বাঁকুড়া ইনস্টিটিউট (ডে স্টুডেন্টস্ হোম)

5
2073
            বর্তমানের করোনা পরিস্থিতি সারা পৃথিবীর জন্যই ভয়ঙ্কর । এই পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর ঠিকই কিন্তু এর জন্য শিক্ষা ,খেলাধুলা,  বিনোদন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সর্বোপরি  ভ্রমণে যে প্রভাব পড়েছে তা আমাদের আরও ভয়াবহ আর্থিক মন্দার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বলে মত প্রকাশ করেছেন বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞরা ।
            এই পরিস্থিতিতে গ্রাম থেকে উঠে আসা মেধাবী অথচ গরিব ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার আশাও যেন নিভে যাচ্ছে। শুধু গ্রাম কেন, বড় বড় শহরে বসবাসরত আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারের ছেলেমেয়েদেরও আজ পড়াশোনার ক্ষেত্রে বড় বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কথায় আছে, মনের ইচ্ছা আর অদম্য জেদ থাকলে কোন বাধাই বাধা হয় না, ঠিক তেমনি প্রকৃত পড়াশোনার ইচ্ছে থাকলে উপায় ঠিকই হয়।
        তাই, এমন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে এই আলোচনা,যা আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া ছেলেমেয়েদের ভরশা ও আশ্রয় যোগাবে।
      এই প্রতিষ্ঠানটি আজকের নয়, জন্মলগ্ন থেকেই এই প্রতিষ্ঠান ছাত্র-ছাত্রীদের উপকারে লাগছে ।এই প্রতিষ্ঠানটি সেভাবে প্রচারের আলোয় না থাকলেও, বহুসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই শিক্ষা সহযোগী প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব যে  কম নয় তা এখানকার অনেক প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রীরা জানিয়েছে।
      এই লেখাটি ‘বাঁকুড়া ইনস্টিটিউট (ডে স্টুডেন্টস্ হোম)’ কে নিয়ে লেখা।  দেখা যাক এই শিক্ষা সহযোগী প্রতিষ্ঠানটি কিভাবে গরীব ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করছে।
ভূমিকা :
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের উচ্চশিক্ষার অধীন একটি শিক্ষা সহযোগী প্রতিষ্ঠান হল  ‘বাঁকুড়া ইনস্টিটিউট( ডে স্টুডেন্টস্ হোম)’।  1998 খ্রীষ্টাব্দের 25 সেপ্টেম্বর এই প্রতিষ্ঠানটি পথ চলা শুরু করে ।আপাতদৃষ্টিতে একটি পাঠাগার সহ  নাম মাত্র মূল্যে মধ্যাহ্নভোজন  বা জলখাবারের  সুবিধা যুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের নিরিখে আর্থিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া এই জেলাটি কিছুটা এগিয়ে থাকলেও উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে  এই জেলা অনেকটাই পিছিয়ে । তাই  আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষার  সাহায্যের জন্য এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম।
প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা :
বাঁকুড়া শহরের প্রতাপবাগানে   এই প্রতিষ্ঠানটি অবস্থিত। এই প্রতিষ্ঠানটির সরকারি ঠিকানা :
Bankura  Institute  (Day Students' Home )
Sponsored  by  the  Government  of West Bengal, Higher Education  Department .
Pratapbagan, Post +district -Bankura.
Pin- 722101
WestBengal, India
Phone - 03242240388
প্রতিষ্ঠানের  পরিকাঠামো:
1998 সালে সাত  জন কর্মী নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটি শুরু হলেও বর্তমান কর্মীসংখ্যা পাঁচজন। অফিস রুম ছাড়াও এই প্রতিষ্ঠানে চারটি বড় ও  চারটি  ছোট রুম আছে ।এরমধ্যে লাইব্রেরী ,ছাত্র-ছাত্রীদের পড়া ও খাওয়ার জন্য, রান্নাঘর, স্টোররুম, ও কর্মীদের বসার জন্য আলাদা আলাদা ঘরের ব্যবস্থা আছে। এছাড়াও  স্নানাগার শৌচাগার ও পানীয় জলের ব্যবস্থা সহ এটি একটি উন্নত পরিকাঠামো যুক্ত শিক্ষা  সহযোগী প্রতিষ্ঠান।
প্রতিষ্ঠানটিতে পড়াশোনার সময়সীমা:
সপ্তাহে সোম থেকে শুক্রবার সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত এবং শনিবার সকাল আটটা  থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানটি খোলা থাকে। তাই এই সময়ের মধ্যে ছাত্রছাত্রীরা সেখানে গিয়ে বসে পড়াশোনা করতে পারে ।এখানে ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের আগ্রহের যে কোন বিষয় নিয়ে পড়তে পারে।
   এখানকার সব  ছাত্র-ছাত্রীরই কোনো কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয় বা  উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের  নিয়মিত ছাত্র ছাত্রী ফলে সেখানে তারা নিয়মিত ক্লাস করে । সেই জন্য এখানে কমপক্ষে দুঘণ্টা পড়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অবশ্য টানা দু ঘন্টা  পড়তে না পারলে ,এক ঘন্টা করে পড়ার সুযোগ রয়েছে। পরীক্ষা চলাকালীন এই নিয়ম শিথিল হয়।
ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তির নিয়মাবলী:
মেধাবী অথচ গরিব ছাত্র-ছাত্রীরাই  এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পায়। তবে এক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তির জন্য কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দরকার –
1)মাধ্যমিক /উচ্চমাধ্যমিক/ স্নাতক স্তরের পরীক্ষার ফলাফলের শংসাপত্র ।
2)বর্তমানে সেই ছাত্র বা ছাত্রী যে প্রতিষ্ঠানে পাঠরত সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধানের অনুমোদনপত্র ।
3)  দু কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি ।
4)ছাত্র-ছাত্রীদের পরিবারের  আয়ের প্রমাণপত্র।
ভর্তির সময়সীমা:
অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো এখানে মূলত কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে বেশিরভাগ ছাত্র ছাত্রী ভর্তি করা হয়। উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্রছাত্রী এখানে ভর্তি হয়। তবে সুযোগ থাকলে প্রায় সারা বছর ধরে ছাত্রছাত্রীদের এখানে ভর্তি করা হয়।
পাঠাগার পরিচালনা:
পাঠাগার পরিচালনার জন্য কোন কর্মী নিয়োগ না হওয়া সত্বেও সকল কর্মীবৃন্দ এবং ছাত্র-ছাত্রীদের সহযোগিতায় এই পাঠাগারটি চলছে। এখানে মোট বই ও সহায়ক বইয়ের সংখ্যা সাত হাজারের মতো ।এখানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে বিজ্ঞান ,সাহিত্য ,দর্শন ,বাণিজ্য ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের বইসহ , IIT,NIT,NEET সহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার  বইও এখানে আছে যা ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি বিষয়ের  বই আলাদা আলাদা ভাবে রাখার সুব্যবস্থা রয়েছে এখানে । ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেরাই তাদের পছন্দ ও আগ্রহ মতো  বই নিয়ে  যেকোন কর্মচারীর সামনে লাইব্রেরীর খাতায় নাম নথিভুক্ত করে পড়তে বসে ।বেরোনোর সময় আবার কোন কর্মচারীর সামনে যেখান থেকে নিয়েছিল সেখানে ছাত্রছাত্রীরা নিজেরাই বই রেখে দেয় অর্থাৎ একটা সুন্দর পরিকাঠামোর ভিত্তিতে এই প্রতিষ্ঠানটি চলে।
ক্যান্টিন পরিচালনা :
ছাত্র-ছাত্রীরা মিল যেদিন খেতে চায় তার একদিন পূর্বে কুপন কাটতে হয়। কুপনের হিসেব মতো রান্নার ব্যবস্থাও করা হয় ।এখানে সপ্তাহে একদিন করে ভাতের সঙ্গে মাছ মাংস ডিম ও সবজি যুক্ত খাবার খাওয়ানো হয়। বর্তমান কুপন মূল্য 4 টাকা অর্থাৎ নামমাত্র মূল্যে ছাত্র-ছাত্রীদের এখানে খাওয়ানোর ব্যবস্থা আছে ।
 এখানে প্রতিষ্ঠানটির স্লোগান হওয়া  উচিত:
‘দুপুরের মিল যদি চাও খেতে,
 দু’ঘণ্টা পড়ায় থাকো মেতে।’
 ছাত্র-ছাত্রীদের স্লোগান হওয়া  উচিত :
‘এখানে পড়াশোনা করলে পরে,
 ছাত্র-ছাত্রীদের অভাব যাবে দূরে।’
কেন এই প্রতিষ্ঠান অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে উন্নত :
 অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের  তুলনায় এই প্রতিষ্ঠানটি বেশ কিছুটা আলাদা । আর এর পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে –
  • সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত খোলা থাকার সুবাদে কোন ছাত্র-ছাত্রী চাইলে আট ঘণ্টাই  পড়াশোনা করতে পারে ।এখানে পড়ার কোনো বিধিনিষেধ নেই ।
  • এই প্রতিষ্ঠানে  ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি অনেক সহজ সরলভাবে করা হয় ।
  • পাঠাগারের পাঠ্যপুস্তক ও সহায়িকা বই গুলি বেশ উন্নত  মানের।
  • এখানকার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শিক্ষা বিষয়ক আলোচনা তাদেরকে শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে।
“Education  is  not  the  learning  of  facts, but the training  of the  mind  to  think.”
                        – Albert  Einstein
এই কথাটি যেনো এখানে  সর্বতোভাবে প্রযোজ্য ।
  • এখানে পুঁথিগত শিক্ষা ছাড়াও ছাত্রছাত্রীরা নীতিগত শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়।
  • ছাত্র-ছাত্রীদের সহযোগিতার জন্য মাঝেমধ্যে কাগজ-কলম বিনামূল্যে বিতরণ করা হয় যা  ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষায় সহযোগী হয়।
  • এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা আজ বিভিন্ন জায়গায় প্রতিস্থিত প্রায় কুড়ি বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠান থেকে 2000 জনেরও বেশি ছাত্র-ছাত্রী আজ প্রতিষ্ঠিত ।এখান থেকে অনেকে প্রাথমিক ,উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত ।এখানে কিছু সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী আজ বিশ্ববিদ্যালয় ও আইআইটিতে অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। আবার অনেকেই এখান থেকে পড়াশোনা করে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারও হয়েছেন ।এছাড়াও  সরকারি অফিসগুলোতেও অনেকেই কাজের সঙ্গে যুক্ত ।
  • ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারীদের সম্পর্ক পরিবারের মতো। প্রতিষ্ঠানের কর্মীগণ ছাত্র-ছাত্রীদের নাম ধরেই ডাকতে পছন্দ করেন ।ছাত্রছাত্রীরাও ভাবে এটা যেন তাদের পরিবার ।
  • খাবারের মান পুষ্টির দিক থেকে বেশ উন্নত মানের। তাছাড়া এই প্রতিষ্ঠানটির সমগ্র পরিকাঠামো বেশ  উন্নত মানের।
  • যেসব ছাত্র-ছাত্রীদের গৃহশিক্ষকতা ছাড়া পড়াশোনা চালানো খুবই অসুবিধাজনক তাদেরকেও পরোক্ষভাবে সহায়তা করা হয় ।
তাছাড়া এই প্রতিষ্ঠানটিতে  বেশ কয়েকটি সর্বভারতীয় পত্রিকা ও জার্নাল নেওয়া হয় যা ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশুনার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে।
এই প্রতিষ্ঠানটি খুব বড় না হলেও মেধাবী অথচ গরীব ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এটি একটি উপযুক্ত শিক্ষাগৃহ ।এখানে ছাত্র-ছাত্রীরা পড়াশোনার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ পায় ।প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত কর্মচারীদের এবং ছাত্র-ছাত্রীদের দীর্ঘকালীন প্রচেষ্টায় এই শিক্ষার পরিবেশ গড়ে উঠেছে ।তাই সমস্ত দিক বিচার করে মনে হয় এই প্রতিষ্ঠানটি অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তুলনায় বেশ আলাদা এবং উৎকর্ষ  মানের ।
এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে থাকলেও এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের  সংখ্যা আজও হাতেগোনা ।শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গে  এই ধরনের প্রতিষ্ঠান আছে মাত্র পাঁচটি যার মধ্যে  চারটি শুধু কলকাতা শহরে এবং একটি এখানে অবস্থিত।
 বর্তমানে করোনা মহামারীর করাল গ্রাস থাবা বসিয়েছে সারা বিশ্বে। সব শ্রেণীর মানুষেরাই এই ক্ষতির সম্মুখীন। তাই এই পরিস্থিতিতে এই ধরনের শিক্ষা সহযোগী প্রতিষ্ঠান ছাত্র-ছাত্রীদের সহায়ক হবে।
 যদি এই ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিটি জেলায় গড়ে ওঠে এবং তবে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশুনার সাহায্য হয়, বহুসংখ্যক গরীব অথচ মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের স্বপ্নও সার্থক হবে ।তাই
“মেধাবী আর গরীব ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে যদি থাকতে চাও,
 এই ধরনের শিক্ষা সহযোগী প্রতিষ্ঠান চারিদিকে ছড়িয়ে দাও।”

কলমে পারমিতা পাইন

5 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here