অসীম ব্রহ্মান্ডের মধ্যে থাকা আরেক বিপুল বৈচিত্র্যের অসীম, অনন্ত, স্বতন্ত্র ‘ব্রহ্মান্ড’;যা আপন রঙে চিররঙিন,আপন আলোয় সমুজ্জ্বল এবং আপন গুণে চিরকালীন ও চিরভাস্বর । সেই ‘ব্রহ্মান্ডে’ আমি নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছি, আমার অন্তরের প্রকৃত ‘আমি’-কে আবিষ্কার করেছি। আমি অতি সাধারণ,অতি সামান্য, ক্ষুদ্র এক মানুষ; উন্নত কাব্যবোধ আমার নেই। কিন্তু বর্তমান সময়ের বীভৎস অধঃপতনের যুগে,এই অবক্ষয়িত কদর্য ‘মনুষ্যত্বের’ যুগে একটা প্রশ্ন আমার বিবেককে বারবার খোঁচা দিচ্ছে- ‘ “মানুষ” হিসাবে আজ আমাদের অবস্থান কোথায়?!!’ মুহুর্মুহু মনে হচ্ছে; আমাদের পরিবারে, সমাজে, স্কুলে,কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন একটা শিক্ষাই খুব জরুরি, কোনো গুরুতর রোগের আপৎকালীন চিকিৎসার মতোই যা খুবই আবশ্যিক ।তা হলো, মানবতার শিক্ষা, মানবতার পাঠ এবং তার সাথে নিজেদেরকে সুন্দর করে গড়ে তোলার জেদ ও সদিচ্ছাটাও খুব প্রয়োজন আমাদের প্রত্যেকের। এছাড়া এই মুহূর্তে আর অন্য কোনো কিছুই না। ঈশ্বরের এই সুন্দর পৃথিবীকে সুন্দর রাখার, সুন্দর করার দায়িত্ব কি আমাদের সকলের নেই?? তাহলে,সেই দিকেই আগে আমাদের দৃষ্টিপাত করা উচিত। এখন তথাকথিত ‘মানবসভ্যতা’-র পরতে পরতে অবক্ষয়ের যে বিষাক্ত ঘুণ-পোকা ধরেছে,’সভ্যতা’ এখন যে মারণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে; তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পথ হলো, তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অব্যর্থ মহৌষধ হলো,অন্তত তা আমার ভাষায় অবশ্যম্ভাবীভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত। কেন রবীন্দ্রসঙ্গীত,তা আমি আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি,উপলব্ধি,মনন দিয়ে আমার সাধ্য মতো বলার চেষ্টা করছি।শুধু হৃদয়টুকুই আছে আমার,তা দিয়েই যতটুকু যা বলার বলি আমি। আমি কোনো সঙ্গীত বিশারদ নই; তবু এটুকু নিশ্চিত আমি, এটুকু আমার নিজের উপর জোরালো বিশ্বাস আছে যে রবীন্দ্রসঙ্গীতই আমার প্রেম, পূজা, সাধনা, আরাধনা, আমার সুখ, দুঃখ,হাসি, কান্না ….. আমার অনেককিছুই; আমার ধমনী,শিরায়,অস্থি, মজ্জায়, রক্তে, হৃদয়ে, দৈনন্দিন কর্মপ্রবাহে আমি ‘তাঁর’ উজ্জ্বল উপস্থিতি অনুভব করি।আমি দৃঢ় বিশ্বাসী, রবীন্দ্রসঙ্গীতে যে সঞ্জীবনী সুধারস আছে, মানুষের আত্মিক জাগরণের যে কার্যকরী উদ্দীপক আছে তা শুধুমাত্র শুকনো পাঠ্যবই আমাদের দিতে পারবে না। প্রসঙ্গত, উল্লেখ করতে চাই যে; আমি সঙ্গীতপ্রেমী মানুষ, সবধরনের ভালো গানই আমি মন দিয়ে শুনি। সুতরাং, অন্যান্য কবি – সাহিত্যিক – গীতিকারের লেখা গান ও গানের ভিন্ন ভিন্ন ঘরানা ,যেমন – নজরুলগীতি, বিভিন্ন ধরনের লোকগীতি, শাস্ত্রীয় – ধ্রুপদী সঙ্গীত, শ্যামাসংগীত, নাম সংকীর্তন, পদাবলী কীর্তন, বাউলগান,তরজাগান , নানারকম আধুনিক গান ইত্যাদি – এই সবকিছুকেই আমি তুচ্ছ করতে চাইছি না,কম মর্যাদা দিচ্ছি না, বা অন্য কারো ব্যক্তিগত বিশ্বাসকে আঘাত করতে চাইছি না। শুধু আমার নিজস্ব অনুভূতিটুকু সকলের সামনে তুলে ধরছি এবং অনুরোধ করছি তা একটু হৃদয় দিয়ে বোঝার জন্য। আমার যেন কেমন মনে হয়, রবীন্দ্রসঙ্গীত সবধরনের সুসঙ্গীতের মহামিলন ক্ষেত্র,মিলিত সঙ্গমস্থল। কেমন যেন মনে হয়, সবধরনের সুসঙ্গীতেরই নির্যাস মেশানো এক অদ্বিতীয় সম্মোহন জাদু আছে রবীন্দ্রসঙ্গীতেই । তাই, কীভাবে ‘তাঁর গান’ আমার থেকে আমাদের সকলের হয়ে উঠতে পারে সেইদিকেই যথাসাধ্য আলোকপাত করার চেষ্টা করছি আমি।
ঈশ্বর যেন তাঁর দৈববাণী উচ্চারণ করেছেন অদ্বিতীয় রবীন্দ্র-স্বরে, সমগ্র পৃথিবীকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছেন অমৃতোপম রবীন্দ্রগানে। কিন্তু আমাদের কতজনের শ্রবণ সেই সুধাময় ”ভালোবাসার পানে ধেয়ে যাচ্ছে”?!! আমরা শুধুই “মিছে কোলাহলে” ব্যস্ত। রবীন্দ্রসঙ্গীত শুধু গান নয়, ‘তাঁর’ প্রতিটা অক্ষর, প্রতিটা শব্দ চিরসতেজ, অক্ষয় জ্যোতির্ময় আলোকসরূপ,যা জড়ের মধ্যে প্রাণময় জীবসত্তা স্থাপন করতে সক্ষম, এমনই জাদু ক্ষমতা আছে এই সঙ্গীতে । রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজলে আমার মনে হয় তা যেন একইসাথে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল-কে অপরূপ সু্রধ্বনিতে অনুরণিত করে চলেছে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত ——- ‘তিনি’ আমাদের প্রতি পদক্ষেপে রয়েছেন আবহমান জীবনচক্রের এক অটুট ধ্রুবতারাসম জ্যোতিষ্ক হয়ে।তাঁর সৃষ্টির সদা হাস্যময়, রঙিন বর্ণময় উজ্জ্বল কুসুমগুলি নিয়তই তাদের চিরযৌবনোদ্দীপ্ত মহিমা প্রকাশ করে যাচ্ছে। পৃথিবীতে থেকেও কেউ যদি নিখাদ, নিরবচ্ছিন্ন ‘সুখ-শান্তি’ পেতে চায়, অপার্থিব আনন্দ পেতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই রবীন্দ্র-উদ্যানে প্রবেশ করতে হবে। প্রত্যেকেরই উচিত সেই উদ্যানে এসে রবীন্দ্র-দর্পণে নিজেদের দেখা, তবেই তারা নিজেদের চিনবে,যেমন করে আমি চিনেছি। নতুবা,আজীবনেও কেউ চিনবে না তার ‘আমার আমি’-কে।
রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনলে আমি আমার অন্তরের কোন্ অজানা ‘আমি’-কে যে খুঁজে পাই তা আমি লিখে প্রকাশ করতে পারব না। শুধু এটুকু বলতে পারি যে, আমার হৃদয়ের সেই অজানা ‘আমি’-র সাথে আমার যেন জন্ম-জন্মান্তরের এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক, আন্তরিক হৃদ্যতা, প্রাণের সখ্য। মনে হয়, আমি আমার অন্তরের এই ‘আমি’-কে খুঁজে পাওয়ার জন্যই চিরজন্ম অন্বেষণ করে এসেছি এবং আজ তাতে আমি সফল। মনে হয়, আমি যেন কোন্ অনির্বচনীয় আনন্দের ”সুধা-সাগরে” ভেসে চলেছি,আরও গভীরে প্রবেশ করছি। মনে হয়, সেই মুহূর্ত থেকে আমি আমার অন্তরের সেই ‘আমি’-কে এক মুহূর্তের জন্যেও আমার কাছ ছাড়া হতে দেব না, তাকে বাহুবন্ধনে জড়িয়ে সারাজীবন আপন করে রাখব। কিন্তু শুষ্ক, কৃত্রিম, কঠোর,রূঢ় বাস্তবের উচ্চ নিনাদে যখন আমার কানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সেই অমৃত সুর ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসে, তখন আশঙ্কা হয়, আমার সেই ‘আমি’ থাকবে তো আমার সাথে?!! আমি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে যাই। যদিও, পরক্ষনেই আমি তাঁর কাছ থেকেই শক্তি পাই সমগ্র কঠিন পার্থিব প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে জয়ী হওয়ার জন্য। তখন আমি তাঁর কাছে আরও শক্তি চাই,তাঁর গানের অমর, অক্ষয়,অনুপম, অমৃত, অনিন্দ্যসুন্দর সুরকে আমার হৃদয়বীণায় সকলের অলক্ষ্যে, নীরবে, নিভৃতে, আজীবন যেন আমি বাজিয়ে যেতে পারি। সেই স্বর্গীয় সুর যেন আমার মনের মন্দিরে সর্বক্ষণ বেজে চলে, সেই প্রার্থনাই করি আমি তখন তাঁর কাছে। এভাবেই আমার সমস্ত জীবন জুড়ে আমি আমার সেই ‘আমি’-র ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে থেকে ‘তার’ কোমল পরশ পেয়ে যেতে চাই এবং এমনি করেই একজন ক্ষুদ্র ভক্ত হয়েই আজীবন আমি ‘তাঁর’ মহান পদযুগলে একটু স্থান পেতে চাই। তবেই, সেই নিবিড় সাহচর্যে আমার জীবন হবে সফল, দুঃখজয়ী , আনন্দময়, আশীর্বাদধন্য ।
তাই, ‘ধ্বংসপ্রাপ্ত’ মানবতার এই ঘোরতর সংকটে অত্যন্ত ব্যথিত মনে আমি সমাজের, সংসারের, দেশের, এমনকি সারা বিশ্বের সব জাতির,সব শ্রেণীর,সব সম্প্রদায়ের, সব প্রান্তের, সর্বস্তরের সবধরনের মানুষকে আন্তরিক অনুরোধ করছি, আহ্বান জানাচ্ছি রবীন্দ্রসঙ্গীতের মিলনসূত্রে “এক” হয়ে ওঠার জন্য। আমাদের সকলের হৃদয়ে যেন একইসাথে বেজে ওঠে “এক সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন,/এক কার্যে সঁপিয়াছি সহস্র জীবন…. টুটে তো টুটুক এই নশ্বর জীবন,/তবু না ছিঁড়িবে কভু এ দৃঢ় বন্ধন….” তবেই আমাদের এই মানবজীবন, এই মানবসভ্যতা সার্থক, সুন্দর, পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। তবেই আমরা সমস্ত পার্থিব পঙ্কিলতা থেকে উন্নীত হতে পারব প্রকৃত নির্বাণ পথে।আর এইভাবেই যুগে যুগে ‘তাঁর’ গান আমাদের সকলের কাছে মিলনের মঙ্গলসূত্র হয়ে উঠুক। তাই,শুধু ইহজীবনের মরণ নয়, মনুষ্যত্বের মরণকেও অতিক্রম করে তাঁর গানের মধ্যে দিয়েই আমরা সবাই এগিয়ে যাই চলো “নব আনন্দে” জেগে ওঠার সেই চির উজ্জ্বল, পবিত্র আলোক-ভোরে।
লেখক পরিচিতি : – প্রসেনজিৎ মন্ডল, বসিরহাট, উত্তর ২৪ পরগণা, পশ্চিমবঙ্গ
[…] Prosenjit Mondal […]