গল্প লেখার গল্প -পর্ব ১

 ধারাবাহিক গল্প -পর্ব ১

1
1270

প্রমিতা দেবী একটু আধটু লেখেন । ওই গল্প কবিতা টুকটাক এটা ওটা। কিছুদিন আগে যেমন একটা উপন্যাস লিখছিলেন। কিছুদূর অবধি সব ঠিকঠাকই ছিল। গোল বাঁধলো যখন লেখাটি তিনি নিজে একবার পড়লেন। ঠিক এইরকম একটা লেখাই তিনি যেন আগে কোথাও পড়েছেন। প্রমিতা দেবীর এই এক সমস্যা। নিজের লেখা কোনো গল্প কবিতা পড়লেই তার মনে হয় যে সেটা আগেই কেউ লিখেছে।চরিত্রের নামগুলোই খালি আলাদা। বাকি সব এক। বেশ কিছুদিন আগে একটা বেশ প্রতিবাদী কবিতা লিখেছিনলেন।কবিতাটা লিখে বেশ একটা আত্মশ্লাঘাও বোধ  করেছিলেন। দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছিলেন পাঠক সমালোোচকরা  তার কবিতা পড়ে মন্তব্য করছেন যে এইরকম একটা বলিষ্ঠ লেখা অনেকদিন কেউ লেখেনি। কিন্তু দু তিনবার পড়ার পরেই তার মনে হতে লাগল তার লেখা কবিতার সঙ্গে কোনো এক বিখ্যাত কবির কবিতার খুব মিল আছে। বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পর প্রমিতা দেবী বুঝতে পারলেন ও হরি ,তিনি জয় গোস্বামীর একটি লেখা একটি কবিতা মোটামুটি হুবহু নামিয়ে দিয়েছেন। প্রমিতা দেবী বুঝেই উঠতে পারেন না এটা কি করে সম্ভব! স্কুল কলেজ এ যখন পড়তেন তখন কোনোকিছু মুখস্ত করতে তার প্রাণ বেরিয়ে যেতো। আর আজ যখন তিনি নিজে কিছু লিখবেন ভাবছেন তখন কোথা থেকে  মুখস্থবিদ্যা এসে তার মাথায় ভীড় করে বসছে ! কদিন ধরেই এটা প্রমিতা দেবীকে খুব ভাবাচ্ছে।

এখনো যেমন ভাবছিলেন। এমন সময় বাইরে থেকে এতে চিৎকার চ্যাঁচামিচির আওয়াজ তার ভাবনাগুলোকে ছিঁড়ে দিল।  এর মধ্যে সব গলা ছাপিয়ে যে গলাটি প্রমিতা দেবীর কানে এসে পৌঁছল সেটি তার  একমাত্র কন্যা দুলকির। পোষাকি নাম অনুত্তমা। দুলকি একটু প্রতিবাদী চরিত্র। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল এই ‘দুলকি’ নামটাও প্রমিতা দেবীর নিজস্ব নয়। কোনো একটা গল্পে এই নামটা পেয়েছিলেন। প্রমিতা দেবী উঠে দরজা খুলে দিতেই দুলকি সজোরে সরোষে ঘরে আঁছড়ে পড়ল। প্রমিতা দেবী একটু ভয়ে ভয়েই  জিজ্ঞাসা করলেন , “কার সঙ্গে আবার ঝগড়া বাধালি ? তোর জ্বালায় তো  পাড়া ছেড়ে উঠে যেতে হবে। গল্প , উপন্যাস লিখতে গেলে মানুষের একটু শান্তি প্রয়োজন হয় দুলকি।” দুলকি বোতল থেকে জল খাচ্ছিল। মাঝপথেই খাওয়া থামিয়ে বড় বড় চোখ বলল ,”আবার ? আচ্ছাখালি ত লিখেই যাচ্ছ। ছাপতে  দেবে কবে?” শুনে প্রমিতা দেবীর বুক ঠেলে একটা নিশ্বাস বেরিয়ে আসল। “শখ তো হয়। কিন্তু  অন্যের লেখা গল্প , কবিতা কি করে নিজের নামে ছাপতে দিই বল। যাই লিখি সেটাই কেউ না কেউ আগে লিখেছে।” মায়ের কথা শুনে দুলকি হেসে ফেলল। নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল ,”ভাত বাড়ো। খিদে পেয়েছে। আমি জামাকাপড় ছেড়ে আসছি।”

ঘরের ভিতর থেকে জামাকাপড় ছেড়ে বেরিয়ে এসে দুলকি দেখল প্রমিতা দেবী তখনো রান্নাঘরে ভাত বাড়ছেন। পাশে তপন কাকুদের ফ্ল্যাট থেকে রাত সাড়ে আটটার টিভি সিরিয়ালের শব্দ শোনা যাচ্ছে। রান্নাঘরের ষাট পাওয়ার বালবের আলোয় মায়ের ঘেমো মুখটা দেখতে দেখতে দুলকি মায়ের  জন্য কেমন একটা কষ্ট অনুভব করলো। সত্যি তো মায়ের জীবনে কিইবা আছে ! দুলকির বাবা নিশিথরঞ্জন যখন মারা যান তখন প্রমিতা দেবীর কতই বা বয়েস ? দুলকি তখন ক্লাস এইট-এ পড়ে।সেই থেকে বলা যায় দুলকিকে প্রায় একা হাতে লই মানুষ করেছেন প্রমিতা দেবী। দুলকির দুই মাসি অবশ্য ছিল। বড় মাসি সমিতা আর ছোট মাসি রমিতা। এক মামাও আছেন । সঞ্জিত বসু। ভাই বোনেদের মধ্যে মা মেজো। নিশিথরঞ্জনের দিক দিয়ে আছেন কেবল এক খুড়তুতো কাকা। বিপদে আপদে এরা সবাই পাশে থাকেন। কিন্তু মনের দিক মা বড় একা। মাঝে মধ্যে এক আধটা সিনেমা দেখলেও টিভি একেবারেই দ্যাখে না। নেশা বলতে বই পড়া আর লেখা। মুখে না বললেও দুলকি জানে যে মায়ের অনেক দিনের চাপা বাসনা নিজের লেখা একটা বই ছাপানোর। মায়ের এই লেখার বাতিক নিয়ে মামা মাসিরা সুযোগ পেলেই মায়ের পেছনে লাগে। মা অবশ্য তাতে কিছু মনে করে না। খালি হাসে।

রান্নাঘরে মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে দুলকি বলল, “এভাবে হয় না মাদামমোজেল (দুলকি মাঝে মাঝেই মাকে আদর করে মাকে মাদামমোজেল বলে ডাকে)।” তোমার চারপাশ থেকে, তোমার নিজের জীবন থেকে গল্পের রসদ জোগাড় কর। তবে তো তোমার লেখা তোমার হবে। নইলে সারা পৃথিবী জুড়ে যুগ যুগ ধরে এত এত বই লেখা হচ্ছে কোথাও তো সব লেখাগুলো একইরকম মনে হবে। মনে হবে এ ওর থেকে টুকেছে।”

প্রমিতা দেবী মেয়ের কথায় হেসে ফেললেন। বললেন, “আমার জীবন থেকে গল্প !” তারপর ভাতের থালা নিয়ে টেবিলের দিকে যেতে যেতে বললেন, “আমার জীবনে গল্পের মতো কিছু থাকলে তো ! সাদামাটার চেয়েও একঘেয়ে আমার জীবন। বাবা ভালো সরকারী করতেন। তাই তিন ভাইবোনকে গড়পড়তা ভাবে মানুষ করতে কোনো অসুবিধে হয়নি। সব ভাইবোনই  কলেজের গন্ডী পেরিয়েছি। বিএ পাশ করার পর সঞ্জ ু  চাকরী করতে ব্যাঙ্গালোর চলে গেল আর আমাদের বোনেদের  বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ে না করে চাকরী করার বৈপ্লবিক মনোভাব আমাদের বোনেদের ছিল না। আর থাকলেই বা শুনছে কে ?”

“আর বিয়ের পরের এপিসোড ? সেখানেও কোনো গল্প নেই বলতে চাও ? রোম্যান্সের গল্প , সাস ভি কভি বহু থির গল্প ?” দুলকি ভাতের দলা মুখে ঢোকাতে ঢোকাতে চোখ মটকে জিজ্ঞাসা করলো।

প্রমিতা দেবী মেয়ের প্রশ্ন করার ধরন দেখে হেসে ফেললেন। “বিয়ের পর ? সে তো আরো সাদামাটা । আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারে মেয়েদের কি করে শ্বশুরবাড়ীতে মানিয়ে নিয়ে থাকতে হয় সেটা ছোটবেলা থেকেই স্কুলের সিলেবাুয়।পাশাপাশি এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটি হিসেবে পড়ানো হয়। তাই কমবেশি মানিয়ে নিতে কোনো অসুবিধেই  হয়নি। প্রমিতা দেবী খেতে খেতেই কথাগুলো বলতে লাগলেন । শ্বশুর শ্বাশুড়ির কথা ছেড়ে দিলাম তোর বাবা নিপাট ভালো মানুষ ছিলেন। কোনোদিন উঁচু গলায় কথা বলেননি আমার সাথে। যা খেতে দিতাম খেতেন , যা পরতে দিতাম পরতেন। এই রকম একটা জীবন থেকে গল্পের কি রসদ পাব ? তোর বাবা মারা যাবার পরও যা রেখে গেছেন ব্যাংক ব্যালেন্স, বাড়ী ভাড়া আর পেনসনের টাকা হিসেবে তাতে মোটের অপর জীবন চলে যাবে। প্রমিতা দেবী কিছুক্ষণ থামলেন নিশ্বাস নেওয়ার জন্য । দুলকিও অপেক্ষা করতে লাগল মায়ের পরের কথাগুলো শোনার জন্য। অল্প কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে প্রমিতা দেবী বললেন —-“এভাবে হয়?”

মাকে দুঃখ পেতে দেখে দুলকি খেতে খেতে হেসে ফেলল। বলল ,” আচ্ছা মা মানুষ এইরকম একটা নিশ্চিন্ত জীবন কাটাতে পারলে ধন্য হয়ে যায় আর তুমি দুঃখ পাচ্ছ ?”   

প্রমিতা দেবীও হেসে ফেললেন, “নারে তুই গল্পের রসদের কথা বললি তো তাই বলছি। তবে কি জানিস যেকোনো সম্পর্কের একটা ওঠা পড়া থাকতে হয়। তবেই তো সম্পর্কের মাধুর্য তৈরী হয়।স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কও তাই। অভিযোগ, অভিমান এগুলো স্বামী স্ত্রী সম্পর্ককে সম্পূর্ণতা দেয়।” দুলকির খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। রাতে খাওয়ার পর এঁটো টেবিল পরিষ্কার করার কাজটা দুলকিই করে। আজ এঁটো থালা বাসন গুলো রান্নাঘরে নিয়ে যেতে যেতে শুনল মা বলছে , “মাঝে মাঝে মনে হয় তোর বাবা যদি একটু রাগী হত তাহলে বেশ ভালো হত মারধোর না করুক অন্তত পক্ষে যদি এক্তু ঝগড়াও করতেন তাহলেও বুঝতাম মানুষটা আছে। সত্যি বলব দুলকি তোর বাবা মরে যাওয়ার পর বুঝেছিলাম তিনি ছিলেন। মেয়েরা শিবরাত্রি করে শিবের মতো বর পাওয়ার জন্য কিন্তু সেই শিবেরও দ্যাখ দোষ আছে। নেশা ভাঙ করে। নিখুঁত সুন্দরীকে যেমন সুন্দরী বলা যায় না নিখাদ জীবনকেও কি জীবন বলা যায়?” প্রমিতা দেবী আপন খেয়ালেই কথাগুলো বলে যাচ্ছিলেন। হঠাৎই খেয়াল করলেন দুলকি এঁটো তোলার কাজ বন্ধ করে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে।  তড়িঘড়ি করে বলে  উঠলেন, “দ্যাখ আমি জানি আমি ভাগ্য করে শ্বশুরবাড়ী পেয়েছি। তুই গল্পের কথা বলছিলিস না তাই।

 

পর্ব ২ >>

 

কলমে অদিতি দে

 

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here