তামিলনাড়ু রাজ্যের ছোট্টো একটি শহর মাদুরাই।মনোমুগ্ধকর এই শহরের অন্তর্ভুক্ত ছোট্টো গ্রাম আদালেই। গল্পটি ওখানকারই এক ছোট্ট বালকের, নাম হরিচন্দন্ নারায়নন্। ছোটোবেলা থেকে যেমন সব শিশুর মাথার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় বড় হয়ে ওঠার একরাশ স্বপ্ন, তেমনই ওর মাথায় অচিরেই চেপে বসে ছিল একরাশ অবহেলা । অল্প বয়সে বাবা মারা যাওয়ার পর পারিবারিক সচ্ছলতা তো দূরস্থ বেঁচে থাকার জন্য নূন্যতম খাবারের জোগান ও পরিবার দিতে অসমর্থ হয়। এই অসমর্থতার মধ্যেও স্বপ্ন দেখতে ভোলেনি ওই একরত্তি কিশোর। কিন্তু ওর স্বপ্নটা আর পাঁচটা ছেলেদের মতো নয়,অনেকক্ষানি আলাদা। ও হতে চেয়েছিল “স্পাইডার ম্যান” । অল্প বয়সে এসব কথা শুনে সবাই নিছক ছেলেমানুষি বলে উড়িয়ে দিলে ও, বয়স যত গড়াতে থাকে তার এই কথা গুলো পরিবার কিংবা প্রতিবেশির কাছে হয়ে ওঠে হাসির কারন। বইয়ের পাতায় লেখা চরিত্র গুলো কি কখনো সত্যি হয় নাকি, এগুলো এক একটা নিছক কল্পনা মাত্র এসব বলে ধমক দিতে থাকে পাড়ার সবাই । শেষ পর্যন্ত কিছু উপায় হবে না ভেবে মা ধারু দেবী একটু কেঁদেই বললেন, ” তোর বাপ মারা যাওয়ার পর, লোকের বাড়িতে ঝি গিরি করে, এর ওর বাড়ি থেকে এক দু মুঠো খাবার এনে তোকে খাইয়েছি। হয়তো বড় লোকেদের মতো অতো স্বাচ্ছন্দ দিতে পারি নি, কিন্তু যতদূর সামর্থ্য ছিল তোকে মানুষ করার চেষ্টা করেছি, আর আস্তে আস্তে তুইও বড় হচ্ছিস, কিছু একটা করে তো আমাদের পরিবারের হাল টা ধরতে পারিস। তা না করে খালি ওই স্পাইডার, স্পাইডার। এতো বড় হলি এবার তো ছেলেমানুষিটা ছাড়”। ” কিন্তু মা আমি তো স্পাইডার ম্যান এর মতো উড়তে চাই, কতোদিন আর এই অন্ধকারময় বদ্ধ দুনিয়ায় বেচেঁ থাকবো, আমি ও উড়তে চাই, আমি ও স্পাইডার ম্যানের মতো উড়ে উড়ে লোকেদের বাঁচাবো, টিভিতে দেখেছি ও কেমন দুষ্টু দের শাস্তি দেয়, আমি ও দেব” একটু উৎসাহী হয়েই বললো হরি। ধারু দেবী রাগে গর্জাতে গর্জতে বললেন, ” এগুলো কি সত্যি হয় নাকি, মুখপোড়া! এর ওর বাড়িতে গিয়ে টিভি দেখে দেখে মাথা টা পুরো শেষ করে ফেলেছে । এতো বড়ো হয়ে গেলি, এবার তো কিছু একটা কর। তোর এই ওড়ার চক্বরে আমাদের পরিবারটা না একদিন উড়ে চলে যায়” । ‘পরিবার মেনে নেবে না’ বলে কতো অবাস্তব স্বপ্ন গুলো বাস্তবে পরিনত হয় না, তা ধীরে ধীরে টের পাচ্ছিল হরি । পরিবারের দুরবস্থা দেখে পাশের বস্তিতে চায়ের দোকানে ঢুকলেও, মনের মধ্যে ওই স্বপ্নটা ওকে রোজ কুরে কুরে খেতো ।কখনো কাজের ফাঁকে, পাইপ লাইন ধরে এর ওর ঘরের ছাদে উঠে যেত, কখনো গাছের ওপর নিমেষেই উঠে যেত, কখনো সেতুর নিচে ঝুলে থাকতো।তার এইসব কাজের জন্য সারা গ্রাম প্রায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তার মা ধীরে ধীরে ওর প্রতি আশাও প্রায় ছেড়ে দিচ্ছিলো। তারপর এলো হঠাৎ একদিন, যেখানে সত্যিকারের স্পাইডার ম্যানের জন্ম হলো। তারিখটা ঠিক মনে নেই সম্ভবত জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে হবে। হঠাৎ বিকেলে সারা পাড়া হুলস্থুল পড়ে গেলো। পাশের বাড়ির মুন্নি, বন্ধু দের সাথে খেলতে গিয়ে হঠাৎ পাতকুয়ায় পড়ে গেছে। সব্বাই ছুটে এসে দেখে অতল গভীরে ছোট্ট মেয়েটি কাতরাচ্ছে। আর ওর জীবন আর মৃত্যুর মাঝে দূরত্ব ক্রমেই আরো বেড়ে চলেছে। কিছুক্ষন পর পুলিশ,দমকল একে একে সব এসে হাজির হলো। বাঁচানোর চেষ্টাও প্রায় দুঘন্টা চললো। কিন্তু বেরোনোর পথের থেকে মুন্নির মৃত্যুর পথ আরো বেশি প্রশস্থ হচ্ছিলো । ওর মা বাবা থেকে শুরু করে পাড়ার সবাই ধীরে ধীরে বাঁচার আশা হারিয়ে ফেলছিল । কিন্তু গল্পের টুইস্ট এখনো বাকি ছিল। হঠাৎ করে বইয়ের পাতার সেই অবাস্তব চরিত্রের মতো বাস্তবে হাজির হলো, ওই পাড়ার মানুষদের রাগ,ক্ষোভের কারন সেই অবাস্তব ‘স্পাইডার ম্যান’।
নিজের জীবনের কথা চিন্তা না করেই সবার চোখের সামনে ঝাঁপ দিলো ওই অন্ধকারাচ্ছন্ন গভীর পাত কুয়ায়। আগে ওর এইসব পাগলামো দেখে যারা হাসতো, পাগল-ছাগল কিংবা মাথায় যা আসতো বলতো, আজ তারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে তার ওই পাগলামিটাই দেখছিল। প্রায় আধ ঘন্টা ধরে অনেক চেষ্টার পর মুন্নি হয়তো ফিরলো, কিন্তু হরি আর ফিরলো না, পাড়ি দিলো ওই না ফেরার দেশে। প্রায় তিন ঘন্টা ধরে সকলের চেষ্টার পর মুন্নি বেঁচে ফিরে এলো । বাস্তবের ওই স্পাইডার ম্যান আবার ফিরে গেলো পুরোনো সেই ছেড়া গল্পের পাতায়। শুধু শিখিয়ে দিয়ে গেলো –
” চরিত্র গুলো বাস্তবে হয়তো ফলবে না, তবু স্বপ্ন দেখাটাও ছেড়ে দিলে চলবে না ”
কলমে অর্পন মাইতি