রাখতেই হবে যেন এই দুবছরেই সম্পূর্ণ তৈরী হয়ে যায় আর মাধ্যমিকটা যেন মোটামুটি ভালোভাবে পাশ করে স্কুলের ও শিক্ষকদের সম্মানটা বজায় রাখতে পারে। স্যারের কাছে সেদিন বড়ো গলা করে বলে এসেছিলাম ‘অচিনকে ভালোভাবে মাধ্যমিক পাশ করানোর দায়িত্বটা আমিই নিলাম। আমি ওর পড়াশোনার দিকে নজর রাখবো আর দেখবো যেন একবারের চেষ্টাতেই ভালোভাবে পাশ করে সকলের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে’।                  

                   *                             *                          *                         *                       *

আমি ইতিমধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং স্নাতক হয়ে কলেজ পাশ করেই চাকুরী পেয়ে চলে এসেছি কলকাতার বাইরে। তবে মাঝে মাঝেই ছুটি কাটাতে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ তৈরী করে নিতে পেরেছিলাম বলে, অচিনের পড়াশোনার ব্যাপারে মোটামুটি খোঁজ খবরটা রাখতাম। আমাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর অচিনের পড়াশোনা শেখার আগ্রহই ওকে খুব ভালোভাবেই মাধ্যমিক পাশ করিয়ে দিলো। ধীরে ধীরে নিজের অধ্যাবসায়ের জোরে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপ্লোমা কোর্সও ভর্তি হয়ে গেলো। অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর সাধনার জোরে সেটাও ভালোভাবে পাশ করে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে একটা চাকুরিও পেয়ে গেলো কলকাতাতেই। সুবিধে হলো এই যে বাড়ি থেকেই অফিস যাতায়াত করার সুযোগটাও পেয়ে গেলো। ভগবান বোধহয় এবার একটু মুখ তুলে চেয়েছেন। ছেলে কলকাতার একটা অফিসে চাকরি করছে। গ্রামের ভাঙা কুটিরে বসে বাবা-মার্ চোখও আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠলো। ভাবতে থাকলো, ‘এবার বোধহয় আমাদের দৈন্যদশা কাটবে। হাতে দুটো পয়সা আসবে। মনের মধ্যে অনেক ভাবনা এসে ভিড় করতে লাগলো। সংসার বড়। এরপরে আরো বড় হবে। সবার জন্য অন্ততঃ মাথা গোঁজার ঠাঁই এর ব্যবস্থাটা এবার করে ফেলতেই হবে। ঘরটা অনেক পুরোনো হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে ভেঙেও পড়ছে। তার ওপর বৃষ্টি হলে তো আর কোনো কথাই নেই। ঘরের চাল চুঁয়ে জল এসে বিছানা বালিশ সব ভিজিয়ে দেয়। তাছাড়া আরো দুএকটা ঘর বানিয়ে নেবারও প্রয়োজন আছে। হাতে দুটো পয়সা জমে গেলেই একটু আধটু জমি জায়গা কেনাকাটার ব্যবস্থাও করতে হবে।

কলকাতায় ঠিক সময়মতো যেতে পেরেছিলো বলেই না আজ পড়াশোনা শিখেছে, চাকুরী করছে। এটাই অনেক শান্তি এনে দিয়েছে মনের মধ্যে। মা বাবার কষ্ট তো কিছুটা হলেও লাঘব করতে পেরেছে। ভাই বোনেরাও আবার পড়াশোনা করার সুযোগ পাবে। বাবার চোখের চিকিৎসার ব্যবস্থাটা এবার অবশ্যই করতে হবে। অফিসের চেয়ারে বসে বসেই নিজের মনেই সাত পাঁচ ভেবে চলেছে অচিন। এবার পুজোতে মা’র জন্য একটা ভালো সুন্দর শাড়ি নিয়ে যাবো। কোনোদিন তো একটু ভালো কিছু চোখেই দেখতে পায়নি। ডুবে যাওয়া সংসারটাকে কোনোমতে টিকিয়ে রাখার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে গেছে। বাবার জন্য একটা ধুতি নিয়ে যেতে হবে। পূজার্চনা করতে এবাড়ি সেবাড়ি তো যেতেই হয়। পরনের কাপড়টা ঠিক ঠাক না হলে প্রাপ্ত সম্মানটুকুও পাওয়া যায় না। ভাই বোনেরাও নিশ্চয় খুব আশা নিয়ে বসে থাকবে যে শহর থেকে দাদা কিছু না কিছু তাদের জন্য আনবেই। এখন পুরোনো দিনের কথা বারে বারেই মনে পড়ে। নিজেদের দৈন্যতার কথা, মাঠে মাঠে গরু চরানোর কথা, দয়ানন্দ বাবুর ক্ষেতের ফসল পাহারা দেবার কথা। নাহ, এবার বাড়ি ফিরে রথীন খুড়োর দোকানের বাকি পয়সা মিটিয়ে দিতেই হবে। কতদিন হয়ে গেলো দেনার পরিমান নিশ্চয়ই আরো অনেক বেড়ে গেছে। রথীন খুড়ো এমন ভালো মানুষ, বাবাকে এতো ভালোবাসেন আর নিজের আপন দাদার মতো সম্মান করেন বলেই বোধহয় দেনার পরিমান বাড়তে থাকলেও মুখফুটে কোনোদিন দেনার পয়সা শোধ না করার জন্য বাবার কাছে কোনো অভিযোগই করেননি। অবশ্য খুড়ো বিশ্বাস করেন যে হাতে দুটো পয়সা আসলে বাবা প্রথমেই রথীন খুড়োর দেনা শোধ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এইসব ভাবনাগুলো মাথার মধ্যে এমনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে যে চেয়ারে বসে বসেই কেমন একটা ঘুম ঘুম ভাব, একটা ঝিমুনির ভাব এসে যাচ্ছে। এটা যে অফিস সেটা মনে পড়তেই জোর করে চোখ খুলে রাখার চেষ্টা করতে থাকে অচিন। উঠে গিয়ে চোখে মুখে জলের ছিটা দিয়ে আসে। কাজ নিয়ে বসে পড়ে। ইদানিং কিন্তু এই ঝিমুনি ভাবটা একটু বেশি করেই আসছে বলে মনে হতে থাকে অচিনের। দুমিনিট চুপচাপ বসে থাকলেই এই ঘুম ঘুম ভাবটা এসে যাচ্ছে। আলসেমিটা বেড়ে যাচ্ছে মনে হয়। হাত পা টা ঝেড়ে নিয়ে, একটু আড়মোড়াটা ভেঙে নিয়ে আবার কাজে মন দেয় অচিন। অফিসের বন্ধু বান্ধবরা আবার এই নিয়ে পেছনে লাগা শুরু করে দিলো। — ‘কি ব্যাপার রে অচিন, অফিসে আসলেই দেখছি ঘুম পাচ্ছে। আজকাল রাতে ঘুমোচ্ছিস না নাকি। সারারাত করছিস টা কি তাহলে’। সকলের ঠাট্টা, ইয়ার্কি ঠান্ডা মাথায়, শান্তভাবে, হাসিমুখেই সহ্য করে নিচ্ছে অচিন। কিন্তু নিজেও তো এ ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। হচ্ছেটা কি ? হাজার চেষ্টা করেও তো ঘুম ঘুম ভাবটা কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছে না। বন্ধু বান্ধবদের দোষারোপ করে কি হবে, ওরা তো যে ব্যাপারটা দেখতে পাচ্ছে সেই সম্বন্ধেই বলছে। ওদের খারাপ লাগছে বলেই না বলছে। কিন্তু, দুচোখ ভেঙে ঘুমের যে ইচ্ছেটা দেখা দিচ্ছে তাকে তো কিছুতেই সামাল দিতে পারছে না অচিন। এর মধ্যে আবার দু’দিন হলো একটু জ্বর জ্বর ভাব হয়েছে। হতে পারে, সিজনটা চেন্জ হচ্ছে বলে শরীরটা এমন খারাপ খারাপ লাগছে। ওষুধ খেয়ে নিলেই মনে হয় কমে যাবে।

ঠিক তাই।  ওষুধেই কমলো । এখন একটু ভালো লাগছে। 

দিন দশেক পর জ্বরটা আবার আসলো। খাওয়ার রুচিটাও একটু কমেছে বলে মনে হচ্ছে। খেতে একদম ভালো লাগছে না। সেদিন তো একরকম জোর করে জলখাবারটা খেতে গিয়েই গা টা গুলিয়ে উঠলো। যেটুকু খাওয়া হয়েছিল সব বমি হয়ে বেরিয়ে গেলো। মাঝে মাঝেই জ্বর আসছে আর কিছু খেলেই গা গুলিয়ে বমি হয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ির পর্যায়ে এসে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। আর নয়, এবার ডাক্তার দেখাতেই হবে। কি থেকে কি হয়ে যায় কে জানে।

আমাদের হাউস ফিজিশিয়ানের চেম্বারে নিয়ে গিয়ে দেখানো হলো। অনেক্ষন ধরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে পেটের এক জায়গায় চাপ দিতে লাগলেন। চাপ দিলেই খুব ব্যাথা লাগছে অচিনের। ডাক্তারবাবু পরামর্শ দিলেন হাসপাতালে ভর্তি করে দেবার জন্য। 

সেই থেকে হাসপাতালেই আছে অচিন। সাত দিন পর পরই ব্লাড পুশ করতে হচ্ছে। ব্লাড কমে গেলেই শুরু হচ্ছে অসহ্য যন্ত্রনা। কেমো দিতে হয়েছে অনেকগুলো। হাসপাতালের ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে দিনদিন অবস্থার আরো অবনতি হচ্ছে।  এরপরে আর কেমো সহ্য করতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। এমতাবস্থায় কি করা উচিত জানতে চাওয়াতে ডাক্তারবাবু বললেন পেশেন্টকে ঘরে নিয়ে যেতে। ইম্প্রোভমেন্টের কোনো লক্ষণই তিনি আর দেখতে পাচ্ছেন না। বরং বাড়ি নিয়ে গেলে মা-বাবা, ভাইবোনদের সান্নিধ্য পেয়ে যদি আরো দুটো দিন বেশি বেঁচে থাকতে পারে সেটাই কাম্য।

হতাশ হয়ে পড়লাম আমি। মাথার ওপর বজ্রপাত হলো বলে মনে হচ্ছে। ডাক্তার হাল ছেড়ে দিয়েছেন, কোনো আশার কথা শোনাতে পারেন নি। এতো চেষ্টা, এতো ছোটাছুটি, দৌড়ে দৌড়ে রক্ত জোগাড় করা, দামি দামি ওষুধ জোগাড় করা, সব কিছুই মূল্যহীন হয়ে গেলো। গ্রামের দুই হতদরিদ্র বুড়োবুড়ির শরীরে যে প্রাণটুকু ফিরে এসেছিলো একটু একটু করে, আচমকা এক ঝড়ের ধাক্কায় প্রাণের সেই প্রদীপখানি দপ করে জ্বলে উঠেই নিভে গেলো। সব আশার সমাধি হয়ে গেলো চোখের সামনে। আমরা কাঠের পুতুলের মতো জড় পদার্থ হয়েই বেঁচে রইলাম।

কলমে মানিকচন্দ্র গোস্বামী, জামশেদপুর

যাদবপুর য়ুনিভার্সিটির ইঞ্জিনিয়ার। বর্তমানে সরকারি চাকুরী থেকে অবসর প্রাপ্ত বৈজ্ঞানিক। বাংলা সাহিত্য নিয়ে লেখালেখির অভ্যাসটা অনেক দিনের।  

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here