বেথুয়া অভয়ারণ্যের অন্দরমহলে

1
1599
Photo: Weekend Destinations near Kolkata

সকাল ছটা পঞ্চাশে যখন কলকাতা ষ্টেশন থেকে হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেসটা ছাড়ল তখনও বেথুয়াডহরী সম্পর্কে স্পষ্ট কোন ধারণা মাথায় ছিল না, শুধু একজন সহকর্মির সুপারিশে আমাদেরএবারের এই বেথুয়া যাত্রা। একটা ভুমিকা দিয়ে শুরু করা যাক। আমার নাবালক পুত্রটির স্কুলের ফার্স্ট টার্ম শেষ হতেই সে হঠাৎ চিড়িয়াখানা দেখবার জন্য আব্দার জুড়ে দিল, যদিও মার্চ মাসের শেষের দিকে হাঁসফাঁস করা গরমে ওই চৌহদ্দির মধ্যে পা রাখাটা নিতান্তই যুক্তিহীন কাজ। তাছাড়া আলিপুরের ওই পশুশালাটায় নতুনত্বের বড়ই অভাব, ওখানকার কর্তারা যদি এব্যাপারে অবিলম্বে কিছু উদ্ভাবনি শক্তির পরিচয় না দ্যান তাহলে শতাব্দী প্রাচীন চিড়িয়াখানাটা তার জৌলুস হারাতে আর বেশী সময় নেবে না। যাইহোক সব শুনেটুনে আমার বন্ধু কাম সহকর্মি জয় জানাল কলকাতার খুব কাছেই বেথুয়াডহরী অভয়ারণ্যের অবস্থান, মোটামুটি একটা ওপেন এয়ার জু বলা যেতে পারে। জয়ের শ্বশুরবাড়ির তরফে কোন আত্মীয়ের বাসস্থান নাকি ওখানেই। এদিকে হাতে সময়ের পুঁজি যথেষ্ট কম, কাজের ব্যাস্ততার ফাঁকে মেরেকেটে একটা দিন ম্যানেজ করা গেছে, সাতপাঁচ না ভেবে ঝটপট টিকিট কেটে ফেললাম। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বাংলোটা বুকিং করার দ্বায়িত্ত্ব অবশ্য জয় স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে নিজের কাধেই তুলে নিল। পথে যেতে যেতে একজন সৌম্যদর্শন ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল, তিনি বেথুয়াডহরীর বাসিন্দা, আগে সরকারী চাকরি করতেন ইদানিং রিটায়ার করেছেন। কথায় কথায় ভদ্রলোক জানালেন আজ থেকে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর আগে নাকি বেথুয়া বাজারে প্রচুর পরিমানে হরিণের মাংস পাওয়া যেত, এবং তিনি নিজেও একসময় ওই মাংসের জাত সমঝদার কাম ভক্ত ছিলেন। আঁতকে উঠে বললাম –সেকি মশাই এ যে বেআইনি? ভদ্রলোক মৃদু হাসলেন, বললেন –অবশ্যই! তবে এখন আর পাওয়া যায় না। সে যুগ চলে গেছে।

বেলা সওয়া নটা নাগাদ হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেস বেথুয়াডহরী এসে দাঁড়াল। ট্রেন এখানে মিনিট খানেকের বেশী দাঁড়াবে না অতএব তাড়াহুড়ো করে নেমে পরলাম। জয় বলে দিয়েছিল এখানকার ছানার গজা নাকি বিখ্যাত, অবশ্যই যেন টেস্ট করে দেখি, যদিও ষ্টেশন চত্বরে কয়েকটা দোকান ঘুরেও ওবস্তুটি চোখে পরল না, অতএব কাছাকাছির মধ্যে ঘোষ সুইটস্‌ থেকে গরম কাঁচাগোল্লার স্বাদ নেওয়া গেল, দুর্দান্ত খেতে! গঁজার বদলে কাঁচাগোল্লা! মন্দ কি। ষ্টেশন চত্বরেই অটো স্ট্যান্ড, সেখান থেকে একটা টোটো ধরে ফরেস্ট বাংলোর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। দুপাশ দিয়ে মফঃস্বল শহর বেথুয়াডহরী দেখতে অবশ্য ভালোই লাগছিল। এখানে রাস্তার দুধারে বেশ কিছু মোটরবাইক সাইকেলের শোরুম যেমন চোখে পরল তেমনই সম্পন্ন গৃহস্থদের আধুনিক বাড়িঘর গুলোও শহরের শোভাবর্ধন করছিল। দশমিনিট মতো চলার পরে টোটো একটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা গেটের সামনে এসে দাঁড়াল। গেটের ওপর সাইন-বোর্ডে লেখা বেথুয়াডহরী অভয়ারণ্য। প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি পঞ্চাশ টাকা যদিও বুকিং থাকার জন্য আমাদের সেসব লাগবে না। রিজার্ভেশন স্লিপ দেখিয়ে ভিতরে প্রবেশের অনুমতি মিলল। একজন ফরেস্ট গার্ড এগিয়ে এসে বললেন –আসুন আপনাদের রুম দেখিয়ে দি।

অভয়ারণ্যের মূল ফটকের মধ্যে খান দুয়েক কটেজ, যার একটিতে আমাদের ঠাই হল। গার্ড ভদ্রলোকের নাম নিত্যানন্দ। আগে থেকে বলে দিলে লাঞ্চের ব্যাবস্থা তিনি করে দেবেন বলে জানালেন। আমরা লাঞ্চ আর ডিনার দুটোরই অর্ডার দিয়ে দিলাম। জঙ্গলের ভিতরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি দেখে নিত্যানন্দ বললেন –এসময় ঘুরে স্যার একটা জন্তুও দেখতে পাবেন না, এখন বাইরের ভিড়টা আছে কিনা, লোকজন থাকলে ওরা সামনে আসে না, তবে চারটের পর পার্কের গেট বন্ধ করে দেওয়া হবে, লোকজন সব বেড়িয়ে গেলে পশুগুলো বেড়িয়ে আসবে। ভালো কথা! তবে ঘরে বসে থাকার জন্য তো এতদূর আসিনি, তাই জঙ্গলের পথে বেড়িয়ে পরলাম।

বেথুয়ার এই অরণ্যের সিংহভাগ অংশেই পর্যটকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। একফালি একটা বাধানো রাস্তা চক্রাকারে জঙ্গলের কিছুটা জুড়ে বেড় দিয়েছে, ওটাই দর্শনার্থীদের বিচরণ ক্ষেত্র। সরু রাস্তাটার দুধারে ঘন জঙ্গল, নানারকমের নাম না জানা মহীরুহ আর পাখির ডাকে মন যে ভালো হয়ে যাবে সে উপায় অবশ্য নেই, চারপাশে মেলা ভিড়। বাস বোঝাই স্কুলের কচিকাঁচারা এসেছে তাদের মাষ্টার-মশাই আর দিদিমণিদের সাথে। দুরন্ত শিশুগুলোকে সামলাতে তাদের শিক্ষক শিক্ষিকাদের দেখলাম নাজেহাল অবস্থা। এছাড়া কাঠের বেঞ্চগুলো দখল করে বসে থাকা নিভৃতকামী কিছু যুবক যুবতিও চোখে পরল। কর্তব্যপরায়ণ ফরেস্ট গার্ডদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়িয়ে অবশ্য কেউই কোনরকম বাড়াবাড়ি করতে পারছে না। এদিকে সূর্যদেব ততোক্ষণে মাথার ওপর চড়ে নেকনজর দিতে শুরু করেছেন। বিরক্ত হয়ে কটেজে ফেরাই সাব্যস্ত করলাম।

দুপুরে নিত্যানন্দের রান্না করা মাছের ঝোল ভাত খেয়ে লম্বা ঘুম দিলাম, ভিড়টা বিদায় না হওয়া পর্যন্ত জঙ্গলের পথ মারিয়ে আর বিশেষ লাভ নেই।

বিকেল পাঁচটা নাগাদ আমরা দ্বিতীয় দফায় জঙ্গল পরিক্রমা শুরু করলাম। সকালের ভিড়টা ইতিমধ্যে বিদায় নিয়েছে। ফরেস্ট গার্ডদেরও ধারে কাছে কোথাও দেখতে পেলাম না। এই নিবিড় অরণ্য প্রান্তরে ফিতের মতো সরু পথে আমরা তিনজনই এখন একমাত্র পথিক। পথের দুধারের ঘন জঙ্গল আর মাটির সোঁদা গন্ধটার সঙ্গে হঠাৎ একটা একাত্মতা অনুভব হতে লাগল। একটা ঘুগু পাখি দির্ঘক্ষন ধরে ক্লান্তিহীন ভাবে ডেকে চলেছে, কি জানি হয়ত সঙ্গী আহ্বান করার জন্যই এত প্রচেষ্টা। একটা বাঁকের মুখে পাঁক খেতেই হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবে একঝাঁক হরিণের মুখোমুখি হয়ে গেলাম। মোবাইল ফোনের ক্যামেরা ওদের দিকে তাক করতেই হরিণের দল ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুট লাগিয়ে একেবারে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। হতাশ হয়ে ফের হাটা লাগালাম। এবারে চোখে পরল একটা সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী, যেটাকে আমরা গোসাপ বলে জানি, ইংরেজীতে যাকে মনিটর লিজার্ড বলা হয়। গোসাপটিকে বেশ সপ্রতিভ আর ক্যামেরা ফ্রেন্ডলি বলেই মনে হল, লাজুক হরিণগুলোর মতো ছুটে না পালিয়ে সে ক্যামেরার সামনে পোজ দিয়ে দাড়িয়ে রইল, আর সেই সুযোগে আমরা তার কয়েকটা স্ন্যাপ তুলে নিতে কসুর করলাম না, আমাদের কার্যকলাপ কিছুক্ষণ সহ্য করার পর হঠাৎ বিরক্ত হয়ে ওটা ফোঁস করে শব্দ করে একটা বুনো ঝোপের আড়ালে চলে গেল।

জঙ্গলটা ভালো করে চড়ে বেড়াবার উদ্দেশ্যে আমরাও এগিয়ে গেলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম আমার নাবালক পুত্রটির চোখে উত্তেজনার আভাষ। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম, জঙ্গলের মধ্যে একটা ফাঁকা মতো জায়গায় হরিণের দল জটলা পাকিয়েছে। এবারে গেরিলা পদ্ধতিতে নিজেদের গাছের আড়ালে লুকিয়ে হরিণগুলোর ওপরে নজর রাখতে শুরু করলাম, হাতের ক্যামেরাটাও অবশ্য এরমধ্যে বারকয়েক ঝলসে উঠেছে। চঞ্চল হরিণগুলো ধীরে ধীরে এক দুই করে বনের অন্যদিকে সরে গেল। সূর্য কিছুক্ষণ হল অস্ত গেছে। দুপাশের গাছগুলোর ফাঁকে এবারে  অন্ধকার জমাট বাধতে শুরু করেছে। মাথার ওপর ডানা ঝাপ্টিয়ে একটা রোমশ বাদুড় উড়ে গেল। আমরা হাঁটতে হাঁটতে একটা খোলা জায়গায় এসে পৌঁছলাম, খানিকটা জায়গা পরিস্কার করে এখানে কয়েকটা বেঞ্চ লাগানো হয়েছে, তারই একটিতে আমরা গিয়ে বসলাম। একজন ফরেস্ট গার্ড সাইকেলে চেপে যাচ্ছিলেন আমাদের দেখে দাড়িয়ে গেলেন, বললেন –সন্ধ্যে নামলে এই জঙ্গলে ঝুপ করে আধার ঘনিয়ে আসে, বিশেষ করে গ্রীস্মকালে আমরা টুরিস্টদের এসময়ে জঙ্গলে বেশী ঘোরাঘুরি করতে বারণ করি। কথায় কথায় ভদ্রলোক জানালেন হরিণদের নিয়ম করে দিনে দুবার খাবার দেওয়া হয়, সকাল ছটা আর বিকেল সাড়ে চারটে। তবে সকালে কাউকে জঙ্গলের ভিতর যেতে দেওয়া হয় না কারন সেক্ষেত্রে সামনে মানুষ পরলে লাজুক হরিণগুলো খাবার ছেড়ে পালিয়ে যায়। আমার স্ত্রী উৎসাহিত হয়ে বললেন –তাও ভালো হরিণগুলো তো এখানে নিরাপদেই আছে, অন্তত বাঘ বা অন্য কোন হিংস্র জন্তুর কবলে তো পড়তে হয় না। ফরেস্ট গার্ড ঠোঁটের কোনে বিষণ্ণ হাঁসি ফুটে উঠল, বললেন –কি জানি? ততক্ষণই নিরাপদ যতক্ষণ না কর্তাদের নতুন কোন অর্ডার আসে!

মানে?

ভদ্রলোক খানিক ইতস্তত করে জানালেন –কয়েক বছর আগে এখান থেকে দেড়শো হরিণ ধরে বক্সার জঙ্গলে চালান করে দেওয়া হয়েছে বাঘের খোরাক জোটাতে। এই শেষের সংবাদটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত, মুখ দিয়ে কোন কথাই যোগাল না। সামান্য বিরতির পর ভদ্রলোক ফের বললেন –আপনারা এখানে বসে থাকবেন না, গরমের সময়, বিষাক্ত সাপগুলো শিকার ধরার জন্য বেড়িয়ে পরবে, সাপ এমনিতে কামড়ায় না কিন্তু গায়ে পা পরে গেলে হিংস্র হয়ে উঠতে পারে। অন্ধকার হবার আগেই কটেজে ফিরে যান। ভদ্রলোক সাইকেলে চেপে জঙ্গলের গেটের দিকে চলে গেলেন। আমরা নিঃশব্দে কটেজের উদ্দেশ্যে হাঁটছিলাম, হরিণগুলোর করুন পরিনতি আমাদের মনেও যেন কোথাও বিষণ্ণতার রং ধরিয়ে দিয়েছিল।

নির্জন নিস্তব্ধ বেথুয়াডহরীর রাত আরও ঘন আরও গভীর হল। আমরা নিত্যানন্দবাবুর রান্না করা ডিনার সেরে সেদিনের পালা সাঙ্গ করলাম। পরদিন ভোরের ট্রেনে ফেরার টিকিট বুক করা আছে। শেষবারের মতো কটেজের বারান্দা দিয়ে জঙ্গলের দিকে চাইলাম, গাঢ় ঘন অন্ধকারে আবৃত বনাঞ্চলকে যেন আরও অদ্ভুত আরও রহস্যময় মনে হচ্ছিল। ইচ্ছে রইল বেথুয়াডহরীর এই অরণ্যভুমিতে আবার ফিরে আসবার।

 

Writer Sanjoy Bhattacharya

লেখক পরিচিতি : সঞ্জয় ভট্টাচার্য , পদ্মপুকুর রোড , কলকাতা।

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here