গোয়ালাপাড়া ঘাটে তখন অস্তমিত সূর্য লাল আভা ফেলেছে। ভাঁটা চলছে গঙ্গায়। সমীরণ ঘাটের এক কিনারায় বসে একটা নেড়ি কুকুরের দিকে তাকিয়েছিলো। হাড়গিলে কুকুরটা একটা আস্তাকুঁড় থেকে কিসব টেনে বার করছে। সমীরণ ভাবে, আস্তাকুঁড়েও কি খাবার থাকে? থাকতেও পারে। তার সবচেয়ে বিস্ময় লাগে, বেঁচে থাকবার কতখানি স্পৃহা থাকলে ঐ হাড়গিলে, ধুঁকতে থাকা দুর্বল একটা প্রাণী অমনভাবে একটা পচা দুর্গন্ধযুক্ত জায়গা থেকে খাবারের খোঁজ করে। কেন এই স্পৃহা? এভাবে বেঁচে থাকবার মানে কি?
ঠিক এমনই সময় একটা মেয়েলি গলা, ‘এখানে একা একা বসে কি ভাবছিস?’ সমীরণ মুখ তুলে না তুললেও বুঝে নিলো মালবিকা এসেছে। এখনই জ্ঞান দেবে। সমীরণ ওর প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না। সে ঐ কুকুরের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে রইলো দিগন্তপারের ঐ সূর্যটার দিকে। গরমকালের মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে। সূর্যটার দিকে তাকিয়ে সমীরণ হঠাৎ বলে উঠলো, ‘আচ্ছা, বল তো, সূর্যটা উঠছে নাকি ডুবছে?’ মালবিকা হেসে বললো, ‘অবশ্যই ডুবছে’। সমীরণ সেভাবেই তাকিয়ে থেকে বললো, ‘না, হলো না।’ মালবিকা পরিহাসের সুরে বলে, ‘তবে? উঠছে বুঝি?’ সমীরণ ভাবুক হয়ে বললো, ‘না, তাও হয়তো নয়। আসলে জানি না রে, বুঝতে পারছি না কিছুই।’ মালবিকা বললো, ‘এখন এসব প্রশ্ন উঠছে কেন বল তো?’ সমীরণ বললো, ‘উঠছে, হয়ত তার কিছু কারণ আছে। যাই হোক, তোর খবর কি বল?’
এই বলে সমীরণ একটু গা–ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো, তারপর হাঁটতে হাঁটতে ঘাটের অন্য প্রান্তে গিয়ে জলের মধ্যে পায়ের পাতা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মালবিকা বলছিলো, ‘সামনের শুক্রবারই ঠিক করা হয়েছে মিছিল বার করা হবে। আমাদের সবাইকেই কিন্তু থাকতে হবে একসাথে।’ মালবিকা মেয়েটাকে বড় অদ্ভুত মনে হয় সমীরণের। সে বোঝে না, কেন যে ও সব ব্যাপারে তার সাথে পরামর্শ করতে আসে। হবু বর ব্যাঙ্গালোরে আই.টি সেক্টরে কাজ করে। মাস ছয় বাদে সেও বিয়ে করে সেখানেই চলে যাবে। তাহলে স্কুলজীবনে ক্লাস ওয়ানের প্রথম মারপিট করা এই বন্ধুটার সাথে আজকের দিনে কিসের এতো তার পরামর্শ? এতসব শুনে কি করবে সমীরণ?
‘আমাদের সাথে কম ক্যান্ডিডেট নেই রে। প্রায় দুশো–আড়াইশো ছেলেমেয়ে রেসপন্স করেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে ব্যাপারটা আরো ছড়িয়েছে। শুক্রবার তো মিছিল করে নবান্ন পর্যন্ত যাবো। তারপরের কর্মসূচী পরে ভাবা যাবে। অনেকে তো বলছে এরপর অনশন আন্দোলন শুরু করবে। অবশ্য সেটা আমরা পরে ভাববো।’
মালবিকাদের এই আন্দোলনের কিছু ইতিহাস আছে। গত বছর ওরা একটা সরকারী চাকরির পরীক্ষায় বসেছিলো। প্রথমে প্রিলি, তারপরে মেইনস্, আর সবশেষে ইন্টারভিউ। সবক’টাতে একে একে পাশ করে ওরা নিশ্চিন্ত ছিলো চাকরি এবার হয়েই যাবে। কিন্তু কোথায় কি? ফাইনাল সিলেকশনের সময় তারা দেখলো তাদের নাম সেখানে নেই। আরো আশ্চর্য যাদের নাম আছে, খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে তাদের র্যাঙ্ক ওদের অনেক পিছনে। এই নিয়ে আন্দোলন চলেছিলো, মন্ত্রী পর্যায়েও চিঠি দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু কিছুই লাভ হয়নি। অতঃপর তারা কেস ঠুকেছে ক্যালকাটা হাইকোর্টে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ওরা একটা গ্রুপও খুলেছে এস এস সি’র বঞ্চিত ছেলেমেয়েরা বা ঐ জাতীয় কিছু একটা নামে যার অ্যাডমিন এই মালবিকা বর্মণ। সমীরণও বকলমে ওদের সাথেই আছে। তবে ও খুব একটা অ্যাকটিভ নয়। কিন্তু মালবিকা সবাইকে একসাথে পেতে চায়। আর এইবারের মিছিলটায় লোক বেশি হলে ভালো, কারণ মিডিয়াকেও ইনফর্ম করা হয়েছে।
মালবিকা বলছিলো, ‘ব্যানার, পোস্টার এসবে অনেক খরচ পড়বে জানিস?’ কিন্তু সমীরণ কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললো, ‘এসব মিছিল ফিছিল করে কি হবে বল তো? চাকরি হবে? কেস তো একটা চলছেই।’ মালবিকা একটু ক্ষুণ্ণ হয়ে তর্কের সুরে বলে ওঠে, ‘তা কেস চলছে বলে কিছু না করে ঘরে বসে কাঁদলেই কি চাকরি হবে? শোন, কেস যেটা চলছে চলুক, আমাদের মিছিল বের করতে অসুবিধা কোথায়?’ বেশ খানিকক্ষণ এই নিয়ে কথাবার্তা চলার পর মালবিকা বাড়ি ফিরবে বলে ভাবছে, এমন সময় বলে উঠল, ‘ও, বাই দ্য ওয়ে, তোর অফিস এখন কেমন চলছে? আগের সেই প্রবলেমগুলো…।’
মালবিকাকে মাঝপথে থামিয়ে সমীরণ বলে ওঠে, ‘চাকরিটা আমি আজকেই ছেড়ে দিয়েছি রে…।’
(২)
রংচটা দেওয়াল, পলেস্তারা খসে কোথাও কোথাও ইঁট বেরিয়ে গেছে। জানালাগুলোও নড়বড়ে। ঘরের টিউবটা নিভে গেলে ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারের মধ্যে বসে স্মৃতি হাতড়াচ্ছিলো সমীরণ। বহুদিনের পুরোনো জমে থাকা স্মৃতি, ধুলো পড়ে সেটাকে যেন আর চেনাই যায় না। কিন্তু ঘা’টা এখনও দগদগে হয়ে আছে।
মিছিল। এই একটা শব্দ শুনলেই সমীরণের মনের কোণে জেগে ওঠে একটা বিভীষিকা। চোখ বুজলে ভেসে ওঠে কয়েক শত লাল পতাকা, কয়েক শত লোক, তাদের বেশিরভাগই সাদা পোশাকে, মুখে গান অথবা স্লোগান। ধীরে ধীরে মিছিলটা এগোচ্ছিল রাজপথ ধরে। সব কিছুই ছিল শান্ত। কিন্তু হঠাৎ ছন্দপতন। কতকগুলো বাঁশ কাটার মতো আওয়াজ। সমীরণ যেন দেখতে পায় মিছিলটা হঠাৎ ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো। কেউ শুয়ে পড়লো, কেউ বসে পড়লো, কেউ বা আধশোয়া। সকলেই কাতরাচ্ছে কিসের যন্ত্রণায়। আর তখনই লাল পতাকা, লাল পোশাক, লাল তরল সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো সমীরণের স্মৃতির পর্দায়। বাকীটা ধূসর।
শুধু আরেকটু মনে আছে। স্ট্রেচারে করে সবাইকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল হাসপাতালে। ডাক্তাররা চিকিৎসা চালাচ্ছিলো অক্লান্ত। কাউকে কাউকে মৃত বলে ঘোষণা করা হচ্ছিলো। এই সকল শায়িত মৃতদেহগুলোর মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎই কাউকে যেন চেনা চেনা ঠেকেছিলো সমীরণের। খুব চেনা কেউ। খুব কাছের কেউ। স্মৃতিটা আরেকটু পরিষ্কার হলেই শায়িত ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে পারলো সে। তার বাবা।
তারপর কেটে গেছে পনেরোটা বছর। তখন শৈশব ছিলো সমীরণের। কিন্তু সেইদিনই সে তার বয়সকে ফেলে অনেকটা এগিয়ে গেছিলো। আর ঘেন্না করতে শুরু করেছিলো মিছিলকে।
ঘরের আলোটা হঠাৎ জ্বলে উঠলো, ‘কি রে, একা একা চুপ করে বসে কি ভাবছিস?’ সমীরণ তাকিয়ে দেখে তার মা। কাঁচাপাকা চুল, মুখে বলিরেখা স্পষ্ট, ছাপা শাড়ি, চোখে মোটা পাওয়ারের চশমা, দাঁড়িয়ে আছে ঘরের দরজার একপাশে। সমীরণকে উত্তর দিতে না দেখে সে আবার জিগ্যেস করলো, ‘বললাম, হাত–মুখ ধুয়ে আয়, দুটো মুড়ি মেখে দিই। তা শুনলি না। জামাকাপড়টা পর্যন্ত ছাড়িসনি। যা তাড়াতাড়ি। আমি চা করে দিই।’
মায়ের কথা শুনে সমীরণ বাথরুমে গেলো। তারপর চেঞ্জ করে এসে তেল দিয়ে মুড়ি খেতে বসলো ঘরের একমাত্র চৌকিটার ওপর। মা চৌকির আরেকপ্রান্তে বসে জিগ্যেস করল, ‘আজ একটু তাড়াতাড়ি হয়েছে তাই না? অন্যদিন তো দশটার আগে আসিস না।’ মায়ের কথায় মনে মনে হাসল সমীরণ। বি.টেক পাশ সমীরণ মাঝে মাঝে ভুলেই যায় তার ডিগ্রীটার কথা। চাকরি নিয়েছিলো একটা ছোট কারখানায়। মাসে দশহাজার আর পুজোর সময় বোনাস। লিখিত ভাবে কাজের সময় সকাল ন’টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। তবে খুব কমদিনই রাত ন’টার আগে সে ছুটি পেত। কতদিন দশটা সাড়ে দশটা পর্যন্তও কাজ করতে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। আর কাজ? ভারী ভারী লোহার সরঞ্জাম বয়ে এক ইউনিট থেকে আরেক ইউনিটে সাপ্লাই করতে হত। জিনিসগুলো টানতেও হত তাকে, আবার সেগুলোর হিসেবও রাখতে হত তাকেই। আর এসব করতে করতে যখন নিজের ডিগ্রীটার কথা তার খেয়াল পড়ত, মনে হত এর থেকে বড় ব্যঙ্গ যেন আর কিছু হতে পারে না।
মা বলছিলো, ‘জানি এই কাজে তোর খুব কষ্ট হয়। কিন্তু কি করবি বল। কষ্ট তো এখন করতেই হবে। তারপর ব্যাঙ্কের লোন আছে। সেসব মেটাতে হবে। সব তো তোকেই করতে হবে।’ মা যখন তার অফিসের কথা তোলে তখনই যেন তাকে ব্যাঙ্কের লোনের কথা মনে করিয়ে দেয়। দেনাটা নেহাৎ কম নয়। সাড়ে চার লাখ! অবশ্য এ ক’টা টাকা খরচ করতে না পারলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া কিসের? সমীরণ তাই ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার নিয়েছে, পড়াশুনোয় তা খরচ করেছে। তারপর চাকরির বাজার যখন তাকে বোকা বানাল, সে ভালোভাবেই বুঝতে পারল এই দশ হাজারের চাকরি দিয়ে শোধ করা সম্ভব নয়। মাকে সে বলে দিল, ‘চাকরিটা আমি ছেড়ে দিয়েছি।’ তারপর নিজেই আবার তর্কের সুরে বলতে লাগলো, ‘তুমি ভাবতে পারো, একটা দিন ছুটি নেবো বলেছি, আর সেই কারণে বস আমাকে কত কথা শোনালো! যা তা ভাষায় অপমান করলো! আমাকে বলে কিনা ‘ফাঁকিবাজের কাজ চলবে না!’ আমি ফাঁকিবাজ? গত বছর একটা দিনও আমি ছুটি নিইনি। আমি ফাঁকিবাজ? করায় তো মুটেগিরি, এমন চাকরির আমার দরকার নেই।’ কথাগুলো জোর গলায় সে বলছিলো ঠিকই। কিন্তু বলতে বলতে নিজের ভেতরে খুব ভেঙে পড়ছিলো সে। কি করবে এরপর? কিভাবে মেটাবে এতগুলো টাকা লোন?
মা সব কথা শুনে নীরবে উঠে চলে গেলো। সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে ঘরের আলোটা আবার নিভিয়ে দিলো সমীরণ।
(৩)
সবটা শুনে শুভাশিস বললো, ‘তোর চিন্তা নেই রে সমু। আমি আছি। তুই বিন্দাস থাক। সব দায়িত্ব আমার।’ পানুদার চায়ের দোকানের সামনে রাখা বেঞ্চিটাতে বসে মাটির ভাঁড়ে চুমুক দিতে দিতে সমীরণ একটু যেন আশ্বস্ত হলো। চায়ের গরম তেজ, শুভাশিসের কথা – এই সবটা মিলিয়ে যেন একটু স্বস্তি লাগতে শুরু করলো তার। আজ আটবছর হলো শুভাশিস সমীরণের এই চা–চক্রের সঙ্গী। অবশ্য আরো তিন–চারজন থাকে। বান্টু, প্রিয়, মনো – এরা আজ আসেনি। সম্ভবত কোনো পরীক্ষা আছে। না হলে এদের আড্ডা প্রায় রাত দশটায় শুরু হয়। আর চলে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত যখন পানুদা দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করতে বেরিয়ে আসে। তার মধ্যে প্রত্যেকেরই দু–তিন কাপ সারা হয়ে যায়।
আজ শুভাশিস একটু আগে এসেছিলো। ও কাজ করে একটা সরকারী সংস্থায়। অনেক জানাশোনা আছে। চাইলে সমীরণের চাকরির ব্যাপারে একটা–দুটো খোঁজ সে দিয়ে দিতেও পারে – সমীরণ অন্তত তাই আশা করে। বায়ো–ডেটাটা তাই সাথেই এনেছিলো সে। শুভাশিস সেটা হাতে নিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। তারপর ভাঁজ করে জামার পকেটে রাখতে রাখতে বললো, ‘আরে, তোর ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী আছে, তোর আবার চিন্তা! যাদের প্লেন ডিগ্রী, তাদের কতজনকে চাকরি পাইয়েছি বল তো! তুই শুধু বল, চাকরি পেলে কি খাওয়াবি?’ সমীরণ মৃদু হেসে বললো, ‘আগে তো পাই। না রে, সত্যিই বড্ড টেনশনে আছি।’ শুভাশিস ওর উরুতে একটা চাপড় মেরে বললো, ‘আরে নো টেনশন ভাই। ডু ফুর্তি! নে আরো এক কাপ চা খা।’ এই বলে পানুদার উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বললো, ‘পানুদা, আরো দু কাপ।’
তারপর দুজনে চা খেতে খেতে গল্প জমাতে লাগলো। একটা সময় শুভাশিস বলে ওঠে, ‘তারপর, তোর ঐ এস এস সি’র ব্যাপারটা কি হলো? তোদের চাকরিটা তো ঝুলেই রইলো।’ সমীরণ মাথা নাড়ায়। বলে, ‘ঐ আর কি। আজ বিকেলবেলায় মালবিকার সাথে দেখা। ওরা তো বলছে মিছিল–টিছিল বের করবে।’ এই বলে সে অবজ্ঞাভরে ঠোঁট ওল্টালো। শুভাশিস বলে, ‘সত্যি, মেয়েটা আছে মাইরি। সামনেই বিয়ে। আর ওদিকে এ এসব করে যাচ্ছে। থাকবে ব্যাঙ্গালোরে, এখানে চাকরি করে কি হবে?’ কথাটা বলেই একটা নোংরা শব্দ সে ব্যবহার করলো যেটা মোটেই তার মতো একজন ‘শিক্ষিত ভদ্র’ ব্যক্তির কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত নয়।
(৪)
সেদিন শুভাশিস ওকে কথা দিয়েছিলো সামনের শুক্রবারের মধ্যেই সে কিছু একটা ব্যবস্থা করে দেবে। ছোটোখাটো চাকরি হলেও চলে যাবে সমীরণের, শুধু সে চাইছে সম্মানের সাথে কাজ করতে। কিন্তু তারই বা খবর আসে কই? দুদিন, তিনদিন পেরিয়ে গেলো। একে ওকে তাকে বলেও কোনো সুরাহা হলো না। পানুদার চায়ের দোকানে রোজই দেখা হয় বন্ধুদের সাথে, শুভাশিসও থাকে সেখানে। তাকে আশ্বাস দেয়, কিন্তু চাকরির কোনো খবর সে দিতে পারে না।
অবশেষে শুক্রবার এলো। সমীরণ ঠিক করলো, শুভাশিসকে আর সে কিছু বলবে না। এবার থেকে সে নিজেই চেষ্টা করবে। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে তার প্রোফাইল আপলোড করাই আছে। সেগুলোকে আরো কিছু আপডেট করে সে আবেদন করতে শুরু করবে।
কিন্তু সেদিনই দুপুর নাগাদ একটা ফোন এলো। মোবাইলের স্ক্রিনে নাম ঝলকাচ্ছে, ‘শুভাশিস’। চট করে ফোনটা তুলেই সমীরণ বলতে লাগলো, ‘কি রে ভাই, কিছু খোঁজখবর পেলি?’ শুভাশিসের গলা ওপার থেকে শোনা যায়, ‘বলছি, তোর এমনি ক্লারিকাল জব হলে অসুবিধা নেই তো? … বেশ ভালো। ক্লারিকাল জব মিলবে। দশ হাজার মাইনে। তবে একটা কথা… বসের কথা শুনে চলতে হবে। মানে বলছিলাম, অফিস জবের পাশাপাশি বসের কথামতো অন্য কোন কাজও করতে হতে পারে। ঐ ক্লারিকাল কাম পি.এ টাইপের জব, বুঝলি তো?’ এতদূর শোনার পরেও সমীরণ যখন নিমরাজি হয়েই সম্মতি দিলো তখন শুভাশিস আরো জুড়ে দিলো, ‘ও হ্যাঁ, আর একটা কথা। জয়েনিংয়ের আগে তোর ইন্টারভিউ হবে। তোকে সব ডিটেলস্ হোয়াটস্অ্যাপে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তো তোকে একটা ফর্ম ফিলাপ করতে হবে যেটার জন্য আড়াই হাজার টাকা মতন লাগবে বুঝলি?’
সমীরণ ওর কথা শুনে অবাক হয়ে যায়, ‘চাকরি করতে যাচ্ছি। আবার আমাকেই টাকা দিতে হবে! এ কেমন কথা?’ শুভাশিস হেসে বলে, ‘এটাই এদের নিয়ম রে। দেখ, তুই ভাব আগে। আমি এখন রাখছি কেমন?’ এই বলে সমীরণের থেকে কোন প্রত্যুত্তরের আশা না করেই সে ফোনটা কেটে দিলো।
সমীরণ অনেকক্ষণ ভাবলো। তার মনে হলো, এ কাজে তার না যাওয়াই উচিত। পুরোটাই ধাপ্পাবাজি হতে পারে। টাকা হাতিয়ে শেষমেশ হয়ত চাকরিই দেবে না বা চাকরি দিলেও মাইনে দেবে না।
অনেক আশা করেছিলো সে একটা ভালো চাকরির। সেটা আর জুটলোই না। তার মনে হতে লাগলো, এই এত বড় পৃথিবী, অথচ কি আশ্চর্য, তার মত একটা ছেলের জন্য এমন একটাও চাকরি নেই যা করে সে স্বচ্ছলভাবে জীবন যাপন করতে পারে, সমাজে সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারে। গোটা দুনিয়ার কাছে নিজেকে খুব অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হতে লাগলো তার। তার পড়াশুনো, তার ডিগ্রী – সবকিছুই যেন আজ অপাংক্তেয়। সে নিজেই আজ অনভিপ্রেত এই সমাজের কাছে।
খুব ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা ব্রিজের ওপর এসে দাঁড়ায় সে। ব্রিজের তলায় একটা নোংরা খাল। দুনিয়ার যত আবর্জনা আর নোংরা জল এসে জমা হচ্ছে তাতে। স্রোত নেই, শুধুই পচা দুর্গন্ধ। খালটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো সে। তার জীবনের সাথে খুব পার্থক্য কি আছে এই খালটার?
হঠাৎ রাস্তা থেকে একটা আওয়াজ উঠলো। হো হো করা আওয়াজ। চমকে উঠলো সমীরণ। তাকিয়ে দেখলো, বাঁদিকের রাস্তাটা থেকে একটা মিছিল এদিকে এগিয়ে আসছে। প্রায় জনা দুশো–আড়াইশো ছেলেমেয়ে। প্রত্যেকেরই বয়স ২০ থেকে ৩০য়ের মধ্যে। মিছিলটা একটু কাছে এগোলে সে লক্ষ্য করলো, সামনের সারিতে হাঁটছে মালবিকা, সঙ্গে আরো জনা ছয়–সাত ছেলেমেয়ে, ওদের হাতে বিরাট বড়ো ব্যানার। তার ওপর লেখা – চাকরি চাই, বিচার চাই। ওদের গলায় স্লোগান, ‘এস এস সি’র সফল ছাত্রছাত্রীদের অবিলম্বে চাকরি দিতে হবে।’ স্লোগানের মধ্যেই মালবিকা সমীরণকে দেখে মৃদু হাসলো, তাকে ইশারায় যোগ দিতে বললো। সমীরণ দেখলো, মালবিকার পাশের মেয়েটাও তাকে ইশারায় বলছে যোগ দিতে। ওর পাশের ঐ বেঁটে ছেলেটা …. তারপর ঐ কালো জামা ফরসা ছেলেটা … আর ঐ ঝাঁকড়া চুল খুঁড়িয়ে হাঁটছে ছেলেটা – সব্বাই ওকে ডাকছে, যোগ দিতে বলছে, যেন কতদিনের চেনা এরা সকলে। সমীরণ অভিভূত হয়ে যায়। ও এদের কোনোদিনও দেখেনি। তবে কেন আজকে কেন এদের এতো চেনা লাগে?
ঠিক এই সময় একটা অল্পবয়েসী ছেলে এসে তার হাতে ধরিয়ে দিলো একটা পতাকা, তার ওপরে লেখা, কাজ চাই। আর দাঁড়িয়ে থাকতে আর পারলো না সমীরণ, পা দুটো যেন আপনা থেকেই চলতে শুরু করে দিলো তার। মনে হতে লাগলো, তার জীবন আর অপ্রয়োজনীয় নয়। এই দুশো ছেলেমেয়ের মাঝখানে তারও দাম আছে, সে আর একা নয়।
এগিয়ে যেতে লাগলো মিছিল। এদিকে দিগন্তের পারে সূর্যটা তার সাক্ষী। উঠছে, না ডুবছে, কে দেবে সেই উত্তর?
::সমাপ্ত::
লেখক পরিচিতি : – শান্তনু চট্টোপাধ্যায়,নৈহাটি, উত্তর ২৪ পরগণা, পশ্চিমবঙ্গ ।বর্তমানে আয়কর দপ্তরে বর্ধমানে কর্মরত। শখে লেখালিখি।
বিঃ দ্রঃ লেখাটি জানুয়ারি,২০২০, “মাসিক জনপ্রিয় লেখনী” প্রতিযোগিতার অন্তর্ভুক্ত।