ঠেলা

1
1290

গলায় তুলসীর কণ্ঠী থাকলেও জিতেন প্যান্ট-শার্ট পরে। যেন কণ্ঠী থাকলে ধুতি-পাঞ্জাবি পরতেই হবে, তবে ওকে কেউ কোনদিন কোন কীর্তনের আখড়ায় বা পাড়ার কালীমন্দিরে কোনদিন বসে থাকতে দেখেনি। বসা তো দূরের কথা, এমনকি রাস্তায়, মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে আর পাঁচটা ধর্মভীরু মানুষের মত হাতজোড় করে, মা কালীকে প্রণামও করতে দেখেনি কেউ। আসলে ওকে দিনেরবেলা দেখাই যায় না। ওর বাড়ি যে ঠিক কোথায়, তা হয়ত বেশিরভাগ মানুষই জানে না। জানার কোন প্রয়োজনই হয় না। কারণ ভোর থেকে দুপুর ফুরিয়ে যাওয়া অবধি জিতেন কারও প্রয়োজনে লাগে না। তাছাড়া প্রান্তিক মানুষদের খোঁজ কে-ই বা কবে নিয়েছে! আর সেটা নেওয়ার সময়ই বা কোথায়! আত্মকেন্দ্রিক ধাবমান জনস্রোত, শুধু কেন্দ্রবিন্দু নিয়েই মাথা ঘামায়। তাই যতক্ষণ না বিকেল হচ্ছে, ওকে কেউ মনে রাখে না। বিকেল চারটে বাজতে না বাজতেই অনেকেরই একটু একটু করে জিতেনকে মনে পড়তে শুরু করে, কারণ জিতেন রোল-চাউমিন বিক্রি করে।

শের শাহ যেদিন জি.টি.রোড বানিয়েছিল, সেদিন কল্পনাতেও আনতে পারেনি যে ভবিষ্যতে কোন একদিন, এই রাস্তারই ধারে, কণ্ঠীধারী এক ব্যক্তি, জপমালা বা খোলের পরিবর্তে খুন্তি হাতে পাম্প স্টোভের মুখে চাটু বসিয়ে, তার ওপর ডিমের ওমলেট ভাজবে এবং তা জনপ্রিয় হবে। নীল রঙ করা একটি টিনের ঠেলা। চারটে বড় চাকা। প্রতিদিন, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, ঠিক বিকেল পৌনে চারটের সময়, ঠেলাটিকে ঠেলতে ঠেলতে জি.টি.রোডের ধারে এনে দাঁড় করায় জিতেন। ঠেলার একপাশে একটা কাচের বাক্স। তার ভেতরে দু’টো কাচের তাক। ঠেলার মাথায় কচ্ছপের পিঠের মত ঢেউ খেলানো টিনের ছাউনি। নীল ছাউনির গায়ে হলুদ অপটু অক্ষরে লেখা—

“জিতেনের চাউ।

বিবাহ ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে অর্ডার নেওয়া হয়।”

-কেউ কোনদিন কোন অনুষ্ঠানের জন্য রোল বা চাউমিনের অর্ডার দিয়েছে কি না, তা কারও জানা নেই। তবে এটা বেশ জানা আছে যে, জিতেনের চাউ-এর একটা ধারাবাহিক চাহিদা আছে। বেশ কয়েক বছর হল এই ঠেলা লাগাচ্ছে জিতেন। এর আগে কী করত, তা কারও জানা নেই। কেউ জানতেও চায়নি কখনও। কারণ সেই একটাই- জানার দরকার পড়েনি কোনদিন কারও।

জনগনের বিলাসী জিভের চাহিদা প্রত্যেকদিন জিতেন পূরণ করলেও, ওর নিজের জীবনের সামান্য চাহিদাটুকু কখনওই কেউ পূরণ করতে পারে না। রোজ বিকেলে সেই একই জামা আর প্যান্ট পরে জিতেন এসে দাঁড়ায়। জামার কলারের কাপড় ছিঁড়ে ভেতরের বক্রম বেরিয়ে পড়েছে। জামার রং এককালে কেমন ছিল বোঝা যায় না আর। প্যান্টে দু’টো জায়গায় রিফুর সুতো খুলে এসেছে। ওটারও রঙ চটে গেছে।

চাউমিনের ঠেলাটা নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড় করিয়ে প্রথমেই জামাটা খুলে ফেলে জিতেন। একটা পেরেকে টাঙিয়ে রাখে। ঠেলার তলায় একটা টিনের খুপরি আছে, সেখান থেকে একটা ঢাউস থলি টেনে আনে। তারপর থলির ভেতর থেকে বের করে লম্বা লম্বা লাল হলুদ কাচের বোতল। লাল বোতলে কুমড়োর পাইল দেওয়া টমেটো সস থাকে। সস্তার। হলুদ বোতলে চিলি সস। সব বোতলের গায়ে চিনা হরফে অং-বং-চং লেখা থাকে। চাউমিন বিক্রিতে চিনা ভাষা হয়ত বা বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ায়। ঠেলায় একটা বড় বেতের ঝুড়িতে রাখা থাকে সেদ্ধ করা চাউমিনের সাদা স্তূপ। কাচের তাকে বিভিন্ন ট্রেতে রাখা থাকে ময়দার গোল গোল লেচি, পেঁয়াজ-শশা কুচি, কাগজি লেবু, মুরগির ছাঁট দিয়ে বানানো তেল জবজবে লাল রগরগে গ্রেভি; আর থাকে অসংখ্য ডিম। নিজের পোশাকের প্রতি যত্ন না থাকলেও, বিক্রির জন্য রাখা খাদ্যসামগ্রীর প্রতি ওর ভীষণ যত্ন। সব কিছু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।

খদ্দের জড়ো হতে থাকে একে একে। টো-টো কোম্পানির ছেলে-ছোকরারা আগে আসে। কেউ একা, কেউ বন্ধুবান্ধব নিয়ে, কেউ বা বাইকের পেছনে বান্ধবীকে বসিয়ে। অনেকে বিকেলে আড্ডা মারতে বেরিয়ে এই রোলের দোকানেএসে আটকে যায়। কেউ টিউশন-ফেরত খিদে পেটে এসে দাঁড়ায়। অনেকে অফিস-ফেরত বাড়ির জন্য কিছু কিনবে বলে দোকানের সামনে থমকে যায়। ঠেলার পাশে বাইক বা সাইকেল দাঁড় করিয়েই ফরমায়েশ হয়- জিতেনদা, দু’টো ডবল ডিমের এগরোল। কেউ অর্ডার করে– আমার হাফ প্লেট চিকেন চাউ, কড়া করে ভেজে। ব্যাস, শুরু হয়ে যায় জিতেনের বিক্রি। ক্রমে ভিড় বাড়তে থাকে। বয়স্করাও আসে। এক একজন ছেলেকে টিউশানে দিতে যাওয়ার পথে অর্ডার দিয়ে যায়, ফিরতি পথে নিয়ে যাবে বলে। তাদের কারও থামার সময় নেই, তাই জিতেনের হাতও থেমে থাকে না। চাউ ভেজে প্লেটে ছড়িয়ে অথবা রোল বানিয়ে হাতে ধরিয়ে দেওয়া, যারা অর্ডার দিয়ে গেছে তাদেরটা পার্সেল করে তৈরি করে রাখা। সবকিছু একা হাতে করতে হয়। সকলেরই ভীষণ তাড়া। সবাই চায় নিজেরটা আগে করিয়ে নিতে। জিতেন তখন যন্ত্র হয়ে যায়। তারও কথা বলার সময় নেই। দেরি করলে যদি খদ্দের চলে যায়! এই আশঙ্কা ওর মাথায় সবসময় মশার মত ভনভন করে।

তাছাড়া আরও একটা চিন্তা জিতেনকে কুরে খায়। আশেপাশে আরও দোকানদার তাদের পসরা নিয়ে এসে বসে। এদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। আগে ছিল ফুচকা, চাটওয়ালা, চপ। ইদানিং জুটেছে মোমো। একটা ছোকরা ছেলে বিক্রি করা শুরু করেছে। বেশ ভিড় হয় ওর কাছে। এমন অনেক মুখ আছে, জিতেন চেনে, যারা একসময় নিয়মিত রোল বা চাউ কিনত ওর কাছ থেকে, এখন মোমোর দোকানে নিয়মিত ভিড় করে। মোমো-বিপ্লব এলাকার রসনায় বেশ একটা নতুন মাত্রা যোগ করেছে। নতুন খাবার, তবে অল্প সময়েই খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

তবে জিতেনের বিক্রি যে কমে গেছে তা হয়ত নয়। পুরোনো খদ্দের যেমন গেছে, নিত্য গজিয়ে ওঠা ফ্ল্যাটবাড়ির দৌলতে নতুন গ্রাহকও যোগ হয়েছে। তারা আসে, খায়, নিয়ে যায়। কিন্তু আয় যা কিছু হয় ওর, কে যে খেয়ে যায়, বুঝে উঠতে পারে না জিতেন। সেই বিকেল চারটে থেকে রাত ন’টা অবধি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে একভাবে এত যে পরিশ্রম করে, তবু সংসারে সামান্যতম স্বচ্ছলতা কেন যে আনতে পারে না, ভেবে পায় না সে। রাতে ঘরে ফিরে ক্লান্ত শরীরটাকে যখন বিছানায় ফেলে, তখন হাত দু’টো যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যায় এক একদিন। ডাক্তার যে দেখাবে, সেটাও পারে না। হাতে টাকা থাকে না। যা থাকে তাই দিয়ে পরদিনের জিনিসপত্র কিনতে হয় সকালে… ময়দা, চাউ-এর প্যাকেট, পেঁয়াজ, শশা, ইত্যাদি। তারপর ঘরের জন্য তো টুকটাক লেগেই আছে।

ছেলেটা স্কুলে পড়ে। তার একটা খরচ আছে। বউটারও শরীর খারাপ লেগেই থাকে। খিটখিটে হয়ে গেছে। সাধ-আহ্লাদ জলাঞ্জলি দিয়েছে সে-ও অনড় অদৃষ্টের পায়ে। অভাবের সঙ্গে লড়তে লড়তে মাথার ঠিক রাখতে পারে না। টিনের বাড়িটা নড়বড় করছে। ছাদে জং পড়ে কয়েকটা জায়গায় ফুটো হয়ে যাওয়ায়, বৃষ্টি হলেই ঘরে জল পড়ে। সারানো হয় না। পেরে ওঠে না জিতেন। তাছাড়া, জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বেড়েই চলেছে। খরচ কমালেও, দিনের শেষে হাতে উদ্বৃত্ত টাকা থাকে না। সঞ্চয় বলতে কিছুই নেই প্রায়। ব‍্যাঙ্কে একটা খাতা আছে বটে, তাতে সাকুল্যে চার-পাঁচ হাজার টাকা পড়ে আছে। জিতেনের দিন চলে টানটান তারের ওপর দিয়ে, দৃশ্যমান ক্রেতা আর অদৃশ্য ঈশ্বরের ভরসায়। সবকিছুই দেখে সে, বোঝে। দাঁতে দাঁত চিপে চুপ করে ভাগ্যের মার সহ্য করে। ঈশ্বরও দাঁতে দাঁত চিপে জিতেনের সহ্যশক্তির পরীক্ষা নেয়!

একদিন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে জিতেন। দিনের বেলা ময়দা মাখতে মাখতে মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে ঢলে পড়ে। স্ত্রী আর ছেলে মিলে হাঁউমাঁউ করে চিৎকার জুড়ে দিলে, আশেপাশের বস্তির লোকজন ছুটে আসে। মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে গেলে, তাকে পরীক্ষা করে ডাক্তার জানায়, মৃদু হার্ট-অ্যাটাক হয়ে গেছে একটা। সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। এখন কোনরকম কায়িক পরিশ্রম বা উত্তেজনা ওর পক্ষে মৃত্যুকে যেচে ডেকে আনার সামিল। কিছুদিন হাসপাতালে থেকে বাড়ি ফিরে আসে জিতেন। এসে বিছানা নেয়। সেই সঙ্গে ডাক্তারের নিষেধ সত্ত্বেও দুশ্চিন্তা দত্তক নেয়- চাউ-এর দোকান এতদিন বন্ধ আছে, আবার কবে যে চালু হবে; কী করেই বা হবে; চালু করতে না পারলে আয় হবে কেমন করে! সংসার কেমন করে চলবে! একদিনে এইসব ভেবেই ঘুম উড়ে যায় জিতেনের। চোখ বসে যায়। মুখে অন্ধকার কালির প্রলেপ জমে ওঠে…

জিতেনদের লড়াই কোনদিন থেমে থাকে না। ওরা লড়তে লড়তে বিছানা নেয়, আবার লড়াই করতে করতেই উঠে দাঁড়ায়। যেমন জিতেনের জায়গায় উঠে দাঁড়াল ওর ছেলে। নিজে হাতে চাউমিন আর রোল তৈরি করার লড়াইয়ে। এতদিন মাঝেমধ্যে, পড়াশোনা না থাকলে, বাবাকে সাহায্য করত দোকানে গিয়ে। বাবাকে এইসব করতে দেখেছে। নিজে করেনি কখনও। কোনদিন করতে হয়নি। এখন হচ্ছে; কিন্তু মাছের ছানাকে যেমন সাঁতার শেখাতে হয় না, জিতেনের বাচ্চাকেও শিখিয়ে দিতে হল না। পেট বড় কড়া শিক্ষক। জিতেনের জায়গায় সেই নীল ঠেলায় কায়েমি হয়ে গেল জিতেনের ছেলে। প্রথম প্রথম অপটু আনাড়ি হাতে চাউ বা রোল বানাতে গিয়ে ছ্যাঁকা খেল, ফোস্কা পড়ল, ব্যথা হল, কিন্তু হার মানল না সে। স্টোভের গরমের তাপে ঝলসাতে ঝলসাতে অচিরেই পাকা রোলওয়ালা হয়ে গেল। বেঁচে থাকার প্রতিযোগিতার নির্মম বাজারে, জিতেনের দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাকি সব বিক্রেতাদের মনে যেটুকু চাপা আনন্দ দানা বেঁধেছিল, তা কয়েকদিনের মধ্যেই উবে গেল। আবার স্বমহিমায় চলতে থাকল ‘জিতেনের চাউ।’ কিছুটা স্বস্তি ফিরে এল জিতেনের শীতল টিনের ঘরে। দিন এনে দিন খেয়ে এভাবেই কাটছিল- হঠাৎ করোনা নামক একটি অতিমারী এসে পৃথিবীর সব হিসেব ভণ্ডুল করে দিল! পৃথিবীর মানুষ হৃদয়ঙ্গম করল নতুন শব্দ–

‘লকডাউন!’

অর্থাৎ ‘স্তব্ধতা!’

সব বাজার, স্কুল-কলেজ, অফিস-কাছারি, খাবার দোকান বন্ধ হয়ে গেল অনির্দিষ্টকালের জন্য। কেবল সবজি আর গোলদারি দোকান খোলা রইল সরকারি ফরমানে। সব গাড়িঘোড়া স্তব্ধ হয়ে গেল। রাস্তাঘাট শুনশান। শোনা গেল এই মড়কটি নাকি মারাত্মক ছোঁয়াচে। তাই সারা পৃথিবীর মানুষকে বিধান দেওয়া হল ঘরে থাকার জন্য। বাইরে বেরনো মানেই রোগ ডেকে আনা। বন্ধ হয়ে গেল জিতেনের ঠেলাও অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য…

মানুষের সংস্পর্শ বাঁচিয়ে কেউ বেঁচে থাকে? অনেকেই থাকে। যাদের অঢেল আছে। বিত্ত বা সম্পদ। যাদের টাকা নিয়ে ভাবতে হয় না, যাদের দীর্ঘদিন অতিবাহিত করার জন্য সঞ্চিত অনেক সামগ্রী আছে ঘরে। তাদের পাঁচদিন, দশদিন বাইরে না বেরোলেও চলে। কিংবা ফুরিয়ে গেলেও একদিন দোকানে গিয়ে আবার কয়েকদিনের রসদ মজুত করে নিতে অসুবিধে হয় না। কিছু না হলেও, চাল ডাল আলু ডিম তেল কিনে ঘরে রেখে দিতে পারে। যারা পেরেছে তারা এভাবেই করেছে। জিতেনরা পারেনি। তাদের সহায় সম্বল কোনটাই নেই। জিতেনের অবস্থাও তেমনই। হাতে টাকা নেই, দৈনিক আয় নেই, ঘরে খাবার নেই। ওষুধবিষুধ যা কেনা ছিল ওর নিজের জন্য, শেষ হয়ে যায়। আর কেনা হয় না। কোনরকমে চালে-ডালে ফুটিয়ে দু’-বেলা খেয়ে দিন কাটায় জিতেনের পরিবার। যেদিন দোকান বন্ধের নির্দেশ এল, সেদিন আর তার পরের দিন কেবল ডিম খেতে পেয়েছিল ওরা। যে ডিমগুলো আগের দিন ঠেলায় খরচ হয়নি। না খেলে এমনিই নষ্ট হয়ে যেত। তারপর থেকে স্রেফ চালে-ডালে-নুনে চলছে। এক কাপ চা খাওয়াও বিলাসিতা!

মার্চের তেইশ তারিখ থেকে শুরু হওয়া লকডাউন এপ্রিল মাসে গড়াল। মুদি ধারে জিনিস দেওয়া বন্ধ করে জিতেনকে আরও সংকটে ফেলে দিল। এদিকে রোগের ভয়ে বাইরে বেরোনো বন্ধ। কিন্তু এভাবে কতদিন! ভাবতে থাকে জিতেন। অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই চোখে ভাসে না। ঠেলার দিকে তাকিয়ে দেখে, ধুলোর পুরু আস্তরণ পড়ে গেছে ওটার গায়ে। একবার ভাবে, বিক্রি করে দেবে। কিন্তু কাকে বিক্রি করবে? কে-ই বা কিনবে? কিনলেও দোকান তো আর দিতে পারবে না। কবে সব আগের মত স্বাভাবিক হবে কেউ জানে না। সবাই টাকা বাঁচিয়ে খরচ করছে। সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। খিদেয় মাথা ঘোরে জিতেনের। শুয়ে শুয়েই টলে যায়। রাতে নিজে খায় না। একজন একবেলা না খাওয়া মানে কিছুটা চাল আর ডাল বেঁচে যাওয়া। অর্থাৎ স্ত্রী আর ছেলে আরও এক বেলা বেশি খেতে পাবে। তাই, খিদে নেই বলে শুধু জল খেয়ে শুয়ে পড়ে। একটাই কথা মাথায় ঘুরপাক খায়- এভাবে কতদিন!

পরদিন সকালে পাড়ার গলিতে দেখা যায়, একটা নীল ঠেলায় কিছু আলু, পেঁয়াজ, একটা লাউ, একটু বেগুন, আদা, লঙ্কা আর ধনেপাতা নিয়ে সবজি ফেরি করছে একটা লোক। মুখে গামছা পেঁচানো। ধীরে ধীরে ঠেলাটিকে ঠেলতে ঠেলতে হাঁক পাড়ছে-

“আলু, পেঁয়াজ, লঙ্কা…. নেবেন?”

মানুষটা জিতেন। বাঁচার লড়াই জারি রাখতে চাউমিনের বদলে সবজি বিক্রি করতে শুরু করেছে সে। ভিক্ষে তো করে খেতে পারবে না। আত্মসম্মানে লাগে। তাই রুগ্ন অশক্ত অসমর্থ শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে দাঁড় করিয়েছে জিতেনের ভেতরে বাস করা পিতৃসত্তা…. ছেলেকে রোগের মুখে ঠেলে না দিয়ে, নিজেই এই অতিমারীর ভয়ঙ্কর জীবাণুর সামনে বুক চিতিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে, বাড়ির বাইরে পা রেখেছে মানুষটা। হাজার হোক, বাপ তো! সংসার তো তাকেই বাঁচাতে হবে। বাঁচতেই হবে-

জিতেনরা এভাবেই বাঁচে…….

 

 

 

লেখক পরিচিতি: মৌলীনাথ গোস্বামী, জন্ম- ১৯৭০। আজন্ম বসবাস আসানসোলে। 
স্কুলজীবন কেটেছে আইরিশ মিশনারিদের মাঝে। ম্যানেজমেন্ট নিয়ে স্নাতকোত্তর। 
বর্তমানে, রাজ্য সরকারের আধিকারিক।
 দীর্ঘ সময় ধরে কবিতা ও গল্প, উপন্যাসের চর্চা করে চলেছেন। বিশ্বাস করেন, 
জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি বস্তু নিয়ে কবিতা রচনা করা সম্ভব। তাঁর লেখায় 
বারবার উঠে এসেছে প্রেম, বিচ্ছেদ, মানুষের সামাজিক অবস্থান এবং গভীর 
মৃত্যু-চেতনা। একাধিক পত্র-পত্রিকায়, তাঁর কবিতা, গল্প নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ- "দয়াল"- প্রকাশকাল, বইমেলা, ২০২০, প্রতিভাস প্রকাশনা।
লিখবেন, যতদিন জীবন লেখাবে তাঁকে দিয়ে...
SOURCE

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here