অপত্যস্নেহ

0
525
              শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশ। সময়টা জোষ্ঠের মাঝামাঝি! প্রকৃতি প্রচন্ড রকম তেতে আছে। পাকশী অফিস পাড়ায় বিশাল মাঠের চারধারে সেই কবেকার লাগানো রেন্ট্রি-গাছগুলো প্রসারিত ডালপালা দিয়ে ঢেকে রেখেছে পুরো এলাকাটাকে। এখানে এলে মন উদাস হয়ে যায়।কবে কোন এককালে কারা লাগিয়েছিলো এসব ছোট ছোট চারাগাছ! বয়সের সীমারেখা পেরিয়ে সেসব চারাগাছ আজ মহীরুহ।
            সরকারি চাকুরীর সুবাদে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে আমাকে এখানে আসতে হয়েছে। লোনাপানি আবহাওয়ার মানুষ আমি। ভৈরব-পশুর-চিত্রা’র বুকে হেসেখেলে কেটেছে আমার জীবন! প্রকৃতির খুব কাছ থেকে দেখেছি আমি জীবনটাকে! কলুষতাহীন,পঙ্কিল-ক্লেদ বিবর্জিত জীবনটা নিরবিচ্ছিন্ন অনাড়ম্বরেই কেটে গেছে জীবনের সিংহভাগ। ঘর-সংসার আর সহজ-সরল জীবনে একমাত্র মেয়েটার সান্নিধ্য আমার ছোট পৃথিবী। আমার জীবনের তাল কেটে দেয় অফিসের ফিতেবাঁধা ফাইল। বদলীর আদেশে মাথায় আকাশ ভেঙে আসে।নির্ঝঞ্ঝাট জীবনে এ কোন কাল-কেউটের অভিশাপ? কোরবানীর খাসীর মত ব্যাঁ ব্যঁ করে কেঁদে ওঠে বুকের কষ্ট! গলায় পরানো দড়ি খোলার জন্য আপ্রান প্রয়াস! বন্দি শিকলে রক্তাক্ত কান্নাগুলো এক সময় থিতু হয়ে আসে! মানিয়ে নেবার অভিনয় করতে হয়। অনাত্মীয় পরিবেশে দম বন্ধ হয়ে আসে। পদ্মার নির্জীব স্রোতের মতই ঘুরপাক খায় বুকের কষ্টগুলো। ভাগ করে নেওয়ার মত নেই কোন বন্ধু-স্বজন।
       বিনিসুতোর মালা গাঁথার মত আমার আত্বজার খোঁজ নেওয়ার জন্য ভিন দেশীয় সংস্কৃতির সেলফোন একমাত্র ভরসা। কারণে অকারণে মনটা ছুটে যায় ছোট্টমেয়েটার সান্নিধ্য পেতে। কাজের চাপে ফুসরৎ নেই ঘরে ফেরার। ছল করে চোখের জল লুকোতে ছায়াঘেরা রেন্ট্রিগাছেরর নীচে দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে ফোন দেই,রিনরিনে সুর ভেসে আসেঃ
হ্যালো পাপা! তুমি কেমন আছো!
=আমি ভালো নেই মা!
= কেন?
= তোমাদের জন্য কষ্ট হয় যে!
= তাই বুঝি?
= হ্যাঁ মাগো!
= জানো পাপা! আমারও না ভীষন কষ্ট!  আমার বন্ধু-রা সবাই কেমন মজা করে মেলা দেখতে যাচ্ছে। তুমি নেই বলে আমি যেতে পারছি না। তুমি কবে আসবে পাপা?
= দেখি, মা!
= ওটা কীসের শব্দ পাটা?
         ঘুঁরুৎ-ঘুঁর, ঘুঁরুত-ঘুঁর, একটা মিষ্টি সুর ভেসে আসছে। শিরীষ গাছের উঁচু ডালে বসা পাখীর কন্ঠ থেকে। এখানে পাখ-পাখালীর অভয়ারণ্য। নাম না জানা হরেকরকম পাখি বাসা বেঁধে আছে দিনের পর দিন। হরিয়াল,কাঠ-ঠোঁকরা, আঁড়চোখে তাকানো প্যাঁচা, ধূসর রঙের বুলবুলি। এ রকম এক নাম না জানা পাখীর সুরে মুগ্ধ হয়েছে মেয়েটা।
= পাপা! ওটা কী পাখী?
= হরিয়াল হবে হয়তো!
= তুমি কি দেখেছো পাখিটাকে?
= না তো মা!
= একটু দেখো তো ভালো করে তাকিয়ে।
মেয়েটার আব্দার রাখতে পাখিটাকে খুঁজে ফেরে আমার দু’চোখ। দেখা মেলে না।
মেয়েটা এখন প্রায়শ ফোন করে ওই পাখিটার সুর শোনার জন্যই। আমাকে বলে, “যখনই পাখিটা ডাকবে তুমি আমায় ফোন করবে, কেমন পাপা? “
= আচ্ছা।
= আচ্ছা নয়, বলো ঠিক আছে!
= আচ্ছা! ঠিক আছে মাগো!
মেয়েটার অনুরোধে পাখিটার ডাক শুনতে শুনতে আমিও পাখিটার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছি! কাজ করি অথচ কানদুটো সজাগ থাকে পাখিটার ডাক শোনার জন্য!
          বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে, ছুটিতে যেতে পারিনি। মনে ভীষন আড়ামোড়া দেয় মেয়েটার কচি-ম্লান মুখটা! অলস দুপুর! নির্জন অফিস ঘর! সবাই দুপুরবেলা খাবার খেতে চলে গেছে। আমিও যাবো, তার আগে মেয়েটার সাথে একটু কথা বলবো! কারণ ওই পাখিটা এখন ডাকছে! মেয়েটাকে শোনাতে হবে। স্পষ্ট আওয়াজ পেতে আমি শিরীষ গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে মেয়েকে ফোন দিয়েছি। এ সময় নজরে এলো -, গাছের গোড়ায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে একটা পাখির ছা! দুটো মা পাখি ছানা-টাকে বাসায় ওঠানোর জন্য ডানা ঝাঁপ্টে উড়ে বেড়াচ্ছে। এদিকে আমার সেলফোনের রিং বেজেই যাচ্ছে! অপর প্রান্তে কেউই ধরছে না! মনটা খারাপ হলো। লাইনটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পাখিটার জন্য কেন জানিনা রাজ্যের কষ্ট এসে জমা হলো মনে। অসহায়া মা পাখিটার কষ্টে আমিও ব্যথিত! ওই উঁচুডালের বাসায় ছানা-টাকে তুলে দেয়ার সাধ্য আমার নেই! তাই পাখিটাকে নিবিড় হওয়ার সুযোগ দিয়ে আমি সরে এলাম। ভারাক্রান্ত মনেই অফিস করলাম।
        পরদিন সকালে
অফিসে এসে প্রথমেই আমি সেই গাছের নীচে এলাম ছানা পাখিটার খোঁজ নিতে! না, নেই-
হয়তো রাতের বেলা কোন কুকুর বিড়াল এসে টুপ করে মুখে পুরে দিয়েছে। তবুও মনকে প্রবোধ দিলাম, মা পাখি হয়তো ঠোঁটে করে বাসায় নিয়ে গেছে! ঘুঁরুৎ-ঘুর আওয়াজটা পাচ্ছি না! তবে বহুদূর থেকে ভেসে আসছে অবিশ্রান্তভাবে একটা কোকিলের কূঁ-উ, কূঁ-উ শব্দের সুর। মেয়েকে ফোন দিলাম।
মেয়ের মা জানালো, গতকাল সন্ধ্যা থেকে মেয়েটার ভীষন জ্বর! ধ্বক করে উঠলো বুকের ভেতর।
কষ্টের চোরাবালীতে আমি এক নির্বাক পিতা!অসহায়ত্ব ছাড়া যার আর কিছু নেই!
লেখক পরিচিতি : ©সিরাজুল ইসলাম,বাংলাদেশ ।কবি, গল্পকার, নাট্যকার, নাট্যশিল্পী, বাংলাদেশ বেতার খুলনা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here