কার্ত্তিক মাসের ভোরবেলা। বাতাসে হালকা শীতের পরশ। লেপমুড়ি দেওয়ার সময় হয় নি, তবে চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে ঘুমের ঘোরে একাত থেকে ওকাত মেরেছেন কি হঠাৎ শুনতে পেলেন খঞ্জনীর মিষ্টি গুঞ্জরণ। ঐ গুঞ্জরণ চলতে চলতেই কার যেন দরদী গলায় ঘুম ভাঙানিয়া  প্রভাতী গান:-
১) জাগো গো শ্যামের কমলিনী রাই।
   পূবদিকে চেয়ে দেখ আর নিশি নাই।।
   শ্যামের অঙ্গে অঙ্গ দিয়া,
   কত সুখে রও ঘুমাইয়া।
   কুলমানের ভয় কি তোর নাই।।
   বাসি ফুল দাও ভাসায়ে,
   আনব মোরা ফুল কুড়ায়ে।
   মনের সাধে মোরা যুগল রূপ সাজাই।।

মনে হল বাড়ির পিছনের দিকটায় তে-মাথার মোড়ে যেখানে মাকালীর বেদীটা আছে সেখানে যেন বাজছে। গানের শব্দ ক্রমশঃ জোর হচ্ছে। বাড়ির তুলসী তলার কাছে এসে থামল কি? কিছুক্ষণ বিরতির পর আবার গান ধরেছেন। এবার কিন্তু গান ও খঞ্জনীর যুগলবন্দি ধীরে ধীরে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে মিলিয়ে গেল। রাঢ় বাংলায় যাঁরা মূলত গ্রামে বসবাস করেন তাঁদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলছে কি? রাঢ়বঙ্গে এটাই প্রভাতী সঙ্গীত নামে সুপরিচিত। স্থানীয় নাম টহল গান যেটা এখানকার ধর্মীয় সংস্কৃতির একটা অন্যতম অঙ্গ।

সাধারণত কার্ত্তিক মাসের পয়লা থেকে শুরু করে সংক্রান্তি পর্যন্ত পূর্ব বর্দ্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন গ্রামের বৈষ্ণব গায়কেরা প্রতি ভোরবেলায় পল্লীর পথে পথে রাধাকৃষ্ণ ও গৌরসুন্দর বিষয়ক ছোট ছোট গানগুলি গেয়ে থাকেন। বৈষ্ণব মতের কৃষ্ণ কীর্তন বা গৌরকীর্তনের একটি অংশ হিসেবে এই গান গাওয়া হয় আবার অনেকের মতে পদাবলী কীর্তনের ‘কুঞ্জভঙ্গ’ এর প্রথম পর্বগুলি টহল গানে পরিবেশিত হয়।

একটা গ্রামে বিভিন্ন জাতির বাস। তাঁদের মধ্যে যাঁরা বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী বা চলতি কথায় বৈরাগী তাঁরাই সাধারণভাবে এই টহল গান গেয়ে থাকেন। তবে বৈরাগীর অভাবে বা ইচ্ছা থাকলে অন্য জাতির লোকও গান গাইতে পারেন। এতে কোন সামাজিক বাধা নাই। গাইয়েটি ধুতি পরে, নগ্ন পায়ে, মাথায় পাগড়ি পরিধান করে, কপাল থেকে নাক অব্দি তিলক কেটে, ভালো করে চাদরখানা জড়িয়ে হাতে খঞ্জনী নিয়ে ভৈরব রাগে গাইতে থাকে:-

  ২)নিশি হলো ভোর ওরে মাখন চোর!
     বলাই দাদা তোরে ডাকিছে।
     ওরে নীলমণি, উঠে খাওসে ননী-
     দিনমনির উদয় হতেছে।
লাইনের শেষাংশটা লম্বা করে টেনে গেয়ে যায়। এক আশ্চর্য মাদকতা থাকে। ঘুম জড়ানো চোখে যে না শুনেছে সে ছাড়া অন্য কারোর পক্ষে অনুভব করা কঠিন। কোন কোন গ্রামে যেমন একাধিক গাইয়ে থাকে তেমনি আবার একজন গাইয়েরও দু তিনটে গ্রামে টহল গান গাওয়ার নজিরও রয়েছে। ভোর তিনটেয় উঠে বৈরাগী সাজে সজ্জিত হয়ে পাড়ায় পাড়ায় টহল গান গাইতে যথেষ্ট কৃচ্ছসাধন করতে হয়। পরিবর্তে অঘ্রাণ মাসে নবান্নের দিন সেই গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে পারিশ্রমিক হিসেবে নতুন চাল, ডাল, সব্জি, নগদ টাকা ইত্যাদি সংগ্রহ করেন। যদিও সেটা খাটনির তুলনায় খুবই নগণ্য। যেখানে গোটা গ্রাম ভোরের শেষ ঘুমটা জমিয়ে ঘুমায়, সেখানে এই গাইয়ে শীতের পরশ উপেক্ষা করে গ্রামের মঙ্গলের জন্য সারা মাস ধরে গেয়ে যায় নাম গান।এবার কয়েকটি গানের উদাহরণ দেওয়া যাক। গোকুলানন্দ বিরচিত ভোরাই গানে দেখা যাচ্ছে যে প্রভাতকালে বাড়ির উঠোনে শ্রীদাম, সুদামেরা গোচারণের জন্য উপস্থিত। মা যশোদা নন্দ লালা গোপালকে ঘুম থেকে ডাকছেন:-

৩) উঠ উঠ মোর নন্দের নন্দন প্রভাত হইল রাতি।
অঙ্গনে দাঁড়াঞা আছে সকল বালক তোমার সাথী।।
মুখের উপর মুখখানি দিয়া ডাকয়ে যশোদা রাণী।
কত সুখে পাঞা, ঘুমাইছ শুঞা, আমি কিছু নাহি জানি।।
নয়ন মেলিয়া দেখহ চাহিয়া উদয় হইল ভানু।
শ্রীদাম সুদাম ডাকয়ে সঘন, ওঠ ভায়া ওহে কানু।।

৪) অন্য একটা গানে যে চিত্র ফুটে ওঠে তাতে দেখতে পাই যে বালক গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু ঘুম থেকে উঠে শচীমাতার আঙিনায় নৃত্যরত:-

প্রভাতকালে শচীর আঙিনাতে
গৌরচাঁদ নাচিয়া বেড়ায় রে।
একে গোরার নবীন বেশ ঘুরাইয়া চাঁচর।  কেশ,
গোরার সোনার অঙ্গ ধুলায় লুটায় রে।।
জাগো নি গো শচীমাতা গৌর আইল প্রেমদাতা
গোরা ঘরে ঘরে হরিনাম বিলায় রে।।

৫) পদকর্তা বাসুদেব ঘোষ বিরচিত গৌরসুন্দর বা গৌরাঙ্গ কে জাগানোর একটি উদাহরণ:-

  ওঠ ওঠ গোরাচাঁদ নিশি পোহাইল।
  নদীয়ার সব লোক জাগিয়া উঠিল।।
  কোকিলার কুহুরব সুললিত ধ্বনি।
  কত নিদ্রা যাও হে গোরা গুণমণি।।
  অরুণ উদয় ভেল কমল প্রকাশ।
  শশধর তেজল কুমুদিনী বাস।।
  বাসুদেব ঘোষ কহে মনের হরষে।
  কত নিদ্রা যাও গোরা প্রেমের অলসে।।

৬) উঠিল নাগর বড় পিছে আলিসে-
     দ্বিয় আঁখি ঢুলু ঢুলু এলাইল বালিশে।
     এখনো শ্যামের ঘুম ভাঙে নাই-
     আঁখি ঢুলু ঢুলু শ্যামের ঘুম ছাড়ে নাই।
     সুবাসিত জল আনি শ্যামের পাখরে-
     ধোয়াইল বদন চাঁদ আপ নিখরে।
     হাসি হাসি এক সখী হাতে বাঁশি দিল,
     বাঁশির বেশ পেয়ে নাগর হরষিত হল।
     গত নিশিতে ছিলে কোথায়?
     বল হে নাগর ছিলে কোথায়?

৭) জাগো রে এইবার, ঘুমায়োনা আর, চৈতন্য এসেছে দ্বারে।
চৈতন্য এসেছে দ্বারে, কলির জীবের উদ্ধার তরে।।
জাগিয়া উঠো নদেরবাসি, উঠিল ভানু আর নাই নিশি।
অলস ত্যাজিয়া ভজ শ্রীহরি শুদ্ধ ভক্তি অন্তরে।।

তবে শুধু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বা চৈতন্য মহাপ্রভুর ঘুম ভাঙানোর জন্যই গান রচনা করা হয় নি; শ্রীরাধিকার ঘুম ভাঙাতেও গান বাঁধা হয়েছে। কৃষ্ণপ্রাণা রাধিকা তাঁর কৃষ্ণের কোলে মহাসুখে নিদ্রারত। তাঁদের পোষ্য আদরের পাখীদ্বয় শুক-সারি রাধাকে ডেকে তুলছে সেটাই গান আকারে ব্যক্ত হচ্ছে:-
৮) রাই জাগো রাই জাগো বলে শুকসারি ডাকে।
কত নিদ্রা যাও হে তুমি কালো মানিকের কোলে।।উপরের প্রভাতী গান গুলির বেশিরভাগই জনপ্রিয় গান। অনেক টহল গাইয়ে নিজেরাই গান বাঁধাতে ও সুর দিতে পারেন। তবে সবার পক্ষে মাসের তিরিশ দিনই তো আর নতুন নতুন গানের সম্ভার নিয়ে হাজির হওয়া সম্ভব নয়। তাই অনেকেই বাকী দিনগুলিতে “হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে।।”
এই ষোল নাম বত্রিশ অক্ষরে ভৈরব, ভৈরবী, বিলাবল, বিভাস প্রভৃতি প্রভাতী সুর বসিয়ে গেয়ে চলেন।
টহল গান মুসলিম সমাজেও দেখা যায়।
তবে তার স্থান কাল পাত্র আলাদা। টহুলে ফকির নামে একদল ফকির আছে যারা বছরে দুবার রাত্রি বেলায় বাড়ি বাড়ি গান গেয়ে ভিক্ষা করে বেড়ায়। যেমন পূর্ব বর্দ্ধমান জেলার কেতুগ্রাম থানার অন্তর্গত রাইখ্যা ও বিরুরি গ্রামে এই টহুলে ফকিরের দল আছে। যেমন বিরুরির একজন ফকির ইদল ফেতর ও বখরি ইদের আগের দিন মুরগ্রামে এসে রাত এগারোটা থেকে ভোর পর্যন্ত গ্রামের রাস্তায় রাস্তায় আল্লা নবির কিস্যা গেয়ে বেড়ায়। লোকবিশ্বাস এই গান যে যে বাড়িতে পৌঁছাবে সেই সেই বাড়ি সৌভাগ্যশালী হয়ে উঠবে। গান শেষে ভোরবেলায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে সিধে তোলেন।
এবার প্রশ্ন জাগতেই পারে যে এত মাস থাকতে কার্ত্তিক মাসের ভোরগুলোতেই কেন টহল গান গাওয়া হয়। কিছু গবেষক মনে করেন যে আগে বছরের শুরু হত অঘ্রাণ মাস দিয়ে। পরবর্তী কালে মুঘল সম্রাট আকবর খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে  বৈশাখ মাস থেকে নতুন বছর শুরু করেছিলেন। কিন্তু তার আগে অগ্রহায়ণ মাসই বছরের প্রথম মাস ছিল। তাহলে কার্ত্তিক মাস হচ্ছে বছরের শেষ মাস। নতুন বছর ধান কাটার মধ্য দিয়ে শুরু হবে। তাছাড়া কার্ত্তিক ঠাকুর প্রজননের দেবতা। নতুন বছরকে আবাহনের জন্যই বোধহয় বছরের শেষ মাসের ভোরগুলোতে ভগবানের নাম স্মরণ করা শুরু হয়েছিল। যাতে গ্রামের সকল অশুভ শক্তি দূরীভূত হয়ে শুভ শক্তির প্রবেশ ঘটে। আবার কিছু বিদ্বজনের মতে, আষাঢ়ে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রার আর গুরু পূর্ণিমার মাঝে যে শুক্লা একাদশী পড়ে তাকে হরিশয়ণী একাদশী বলে। এই একাদশী থেকে কার্ত্তিক মাসের রাস পূর্ণিমার আগে উত্থান একাদশী পর্যন্ত (মোট আটটি একাদশী) বাঙলার অনেক মেয়েরা চতুর্মাস্য ব্রত পালন করে। এই চার মাস শ্রীহরি ক্ষীরদ সাগরে অনন্ত শয্যায় শায়িত থাকেন। কেবল পদ সেবায় নিরত ও জাগ্রত থাকেন মাতা লক্ষ্মী। মাঝে ভাদ্র মাসের শুক্লা একাদশীর দিন হরি একবার পাশ ফেরেন মাত্র। তাই একে পার্শ্ব একাদশী বলে। কার্ত্তিক মাসের শুক্লা একাদশী বা উত্থান একাদশীর দিন ভগবান বিষ্ণুর ঘুম ভাঙে। তাই কার্ত্তিক মাসের ভোরবেলা জুড়ে ভগবান কৃষ্ণের নাম গান করা হয় যাতে শ্রীহরি তাঁর নিজের নামগান শুনেই ঘুম থেকে উঠতে পারেন।
বর্তমানে টহল গান শিল্পীর সংখ্যা খুবই নগণ্য। বেশিরভাগ বয়স্কদেরই এই গান গাইতে দেখা যায়। যুবকেরা খুব একটা আকৃষ্ট হচ্ছে না। কোথাও যেন একটা ভাঁটার সৃষ্টি হচ্ছে। তবুও ব্যস্ততম আধুনিক পরিবেশেও রাঢ় জননী আঁকড়ে ধরে আছে তার এই পুরোনো ঐতিহ্যকে। সরকার থেকে এঁদেরকে টহল শিল্পীর আলাদা মর্যাদা দিলে বোধহয় একটু অক্সিজেন পেলেও পেতে পারে, যাতে পরের প্রজন্ম এই টহল নামক লোকসঙ্গীত ঘরানার প্রতি একটু শ্রদ্ধাশীল হ’তে পারে।

তথ্যসূত্র: মুর্শিদাবাদ বীক্ষণ – পাক্ষিক পত্রিকা।  ‘বাঙলার মুখ’ – স্বপন কুমার ঠাকুর।
এছাড়া, রটন্তী ঘোষ (গোয়ালপাড়া), সামিউল ইসলাম (মুরগ্রাম)। 

কলমে কৌশিক রায় চৌধুরী, পূর্ব বর্দ্ধমান

প্রাথমিক শিক্ষক। এছাড়া ক্ষেত্র সমীক্ষা করে লোক সংস্কৃতি ও লোক ইতিহাস  নিয়ে লিখতে ভালো লাগে।



SOURCEকৌশিক রায় চৌধুরী
Previous articleমেঘ তুই আয়
Next articleছোট্ট সোনা
Avatar
Disclaimer: Monomousumi is not responsible for any wrong facts presented in the articles by the authors. The opinion, facts, grammatical issues or issues related sentence framing etc. are personal to the respective authors. We have not edited the article. All attempts were taken to prohibit copyright infringement, plagiarism and wrong information. We are strongly against copyright violation. In case of any copyright infringement issues, please write to us. লেখার মন্তব্য এবং ভাবনা, লেখকের নিজস্ব - কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত..................

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here