রাস্তার ধারে অনেক অচেনা গাছ বন্ধুদের সঙ্গেই আমার জন্ম।জন্ম থেকেই আমি অবহেলিত হয়ে বড় হচ্ছিলাম।মানুষ বা অন্য উচ্চশ্র্রেণীর জীবেদের বাচ্চার মতো মা–বাবার যত্ন ছাড়াই দিব্যি বড় হচ্ছিলাম প্রকৃতির কোলে। আমি একটি ছোট্ট চারা ‘নিমগাছ‘।
ধীরে ধীরে প্রকৃতি–মাতাই আমার ছোট্ট শরীরটাকে ছোট ছোট কচি পাতাতে সাজিয়ে দিচ্ছিলেন। রাস্তার পাশে থাকলেও কত মানুষ, কত গাড়ি, কেউই আমার দিকে ফিরে তাকাত না।কারণ ,আমি তো গাছ, ভগবান আমাকে স্বরযন্ত্র দিয়ে সৃষ্টি করেননি।এমনি করেই রোদজলে দিন কাটছিল আমার।হঠাৎই একদিন সকালবেলাতে দেখি একজন মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা তার একজন সহকারীকে নিয়ে এসে আমাকে সযত্নে মাটি থেকে তুলে নিলেন।আমি তো বেশ ভয় পেয়ে গেলাম!দেখি ওই ভদ্রমহিলার বাড়ি পাশেই।তিনি সেখানে স্বল্পপরিসর বাগানের একধারে আমাকে যত্ন করে মাটিতে লাগালেন জল–সার দিয়ে।আমি তো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।যাক্,এতদিনে একটা ঠিকানা পেলাম।ওনার যত্নে আমি খুব তাড়াতাড়ি বাড়তে লাগলাম।এমনিভাবে বছরখানেকের মধ্যে আমি বেশ লম্বা হয়ে উঠলাম।
কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস!
ওনার আবাসনের অন্য সব বাসিন্দাদের আপত্তি উঠল আমাকে নিয়ে।আমি নাকি ভবিষ্যতে অনেক বড় হব, তখন আমার শিকড়ে নাকি বিল্ডিং–র ক্ষতি হবে।আমি বেশ বুঝতে পারলাম এতে ভদ্রমহিলার খুব মনখারাপ হয়ে গেল।ছোট্ট থেকে এতটা বড় করলে কার না মায়া পড়ে?হলামই না হয় গাছ।আমারও তো প্রাণ আছে!বুঝতে পারলাম আমাকে কেটে ফেলতে ওনার মন একেবারেই সায় দিচ্ছে না।আমিও এখন সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকি।একদিন দেখলাম বিকেলবেলা,অল্প অল্প বৃষ্টি পড়ছে,বাচ্চারা রাস্তায় রথ টানছে।বুঝলাম আজ শ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা।ঐ সময় ভদ্রমহিলা ওনার সেই সহকারী মালীকে নিয়ে আবার আমাকে মাটি সমেত তুললেন এবং ওনারই বাড়ির সামনের দ্বিমুখী রাস্তার মাঝখানে যে অল্প জায়গা থাকে সেখানে বসিয়ে দিলেন।এতে আমার মনের ভয় দূর হলো।যাক্,কাটা তো পড়িনি।বাড়ির বাইরে হলে কি হবে,উনি আমাকে নিয়মিত যত্ন ও দেখভাল করতেন।কিন্তু এটা তো খোলা জায়গা।আমি তো এখন অল্পবয়সী ও বেশ আকর্ষণীয়,সবার চোখে পড়ার মতো।এই ব্যাপারেও ভদ্রমহিলার লক্ষ্য কিছু কম নয়।পরদিন দেখলাম আমাকে ঘিরে দেবার জন্য বাঁশের বেড়া আমার চারিদিকে লাগানো হল, আর তার গায়ে প্লাষ্টিকের পেপারে লিখে দেওয়া হলো, ‘এই গাছের পাতা তোলা নিষেধ ’।সেদিনের রাতটা যে কি শান্তিতে কাটালাম কি বলব!ভাবলাম ঈশ্বরই ওনাকে আমার পালিত ‘মা’ করে পাঠিয়েছেন।
এইভাবে বেশ দিন কাটছিল।আমিও অনেকটা বড় হয়েছি।এরমধ্যে একদিন রাতে দুজন লোক আমার চারিদিকের বেড়া ভেঙে নিয়ে চলে গেল।পরদিন আমায় ওই অবস্থায় দেখে আমার পালিত মায়ের মন খারাপ হয়ে গেল।উনি বেশ হতাশ হয়েছেন দেখে বুঝতে পারলাম।আমার মনও খুব খারাপ হয়ে গেল।কারণ আমি তো মানুষের মত নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারি না।এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই ভোরবেলার কিছু প্রাতঃভ্রমণকারী আমার অত সুন্দর পাতা যথেচ্ছভাবে তুলে নিতে শুরু করল।বুঝতে পারলাম আমার পাতার অনেক ঔষধীগুণ থাকাটাই আমার কষ্টের কারণ।আমার ডাল সবাই ভেঙে নিয়ে যায়।আমিও আপ্রাণ নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতে লাগলাম,যত তাড়াতাড়ি পারি প্রাণপণ লাল লাল কচি পাতা বের করে খাবার তৈরী করার চেষ্টা করি।
হলে কি হবে,মানুষের সাথে আমি এত ছোট্ট একটা নিমগাছ পারব কি করে!এরা মস্তিষ্কের জোরে উচ্চ ক্ষমতার অধিকারী।এত কষ্টের মধ্যেও আমার পালিত মায়ের জন্য আমার বেশী কষ্ট।আমার কাছে এসে প্রতিদিন ওনার ম্লান মুখ আমার কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিত।একদিন উনি সামনের দোকানদার ভদ্রলোককে বললেন,‘ দাদা,এই নিমগাছটা আমি লাগিয়েছি।বড় হলে সবারই উপকার হবে।কেউ পাতা–ডাল ছিঁড়লে একটু বারণ করবেন।’যথারীতি একজন ধোপদুরস্ত পোশাক পরা ভদ্রলোক আমার ডাল ভাঙতে শুরু করলে দোকানদার ভদ্রলোক বারণ করলেন।বললেন এক ভদ্রমহিলা ওই গাছটি লাগিয়েছেন।উত্তর এল,‘এটা কারও বাবার জায়গা নয়।রাস্তার গাছ থেকে তুলছি আপনি বলার কে মশাই?’
তবুও ভদ্রমহিলার আপ্রাণ চেষ্টা আমাকে বাঁচানোর।মাঝে মাঝে জল নিয়ে এসে আমাকে স্নান করান।আমার সামনে দাঁড়িয়ে অনেকের সাথেই নানান কথা বলেন।তাতে বুঝি,ওনারও কত পারিবারিক সমস্যা।ওনার স্বামী খুবই অসুস্হ থাকায় অনেক চাপ ওনার ওপর।তা সত্তেও আমার ওপর এত ভালবাসা!আমি অবাক হয়ে ভাবি,আমাদের গাছেদের যেমন ফুল,কান্ড,পাতা,শেকড় সব আছে সেরকমই মানুষেরও তো সবার হার্ট,লাঙ,কিডনি,লিভার,রক্ত ইত্যাদি সব একই আছে, তবে মানুষে মানুষে এত তফাৎ কেন?এত কষ্টের মধ্যেও এটাই আমার সান্ত্বনা,অন্তত এরকম মনের মানুষের দেখা পেয়েছি তাই।এইভাবে আমার বেড়ে ওঠা তো দূরস্ত,আস্তে আস্তে আমি শীর্ণকায় খর্বাকৃ্তি হতে লাগলাম।এখন আমার সেই সুন্দর চেহারা আর নেই!একদিন হতাশ ভদ্রমহিলাকে আমার সামনে দাঁড়িয়ে কাউকে ফোন করতে শুনলাম।উনি এখানকার কাউন্সিলর–কে বলছেন,‘ভাই,আমি আমার বাড়ির সামনের রাস্তায় বুলেভার্ডে একটা ছোট নিমগাছ বসিয়েছি।কিন্তু,পথচলতি মানুষের জন্য গাছটাকে বাঁচাতে পারছি না।আপনি যদি দয়া করে একটা লোহার খাঁচার ব্যবস্হা করে দিতেন তাহলে গাছটা হয়তো বেঁচে যেত’।ফোনের ওপার থেকে হয়ত কোন ইতিবাচক কথাই শুনেছিলেন বলে আমার মনে হল।কিন্তু কোথায়?এখন আমার বেঁচে থাকাটাই প্রশ্নচিহ্ন!
বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমি স্বপ্ন দেখতাম,বড় হয়ে আমি মানুষের ও অন্যান্য জীবজগতের কত উপকার করব।তার সাথে অনেক দূষিত গ্যাস শোষণ করে বাতাসকে দূষণমুক্ত করব।আমার আশেপাশে কোন বড় গাছ না থাকায় আমার ছায়াতে অনেক মানুষ আর জীবজন্তু বিশ্রাম নিতে পারবে।কত পাখি ও অন্যান্য জীব আমার শরীরে আশ্রয় নিতে পারবে।পাখিরা আমার ফলও খেতে পারবে।তাছাড়া,আমি অনেক বড় হলে অল্প অল্প পাতা দিয়ে দিলেও আমার অত ক্ষতি হবে না।জানি না, আমার আর আমার পালিত মায়ের স্বপ্ন পূরণ হবে কিনা!
বেশ কিছুমাস পর…….
আমি মনে মনে যা ভেবেছিলাম,তাই–ই সত্যি হল!জানতাম,উনি সহজে হাল ছাড়বেন না।একদিন দেখি,একজন লোককে সাথে নিয়ে সঙ্গে নাইলনের নেট,বাঁশের কঞ্চি ও তার নিয়ে উনি হাজির।বুঝলাম আমার ভাগ্য খুলেছে।এবার আমি বেশ সুরক্ষিত।আমি এখন বাঁচার আনন্দে মসগুল।এখন বর্ষা ঋতু।প্রকৃতি মাতার অকৃপণ বারি সিঞ্চনে নিজেকে সমৃদ্ধ করছি।
আরও কিছুদিন পর……
এখন আমি নবযৌবন প্রাপ্ত।অনেক কিছুই করতে আগ্রহী।আমার কর্তব্যও শুরু করে দিয়েছি,অবশ্যই লোকচক্ষুর অন্তরালে।আমাদের বৈশিষ্ট্যই তাই।
আমার এই পুণর্জন্মপ্রাপ্তির সঙ্গে যারা যারা জড়িত,প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে,সকলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।অবশ্যই আমার পালিত–মা বাদ — মায়ের ঋণ কি শোধ করা যায়?চেষ্টা করাও উচিত নয়।
এখন আমি
লেখিকা পরিচিতি : মধুমিতা (দেব) ঘোষ। বি: দ্র:- লেখিকা একজন অত্যন্ত দক্ষ ২৯ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ‘ পার্কিনসন্স disease-র Caregiver ’।