মনের ভিতর একটা খুশির আমেজ নিয়ে আমাদের চারজনের দলটা ফিরে চলেছি চাটিকোনা থেকে বিষম-কটক স্টেশনের দিকেই। যদিও ফিরতে আমার একেবারেই মন নেই- এত সুন্দর এই ছোট্ট জায়গাটা। ভাবা যায়না গ্রাম্য পথটার বাঁকের আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে এত সুন্দর ধাপে ধাপে একটা চ্যাটালো পাহাড়, যার ওপরে ওঠাও কষ্টকর নয়। পাহাড়ের একপাশ দিয়ে রীতিমতো গর্জন করে চওড়া হয়ে নেমে এসেছে ঝর্না; আসলে ফাউন্টেনের জল, যেজন্য খাওয়াও যায়। চাটিকোনা সুন্দর, শুধুই সুন্দর, ভয়াল একটুও নয়। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে গুহাও আছে, বেশ একটা রহস্য ভাব। চারপাশটা বড়ো বড়ো গাছ, গুল্মে ছাওয়া, ক্লান্ত হলে বসে জিরিয়ে নেওয়া যায়, স্বচ্ছ ঝর্নার জলে মুখ হাত ধোয়া যায়।
যে পথ দিয়ে স্টেশন থেকে হেঁটে এসেছিলাম, সে পথে একটা গাছে ছাওয়া গোলমতন জঙ্গুলে মাঠে আমাদের জন্য এক বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। সে হলো আদিবাসী হাট। হঠাৎ আমার চোখের দৃষ্টি একেবারে চুম্বকের মত টেনে নিয়েছিল এক দৃশ্য। একটি গোন্ড উপজাতীয় তরুণী, সুন্দর ছিপছিপে গড়ন, তামাটে রং, প্রকৃতির স্নেহ দিয়ে মেজে চকচক করছে। বুক থেকে হাঁটুর নিচে পর্যন্ত লাল পাড় সাদা একটা কাপড় বাঁধা, মেয়েটির কোলে একটি শিশু, বয়স বড়োজোর মাস দুয়েক হবে। হাসি উছলে পড়ছে তরুণীর সমস্ত শরীর দিয়ে। বহুদিন পরে বোধহয় হাটে বাপের বাড়ির গাঁয়ের সখীদের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। আজ এসেছে গর্বিত মা, সখীরা বাচ্চাটিকে কোলে নেবার জন্য অত্যন্ত আগ্রহী। মায়ের বাঁকা খোঁপার বেগুনী ফুলের থোকাটার মতন গোলাকার স্থানটা একটা মানবিক আলোর বৃত্ত হয়ে উঠেছে। ভাষা না বুঝলে কি আসে যায়, আমি তো মেয়েটার ও তার সখীদের অনেকদিন পর দেখা হওয়ার আনন্দ, শুভেচ্ছা, গর্ব সবটুকু বুঝতে পারছিলাম। একজনকে দেখলাম একটা পাখি নিয়ে বসেছে বিক্রির জন্য – ওটাই আজ তার পসরা। কাঁধে বাঁক ঝুলিয়ে হাঁড়িতে মহুয়ার মদ নিয়ে চলেছে অনেকে। দারিদ্র্য তাদের সারা অঙ্গে, পুরুষদের কোমরে ঘুনসি সম্বল। কয়েকঘন্টা পর যখন ফিরছি, দেখছি কোথাও কিছু নেই। পথের ধারে এদিক ওদিক পড়ে আছে বেহুঁশ কয়েকজন।
রায়গড়া থেকে রায়পুরগামী প্যাসেঞ্জার ট্রেনে ওঠার পর থেকেই তীব্র ঝাঁঝালো একটা মাদকতাময় গন্ধে একটু অস্থির লাগছিল। কামরা ভর্তি বস্তা বস্তা মহুয়া ফুল চলেছে। আর ডাউনে চালান যায় বিরাট বিরাট কাঁঠালের বস্তা। ভাই বলল, এই কাঁঠাল চালানের সময় নাকি এক শ্রেণীর রেলকর্মীদের বিশেষ প্রয়োজনেও ছুটি মেলেনা। বা কেউ হয়ত নেয়না। বিষম-কটক প্ল্যাটফর্মে নেমেই বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম। একেবারে আদর্শ ত্রিভুজ পাহাড়। দুধারে পাহাড় সারির মধ্য দিয়ে কেটে রেললাইন বেরিয়ে গেছে। দুপুরের খাবার নিমন্ত্রণ আগেই এসে গিয়েছিল ভাইয়ের একদা সহকর্মী সমীরদার বাড়ি থেকে। কিরণ্ডুল থেকে ওয়ালটেয়ার (ভাইজাগ) পর্যন্ত এমন কতজনের বাড়িতে যে মেঝে থেকে টেবিলে বসে পাত পেতেছি, তার ঠিক নেই। এখন চাটিকোনা থেকে চলেছি রেলগার্ড সমীরের কোয়ার্টারে। কোয়ারটারের কাছাকাছি আসতেই এটা চেঁচামেচির আওয়াজ পেলাম। একটি ছেলে চিৎকৃত অনুনয় করছে,
– ” আমার দরজা খুলে দাও, আমি কিছু করবনা, কথা দিচ্ছি। খুলে দাও না।”
মা বলছেন,” থাকো না বাবা একটু। তোমার কাকু পিসিরা আসছে, তারা যদি কিছু ভাবে-“। ছেলেটি দরজায় ধাক্কা মেরেই চলেছে,
– ” খুলে দাও, আমি কিছু করবনা, কাউকে কিছু বলবনা”।
এরমধ্যেই আমরা কড়া নাড়লাম। সমীরদার স্ত্রী সুমনা বেরিয়ে এলো। বিব্রত কিন্তু অত্যন্ত আন্তরিকভাবে বললো,
” তোমরা কিছু মনে করোনা। কদিন ধরে ছেলেটার একটু সমস্যা দেখা দিয়েছে। বোনকে দেখলেই ক্ষেপে যাচ্ছে, একেবারে সহ্যই করতে পারছেনা। তোমাদের সামনে কি করে ফেলবে তাই বন্ধ করে রেখেছি।”
ব্রতদার স্ত্রী সমতা বললো, “এরকম করোনা। এতে ও আরো রেগে যাবে। আমাদেরও খুব খারাপ লাগবে। ওকে খুলে দাও।”
সমীরদার মেয়েটি মুখ কাঁচমাঁচু করে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। শ্যামলা রঙের শ্রীময়ী মুখ, পড়ে ক্লাস সিক্সে। ডাকনাম রুমি। কোথায় সবাই মিলে হইচই করবে। কারণ বাঙালি এদিকে কম। কোনো অতিথি এলে সবারই খুব আনন্দ হয়। মনটা একটু বিষন্ন হয়ে গেলো। গৃহিণীর কিন্তু যত্নের ত্রুটি নেই। আমাদের কথায় ছেলেটির ঘর খুলে দিতে সে এসে আমাদের সামনে চেয়ারে বসলো। বোন ইতিমধ্যে রান্নাঘরে চলে গিয়েছে। ছেলেটিকে ভালো ছেলে বলেই জানতাম। পড়ালেখায় মাঝারিমানের, কিন্তু ভদ্র সভ্য। পরিবারের সকলকে খুব ভালোবাসে। প্রতিবেশীরাও তাকে পছন্দ করে। সংকুচিত ভাবে আমাদের সামনে বসে সে। একটা রুগ্ন ছাপ পড়েছে চেহারায়। সম্রাট নাম, ক্লাস ইলেভেনে পড়ে। নিজেই বললো, কদিন স্কুলে যাচ্ছেনা। ওর স্কুলে যেতে ভয় করছে।
আমরা একসাথে বসে খেলাম, সুমনা আর রুমি পরে খাবে। ইতিমধ্যে সুমনার কাছে জানতে পেরেছি দিন কুড়ি হলো সম্রাটের এই অস্বাভাবিকতা দেখা দিয়েছে। একদিন স্কুল থেকে – ” বোন কোথায়, বোন কোথায়” বলে চিৎকার করতে করতে বাড়ি ঢোকে। বোন স্কুল থেকে ফিরে খাবার খাচ্ছিল। বেরিয়ে আসতেই – ” শিগগির ঘরে যা” বলে ওকে ঘরে ঢুকিয়ে মা কে বলে, ” মা বোন কে একদম বাইরে বেরোতে দেবেনা। স্কুলে যেতে হবেনা, বোন ঘরে থাকবে”। মা যত বলে, ” ওমাঃ সেকি কথা? এরকম বলছিস কেন?” ও কেবল এককথাই বলতে থাকে।
সন্ধ্যেবেলা জানা যায় রেলের ক্যাসুয়াল সুইপার ছত্তিসগড়িয়া লছমিয়ার বছর ছয়েকের মেয়ে দুলিয়াকে পাওয়া যাচ্ছেনা। এই রেল কলোনির সব ঘরেই দুলিয়ার ছটফটে যাতায়াত ছিল। কোনো বাড়িতেই মেয়েটিকে সে রাতে পাওয়া যায়নি। পুলিশে খবর গেলো। এখানে বাঙালি, ওড়িয়া, ছত্তিশগড়িয়া, তামিল, তেলেগু সবাই মিলেমিশে থাকে। জানা যায়, দুলিয়াকে শেষ দেখা গেছে, প্রাইমারি স্কুলটার কাছে। স্কুলের কিছু আগের কোয়ার্টার থেকে বাঙালি মেয়ে মিনা ওকে সেদিন ফিতে দিয়ে চুল বেঁধে দুপুরের খাবার খেতে দিয়েছিল। পুলিশ খুঁজতে খুঁজতে চাটিকোনা পাহাড়ের পিছনে একটা নালার পাশে মেয়েটার মৃতদেহ পায়। বাচ্চা মেয়েটির ধর্ষিত, ক্ষতবিক্ষত দেহটা অনেকেই দেখেছে। জানা যায়, মেয়েটিকে শেষপর্যন্ত দেখা গিয়েছিল ‘রনি’র সঙ্গে। তার মা রেলের নার্স, বাবা রেলের ডাক্তার। রায়পুরে ওদিকে কোথাও পোস্টেড ছিল। পুলিশ ছেলেটিকে ধরেছিল কিন্তু সে জামানত থানা থেকেই পেয়ে যায়। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট আসে উঁচু জায়গা থেকে শক্ত কিছুর ওপর পড়ে মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে। গায়ের ক্ষতগুলো কোনো বুনো জন্তুর আক্রমণের চিহ্ন। কোনো ভিসেরা টেস্ট হয়নি। মেয়েটির দাহকার্য সারা হয়ে যায় নির্বিরোধে। রনি ছাড়া পাওয়ার পর থেকে সম্রাটের অস্বাভাবিকতা আরো বাড়ে। কলোনির সবাই ভাবছে এটা রনিরই কীর্তি কিন্তু ওদের অনেক টাকা ও অনেক ক্ষমতা। মা মুখরা, কেউ কিছু বলতে সাহস পায়না। শোনা যাচ্ছে, রনির মা ট্রান্সফারের আবেদন করেছেন, খুব জোরালো কারণ ও অর্থসহযোগে। শীঘ্রই বদলি হয়ে যাবেন। সুমনা জানালো যে সে ছেলেকে অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছে এই ঘটনার সাথে ও কোনোভাবে যুক্ত কিনা। কেনো তবে সেদিন বিকেল থেকেই এরকম আচরণ করছে? বললো, “এও বলেছি, রনি তো ছাড়া পেয়ে গেছে। তুই যদি কিছু করে থাকিস, বল। তোর কিছু হবেনা।” ছেলে আঁতকে উঠে বলেছে,” মা, রনিদা তো ছাড়া পেয়ে গেল। এজন্য আমার আরো ভয় করে। কেন তুমি একথা বলছো? আমি কিছু জানিনা।”
-” তবে দিদি দিনদিন ওর যতো রাগ যেন বোনের ওপর গিয়ে পড়ছে।”
ফিরে আসার জন্য আমাদের বিকেলের ট্রেনটা ধরতে হতো। ওই একটিই ট্রেন। কিন্তু ঠিক করলাম, সম্রাটের সঙ্গে কথা বলব। তাতে যদি বিশ্বের জঘন্যতম বাস জার্নি করে আসতে হয়, তাই হোক। সুমনার অসহায়তা, ওর ছেলে এবং এইজন্য মেয়েটার করুন পরিস্থিতি, এদিকে ওর বাবার নাকি তেমন মাথাব্যথা নেই, সে কাঁঠাল চালান দিচ্ছে। সম্রাট কে ডাকলাম, ” তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই। তুমি কি কথা বলবে? তুমি কি বুঝতে পারছ তোমার সবকিছু ঠিকঠাক চলছে না?”।
সে মাথা নিচু করে ঘাড় নাড়লো।
-” তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করে কিছু কথা বলতে পারবে? দেখবে তোমার সমস্যা কমবে।”
-” বলবো? যদি অন্যরা জানতে পারে?”
– “মা কে তো বলতে পারতে যে তুমি কিছু দেখেছ। মা তো কাউকে বলতেন না।”
ও কেমন সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কী করে জানলে?”
-” আমি জানি তুমি ভালো ছেলে। বোনকে কত ভালবাসো, মেয়েদের সম্মান করো। তাই তুমি কোন খারাপ কাজ করনি। কিন্তু হঠাৎ হয়ত দেখে ফেলেছো কিছু, তাই বোনকে নিয়ে ভয় পাচ্ছো, তাইনা?”
ও আঁতকে উঠে বললো, ” রনিদা দুলিয়াকে চকলেট কিনে দিয়ে চাটিকোনা নিয়ে গিয়েছিল। ও দুলিয়ার সাথে অসভ্যতা করেছে, দুলিয়া মরে গেছে।”
-” তুমি দেখেছ?”
-” তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হলে আমি বাসে করে ফিরে অনেকদিন চাটিকোনা ফলসের নিচে বসে থাকতাম। সেদিনও সেরকম গিয়েছিলাম। রোদ লাগছিল বলে একটা ঝোপের নিচে বসেছিলাম। দেখলাম রনি দার সাথে বকবক করতে করতে দুলিয়া আসছে, হাতে চকোলেট। রনিদা ছেলেদের দেখলে গাট্টা মারে, বাজে কথা বলে তাই আমি লুকিয়ে পড়েছিলাম। কিছু পরে দেখলাম, যেদিকে গুহামত আছে সেদিকে চলে গেলো দুলিয়াকে নিয়ে। তারপর দুলিয়ার চিৎকার শুনে উঁকি মেরে আমি সব দেখেছি। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আমি পালিয়ে আসি, রনিদা আমায় দেখতে পায়নি।
পিসিমনি, তুমি কাউকে কিছু বলনা। মাকে বলতে পারিনি, ভীষণ লজ্জা করছিল, ভয় করছিল যদি সবাই ভাবে আমি কিছু করেছি। রনিদা তো ছাড় পেয়ে গেলো, আমাকে তো ফাঁসিয়ে দেবে।”
-” আমি সাইকোলজির ছাত্রী, শিক্ষিকা, তুমি তো জানো। আরো কিছু আছে, বলো।”
সম্রাট হঠাৎ বলে বসল, “আগে তো বাবাকেই বলবো ভেবেছিলাম।” এবার ও কেঁদে ফেললো, ” আমি খারাপ হয়ে গেছি, দিনদিন খারাপ হয়ে যাচ্ছি। বোনকে দেখলে আমার মাথায় খুন চেপে যায়। পিসিমনী, চোখ বুজলেই দুলিয়া বোন হয়ে যায় আর আমি রনিদা। আমি পাগল হয়ে গেছি পিসিমনি, আমি আর ভালো হবোনা। আমি মরে যাবো, তাহলে বোধহয় শান্তি পাবো।”
ওকে শান্ত করে বললাম, “তোমার এমনকিছু হয়নি। ব্রতদা ডাক্তার, এখন তোমাকে ওষুধ দেবে। বাবাকে বলে যাবো, তোমাকে কলকাতা নিয়ে ডাক্তার দেখাবে। নিয়মিত ওষুধ খাবে, ভালো হয়ে যাবে। সম্রাট, এবার আমরা যাবো। কখন বাস আছে বলে দাও তো। আর, তুমি আমাদের একটু চা খাওয়াবে, যাবার আগে?”
ওর হাত কাঁপছিল। ঘর থেকে বেরোলাম। ও কিন্তু চা তৈরি করে খাওয়ালো। ব্রতদা কে বললাম কিছু ওষুধ দিতে যাতে একটু ঘুমোতে পারে। নার্ভের অস্থিরতা কিছু কমে। ওষুধ তো এখানে কিছুই পাওয়া যাবেনা। কালকের ফার্স্ট প্যাসেঞ্জারে পাঠানো হবে ঠিক হলো। ওর বাবাকে বারবার করে বলা হলো, যতো শীঘ্র সম্ভব, কলকাতায় নিউরো-সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে।
পরদিন কিছু ওষুধ রেল ড্রাইভারের হাতে পাঠানো হলো। মাঝেমাঝেই সমীরদা কলকাতায় এলো কিনা খোঁজ নিয়েছি, আসেনি। একদিন সুমনার ফোন এলো, “দিদি আমার সব শান্তি হয়ে গেছে। ছেলেটা আমার লাইনে ঝাঁপ দিয়ে ওর সমস্যা শেষ করে গেছে। ওর বাবা এখন কাঠের চালান লিখতে ব্যস্ত। আমি তো চাকরি করিনা, এই লোকটাকে ছাড়া তো আমার চলবেনা…”।
কলমে কৃষ্ণা চক্রবর্তী, ইছাপুর, পশ্চিমবঙ্গ
জন্ম ১৯৫২, ইছাপুর। কলকাতা ও কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা। ইছাপুর গার্লস হাইস্কুলের প্রাক্তন শিক্ষিকা। ধর্ম হিসেবে মানবতাবাদী।
[…] বিষম সমাধান […]