উইন্ডো সিটে বসে মোবাইল টা চেক করল বন্ধন। সকাল থেকে বাবার ম্যাসেজ গুলো আনসিন হয়েই পড়ে আছে। আরো একটা ম্যাসেজ এলো। সবেমাত্র ভাবছিল ওপেন করবে কিন্তু পায়ের উপর চাপ খেয়ে মোবাইল টা হাত থেকে পড়ে গেল। সেটাকে তুলতে গিয়ে আবারও একটা ধাক্কা, তবে এবার মাথায়। প্রচন্ড রাগ হয়ে গেল বন্ধনের। কিছু বলার আগেই,
‘আই অ্যাম সো সরি! আই হ্যাভ সো মেনি থিংস ইন মাই হ্যান্ডস দ্যাট….’
‘ইটস অলরাইট!’
বন্ধনের রাগ কমে যাওয়ায় একমাত্র কারণ হল ভদ্রমহিলার কন্ডিশন। এনাকে ভদ্রমহিলা কম মেয়েই বেশি বলা যায়। বন্ধনকে কথাটা বলে ইতিমধ্যে একটা ব্যাগ, জলের বোতল, ম্যাগাজিন এসব সিটে রেখে আর একটা ব্যাগ কেবিনে ওঠাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বন্ধন হেল্প করার জন্য উঠবে ভাবছিল কিন্তু ততক্ষণে ম্যাডাম তার সিটে ব্যাক করেছেন। ব্যাগটা কোলে নিয়ে দুঢোক জল খেয়ে ফাইনালি দমটা ছাড়লেন। বন্ধন একদৃষ্টে মেয়েটিকে দেখে চলেছে। ছোটোখাটো স্লিম চেহারা, পরনে একটা হলুদ স্লিভলেস কূর্তি আর জিন্স। চুলগুলো টপনট করা আর মাথার উপর একটা চশমা গোঁজা। আইটি সেক্টরে রোজরোজ ফ্যাশানিস্তাদের দেখতে দেখতে বন্ধনের মনে মেয়েদের সম্পর্কে যে একঘেঁয়ে ধারণাটা জন্মেছিল, এই মেয়েটির অত্যন্ত সাধারণ চেহারা এক ঝটকায় তার বেশ কিছুটা বদলে দিল। কোনরকম সাজগোজ ছাড়াই যে কাউকে এতটা সুন্দর দেখতে লাগে সেটা আগে জানত না বন্ধন।
বন্ধনকে এভাবে হ্যাংলার মত চেয়ে থাকতে দেখে মেয়েটি প্রথম কথা শুরু করল,
‘জয়িতা সেন। এমবিএ স্টুডেন্ট।’
হ্যান্ডশেক করার জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিল বন্ধনের দিকে। আঙুলের শেপগুলো অবধি নিখুঁত।
‘বন্ধন সেনগুপ্ত। আইটি অ্যানালিস্ট, টিসিএস পুনে।’
‘বাঙালি তো? তাহলে বাংলাতেই কথা হোক?’
‘নিশ্চয়ই!’
‘উফফ! বাঁচালেন মশাই! সারাক্ষণ এই ইংরিজিতে বকবক বকবক আমার জাস্ট আর ভালো লাগে না। তো আপনার হোমটাউন?’
‘কলকাতা। মা বাবা ওখানে থাকে,আমি মাঝে মধ্যে যাই।’
টেক অফের সময় হয়ে এসেছে। সিট বেল্টটা বেঁধে নিয়ে আবার কথায় ফিরে গেল বন্ধন।
‘আপনি কলকাতার কোথায় থাকেন?’
উত্তর দেওয়ার আগেই জয়িতার ফোন বাজলো, ‘এক্সকিউজ মি’ বলে কলটা রিসিভ করল। বন্ধন এবার জানলার বাইরে তাকালো,প্লেনটা রানওয়েতে পজিশন নিচ্ছে। এয়ার হোস্টেস এসে জয়িতা কে ফোন বন্ধ করার রিকোয়েস্ট করে গেল। ফোনটা রাখার পর জয়িতা কে একটু আপসেট লাগছিল, বন্ধন নিজেই জিজ্ঞেস করল,
‘এনিথিং রং? অসুবিধা না থাকলে আমায় বলতে পারেন।’
জয়িতা কে চুপ থাকতে দেখে বন্ধন আর কথা বাড়ালো না। প্লেন রানওয়ে ধরে ছুটতে ছুটতে আকাশে উড়ে গেল। নীচে শহরটা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। বন্ধন একমনে সেদিকেই তাকিয়ে ছিল হঠাৎ জয়িতা বলে উঠলো,
‘আমার দিদি বিয়ে করবে না বলে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে।’
কথাটা শুনে বন্ধন কি রিঅ্যাকশন দেবে বুঝতে পারলো না। তবু বলল,
‘সেকি, কবে বিয়ে?’
‘আরে এখনো ঠিকই হয়নি, সবেমাত্র ছেলে দেখা স্টার্ট হয়েছে। কিন্তু ও কিছুতেই বিয়ে করতে চায়না, এদিকে মা বাবা ও নাছোড়বান্দা। কাল পাত্র দেখতে আসবে আর আজ মেয়ে হাওয়া!’
‘শুনে খারাপ লাগলো। তবে আপনার তো আর কিছু করার নেই এখানে।’
‘আমাকেই তো এবার করতে হবে। প্রবলেমে তো আমি পড়ে গেলাম।’
‘কেন?’
‘মা বাবা চাইছে আমি কাল পাত্রপক্ষের সামনে বসি দিদির জায়গায়। আচ্ছা বলুন ইজ ইট পসিবল?’
‘ভালোই তো, বিয়ে করে নিন।’, বন্ধন হেসে বললো।
‘আপনি এই কন্ডিশনে ইয়ার্কি মারছেন? আমার কি হবে বুঝতে পেরেছেন?’
‘সো সরি জয়িতা,আমি এভাবে বলতে চাইনি। আসলে আমি নিজেও একটা ব্যাপার নিয়ে টেন্সড আছি তাই কি বলতে কি বলছি! প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।’
‘আপনাকে ও কি পাত্রীপক্ষের সামনে প্রক্সি দিয়ে হবে নাকি?’, এবার জয়িতাও আর হাসি চেপে রাখতে পারলো না।
বন্ধন আলতো করে হাসলো শুধু।
বাকি জার্নিতে জয়িতা একটু চুপচাপ ছিল। নামার আগে বন্ধনই ওর নম্বরটা চেয়ে নিল। তারপর দুজন দুজনের রাস্তায় পাড়ি দিল। বাড়ি ফিরেই ল্যাপটপে বসে জয়িতার ফেসবুক টা চেক করছিল এমন সময় বন্ধনের মা ঘরে ঢুকলেন।
‘বাবার একটা ম্যাসেজ ও নাকি দেখিসনি? এদিকে বাড়ি ফিরেই ল্যাপটপ খুলে বসে পড়লি। কি হয়েছে তোর?’
ল্যাপটপ বন্ধ করে শুয়ে পড়ল বন্ধন,কথা বলতে ভালো লাগছে না। মা যাওয়ার সময় বলে গেল,
‘কাল তুই ও যাচ্ছিস আমাদের সাথে।’
কিচ্ছু ভালো লাগছে না বন্ধনের। হঠাৎ মনে হল জয়িতার সাথে যদি একটু কথা বলা যায়। হোয়াটসঅ্যাপে অনলাইন দেখে অনেক কথা বলতে ইচ্ছা করল, কিন্তু একটা ম্যাসেজই পাঠাতে পারল শুধু,
‘অল দ্য বেস্ট ফর টুমরো!’
পরদিন মা বাবার সাথে বন্ধন পৌঁছে গেল যাদবপুর ৮বি বাসস্ট্যান্ডের কাছে ‘কুহেলী’ অ্যাপার্টমেন্টে। চার তলার লিফ্টের একদম সামনের ফ্ল্যাট টার দরজা খুলতেই একজন কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা মায়ের চেহারা দেখা গেল। আপ্যায়নে কোন ত্রুটি রাখলেন না তারা কিন্তু কোথাও যেন একটা ইতস্তত ব্যাপার কাজ করছিল। বন্ধনের অবস্থা একরকম বেহাল। এভাবে কোনদিন পাত্রী দেখতে আসতে হবে ওকে সেটা ভাবতেই পারিনি। ওর অবস্হাও অনেকটা জয়িতারই মত, অগত্যা এসব করতে হচ্ছে। জয়িতা এখন কি করছে বন্ধনের জানা নেই, হয়ত পাত্রপক্ষ ওকেই পছন্দ করে নিল। বন্ধনের কি হবে তাহলে?
‘বন্ধন, তুমি একটু পাশের রুমে যাও,আমি মেয়েকে পাঠাচ্ছি।’, পাত্রীর মা স্বল্প হাসি নিয়ে বললেন।
বন্ধনের মা বাবাও এককথায় রাজি হয়ে যাওয়ায় বাধ্য ছেলের মত পাশের রুমে চলে গেল। একটা অস্বস্তি কাজ করছে ভিতরে, মনটা শক্ত করে আজ ওকে একটা ডিসিশন নিতেই হবে। একটা পায়ের শব্দ এলো পিছন দিক থেকে, সাথে খুব চেনা একটা কন্ঠস্বর,
‘এক্সকিউজ মি!’
এক ঝটকায় পিছন ঘুরে তাকালো বন্ধন। লাল শাড়ি আর খোলা চুলে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে জয়িতা।
‘আপনি?’
একসাথে বলে উঠলো দুজনে। তারপর কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। হঠাৎ সব নিস্তব্ধতা ভেঙে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল বন্ধন আর জয়িতা। কিছু বলার আগেই পাশের ঘর থেকে উত্তেজিত কথাবার্তা কানে এলো। দুজনেই ছুটে গেল একসাথে। ঘরে ঢুকতেই জয়িতার মা এসে বন্ধনের হাত দুটো চেপে ধরলেন।
‘আমাদের বড় মেয়ে এমনটা করবে বিশ্বাস কর আমরা একটুও টের পাইনি। আমাদের তুমি ক্ষমা করো বাবা।’
ভদ্রমহিলার চোখ ছলছল করছে, জয়িতার বাবা মাথা নীচু করে বসে আছেন,আর বন্ধনের বাবা মা কি বলবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না।
‘কিন্তু আন্টি, শুধু শুধু ক্ষমা তো করতে পারব না। আমার যে আপনার মেয়েকেই চাই।’
সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে বন্ধনের দিকে।
‘আপনার এই মেয়েটিকে আমার খুব মনে ধরেছে। অনুমতি দিলে ওর পড়াশোনা শেষ হলে ওকে বিয়ে করতে চাই।’
জয়িতার মা জড়িয়ে ধরলেন বন্ধনকে। বন্ধনের মা মিষ্টি পুরে দিলেন জয়িতার মুখে,আর বললেন,
‘আমার ছেলের সত্যিই পছন্দ আছে।’
জয়িতা যেন এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। বন্ধন ওর মুখ দেখে বিষয়টা বুঝতে পারলো।
‘আমি একটু জয়িতার সাথে কথা বলতে চাই। ওর মত টা জানা আগে প্রয়োজন।’
পাশাপাশি সোফায় বসে আছে বন্ধন আর জয়িতা। শুরুটা বন্ধনই করল,
‘আপনার আপত্তি থাকলে আপনি বলতে পারেন। আপনার ডিসিশন কে আমি পুরোপুরি রেসপেক্ট করব,কথা দিলাম।’
‘মোবাইলটা একটু পাওয়া যাবে আপনার।’
‘নিশ্চয়ই। কিন্তু কেন জানতে পারি?’
‘দিদিকে একটা কল করব,আমারটা চার্জে আছে। একটা কথা বলতে চাই ওকে।’
‘কি?’
‘থ্যাঙ্ক ইউ।’
বন্ধন ওর উত্তর পেয়ে গেছে। জয়িতার হাতটা ধরে বলল,
‘তোমার দিদিকে আমার তরফ থেকেও থ্যাঙ্ক ইউ!’
লেখিকা পরিচিতি: শ্বেতা আইচ, বরাহনগরের বাসিন্দা।গল্প লিখতে ভালোবাসেন , বিশেষ করে ছোট গল্প।