গত রাতে আসমানের দিকে তাকিয়ে, বার কতক হিঁচকি তুলে, কাল ঘাম ছুটিয়ে, বাতাসে ভেসে যাওয়া খড় কুটোর মতো সতু বাগদি তার জ্বরা জীর্ণ দেহ ছেড়ে চলে গেল। মারা যাওয়ার আগে তার দশ বছরের ছেলে মাধবের হাত খানি ধরে বলে গেল–‘ অন্য কোথাও চলে যাস, এ জায়গা সইবে না বাবা তোর, এখানে আমি সব হারিয়েছি। দূরে কোথাও গিয়ে বড়ো হোস।তবেই আমি শান্তি পাবো।’
ব্যস্ত শহর এই মৃত্যু যন্ত্রণার ঘূণ অংশ খবর পেলো না। দিনে রাতে এরম অজানা অখ্যাত পৃথিবীর বোঝার মতো কত সতু ঝরে পড়ছে ,কে খবর রাখে ! কথাটা এক কান থেকে দুকানে পৌঁছাতে বেলা গড়িয়ে বিকেল নামলো। রেল স্টেশনের বড়ো বাবু লোকজন সমেত উঁকি দিয়ে বললেন– ‘ সব্বনাশ করেছে! এই সব উটকো ঝামেলা এখন কি করে সামলায় ! রেলে কাটা পড়লে না হয় অন্য ব্যবস্থা ছিলো। এতো জবর দখল করা রেলের জমির ওপর লাশ ! এসবে হাজারো ঝক্কি ! একে তো জমি নিয়ে প্রশ্ন তার ওপর মরা। এসব ওপর মহলে পৌঁছালে কৈফিয়ত দিতে দিতে আমার চাকরী বুঝি যায় যায়!’
মদ্যপ কুলি হরিয়া বলে ওঠে –‘ এক্ষুনি হুকুম দিলে স্যার ! ঝুপড়ি ভেঙে ,ঠ্যাং ধরে লাশ রেলের সীমানার বাইরে ফেলে আসি। ল্যাটা চুকে যাবে।’
‘–না ..না ও সবে যেয়ো না। ওতে আরো ফাঁসবো। তোমরা বরং লোকাল থানায় একটা খবর দাও। আমি দু কলম লিখে দিচ্ছি যে ভবঘুরে রেলের জমিতে আশ্রয় নিয়ে অকস্মাৎ মরেছে। এর সঙ্গে রেল কর্তৃপক্ষ কোনভাবেই দায়ী নয়। হরিয়া ! শিগগিরই ব্যবস্থা করে ফেল ! গন্ধ ছুটলে কেলেঙ্কারি বাঁধবে ‘– বললেন স্টেশন মাস্টার।
হরিয়া কোমরে গামছে বেঁধে ‘জি হুজুর’ বলে ছুট দেয়।
মাধব খানিক তফাতে দাঁড়িয়ে সব নাটক দেখে, চুপ মেরে থাকে। যেন পাথর বনে গেছে সে।বয়েসে অল্প হলেও এই মুহূর্তে সে বাস্তব অভিজ্ঞতার উঠোনে মস্ত বড় একটা চারা গাছ। সতু বাগদীর মরদেহ আকাশের দিকে চেয়ে শক্ত কাঠের মতো কঠিন হয়ে রয়েছে। ধূলো ময়লার শরীর টা রক্ত শূন্য হয়ে আসতে আসতে ফ্যাকাসে রং ধারণ করছে ক্রমশ।
একে বারে মাঝ রাত্তিরে মিউনিসিপ্যালিটি আর লোকাল থানার তদারকিতে সতু বাগদির মুখে আগুন জুটলো। দাহ সমাপ্ত হলে দেহাংশ গঙ্গা বিসর্জন দিয়ে রেল লাইনের ধারে ফাঁক ফোকর পূর্ন কঞ্চির বেড়া দেয়া ঘরটায় ফিরে এলো মাধব। ঘুট ঘুটে অন্ধকারে কেরোসিনের কুপি জ্বেলে বসে মাধব ভাবে এখন তার কি করনীয়? পাশ ফিরে শোবার অযোগ্য ঘরখানি আজ তার বড্ড ফাঁকা ফাঁকা ঠেকে। অনেকটা চার দিনের দুর্গা পূজার শেষে বিসর্জনের দিন যেমন ঘাট থেকে ফিরে পূজার মণ্ডপে তাকালে যেমন টা মনে হয় ! আজ তার ঠিক তেমন মনে হচ্ছে। শূন্য অন্ধকারাচ্ছন্ন বেদীতে একটা সরু সলতের প্রদীপ জ্বলতে থাকে ।তবুও তো ফি বছর প্রতিমা ফেরে ।কিন্তু তার মা? সে তো ছাই হয়ে ধুলোয় মিশে গেছে।এটা সেটা অনেক কথায় মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। মনে পড়ে একদিন সতু ওকে বলেছিল –‘ তুই আমার পেট চিরে পৃথিবীতে আসিস নি রে । খুব ভোরে কারা যেন চুপ করে, তোকে স্টেশনে ফেলে রেখে গিয়েছিল। সেদিন আমি কুকুরের চেঁচানি শুনে না এগুলে, শিয়াল কুকুরে তোর মাথা চিবিয়ে খেতো। এ বাড়ি ও বাড়ি বাসন মেঝে সাত লোকের ফাই ফরমাস খেটে তোকে বাঁচিয়ে রাখি। কি ফুট ফুটে চেহারা ছিল তোর! না জানি কোন বড়লোকের রক্ত তোর গায়ে বইছে। গোপালের মতো মুখ দেখে তোর নাম রেখে ছিলাম মাধব।’
দশ বছরের মাধব বেঁচে থাকার সংগ্রামে আজ এই জান্তব পৃথিবীতে একা। সমস্ত চেনা মানুষ গুলো আজ যেন বড্ড অচেনা। নিজেকে একটা রণক্ষেত্রর ক্লান্ত সৈনিক মনে হয় তার । কেউ উঁকি মেরে তার দিকে চায় না। প্রত্যেকে অন্যর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত ।সতু মরার সময় রেখে গেছে এই হাওয়া বাতাসের লুকো চুরি খেলা বাসস্থান আর এক টিনের কৌটা। যে কৌটা ঘরের চালের বাঁশের সাথে এক যুগ ধরে বাঁধা। মাধবের নাগালের বাইরে। ছোট বেলায় এক ঝড় জলের রাতে যখন ঝুপড়ি টা ঠিক জলে ভাসমান শ্যাওলার মতো দুলছিল। আর টিনের কৌটা টাও শব্দ ছেড়ে ঠেকনা দেয়া বাঁশের সাথে পাল্লা দিয়ে নড়ছিল, সে সময় অনেক বার মাধব ওর মাকে জিজ্ঞাসা করে ছিলো — ‘ওটা কি ?এতে কি আছে মা? ‘
সতু বাগদি অনেক বড় বড় চোখ করে হাত নাড়িয়ে বলেছিল– ‘ওতে যা সামান্য টুকু তোলা আছে , আজ আর আমাদের নেই বাবা। খুলে ফেললেই সব ওলট পালট হয়ে যাবে। ও কৌটো টা,খবর দার ! আমি বেঁচে থাকতে ছুঁয়েও দেখিসনা। খুলবিও না। ওর থেকে নিজেকে দূরে রাখ। ও তোর বাপের সম্পদ।বাপের চিন্নত। ‘
মাধবের শিশু মনের কৌতূহল বন্দি হয়েই রয়েছে কৌটায়। মা এর কথার অর্থ আজ অব্দি সে বোঝেনি। গরিবের ঘরে কি এমন মূল্যবান জিনিস থাকতে পারে? আর যদি দামি জিনিস থাকে, তাহলে তারা গরিব কেন?
কৌটাটা কি করে এলো এবার বলি। ওতো ঠিক কৌটা নয়, মুখের কাছটা চওড়া গোলাকৃতির। তারপর একটা লম্বা চোঙ এর মত নেমে গেছে নীচ বরাবর ধাতব বস্তু টি। মাথার ওপর ঢাকনা। বর্তমানে শরীরে কয়েক স্থানে ভাঙা অংশ উঠে আছে। আগে তা তেমন ছিল না। সতু বাগদির স্বামী নিতাই বাগদি মৃত্যু কালে এটি সতুর হাতে তুলে দিয়ে বলে যায় — ‘দ্যাখ সতু এটির বড়ো মান বুঝলি। প্রাণ থাকতে এটি হাত ছাড়া করবি না আর দেবতা জ্ঞানে সম্মান করে মাথায় তুলে রাখবি।এ আমাদের বংশের মান জেনে রাখিস। ‘
স্বামীর দেয়া অতুল্য সম্পদ সতু সারা জীবন বাঁশের খুটায় বেঁধে মাথায় তুলে রেখেছিল। কি করে পেলে এ পাত্র খানি জানতে চাওয়া তে নিতাই বলে ছিল–‘এক সময় অল্প বয়সে নদিয়ার বিখ্যাত কীর্তনিয়া ব্রজহরি দাস রাধা কৃষ্ণ পালা কীর্তনে সুরেলা কণ্ঠে গেয়ে আসর মাতালে তার সঙ্গে বাঁশি ফুকতো এই নিতাই বাগদি।আর মাঝে মাঝে ধুয়া পদ ও গাইতাম । একবার পদ্মাপারে পালার ডাক পড়লে সেখান কার জন দরদী নেতা সুরেন বাগচী আমার বাঁশীর শব্দ শুনে এতোটাই মোহিত হয়ে ছিলেন যে পালার শেষে নগদ টাকা, এই ধাতুর ভেট খানি হাতে তুলে দেন। আর পালার আয়োজন কারীরা সঙ্গে দেন রূপার মেডেল। আমার মা অবশ্য এটিকে টিনের কৌটা হিসেবেই ব্যবহার করত। নারকোল নাড়ু, পুরে ঢাকনা তুলে রাখতেও দেখেছি । দারিদ্র্যর সংসার ,বাসন পাবো কোথায়। জ্বর জ্বালা হলে ওতেই মা বার্লি কি সাবু গরম করে মুখে তুলে দিতো। অনেক ধকল সোয়েছে ওটি। ভুলেই গিয়েছিলাম এর আসল ব্যবহার। একসময় অনেক সম্মান আর খাতির পেয়ে ছিলাম, তার চিহ্ন এই টিনের কৌটা। খবর দার !আমি না থাকলে বেচে খাসনি যেন।’
ওর মূল্য বোঝবার মতো আজ আর কেউ বেঁচে নেই। কুঁড়ে ঘরে, ধুলো মাখা ওই বস্তুটিকে বড়ো অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়। মাধবের ছেলে বেলার রহস্যের আধার যেন আজ ওকে ভীষণ ভাবে পেয়ে বসলো। পিতা মাতার অবর্তমানে তাদের গচ্ছিত যা কিছু আজ সব কিছুর মালিক তো সে।অভাব সেই কবে থেকে সহ্য হয়না মাধবের। হয়তো তার শরীরে ভেতরের রক্ত কথা বলে। করণীয় কিছু ছিল না এতোদিন। এখন সে নিজের মালিক নিজেই। কঞ্চির বেড়ায় পা ফাঁসিয়ে ওপরে উঠে নামিয়ে নিয়ে আসে বহু অপেক্ষার সেই টিনের কৌটা। মুখ খুলতেই ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসে একটা রুপোলি গোলাকার চাকতি। ওটা হাতে গুঁজে নিয়ে, টিনের কৌটা ধরে ঝুপরি ফেলে চলতি ট্রেনে চড়ে বসে মাধব। ঘরের এক কোনে বাঁশের খাঁচায় অযত্নে পরে থাকে নিতাই বাগদির বাঁশি।
আচমকাই ট্রেন থেকে নেমে পড়ে এক জমজমাট স্টেশনে। সারাটা দিন শহরের এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্ত হেঁটে ঘুরেও একটু খানি আশ্রয় বা কাজ তার জোটেনা। এই বয়সে কাজে নিলে অনেক ফাঁপরে পড়তে হবে বলে সকলে এড়িয়ে যায়। তা ছাড়া সম্পূর্ণ অপরিচিত অন্য জায়গা থেকে আজই উড়ে এসেছে।আজ আছে কাল নাই। কে তার দায়িত্ব নেবে। পেটে টান পড়াতে। রুপোর মেডেল বেঁচে কয়েক দিন চালায়। মন খারাপ করে এদিক ওদিক বসে থাকে আর সতুর কথা ভাবে। এই অল্প বয়সে দুই বার পরিত্যক্ত সে। সতুও তাকে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে গেল। নিতাই বাগদির কথা কোনো কালেই তার মনে পড়েনি। অল্প মাথায় হাজারো চিন্তা এনে টিনের কৌটা হাতে ধরে স্টেশনের মেঝেতে নিজের অজান্তে ঘুমিয়ে পড়ে মাধব। হঠাৎ টুং টাং শব্দে ঘুম ভেঙে দেখে তার টিনের কৌটা উপচে পড়ছে চক চকে কয়েন। এক মুহূর্তে হাসি গাল ছাপিয়ে ওঠে । যেন ওই ধাতুর কয়েনের শব্দের মাধ্যমে ,কথা বলে ,বেঁচে থাকার উপায় তাকে বাতলে দিয়েছে টিনের কৌটাটা। এ যেন তার পালিত পিতা নিতাই বাগদির আশীর্বাদ। তার বংশের একমাত্র সম্মান।
এরপর থেকেই টিনের কৌটা পেতে ভিক্ষা করে মাধব। রেল স্টেশনের একপাশে ইঁট তুলে উনুন ধরায়। রান্নার উপকরণ বলতে একমাত্র সেই টিনের কৌটা। সেই টিনের কৌটা চড়িয়ে শুকনো কাঠ জ্বেলে ফুটিয়ে নেই ভাত। এভাবে ভাত ফুটানো মাধব কে সতু বাগদি শিখিয়েছিল। গরম ভাত কলা পাতায় ঢেলে ,মুখে তুলতে তুলতে কালি মাখা টিনের কৌটার দিকে চেয়ে মনে পড়ে সতু বাগদির কথা। সতু বাগদি বলেছিল ও কৌটা খুললে সব ওলট পালট হবে। হলোও তাই।
কলমে আশিস চক্রবর্তী, সুকান্ত পল্লি, মুর্শিদাবাদ
বর্তমানে একটি স্কুলে পার্শ্ব শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। ছেলে বেলা থেকেই লেখালিখি শুরু। দীর্ঘ সাত বছর নিজের একটি প্রিন্টেড পত্রিকার সম্পাদনা করেছি। বর্তমানে গল্প ,কবিতা , উপন্যাস ,নাটক , প্রবন্ধ , অনুগল্প প্রভৃতি কানাডা , অস্ট্রেলিয়া , বাংলাদেশ এবং ভারত থেকে নিয়মিত প্রকাশ হয়ে চলেছে -অনলাইন ও প্রিন্টেড আকারে।
[…] জয়া ঘটক সুদীপা মন্ডল রশ্মি ভট্টাচার্য্য সুপ্রিয়া মণ্ডল আশিস চক্রবর্তী […]