ছবি : মন ও মৌসুমী
 ‘সত্যিকারের শিক্ষক তাঁরাই,যাঁরা নিজের জন্য চিন্তা করতে শেখায়।’

                                                                                     –ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন

শিক্ষক-শিক্ষিকা আমাদের সমাজের স্তম্ভ ….আমাদের ভবিষ্যতের মূল ভিত্তি এবং দায়িত্বশীল নাগরিক এবং মানুষ তৈরির কারিগরহিসাবে কাজ করেন ।তাঁরা আগামীকে, জীবনের বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে শিখিয়ে তুলতে এক অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। সর্বকালের মহান শিক্ষকদের দ্বারা প্রদত্ত জ্ঞানের জন্য ভারতকে স্বর্গ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

বর্তমান ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন সত্বেও ভারতের আদি শিক্ষার কাঠামো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সে-যুগের আর এযুগের শিক্ষক শিক্ষিকারা, যাঁরা প্রতি যুগের মেলবন্ধন করিয়েছেন শিক্ষাকে মাধ্যম করে , ছোট ছোট মস্তিষ্কে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে তুলেছেন পরিবর্তনের অভিযোজন। শিক্ষক-শিক্ষিকা আমাদের সমাজের ভিত গড়ে তোলেন। প্রতিটি মানুষ তার শিক্ষক -শিক্ষিকার কাছে চির ঋণী। আর সেই ঋণ কখনই একদিনে শোধ করা সম্ভব নয়। তবুও প্রতি বছর আমরা তাঁদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে একটি দিন বেছে নিয়েছি।এই দিনটি আমরা আমাদের শিক্ষকদের জন্য যারা আমাদের সমাজের উন্নয়নের জন্য যে কঠোর পরিশ্রম করেছেন তার স্বীকৃতি জানাতে উদযাপিত করি।

তবে এই দিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেন ঠিক একটি দিন ৫ই সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস পালন করা হয় !

আপনি কি জানেন কীভাবে শিক্ষক দিবসের উদ্ভব হয়? হ্যাঁ এই প্রশ্নের উত্তরে আসে এক মহান শিক্ষকের কথা।ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন। ডাঃ রাধাকৃষ্ণন আমাদের দেশের বিভিন্ন ভাবে সেবা করেছেন, তিনি জীবনের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিযুক্ত থাকলেও তার আসল পরিচয় তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক।

রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিনের শুভ উপলক্ষে তাঁর ছাত্র ও বন্ধুরা তাকে তাঁর জন্মদিন উদযাপনের অনুমতি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন আর তার জবাবে ডঃ রাধাকৃষ্ণান বলেছিলেন যে “আমার জন্মদিন আলাদা ভাবে পালনের পরিবর্তে, এটি শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করলে আমি বেশি খুশি হবো ”। আর সেই থেকেই অর্থাৎ ১৯৬২ সালে (ভারতের রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন (১৯৬২-৬৭) ) ভারতের শিক্ষক দিবস ‘৫ই সেপ্টেম্বর’ পালন করা হয়।

জেনে নিন ডাঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

  • ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান ১৮৮৮ সালে ব্রিটিশ ভারতের মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে (বর্তমানে তামিলনাড়ু, ভারতে) মধ্যবিত্ত তেলেগু ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন জমিদারের তহসিলদার বীরা সামায়ার দ্বিতীয় পুত্র।তাঁর পিতা তাঁকে পুরোহিত তৈরী করতে চেয়েছিলেন বটে, তবে তাঁর জ্ঞান এবং আগ্রহের কাছে হার মেনে তিনি তাঁকে দর্শন নিয়ে পড়ার অনুমতি দেন।
  • একদিকে রাজনীতিবিদ, দার্শনিক ও অধ্যাপক এই মানুষটি ছাত্রজীবনে ছিলেন অতি মেধাবী ও শান্ত। জীবনে কোন পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় হননি। সচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেননি তিনি, তাই বিভিন্ন বৃত্তির মাধ্যমে তাঁর ছাত্র জীবন এগিয়ে চলেছিল।
  • তিনি মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছিলেন এবং এম.এ-তে তিনি একটি থিসিস লিখেছিলেন, “বেদান্ত দর্শনের বিমূর্ত পূর্বকল্পনা’(The Ethics of the Vedanta and its Metaphysical Presuppositions)”।
  • মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অধ্যাপনাজীবন শুরু করলেও, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, মহীকলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, মহীশুর বিশ্ববিদ্যালয়ও তিনি অধ্যাপনা করেন। এরপর তিনি অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের ভূমিকাও পালন করেছিলেন।
  • ১৯৩১ সালে তাঁকে British knighthood-এ সম্মানিত করা হয় এবং ১৯৫৪ সালে তিনি ভারতরত্নে ভূষিত হন।
  • তাঁর একটি দীর্ঘ রচনায় তিনি দেখিয়েছিলেন যে ভারতীয় দর্শন এককালে স্ট্যান্ডার্ড একাডেমিক জারগনে অনুবাদ করা হয়। তিনি ভারতীয় দর্শনে প্রচুর সম্মান অর্জন করেছিলেন। তার পূর্ব ও পাশ্চাত্য এর মেলবন্ধনে যে দর্শনবোধ, তা তাঁকে আধুনিক প্রগতিবাদী মানুষ হিসাবে প্রমান করে।
  • তিনি ১৯১৩ সালে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জন্য লীগ অব নেশনস কমিটিতেও মনোনীত হন। এবং ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে ডঃ রাধাকৃষ্ণন ইউনেস্কোতে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন এবং ১৯৪৯ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।
  • তিনি ভারতের গণপরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং পরে ১৯৫২-১৯৬২ সাল অবধি তিনি ভারতের প্রথম উপ-রাষ্ট্রপতি হিসাবে এবং ১৯৬২ সালে ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত হন তিনি ।
  • তাঁর স্মরণে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় রাধাকৃষ্ণান চেভেনিং বৃত্তি এবং রাধাকৃষ্ণান স্মৃতি পুরস্কার প্রদান করা হয়। তিনি জার্মান বুক ট্রেডের শান্তি পুরস্কারও পেয়েছিলেন।
  • ১৯৭৫ সালে তাঁকে টেম্পলটন পুরস্কার সম্মানিত করা হয় এবং পুরস্কার প্রাপ্ত পুরো পরিমাণ অর্থ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেছিলেন।
  • তিনি বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য পত্রিকায় লেখা লিখতেন। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘The Philosophy of Rabindranath Tagore’। দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘The Reign of Religion in Contemporary Philosophy’ প্রকাশিত হয় ১৯২০ সালে।
  • আশ্চর্যের বিষয়, তিনি এতটাই নম্র এবং ভালো মানুষ ছিলেন, যে তিনি যখন ভারতের রাষ্ট্রপতি হন, রাষ্ট্রপতি ভবন সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল এবং সমাজের সমস্ত জাতের মানুষ তাঁর সাথে দেখা করতে পারতেন ।
  • আপনি কি জানেন যে তিনি ১০০০০ টাকার বেতনের মধ্যে কেবল ২৫০০ টাকা গ্রহণ করতেন এবং বাকি অর্থটি প্রতি মাসে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় ত্রাণ তহবিলে অনুদান দিয়েছিলেন? সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান মারা যান ১৭ এপ্রিল, ১৯৭৫ সালে ।

তাঁর দর্শনবোধ ,শিক্ষা,সংস্কৃতি,সমাজচিন্তা ও দেশত্ববোধ সর্বকালের সর্বজনের।আজও তাঁর দর্শন চিন্তা আমাদের জীবনের অন্যতম পথপ্রদর্শক। জীবনে তিনি বহু উচ্চপদে প্রতিষ্ঠা পেয়েও প্রথম জীবনের শিক্ষকতা তিনি ভুলে যান নি।
তাই তাঁর নিজের জন্মদিনটিকে ‘শিক্ষক-দিবস’ হিসাবে পালন করতে নির্দেশ দিয়ে গেছেন। তিনি পুঁথি সর্বস্ব শিক্ষা দানের বিরোধী ছিলেন এবং তিনি ছাত্রদের প্রকৃত মানুষ গড়ার কথা বলেছিলেন, তাই শিক্ষকদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে সে কথাও উল্লেখ করেছিলেন।তিনি পুঁথি বিদ্যার বিরোধী ছিলেন। শিক্ষকদের জন্য ডাঃ রাধাকৃষ্ণনের মতামত ছিল ‘সঠিক ধরণের শিক্ষাই সমাজ ও দেশের অনেকগুলি অসুবিধা সমাধান করতে পারে।

তদুপরি, তিনি চেয়েছিলেন যে শিক্ষার মান উন্নত করতে এবং শিক্ষক,ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় করে তুলতে। সব মিলিয়ে তিনি শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। তাঁর মতে ‘শিক্ষকের উচিত ছাত্রদের স্নেহ লাভ করা এবং শ্রদ্ধা অর্জন আদেশ এর সাথে আসে না, তা অর্জন করতে হয়।’

বর্তমানযুগে সকল শিক্ষক-শিক্ষিকাকে তাঁর পথে এগিয়ে যাওয়া উচিত , শপথ নেওয়া উচিত, কঠোর পরিশ্রম -একাগ্রতা – সততার পথে শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে আগামীর প্রকৃত মানুষ গড়ার কাজে হাত লাগাতে হবে আর তাহলেই তাঁর এই জন্মদিনে ‘শিক্ষক দিবস’ পালন সার্থকতা পাবে।

 

‘মন ও মৌসুমী’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here