ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে মহাশ্বেতা টেবিলে তার সেল ফোনটা দেখতে পেল না। বিরক্ত হয়। কোথায় যে রাখল! সোফার ওপর, টিভির মাথায়, কিচেনের সেলফে কোত্থাও পেল না।
মৌমিতা আজ সকালে কী পোস্ট দিল তা কাজের ঝামেলায় দেখাই হয়নি। ও খুব সুন্দর করে সমাজ ভাবনার ওপর আর্টিকেল লেখে। কবিতা লেখে। কখনও মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্ক আর তার অন্তঃসারশূন্যতা নিয়ে পোস্ট দেয়। এখন তো লকডাউন আর পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে পোস্ট দিচ্ছে। তাদের অভাব আর দুর্দশার কথা বলছে। ফেসবুকে মহাশ্বেতা ও তার বন্ধুগ্রুপ মুখিয়ে থাকে ওর পোস্ট পড়ার জন্য। গতকাল মহাশ্বেতাও একটা মজার পোস্ট দিয়েছিল। লকডাউনে কী করবে, পুরনো অ্যালবাম ঘাঁটছিল। স্কুল লাইফে একঢাল কালো চুল ছিল তার। দু’বেণী করে স্কুলে যেত। তারপর কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় লাইফের পিঠময় খোলা চুল কমতে কমতে বর্তমানে শূন্যের দশা। সকালে স্নান করে ভিজে চুলে অফিস গেলে মাইগ্রেনটা বাড়ে। অগত্যা পার্লার আর চুল ছোট করা। লকডাউনের গৃহবন্দী অবকাশে একটু মজা করতে ইচ্ছে করল। বিভিন্ন বয়সের সেই চুল-ছবির একটা কোলাজ করে ফেসবুকে পোস্টাল। ক্যাপশন দিল “কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে।” তারপর থেকে শুধুই কমেন্ট আর ইমোজিতে ভরে যাচ্ছে ওয়াল। গতকাল রাতে শুতে যাবার আগে পর্যন্ত প্রায় ২০০ মন্তব্য ও ইমোজি এসেছে। আজ সকালে সেটা কতটা বাড়ল দেখার জন্য মনটা হু-হু করছে। কিন্তু ফোনটাই তো হাওয়া। মাথা ঠিক মত কাজ করছে না।
তিন কামরার ফ্ল্যাট। দুটো অপেক্ষাকৃত ছোট রুম ছেলে বিক্রম আর মেয়ে তিতিরের দখলে। বড় বেডরুমটার মাঝখানে প্লাইউডের পার্টিশন দিয়ে স্বামী-স্ত্রী আত্মরক্ষা করছে এই লকডাউন পিরিয়ডে।
রজত সবে খবরের কাগজটা শেষ করে একটা সিগারেট ধরিয়েছে। মহাশ্বেতার আপত্তি ছিল খবরের কাগজ নেওয়াতে। ওতে নাকি ভাইরাস আসবে ঘরে। রজত দৃঢ় গলায় বলেছিল, “না, খবরের কাগজ আসবে। পেপার ছাড়া আমার চলবে না। স্যানিটাইজ করে নেব।” আজকাল কী হয়েছে মহাশ্বেতা যা বলে রজত তার উলটো বলে। মেজাজটা কেমন খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। একটানা চল্লিশ দিন গৃহে বন্দী থাকার ফল কিনা কে জানে। সারা বিশ্বে এই মারণ ভাইরাস কোভিড-১৯ থাবা বসিয়েছে। সব দেশে মানুষ মরছে অকাতরে। এখন পর্যন্ত ছাপান্ন লক্ষ মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়েছে। আর প্রায় ছ’ লক্ষের মত মানুষ মারা গেছে। ছেলে বিক্রম আমেরিকার মিশিগান ইউনির্ভাসিটিতে পোস্ট ডক্টরেট করতে যাচ্ছিল চার বছরের জন্য। দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে সিকিউরিটি চেকআপ করে ইমিউনাইজেশন সার্টিফিকেট না থাকায় তাকে ফেরৎ পাঠায় ইণ্ডিয়াতে জানুয়ারির শেষটায়। রজতের মেজাজ তাই ভালো নেই। এমন সময় কালবৈশাখী ঝড়।
-“বলি শুনছ? আমার ফোনটা নিয়েছ?”
-“কী আশ্চর্য! তোমার ফোন আমি নেব কেন?”
-“ন্যাকা। সাধু সাজা হচ্ছে। আমার ফোন যেন মোটেও ঘাঁটো না।”
-“সে দু’একবার নিয়ছি বটে। ব্যালেন্স ছিল না, ফোন করব, তাই।”
-“তাই! না অন্য কিছু খুঁজছিলে!”
-“কী আর খুঁজব। সবই তো ওপেন।”
-“ওপেন, মানে? মুখ সামলে, কী বলতে চাইছ?”
-“বলব আর কী। অফিস ছুটির পর তোমার শ্যামলদার সঙ্গে দিলখুশ কেবিনে বস না?”
-“বসি, তো! ওখানকার চা’টা খুব ভালো। খেলে সারাদিনের মাথাজ্যাম আর টেনশন কেটে যায়। ক্যাশে বসলে বুঝতে পারতে, চাপ কাকে বলে।”
-“বুঝছি তো। সেই বিয়ের পর থেকেই বুঝছি। বিশেষ দোকান, বিশেষ ব্যক্তির সঙ্গে চা খাওয়া।”
-“শুধু তুমি একা বুঝেছ? আমিও হাড়ে হাড়ে বুঝছি। কেন যে দিদির কথায় রাজি হলাম ।”
-“ওঃ! আফসোস হচ্ছে । তা সেপারেশন দিয়ে দিচ্ছি, তোমার শ্যামলদার গলায় ঝুলে পড়। শুনেছি তিনি তো এখনও ব্যাচেলর।”
-“খবরদার! মুখ সামলে। শ্যামলদার নামে একটাও খারাপ কথা বলবে না । জঘন্য ভাইরাস একটা।” মহাশ্বেতা গলা চড়াতে রজত এবার আরও কয়েক ডেসিমেল বাড়ায়।
-“এবার কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। আমি ভাইরাস?”
-“হ্যাঁ, হ্যাঁ! তুমি করোনা, কোভিড-১৯।”
-“তুমি তাহলে মারাত্মক স্পেনীয়-ফ্লু।”
-“….. “
-“….. “
-“কী করছ তোমরা? ড্যাডি, মম! এভাবে এত জোরে ঝগড়া করছ কেন? ফ্ল্যাটের অন্য লোকেরা তো শুনতে পাবে। বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে।” বাবা-মার ঝগড়া শুনে ছেলে বিক্রম ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে দু’জন।
- “বলি, তোমাদের ঝগড়ার কারণটা কী?”
-“এই দ্যাখনা, আমার সেলফোনটা পাচ্ছিনা, তাই তোর বাবাকে… “
কথা শেষ হওয়ার আগেই মেয়ে তিতির তার ঘরের দরজা খুলে বাইরে এল।
-“সরি, মম। আমার নেট প্ল্যান শেষ হয়ে গ্যাছিল, তাই তোমার ফোনটা নিয়ে গেম খেলছিলাম।”
রজত ও মহাশ্বেতা এবার দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে বুঝে নেবার চেষ্টা করছিল কে বেশি ভয়ানক ভাইরাস!
কলমে রবীন বসু, কসবা , কলকাতা
সাহিত্যের সব শাখাতেই বিচরণ। প্রকাশিত সাতটি কাব্যগ্রন্থ, তিনটি গল্পগ্রন্থ, একটি উপন্যাস। মহাশ্বেতা দেবী স্মৃতি পুরস্কার ও জেলার সেরা গল্পকার সহ দশটি পুরস্কার ও জীবন কৃতি সম্মাননা।