<< জাপান পর্ব ১৯ ১৭ই জুন থেকে ১ জুলাই ,২০১৮
দিন চলছিল যেমন চলে , সপ্তাহের পর সপ্তাহ কাটিয়ে এগিয়ে চলেছিলাম বেশ আনন্দ -উৎসাহ নিয়ে। এই উৎসাহে এভাবে বাঁধ সাজবে প্রাকৃতিক বিপর্যয় , তা কে জানতো। ১৮ই জুন , সকাল সকাল, তাড়াহুড়ো করে মেয়ে – বরের জলখাবার -দুপুরের খাবারের তোড়জোড় চলছে , ভাস্কর স্নান ঘরে , মেয়ে অন্য ঘরে বিছানায় বসে খেলছে। হঠাৎই এক সজোরে কাঁপুনি। মনে হলো , মনের ভুলে কিছু ঘটে গেলো। ঘড়ির কাঁটা সকাল ৮টার কাটা ছুঁই ছুঁই। আবারও !! এবার বেশ জোরে। চারিদিকে অ্যালার্ম বাজতে শুরু করলো। বুঝলাম জাপানে আমি। ৫ তলার বিল্ডিং এ সবথেকে উঁচু তলা তে আমাদের বাস। এই তলাতে সব পরিবার সহ বাস করে। মানে সবার ই কচিকাঁচা আছে। সবাই ছুটে বেরিয়ে গেলাম বাইরে। ততক্ষনে বিল্ডিং এর লিফ্ট-আরো কিছু দরজা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে বন্ধ হয়ে গেছে। সবাই নিচে পৌঁছে , প্রায় ৩০ মিনিট অপেক্ষা করে বুঝলাম আর বোধহয় কিছু হবে না। ততক্ষনে , ইন্টারনেট এ এসে গেছে ভূমিকম্পের বর্তমান হাল বা খবর।
আপডেট টি কিছুটা এরকম : ভূমিকম্পটি 18 জুন জাপান এর স্ট্যান্ডার্ড সময়ের সকল ৭ টা বেজে ৫৮ মিনিটে এ, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ওসাকাের টাকাসকি অঞ্চলে ঘটেছে। যার উপকেন্দ্রের সাথে গভীরতা ছিল 13.2 কিলোমিটার (8.2 মাইল) । কানসাই অঞ্চলে বেশ কয়েকটি সক্রিয় ফল্ট তখন রয়ে গেছে , যা বর্তমানে অভ্যন্তরীণ অগভীর ভূমিকম্প উত্পন্ন করতে পারে।1995 সালে “গ্রেট হানশিন” ভূমিকম্পে প্রচুর পরিমাণে তীব্রতা সহিত কোবে Kobe এ কাঁপিয়ে প্রায় শেষ করেছিল ।সে সময়ও উত্তর ওশায়া সহিত ,নিকটবর্তী কিয়োটো অঞ্চলের অনেক অঞ্চলকে দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত করেছিল।
আজ প্রায় ২৩ বছর পর কিয়োটো এভাবে কেঁপে উঠলো। ভূমিকম্পে ওসাকার অনেক ক্ষতি হয়েছিল , তার অন্যতম কারণ ছিল সময়। অনেক মৃত্যুর সংবাদ ও ক্ষয়ক্ষতির খবর ধীরে ধীরে আসতে থাকে। সব প্রাইমারি সেকেন্ডারি স্কুল গুলো বন্ধ হয়ে গেলেও , আমার মেয়ের কিন্ডারগার্টেন খোলা ছিল আর তারা প্রায় জোর করে মেয়েকে ওখানে রেখে দেয় , বলে ওখানেই নাকি বাচ্চারা বেশি সুরক্ষিত। সবাই কে ফোন করে মেইল করে জানায় এই ভূমিকম্পের কথা। দিন থেকে রাত হতে হতে প্রায় ভুলেই গেছিলাম ভূমিকম্প হয়েছে সকালে যার তীব্রতা বা Magnitude ছিল প্রায় 5.5 Mw (Max. intensity: VIII (Severe); 6弱) . রাত ১২ টার কাছে হঠাৎ এ মনে হয় খাট নড়ছে। আরে হ্যাঁ , ঘুম থেকে উঠে রীতিমতো বুঝি খুব বেশি জোরে খাট নড়ে উঠলো।ধড়পড় করে উঠে একছুটে আবার নিচতলায়। মেয়ে ভয়ে বমি শুরু করে দিলো। বুঝতে পারলাম আমরা বিপদে। সকালে অতটা ভয় পাইনি, যতটা এবার পেলাম। এর পর পরের দিন সকাল ৮ টা নাগাদ সেই একি অবস্থা। এগুলো নাকি আফটার শক। ১৮ জুনের পর আগামী ১০ দিনে ৪০ টি এমন আফটার শক হয়। অনেক সময় ধরে আমার মাথা ঘোরা ব্যাপারটা থেকে গেছিলো। বিছানায় শুয়ে মনে হতো এই নড়ছে , এই বোধহয় , আবার জোরে কিছু হবে। কত দিন যে ঘুম হয়নি , তা বলার নয়। দিনে রাতে ভালো জামা পরে শুতাম , যদি পালিয়ে বেরিয়ে যেতে হয় সেই ভেবে। একটা ব্যাগ এ সব দরকারি কাগজপত্র রেখে সব সময় তৈরী থাকতাম। সে এক বীভৎস অভিজ্ঞতা। এই প্রথম মনে হলো , এবার বাড়ি যাওয়ার সময় এসে গেছে। ভাস্কর ও খুব ঘাবড়ে গেছিলো , বার বার আমাদের ভারতে পাঠিয়ে দেবার জন্য টিকিট দেখতে শুরু করেছিল রীতিমতো।
ভূমিকম্প আমাদেরকে কে কাঁদিয়ে কাঁপালেও , জাপান ছিল নিরুত্তাপ। হয়তো বা ওরা এভাবেই জীবন কে মেনে নিয়েছে , ভগবানের জন্য ছেড়ে দিয়েছে সব। এক সপ্তাহ এর বেশি কোথাও না বেরোলেও , পরের সপ্তাহে বেরিয়ে পড়েছিলাম কাছাকাছি অন্যতম প্রসিদ্ধ শ্রাইন এর উদ্দেশ্যে। যাসাকা শ্রাইন , Gion . Gion এমনিতেই কিয়োটো র একটি জনপ্রিয় জায়গা পর্যটকদের জন্য।
গিয়োন (祇 園) কিয়োটোর মধ্যে সব থেকে বিখ্যাত Geisha (Geiko) গীশা জেলা, যা পূর্বদিকে ইয়াসাক/যাসাকা শ্রাইন এবং পশ্চিমে কামো নদীর মাঝখানে অবস্থিত শিজো এভিনিয়ার কাছাকাছি অবস্থিত। এটি দোকান, রেস্টুরেন্ট এবং ওখায়া (টিহাউস) দিয়ে ভরা। এবার কি এই Geisha বা Geiko , যার জন্য এটি এতো জনপ্রিয়। আসলে গাইশা (বা গাইকো) হলো পেশাদার বিনোদন এর মহিলা বা পুরুষ সদস্য , যারা রেস্টুরেন্ট , ভোজ এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানগুলিতে অতিথিদের বিনোদনে সাহায্য করেন । তারা বিভিন্ন ঐতিহ্যগত জাপানি আর্টসে ( যেমন নৃত্য এবং সঙ্গীত ) প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন। এদের ভূমিকা কথোপকথন, পানীয় গেম এবং নৃত্য প্রদর্শন সঙ্গে সঙ্গে অতিথির সেবা ইত্যাদি হয়ে থাকে ।
আমরা এরকম এ এক শনিবার পৌঁছে যায় Gion এর প্রাণ স্থাপনের উৎস যাসাকা শ্রাইন এ। যেটি শহরের ঠিক মাঝামাঝি অবস্থিত। এই শ্রাইন টি বিশেষ ভাবে বিখ্যাত , GION Festival এর জন্য , যেটি কিয়োটোর সবথেকে বড় ধার্মিক অনুষ্ঠান।
ইয়াসাক শ্রাইন (八 坂 神社, ইয়াসাক জিনজা ), ছাড়াও গিওন শেরাইন নামেও এই শ্রাইন টি পরিচিত। 1350 বছর আগে প্রতিষ্ঠিত, মন্দিরটি জনপ্রিয় গিওন জেলা এবং হুশিশিমা জেলার মধ্যে অবস্থিত।
সূর্যের রগে রাঙা শ্রাইন এর দূর্গা দিয়ে ঢুকেই চোখে পরে ,ছোট ছোট দু-তিনটি মন্দির ঘর , যেখানে প্রণাম সেরে ডানদিকে গেলে চোখে পর্বে কিছু খাওয়ার জিনিসের আর রকমারি সরঞ্জামের দোকান। তা চপস্টিক থেকে বৌদ্ধ মূর্তি , বা বরফের গোলা হোকনা কেন।
আসল প্রাঙ্গণে ঢুকতে নজরে পড়লো অসংখ্য সাদা লণ্ঠন ঝোলানো একটি হল আর তার সামনে আরো একটি হল। যেখানে মানুষ লাইন দিয়ে ঘন্টা বাজাচ্ছে , নমস্কার জানাচ্ছে। মন্দিরের এই প্রধান ঘরটির একক ভবনের মধ্যে হণ্ডেন (ভেতরের আশ্রয়স্থল) এবং হায়দার (হাউস অফার) সম্মিলন রয়েছে । সামনের লণ্ঠন যুক্ত হল এর প্রতিটি লণ্ঠন কেউ না কেউ দান করছেন , যেখানে দান মূল্য অনেক বেশি।
Main Hall
যেদিন আমরা গিয়েছিলাম সেদিন প্রধান হল এর উল্টোদিকে একটি স্টেজ মতো জায়গায় ছিল অনেক লোকের ভিড়। ছিল কিছু সভা আয়োজন। মনে হল অনেক গুণী ব্যক্তির সম্মেলন চলছিল। কিছুক্ষন এদিক ওদিক দেখে ফেরার পথ ধরি।
আমরা এখানে সুগাকুইন থেকে ৫ নম্বর বাস এ পৌঁছে ছিলাম , তবে ৩১ নম্বর বাস ও এখানে আসে। এছাড়া কেউ যদি কিয়োটো স্টেশন থেকে এখানে আসতে চান তাহলে ১০০ বা ১০৬ নম্বর বাস ধরে Gion বাসস্টপ এ নামতে পারেন। এছাড়া ট্রেন এ আসতে হলে Keihan Line এর ট্রেন ধরে Gion Shijo Station অথবা Hankyu Line এর ট্রেন ধরে Kawaramachi Station .
এখন থেকে আমরা চলে গেছিলাম , Shijo Kawramachi তে ,সেখানে আমাদের প্রিয় বসে থেকে সময় কাটানোর জায়গাটার সামনেই ছিল একটি বৌদ্ধ মন্দির। যা অনেকদিন চোখে পড়লেও দেখে ওঠা হয়নি। সেদিন সময় পেলাম। অসাধারণ সেই বৌদ্ধ মূর্তি। সোনালী আভা যেন চারিদিকে আলো ঠিকরে দিচ্ছে। বিশালকায় বৌদ্ধ মূর্তি না জানি কি কি ইতিহাস বুকের ভেতর বহন করে চলেছে আজ ও।
এই প্রথম চোখে পড়লো চিকেন এর মোমো দোকান। কারণ এটা প্রায় এখানে দুর্লভ। ভুল করে জাপানীস সস মিক্স করে নিয়েছিলাম বলে , খাওয়ার আমেজ পুরোপুরি নিতে বাধাগ্রস্থ হলেও , মোমো গুলো আমাদের হাত থেকে রক্ষা পাইনি সেদিন। এর পর আবার ফিরে আসা সুগাকুইন এ , আবার একটা ব্যস্তময় সপ্তাহ কাটিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে দিন গোনা।
ইতিমধ্যে ভাস্করের মেরি কিউরী ফেলোশিপ এ নাম আসে। প্রথমে খুব আনন্দ হয় ঠিক এ , কারণ এই ফেলোশিপ এর কাছে কোনো কিছুই ঠিক দাঁড়ায় না। কিন্তু আমরা দুজনেই ঠিক বুঝে পাইনা যে আনন্দ করবো না দুঃখ। কারণ জায়গাটা টা ইউরোপের বিখ্যাত জায়গা ডেনমার্ক এ , ডিসেম্বর এর প্রথমে যোগ দিতে হবে কাজে , আর এদিকে জাপানের বর্তমান ফেলোশিপ। মনেহলো ভগবান যেন খেলা খেলছেন আমাদের সাথে। এক দেশ থেকে অন্য দেশ , তও এতো কম সময় এ , সব যেন গুলিয়ে যাচ্ছিলো। ডেনমার্ক থেকে খবর এলো হাতে ১৭ দিন , ১৭ ই জুলাই এর মধ্যে জানাতে হবে , ভাস্কর যাবে কি যাবে না।
সব যেন হঠাৎ করে ভালো যেতে যেতে খারাপ রূপ নিতে শুরু করলো। অনেকটা সব পেয়ে হারানোর মতো অবস্থা। ভাস্করের অনেক দিনের ইচ্ছে ছিলো এই ফেলোশিপ এ যাওয়ার এদিকে শরীর মন পরিস্থিতি সব যেন বিকর্ষণ শক্তিতে এদিক ওদিক ছিটকে যাচ্ছে। বিকর্ষণ শক্তির অন্যতম কারণ আমিও বটে। কারণ আমি জাপান এই আসতে চাইনি। এখানে এসে সব ভালো ভালোই মিটেছে কারণ এখানকার সব সুবিধা গুলো হাতের কাছে , কে জানে ওখানে কি হবে , কোথায় গিয়ে পরবো। সব মিলিয়ে গুলিয়ে গ। হাতে কিছু সময় , তাই মস্তিস্কে একটু শান্তি দিয়ে সব ভুলে থাকার প্রচেষ্টা তে মন দিলাম দুজনে।
<< জাপান পর্ব ১৯ জাপান পর্ব :২১ >>