এক
সেদিন সবে মাত্র বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, এমন সময় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। অফিসের বাস সময় মত আসতে কিছুটা দেরি করায়, বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আমি একা এক দৃষ্টিতে প্রকৃতিকে ভিজতে দেখছিলাম। অসময় এমন বৃষ্টি দেখে পুরনো ফেলে আসা কলেজ লাইফটা যেন ওই মুহূর্তে বড্ড মনে পড়ছিল। হ্যাঁ! এইরকম এক বৃষ্টির দিনেই তো ভিড় ঠেলা এক মিনিবাসে আমার সঙ্গে বর্ষার প্রথম দেখা। আমি তখন কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্ট আর বর্ষা? না! সে তখন সবে উচ্চ মাধ্যমিক দিচ্ছে। বাসের একদম পিছনের জানালার সিটটায় দিব্বি দুটো বিনুনি ঝুলিয়ে, বই হাতে সে বসেছিল। একদিকে কন্ডাক্টরের অনর্গল চেঁচিয়ে যাওয়া, অন্যদিকে বাসের মধ্যে থাকা নানা লোকের নানা কথোপকথন, কোনও কিছুতেই ওর আগ্রহ ছিল না। আর থাকবেই বা কি করে? ওকে দেখে বুঝতেই পেরেছিলাম, বড্ড টেনশনে ছিল যে।
বাসের ভিড় ঠেলতে ঠেলতে আমি যে কখন ওর সামনে এসে পড়েছিলাম, তার টেরটুকু পাইনি। বড়ো রাস্তা পেরোবার পর যখন কন্ডাক্টর ওকে টিকেট করার জন্য ডাকল, তখন বর্ষার প্রায় ভিমরি খাওয়ার মত অবস্থা! সামনে দাঁড়িয়ে আমি। ওই প্রথম বইয়ের পাতার উপর থেকে নজর সরল ওর। আর সেই নজর সরাসরি এসে পড়ল, বাসের রড ধরে প্রায় ঝুলতে থাকা অবস্থায় ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই যুবকটির উপর।
মজার বিষয় হল, কন্ডাক্টর ভেবে বর্ষা আমার হাতেই টিকিটের টাকাটা গুঁজে দিয়ে বলেছিল,
– বিনোদিনী বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে নামবো।
না! কন্ডাক্টর আমি নই, তবু ওর ওই মিষ্টি গলার স্বর শুনে আমি নিজের অজান্তেই ঘাড় নেড়ে টাকাটা ওর হাত থেকে নিয়েছিলাম। সেদিনের এই কলেজ পড়ুয়া ছেলেটা কখন যে নিজের অজান্তেই কিছু মুহূর্তের জন্য বাস কন্ডাক্টরে পরিণত হল, তা বাসে উপস্থিত এত লোকের মধ্যে কেউই টের পেল না। জানি না কেন সেদিন ওর ওই একবার আমার দিকে তাকানো, ওর সেই চোখের চাওনি আমাকে যেন এক অদ্ভুত দোটানায় ফেলে দিল, যার কারণে আমি কলেজ ফাঁকি দিয়ে ওর সঙ্গে নেমে পড়লাম ওর স্কুলের সামনে এবং কাটিয়ে দিলাম একটা গোটা দিন, এক অজানা অনুভূতির টানে। মনের ইঙ্গিতটা তখনো টের পাইনি। তবে, পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছিলাম যে সেদিনের ওই বাসের ভিড় আর লোকজনের অজস্র আওয়াজের মাঝে, আমার জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল।
দুই
তারপর থেকে বর্ষার প্রত্যেকটা পরীক্ষার দিনই, আমি ওর সঙ্গে একই বাসে উঠেছি এবং ওর স্কুলের গেট অবধি গিয়েছি। ব্যাস! আমার দৌড় ছিল ওই অবধি, কখনো ওর নামটাও জানার সুযোগ হয়নি। আমি অবশ্য চেষ্টাটাও করিনি। তবে, আশ্চর্যের বিষয় হল, পরীক্ষার শেষ দিন হঠাৎ স্কুল গেটের সামনে এসে বর্ষা পিছন ফিরে আমার নাম ধরে ডেকে বলেছিল,
– উজান–দা, রোজ রোজ এক অচেনা মেয়ের পিছু করছ অথচ তার নামটাও জিজ্ঞেস করবে না?
ওর মুখে নিজের নামটা শোনা মাত্রই আমি একেবারে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এতদিন ধরে যার অজান্তে যাকে পিছু করছি ভেবেছিলাম, সেটা আদতে তার কাছে কোনও অজানা ঘটনা নয়। আমি এই কদিনে ওর নামটা জানতে না পারলেও, আমার নামটা ও ঠিকই জেনে নিয়েছিল। কিন্তু কেন? আর এই বিষয়টা নিয়েই আমার মনে জাগল প্রশ্ন– আচ্ছা, আমার নামটা জানার কি উদ্দেশ্য ওর?
পরীক্ষা শুরু হওয়ার ঘণ্টা বাজতে না বাজতেই আমার অবাক মুখের দিকে চেয়ে সে শুধু বলে গিয়েছিল,
– বর্ষা নামটা এবার থেকে মনে রেখো।
ব্যাস! ওই শুরু আমাদের গল্প, স্কুল পেরিয়ে বর্ষার কলেজ জীবন প্রায় শেষ হয়ে এল, তবু চিঠি লিখে বাসের সিটে ফেলে আসার স্বভাবটা ওর আর পাল্টালো না। আমার প্রতি ওর অভিমানের কথা বর্ষা এভাবেই চিঠির মাধ্যমে আমাকে জানাত।
আমি তখন পড়াশোনা শেষ করে চাকরি খুঁজছি, একটা চলে যাওয়ার মত চাকরিও নিজের জন্য জুটিয়ে নিয়েছিলাম এবং অল্প মাইনের চাকরি হলেও, তাতে নিজের সুখ খোঁজার চেষ্টা করেছি। কারণ আমার জন্ম এক অত্যন্ত নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে, যেখানে আমার বাবার সামান্য আয় দিয়েই আমাদের সংসার চলতো। তবে, এই বিষয় আমার মায়ের কখনোই তার স্বামীর প্রতি কোনও অভিযোগ ছিল না। দু–বেলা দু–মুঠো খেয়ে স্বামী ও ছেলের সঙ্গে এক ছাদের তলায় থাকতে পারাটাই ছিল তার কাছে প্রকৃত সুখ। ফলে, ছোট থেকে মাকে ওইভাবে দেখে বড়ো হয়েছি বলে, আমিও মায়ের মত একইরকম স্বপ্ন দেখতাম। অল্প রোজগারে সংসার সাজানো এবং তাতে সুখ বজায় রাখা।
বর্ষার পরিবার অনেকটা আমাদের মত একই ধাঁচের হলেও, যেহেতু ও মেয়ে সুতরাং ওর বেলায় এই নিয়মটা খাটল না। ওর বাবা–মাও বাকি আর পাঁচটা কন্যা সন্তানের অভিভাবকদের মতই সবসময় চাইত যাতে তাদের একমাত্র মেয়ের বিবাহ এমন ঘরে হয়, যেখানে ‘সুখ‘ বলতে কেবলমাত্র ভালোবাসা নয়, অর্থের দ্বারা সু–পরিকল্পিতভাবে ভালো থাকাকে বোঝায়।
তবে, এই বিষয়কে বর্ষা কখনোই বেশি পাত্তা দেয়নি। ওর কাছে ভালো থাকার অর্থই ছিল উজান। কখনো ট্রামে চেপে শহর দেখা, তো কখনো আবার কুরানো ঠোঙ্গা দিয়ে গঙ্গায় কাগজের নৌকা ছাড়া। এই ছিল ওর তথা আমাদের সুখ। একবার আমার জন্মদিনের আগে বর্ষা নিজের হাতে পায়েস রেঁধে এনেছিল, সেই পায়েস খেয়ে আমি এতটাই উৎফুল্ল হয়েছিলাম যে প্রত্যেকবার ওর হাতে বানানো পায়েস খেয়েই নিজের জন্মদিনটা পালন করব, এই আবদার আমি ওর কাছে রেখেছিলাম। হ্যাঁ! আমার সেই আবদার বর্ষা প্রত্যেকবার রেখে এসেছে।
মনে আছে সেবার আমাদের বিয়ের পর যখন ওর পরিবার আমাদের মেনে নেয়নি এবং তার মধ্যেই আমার চাকরি চলে যাওয়ায়, সেই সময় আমরা খুবই আর্থিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু বর্ষা এর মধ্যেও আমার সেই আবদারের কথা ভোলেনি। সে তার মায়ের দেওয়া জন্মদিনের উপহার স্বরূপ নিজের সোনার হারটা বিক্রি করে আমার জন্য সেবার পায়েস বানিয়েছিল। সত্যি, একেই তো প্রকৃত ভালোবাসা বলে, যেই ভালোবাসার কাছে অর্থ তথা অর্থের দ্বারা সু–পরিকল্পিতভাবে ভালো থাকা বারবার হার স্বীকার করে নেয়।
তিন
পুরনো দিনের সেই কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে অফিসের বাস এসেছে পড়েছে, তা বুঝতে পারেনি। সেদিন অফিস শেষে বাড়ি ফেরার সময় খানিকটা ইচ্ছাকৃত ভাবেই মাঝ পথে নেমে পড়লাম। ভেজা রাস্তা, মাথার ওপর পরিষ্কার আকাশ আর পাখিদের বাড়ি ফেরার গানের মাঝেই হঠাৎ মোবাইল ফোনটা কেঁপে উঠল। পকেট থেকে ফোনটা বের করে মেসেজটা পড়ে বুঝলাম, গতমাসের বেতনটা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সবে মাত্র ট্রান্সফার হয়েছে। সাধারণ চাকরিজীবীর কাছে মাসের এই একটা দিন সবসময় বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে। তবে, ওই দিনটা আমার কাছে আরও বিশেষ কারণ সেদিন ছিল আমার জন্মদিন। জানি বাড়িতে আবারও পায়েস রেঁধে রেখেছে বর্ষা কিন্তু প্রতিবারের মত একইভাবে নিজের জন্মদিন পালন করব? এটা মানতে ঠিক মন সায় দিচ্ছিল না। সুতরাং তাই ঠিক করলাম এবারের জন্মদিনে আমিও আমার সহধর্মিণীর জন্য কিছু একটা উপহার নিয়ে যাব।
নিজের সেই ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে সোজা মার্কেটে চলে গেলাম এবং অনেক খুঁজে যখন কিছুই নিজের চোখে ভালো লাগছিল না বলে বাড়ি ফেরার পথটা ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েও বেছে নিতে হচ্ছিল, ঠিক তখনই উল্টো দিকে এক সোনার দোকানের বাইরের কাচের মধ্যে কিছু বছর আগে আমার জন্য বর্ষার বিক্রি করে দেওয়া ওর মায়ের উপহার দেওয়া গলার হারটার মত একই ধরণের একটি সোনার হার দেখি সাজানো রয়েছে।
আমি হারটা দেখা মাত্রই রাস্তা পার হয়ে দৌড়ে সেই দোকানে গিয়ে ঢুকলাম এবং ওই হারটা কেনার পর মনের মধ্যে যেন এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করলাম। সেবার আমার জন্মদিনে পায়েস রাঁধার জন্য বাড়িতে ওই সামান্য টুকুও টাকা না থাকার কারণে বর্ষা যেই হারটা বিক্রি করে দিতে একবারও ভাবল না, আজ এতবছর পর সেই আমার জন্মদিনের দিনই যখন ওকে ওই একই রকমের হার উপহার দিতে পারছি, তখন আমি মনে করি বর্ষাকে দেওয়া এটাই আমার শ্রেষ্ঠ উপহার।
এরপর আর কোনও দিকে তাকানো নয়, সোজা বাড়ির পথ ধরলাম এবং বাড়ি পৌঁছে যখন সদর দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকতে গেলাম, ওমনি চারপাশটা যেন নিমেষের মধ্যে অন্ধকার হয়ে গেল। যেদিকে তাকাচ্ছি, সেদিকেই শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। কান পাতলে দূর থেকে কার যেন গলার স্বর শুধু ভেসে আসছিল। ধীরে ধীরে সেই গলার স্বর যেন আরও স্পষ্ট হতে লাগল আর মুহূর্তের মধ্যে ওই অন্ধকারটাও একেবারে কেটে গেল।
চার
চোখ খুলে দেখি ছাদের চিলেকোঠার ঘরে মা আমাকে ঘুম থেকে তুলতে এসেছে। বুঝতে পারলাম আজ চারটে বছর কেটে গেছে, তবু বর্ষা আমাকে একদিনের জন্যও একা করে যায়নি। রোজ রাতে সময়ের নদীতে নৌকা ভাসিয়ে সে আমার ঘুমের মধ্যে আসে এবং ভোর হলেই পাখিদের মত কোথায় যেন হারিয়ে যায়, আমার হাজারও চিন্তার ভিড়ে।
আমাদের ছাদের চিলেকোঠার ঘরটা ছিল বর্ষার অত্যন্ত প্রিয় একটা জায়গা। ফলে, এখন এটাই আমার জগত। গোটা বাড়ির মধ্যে এই একটা ঘরেই আমি সীমাবদ্ধ। আজ তো আবার আমার জন্মদিন, তাই বর্ষা হয়ত ঘুমের মধ্যে এসে আমাকে আমার জন্মদিনের ওই পায়েসের স্বাদটুকু দিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু মায়ের আমাকে ডেকে তোলার সাথেই, সেই স্বাদ আমার কাছে অধরাই থেকে গেল।
সেদিন আকাশে শ্রাবণের মেঘ ছিল। শঙ্খচিল যেন ওই নীল আকাশে ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়াচ্ছিল। মেঘের ফাঁকে উঁকি দেওয়া রোদের তীব্রতা আজ নেই বললেই চলে। ঘরের জানালাটা মনে হয় খোলা ছিল, তাই হাওয়ার তীব্রতায় দেওয়ালে টাঙ্গানো ওর ফটোর উপর লাগানো মালাটা গিয়েছিল খুলে।
আমি তড়িঘড়ি গিয়ে ওই মালাটা সরিয়ে রেখে, আলমারি থেকে সেবার ওর জন্য কেনা ওই সোনার হারটা বের করে এনে, বর্ষার ফটোয় পড়িয়ে দিলাম। ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় লক্ষ্য করলাম ঘরের ঠিক উল্টো দিকে একটা রঙিন পাখি কোথা থেকে যেন উড়ে এসে চুপটি করে বসেছিল। পাখির বেশে হয়ত বর্ষাই ওর উজানের কাছে এসেছিল এবং বলতে চেয়েছিল,
– আবারও আমরা একসঙ্গে বাঁধব ঘর।
– হ্যাঁ! বর্ষা, কথা রইল। তুমি আসবে নতুন রূপে, আমি সাজবো জাতিস্বর।
কলমে রণিত ভৌমিক, কলকাতা