অফিসে বেরোনোর আগে খাওয়ার টেবিলে বসতে গিয়ে মাথাটা গরম হয়ে গেল আর্যর। আাঁহাতক আর সহ্য করা যায়? পনের দিন হয়ে গেল, লাঞ্চ আর ডিনারের মেনু সেদ্ধ আর ঝোলভাত। এখনো কয়েকদিন বাকি। দিনের পর দিন এই মেনু গলাধঃকরণ করতে হলে বুঝতেন। দুপুর আর রাতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই চলছে। আর্য অফিস ক্যান্টিনে লাঞ্চটা সারে বলে কষ্টটা তাও সহ্য করে নেয়। পাপাইটার জন্য কষ্ট হয়। মাঝে মাঝে বিদ্রোহ করে বটে, কিন্তু এই ছয় বছরেই মাকে নিজের মতো করে চিনে নিয়েছে।এই কদিন বলে কোনো লাভ হবে না বুঝে সোনামুখ করে চুপচাপ খেয়ে নেয়। জানে এ কদিন বাপীও বাইরে থেকে কিচ্ছুটি নিয়ে ঘরে ঢুকবে না, মাকে খুব ভয় পায় কিনা। মাঝে মাঝে তো মনে হয় পাপাইয়ের থেকেও বেশী। দুপুরের মিটিংটার জন্য আজ আর ক্যান্টিনে যাওয়ার সময় হবে না ,তাই খেয়ে যাওয়া। তবে বলা বৃথা বলে চুপচাপ দুটো মুখে গুঁজে বেরিয়ে পড়ে আর্য।
এমনিতে দিদুন আসে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আর তখন পাপাইকে পায় কে? যদিও দুপুরের দিকেই আসে বেশী, তাও স্কুল থেকে ফিরে দিদুনের হাসিমুখটা দেখলে মনটা খুশীতে বেলুন হয়ে যেন উড়ে যায়। উপরি পাওনা,কত কি রান্না করে আনে, ইয়াম্মি আর টেস্টি। কি যে ভালো লাগে পাপাইয়ের সেগুলো খেতে। কিন্তু এখন কদিন দিদুনেরও দেখা মিলবে না। আর্যর মাঝে মাঝে মনে হয় তিথির স্বভাবের এই দিকটা সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। তিনবছর প্রেমপর্বের পরে বিয়ে, সেও হয়ে গেল দশ বছর। তেরো বছরে এমনকিছু উল্লেখযোগ্য অন্ধকার দিক তিথির স্বভাবে ধরা পড়েনি যার দরুণ তাকে কোনো দাগী তকমা সেঁটে দেওয়া যায়। আর্যর বাবা মা শহরতলির বাড়িতে থাকেন, শরীরও সুস্থ আছে। তাই কোলকাতার দুকামরার ফ্ল্যাটে তিথির একচ্ছত্র আধিপত্য। আর্যর সঙ্গেও বোঝাপড়া টাল খায় না খুব একটা। সত্যি বলতে গেলে আর্য বুঝেসুঝে চলে বলে বোঝাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে দাম্পত্যসুখের গ্রাফটাও ঊর্ধ্বমুখী,কোথাও টাল খায়নি এখনো।
গন্ডগোলটা শুরু হয়েছে বছর দেড়েক ।তিন বছর আগে পাপাইয়ের অ্যাডমিশনের ঝামেলাটা মসৃণভাবেই চুকে গিয়েছিল। আর্যর পছন্দ ছিল সেই ধরনের স্কুলগুলো যেখানে জুনিয়র ক্লাসে পরীক্ষার ধরাবাঁধা নিয়ম থাকে না। কিন্তু তিথির যুক্তি হলো শেষপর্যন্ত যখন ইঁদুরদৌড়ে নামতেই হবে তখন প্রথম থেকেই প্র্যাকটিস থাকা ভাল। ফলস্বরূপ, পাপাই ওরফে অপ্রতিম রায় ভর্তি হয়েছে কোলকাতার যে নামী স্কুলটিতে সেখানে নার্সারি থেকেই বছরে দুবার বিধিবদ্ধ পরীক্ষাব্যবস্থা চালু আছে। সারাবছরব্যাপী খুচরোগুলো বাদ দিলে যেগুলোর পোশাকি নাম ক্লাসটেস্ট। সেই সূত্রেই অ্যানুয়াল পরীক্ষা চলাকালীন বাড়ির পরিবেশ যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে কনট্রোল করা হয়। শারীরযন্ত্র যাতে কোনভাবে বিকল না হয় সেকারণেই সেদ্ধ আর ঝোলভাত। তাছাড়া পড়ার সময়টাও বেশী পাওয়া যায়।
এবার তিথি একটু বেশী চিন্তিত কারণ বাংলা এবার নতুন বিষয়। যতই মাতৃভাষা হোক না কেন, পরীক্ষায় তাতে পাণ্ডিত্য দেখিয়ে ভাল মার্কস পাওয়া সহজ নয়। গতবার ফার্স্ট হওয়ায় চাপটা একটু বেশী। তা আজই ছিল বাংলার দিন। এরপর তিনদিন ছুটি, তারপর G. K. হলেই নিশ্চিন্তি। অনেকটা নির্ভার লাগছিল তিথির। সন্ধ্যা পার করে বাড়ি ফিরে আর্য দেখলো আবহাওয়া বেশ ঝলমলে। পাপাই বল নিয়ে খেলছে আর তিথি question paper হাতে ছেলের মুখ থেকে উত্তর শুনে নিশ্চিন্ত হচ্ছে।
‘শোনো, ভালোই দিয়েছে পরীক্ষা। মনে তো হয়, পুরো নাম্বারই পাবে। ‘ চায়ের কাপটা হাতে দিয়ে হাসিমুখে সামনে দাঁড়াল তিথি।
‘সে তো আমি জানিই। ‘
‘হ্যাঁ। কোনোদিন না পড়িয়েই জেনে গেলে। জানোনা তো, তথাগতর মা খুব খাটছে, আগের বার মাত্র দু নম্বর পিছিয়ে ছিল তো। ‘
এটা অবশ্য গুরুতর সমস্যা।
‘দাড়াঁও । বানানগুলো কি লিখেছে দেখে নিই। ‘
আসলে বানান তো আর প্রশ্নপত্রে থাকে না, শব্দগুলো পাপাইকে জেরা করে আর বাকিটা বন্ধুদের মায়েদের ফোন করে জেনে নিয়েছে। খাতায় লিখে পাপাই এবার মাকে দেখাতে এলো। তিথির তীক্ষ্ণ আর্তনাদে আর্যর হাতের কাপটা থেকে খানিকটা চা ছলকে পড়ল মেঝেতে।
‘এটা কি করেছিস? সব ঠিক, শুধু দুঃখ-এ ‘দ’ এ দীর্ঘ উ(ঊ়) দিয়েছিস কেন? ‘ রবীন্দ্রনাথের নোবেল পদক চুরিতে বাঙালির সমবেত দুঃখও বোধহয় তিথির শোকের কাছে তুচ্ছ।
আর্য দিব্যদৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করল, তথাগত এবার দৌড়ে এগিয়ে গেল। মারমুখী তিথিকে সরিয়ে পাপাইকে কোলে তুলে নেয় আর্য, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, ‘ কেন জেনেশুনে ভুল লিখলে পাপাই? ‘
নিষ্পাপ হাসিমুখে পাপাই একটু অবাক হয়েই তাকাল – ‘জানো বাবা, ই, ঈ, ও, এ – সব দিয়ে বানান এসেছে। কিন্তু আন্টি ঊ দিয়ে একটাও spelling লিখতে দেয়নি। ঊ -র মন খারাপ হয় না বুঝি? তাই তো আমি…….’
বাক্যহারা বৌয়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেরী না করে বারান্দায় পালালো আর্য, হাসি চাপতে চাপতে। তিথির চোখে পড়লে আর এক প্রস্থ অনর্থ ঘটবে। বইয়ের পাতায় তখন ঝলমল করে যেন বর্ণমালার অক্ষরগুলোও হাসছিল আর্যর মতোই।
কলমে সুস্মিতা পাল, কলকাতা