নৈরাশ্যের বেড়াজাল ছিঁড়ে সূর্যমুখীর ন্যায় রৌদ্রপানে মাথা তুলে চেয়ে ও শীতকালীন হালকা সূর্যরশ্মি গায়ে মেখেই ইদানীং ঘুম ভাঙে লিপির। তার ভালো নাম দেবাত্ময়ী। দেবীপক্ষের অষ্টমী তিথিতে তাঁর জন্ম হয়। তাই, ঠাকুরদা তার অমন নামকরণ করেছিলেন। সে এখন অর্থনীতি অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। চুড়ান্ত মেধাবী ও বাকপটু যুবতীটি অন্যায় দেখলেই তার অণু-পরমাণু স্তর অবধি বিশ্লেষণ করে অপরাধীদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে উদ্যত হয়ে ওঠে। সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা না থাকলেও তাদের পরিবারে স্নেহ ও ভালোবাসার কখনোই অভাব প্রতিফলিত হয় নি।

পর্ব ১
আধ্যাত্মিক চেতনার বীজ বপন

লিপিদের বাড়িটি শ্যামবাজার ফড়িয়াপুকুরের কাছে একটি আয়তাকার জমিতে হলেও বাড়ির গঠন সিংহমুখী অর্থাৎ বাড়ির সামনের দিকটি চওড়া কিন্তু পিছনদিকটি ক্রমশ সরু । ওইরূপ বাস্তুশাস্ত্রসম্পন্ন বাড়িতে থাকলে নাকি মানুষ ধনলক্ষ্মীর কৃপা লাভ করে ও শরীর-স্বাস্থ্যও উত্তম থাকে। কিন্তু, বাস্তবের সাথে এইরূপ কথিত কাহিনীর মিল কোথায়? একের পর এক জীবনহানিই তো হয়ে চলেছে তাদের বাড়িতে। ৫ মাস আগে এক অবিবাহিতা পিসি গত হলেন। তারপর আবার, ১৪ দিন আগে লিপির ৫৪ বছর বয়সী কাকা পরলোকগমন করলেন। গত পরশু তার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সুসম্পন্ন হল। অগ্নাশয়ের ক্যান্সারে ভুগছিলেন বিগত ৭ মাস ধরে তিনি। এই ঘটনার জেরে তাদের পরিবারের সকলেই শোকসন্তপ্ত। কাকাকে আদর করে মিষ্টু  বলে ডাকত লিপি। সেই ডাক বারংবারই তার মিষ্টুর সাথে কাটানো সুখস্মৃতির জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে।  ব্যাকুল হৃদয় ও অশ্রুসিক্ত চক্ষু নিয়ে মনমরা হয়ে আকাশপানে চেয়ে বসে থাকে সে আজকাল। লিপির বাবা শ্রীকুমারবাবু আধ্যাত্মিক মানুষ ও সমাজসেবী।  শ্রীকুমারবাবু শৈশব থেকেই লিপিকে আধ্যাত্মিক শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন ও তার আত্মার অভ্যন্তরে আধ্যাত্মিক চেতনার বীজ বপন করেছেন। শ্রীকুমারবাবুকে পিতা হিসাবে পেয়ে লিপি নিজেকে প্রকৃতপক্ষে সৌভাগ্যবতী মনে করে, পূর্বজন্মের সুকৃতি ছাড়া এমন পিতা লাভ সকলের ভাগ্যে থাকে না। ।

গীতার শ্লোক অনুযায়ী এই কথার সত্যতা বিচার করা যায়-

“তত্র তং বুদ্ধিসংযোগং লভতে পৌর্বদেহিকম্
যততে চ ততো ভূয়ঃ সংসিদ্ধৌ কুরুনন্দন”

অর্থাৎ কৌন্তেয় অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, পূণ্যবাণ যোগভ্রষ্ট ব্যাক্তি বহুকাল যাবত স্বর্গে বসবাস করার পর কোনো সদাচারী যোগীগৃহেই জন্মগ্রহণ করেন ও পূর্বজন্মকৃত আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও পারমার্থিক চেতনা সংযোগে মদগত চিত্তে ঈশ্বরসাধনায় ব্রতী হন। লিপির আধ্যাত্মিক জ্যোতিপূর্ণ চোখ দুটি দেখে তার বাবা সদাই বলতেন, “তোর চোখে আধ্যাত্মিক ছাপ, বৈকুণ্ঠলোকের চিহ্ন, তুই আমার বিষ্ণুপ্রিয়া,  বিষ্ণুর কৃপাধন্য”। লিপি বড়ই কৃষ্ণভক্ত কিনা!

পর্ব ২
লৌকিক- অলৌকিকের জটিল সমীকরণ

সম্প্রতি লিপির জীবনে এক চরম অলৌকিক ঘটনা ঘটে যায় , যার সত্য উৎঘাটন করতে গিয়ে, সে গোলকধাঁধার অন্ধগলিতে বারবারই হারিয়ে যাচ্ছে। মাইগ্রেন ও মাথা ঘোরার সমস্যা তার বরাবরই, তাই ওগুলিকে আজকাল সে আর খুব একটা গুরুত্ব দেয় না। কলেজে সেদিন ক্লাস চলছিল অনার্সের। এইসময় হঠাৎই ক্লাসের বাইরে শোরগোল তৈরী হয়। মাস্টারমশাই দরজা বন্ধ করেই ক্লাস করাতেন, তাই ক্লাসরুমের ভিতর থেকে বাইরে কি চলছে বোঝার উপায় ছিল না। হঠাৎ, ক্লাসরুমের দরজায় কারা যেন ধাক্কা দিতে লাগলো। মাস্টারমশাই দরজা খুলতেই তড়িঘড়ি লিপির বাবা ক্লাসে ঢুকে তাকে ভালো নাম ধরে চিৎকার করে ডাকতে থাকলো। পেছনে ইউনিয়ন রুমের কয়েকজন পরিচিত দাদারা ভিড় করেছিল।
লিপি সম্পূর্ণরূপে হতবাক হয়ে বাবার দিকে একভাবে চেয়ে রইল। শ্রীকুমার বাবু ছুটে লিপির ডেস্কের কাছে গিয়ে বললেন কলেজ থেকে জনৈক ব্যক্তি তাকে ফোন করে জানিয়েছেন যে, “লিপি বড়ই অসুস্থ। ওকে এসে বাড়ি নিয়ে যান ও সত্বর হাসপাতালে ভর্তি করুন। ওর পক্ষে আজ একা বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়।” “আপনি কে বলছেন” জিজ্ঞাসা করার আগেই উনি ফোন ছেড়ে দিলেন। তাছাড়া, লিপির এই ডাকনামটি কলেজের কেউ জানলো কিভাবে? কলেজে তো সে দেবাত্ময়ী নামেই পরিচিত। বন্ধুবান্ধবরা তাকে দেবী বলেই সম্বোধন করে থাকে। ঘটনাটি বোঝার আগেই মাস্টারমশাই লিপির বাবাকে অতি চিন্তিত দেখে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে বললেন। তখন ঘড়ির কাঁটায় ঠিক ৪ টে বাজে।
লিপি প্রতিদিনই কলেজে ক্লাস সেরে ৫-৫:৩০ টা নাগাদ বাড়ি ফেরে। বাবার এরূপ অদ্ভুত আচরণে লিপি খানিকটা হতাশ হয়ে অসমাপ্ত ক্লাস করেই বেরিয়ে এল সেদিন। বাড়িতে আসার কিছুক্ষণ পরই মাথা যন্ত্রণা শুরু হল তার। মাইগ্রেন ভেবে প্রথম দিকে এড়িয়ে গেল সে। ভাবল, চাদরটা গায়ে বিছিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। ঘড়িতে ঠিক তখন ৫:৩০ টা, হঠাৎ সে ঘুম থেকে উঠে পড়ল। গায়ে ধুম জ্বর, থার্মোমিটার দিয়ে তার মা জ্বর মেপে দেখলেন ১০৩° ফারেনহাইট, তার সাথে অসহ্য মাথা-ঘাড় ও শরীরের গাঁটে গাঁটে যন্ত্রণা। রাতে জ্বর আরও বাড়লে শ্রীকুমার বাবু হাউস ফিজিশিয়ানকে বাড়িতে কল দিলেন। তিনি কিছু ওষুধ দিলেন ও কয়েকটি রক্তপরীক্ষা করে রিপোর্ট দেখাতে বলে গেলেন। পরদিন সকালে রক্তপরীক্ষা করার প্রায় ৮ ঘন্টা পর রিপোর্ট হাতে এল। NS1 অ্যান্টিজেন পজিটিভ এল রক্তে, অর্থাৎ লিপি ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। রক্তে অণুচক্রিকার পরিমাণও ৪০০০০,অর্থাৎ স্বাভাবিকের থেকে অনেকটাই কম। রিপোর্ট ডাক্তারবাবুকে দেখাতে তিনি প্রেসকিপশনে “অ্যাডমিট” লিখে দিলেন। শ্যামবাজারের সঞ্জীবনী নার্সিং হোমে ভর্তি করা হল তাকে। ওখানে প্রসিদ্ধ ডাক্তারের হাতেই তার চিকিৎসা হল। ডাক্তার শ্রীকুমার বাবুকে ডেকে বললেন আর একটু দেরী করলে মেয়ের জীবনসঙ্কট হতে পারতো। শ্রীকুমার বাবু হতচকিত হয়ে সেই অজ্ঞাত ব্যক্তির কথা ভাবলেন। পরমব্রহ্মময় ঈশ্বরকে দুহাত তুলে প্রণাম করে মেয়েকে বুকে করে আগলে তিনি বাড়ি নিয়ে এলেন।

পর্ব ৩
সমীকরণের ঐশ্বরিক সমাধান

শ্রীকুমার বাবু প্রায় ১৪ বছর বয়স থেকে তারাপীঠ যাতায়াত করেন। ব্রহ্মময়ীর তারার হাতছানি যে বড়ই লোভনীয়। বহুকাল যাবতই তারাপীঠের অজ পাড়াগ্রামগুলিতে নিজের ভক্ত ও মিত্রদের সহায়তায় প্রচুর ভান্ডারা ও বস্ত্র বিতরণের আয়োজন করে আসছেন তিনি। সেসব এমনই দুঃস্থ পরিবার, যেখানে পরিণত স্ত্রীলোকদেরও ছিঁড়ে যাওয়া শাড়িতে গিঁট বেঁধে পড়তে দেখা যায়। ভাবলেও চোখ ভিজে আসে। তারাপীঠের শ্মশান শ্রীকুমার বাবুর অন্যতম বিচরণস্থল ছিল। চারিদিকে কাঠের অভাবে অগ্নি সৎকার করতে না পারা হতদরিদ্র মনুষ্যদের মাটি চাপা দেওয়া ঢিবি, দুপাশে মাটির বুকে ঝুঁকে পড়া শেওড়া গাছ ও মুহুর্মুহু খোল-করতালের আওয়াজ। ২ টি বৃহৎ চিতার মধ্যবর্তী স্থানে দাঁড়িয়ে তারা মায়ের নামে সংকল্প সেরে, বহুবার অমাবস্যার রাতে তিনি লাল বসন পরিহিত অবস্থায় চিতায় বসে যোগ্য করেছেন। চিতায় বসে তারা মন্ত্র জপ করতে করতে তাঁর গায়ের রোম খাড়া হয়ে উঠতো। তাও তিনি থামতেন না, জপেই যেতেন
                   “হূং ভগবত্যে একজটায়ৈ বিদ্মহে বিকট দংষ্ট্রে ধীমাহি তন্যস্তারে প্রচোদয়াৎ। ॐ তারা ॐ তারা ॐ তারায়ৈ বৌষট।”

মা তারা সাকার ও নিরাকার দুই-ই । নিরাকারে তাঁর স্বরূপ দুর্বোধ্য আর সাকার অবস্থায় তিনি শবরূপী ভোলা মহেশ্বরের বক্ষে দন্ডায়মানা। একদা তারা মন্ত্র জপতে জপতে তীব্র ঘুঙুরের আওয়াজে তার মনোসংযোগ ছিন্ন হয়। তিনি এদিক ওদিক চাইতে এক জটাধারী ব্রাহ্মণ তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ওই ব্যাক্তিটি চিতার উপর উঠে শ্রীকুমার বাবুর যজ্ঞবেদীর পাশে বসেন। ওইদিন ছিল ফলহারিনী অমাবস্যার রাত। যজ্ঞ শেষ হলে শ্রীকুমার বাবু জটাধারী ব্রাহ্মণের পদযুগলে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করেন। ব্রাহ্মণ ব্যাক্তিটি প্রসন্ন হয়ে আশীর্বাদস্বরূপ তাঁকে একটি বর প্রদান করেন ও  সেই বরের ফল সম্পর্কে তাকে অবহিত করেন । বরের ফলস্বরূপ তিনি সর্বাধিক প্রিয় মানুষের বিপদ সম্পর্কে সর্বাগ্রে অবগত হবেন ও তাকে রক্ষা করতে সক্ষম হবেন, স্থির হয়। লিপিকে এই ঘটনা বলতে বলতে পরমেশ্বরের বিচিত্র লীলা সম্বন্ধে তাকে আরও অনেক তথ্য প্রদান করে শ্রীকুমার বাবু ভাবে বিভোর হয়ে কিছুসময় ধ্যানযোগে অতিবাহিত করলেন। লিপিও গোলকধাঁধায় হারানো পথ খুঁজে পেয়ে পরমব্রহ্মময়কে অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করল।

কলমে রশ্মি ভট্টাচার্য্য, ভবানীপুর, কলকাতা নিবাসী

পেশায় একজন প্রাণীবিদ্যার গবেষক। বর্তমানে জুলজিকাল সার্ভে অব্ ইন্ডিয়ার ডিপ্টেরা সেকসানে ফরেনসিক এন্টোমোলজি নিয়ে গবেষণারত। পি. এইচ. ডি – এর কাজে নিযুক্ত হওয়ার পূর্বে চারুচন্দ্র ও বঙ্গবাসী কলেজে প্রাণীবিদ্যার অতিথি অধ্যাপিকা ছিলাম। তাছাড়া , আধ্যাত্মিক প্রভাবক হিসাবে নিজের ব্লগে ( Spiritual Words by RB) লিখি। শৈশব থেকেই লেখালেখির বিষয় প্রবল আগ্রহ । ইন্টার স্কুল লেখা প্রতিযোগিতায় এবং আরও অনেক অফলাইন ও অনলাইন লেখা প্রতিযোগিতায় উল্লেখযোগ্য স্থান অর্জন করেছি।



7 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here