“স্বাস্থ্যই সম্পদ ” , “সুস্থ শরীরেই সুস্থ মনের বাস” — এসব শব্দবন্ধের সাথে আমরা খুব ভালোভাবেই পরিচিত। দৈনন্দিন জীবনযাত্রার শত ব্যস্ততার মধ্যেও সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে কেই বা না চায় ! ঘড়ির কাঁটা ধরে বাঁধা নিয়ম করে কেউ হয়তো শরীর ও মননের জন্য যথেষ্ট সময় ব্যয় করতে পারেন, আবার কারো পক্ষে হয়তো তা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনা । আর কথা যখন আসে ‘ বডি বিল্ডিং’য়ের , তখন তো বোধহয় তরুণ সমাজের কাছে এর চেয়ে বড় গর্বের বিষয় আর কিছু হতেই পারেনা ! তাই ছোট হোক বা বড়, কারো কাছেই সুস্বাস্থ্য আর উচ্চমানের জীবনযাত্রার স্বপ্নের ব্যাপারে কোনো রকম ‘কনসিডারেশন’ তো চলেই না।

‘ স্বাস্থ্য ‘ — এই কথাটা কিন্তু শুধুমাত্র দৈহিক বিষয়ের সাথেই সম্পর্কিত নয় ; দেহ ও মনের সম্পূর্ণ সুস্থ ,স্বাভাবিক ও রোগমুক্ত অবস্থাকেই বলা হয় সুস্বাস্থ্য । আবার সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মূল কাঠামো বা ভিতই বলা যেতে পারে সুস্বাস্থ্যকে । তাই সঠিকভাবে এবং অবশ্যই সুস্থ ভাবে জীবন যাপনের জন্য সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় বিষয়টি হলো সুস্বাস্থ্য।

মানুষের স্বাস্থ্য বহু বিষয়, নিয়ম বা অভ্যাসের সাথে যুক্ত । অর্থাৎ এগুলিকে এক কথায় স্বাস্থ্যের নিয়ন্ত্রক বা ‘ Determining Factor ‘ বলা যেতে পারে। মানুষের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাস, শরীরচর্চা, নেশা, দৈনিক কৃতকর্ম তথা আয়ের উৎস, সামাজিক আচরণ – এই সমস্ত বিষয়গুলিই স্বাস্থ্যের সাথে প্রত্যক্ষ এবং ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রত্যেকটি বিষয়ে বিশদ আলোচনা এই ধারণাটিকে সম্পূর্ণ স্পষ্ট করতে পারে।

স্বাস্থ্যের নির্ভরশীলতা সবচাইতে বেশি যে বিষয়ের উপর তা হল খাদ্যাভ্যাস। সঠিক খাদ্যাভ্যাস যেমন একজন মানুষের স্বাস্থ্যকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক রাখতে পারে আবার খাদ্যাভ্যাসের ত্রুটি মানুষের স্বাস্থ্যকে সম্পূর্ণভাবে বিগড়েও দিতে পারে। খাদ্যের বিভিন্ন মৌলিক উপাদান তথা প্রোটিন ,ভিটামিন, কার্বোহাইড্রেট প্রভৃতি নির্দিষ্ট পরিমাণে প্রতিদিন মানুষের শরীরে গ্রহণ করা উচিত। সঠিকভাবে খাদ্য গ্রহণ মানুষের হৃদপিণ্ড, পেশি, দৈহিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং বিপাক ক্রিয়া সঠিকভাবে সঞ্চালন করে। দৈনিক নিয়মিত মাত্রায় মূল খাদ্য উপাদান গ্রহণ মানুষের শরীরের সুস্থতা এবং সতেজতাকে নিশ্চিত করে । খাদ্যাভ্যাসের ত্রুটি মানুষের জীবনে ডেকে আনতে পারে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, গ্যাস্ট্রিক প্রভৃতি দুর্বিষহ রোগকে।

খাদ্যাভ্যাসের পরেই সুস্বাস্থ্যের উপর দৃঢ় ভাবে প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে শরীরচর্চা ও অনুশীলন। দৈনিক নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য শরীরচর্চা ধরে রাখতে পারে একটি রোগ প্রতিরোধক, সুস্থ সবল দেহকে। দীর্ঘমেয়াদী কোন সময় নয় , কিন্তু নিয়মিত কুড়ি বা তিরিশ মিনিটের সাধারণ কিছু ব্যায়াম ও অনুশীলনই সতেজ রাখার পক্ষে যথেষ্ট। আর বর্তমানে তো এর জন্য বহু প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও গড়ে উঠেছে ।

দৈনিক নির্দিষ্ট পরিমাণ ঘুম মানুষের স্বাস্থের অপর একটি বড় রকম প্রভাব বিস্তার করে ।উপযুক্ত মাত্রায় শরীরকে বিশ্রাম তথা সঠিক পরিমাণে ঘুম মানুষের দৈহিক প্রতিটি অঙ্গ এবং কোষকে পুনরায় কর্মক্ষম করে তোলে। তাই নির্দিষ্ট পরিমাণ ঘুম সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত জরুরী।

অতিরিক্ত স্ট্রেস বা চাপ মানসিক অবস্থার অবনমন ঘটায়। অযথা বিনা কারণে অথবা পারিবারিক, সাংসারিক বা সামাজিক – যে কোন কারনেই অতিরিক্ত চাপ সুস্বাস্থ্য কে বিঘ্নিত করে। তাই চাপ নিয়ন্ত্রণ সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য বর্তমানে বহু পরামর্শ কেন্দ্র, ‘Stress Control Center’ ও গড়ে উঠেছে। তাই প্রয়োজনে এগুলির সাহায্য নিয়ে অতিরিক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণ করা আবশ্যিক।

মদ, বিড়ি ,খৈনি ,গুটকা ,ড্রাগস প্রভৃতি বদনেশা মানুষের জীবন বিপন্ন করে তোলে। ক্যান্সারের মতো মারণ রোগঃর পেছনে মূল কারনই হল যথেচ্ছভাবে এবং বহুদিন ধরে নেশা করা। তাই সুস্বাস্থ্য গঠন তথা বেঁচে থাকার নিমিত্তে মাদকদ্রব্য ও ড্রাগস ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করতে হবে।


যথেচ্ছ যৌন সংযুক্তি বা যৌন ক্রিয়া-কলাপ মানুষের স্বাস্থ্যকে বিঘ্নিত করতে পারে। গনেরিয়া, হারপিস, AIDS, Human Papillomavirus infection, জরায়ুর ক্যান্সার প্রভৃতি বিভিন্ন রোগ এই কারণে হতে পারে। বিশেষত বয়ঃসন্ধিকালীন এবং সদ্য তরুণ গোষ্ঠীর মধ্যে অধিক যৌন ক্রিয়া-কলাপ এর প্রবণতা দেখা যায়। তাই যৌন ইচ্ছাজনিত বিষয়গুলির থেকে নিজেকে দূরে রাখাই শ্রেয়।

স্বাস্থ্যের ওপর দৈনন্দিন বিভিন্ন বিষয়গুলির প্রভাব স্পষ্ট হওয়ার পরই আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে সেই সমস্ত বিষয়গুলির উপর, যার সঠিকভাবে পালন সহজ করে দিতে পারে সুস্বাস্থ্যের সাথে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপনের পথ।

● নিজের দৈনিক খাদ্যাভ্যাসের নিয়ম এবং তালিকা এমনভাবে তৈরী করতে হবে যাতে তার মধ্যে দেহের প্রয়োজনীয় প্রত্যেকটি মৌলিক খাদ্য উপাদান সঠিক মাত্রায় উপস্থিত থাকে।

● কোন ভালো কাজের জন্যে পুরস্কার স্বরূপ বা খুশি করার জন্য বাচ্চাদের চিনি বা ওই ধরনের বেশি মিষ্টি জাতীয় উপাদান দেওয়া যথাসম্ভব পরিহার করতে হবে । কেননা এই অভ্যেস চিরন্তন হিসেবে পরিণত হতে পারে এবং তা পরবর্তীতে সুগার, ডায়াবেটিস – এর মতো বিভিন্ন রোগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

● দৈনিক নিয়ম করে অন্তত কুড়ি মিনিট শরীরচর্চা করতেই হবে। শরীরচর্চার জন্য জিম যাওয়াই আবশ্যিক নয় ,কিছু সাধারন ব্যায়াম ও শারীরিক অনুশীলন তথা দৌড়ানো, সাঁতার কাটা ,ওয়েট লিফটিং বা ভার উত্তোলন প্রভৃতি শারীরিক সক্ষমতা বজায় রাখার পক্ষে যথেষ্ট। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন সপ্তাহে কমপক্ষে চার বা পাঁচ দিন নিয়ম করে শরীরচর্চা করা হয়ই।

● পেশীবহুল শরীর গঠনের উদ্দেশ্যে বিশেষত তরুণ সমাজের মধ্যে স্টেরয়েড জাতীয় বিভিন্ন ঔষধ নেওয়ার প্রচুর প্রবণতা রয়েছে। কিন্তু এর থেকে দূরে থাকতে হবে । কেননা অধিকমাত্রায় স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ গ্রহণ শরীরকে ভেতর থেকে ধ্বংস করে দিতে পারে।

● খাদ্যের মাধ্যমে দৈনিক যে পরিমান ক্যালোরি গ্রহণ করা হবে ,সেই পরিমান ক্যালোরি খরচেরও ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থাৎ দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজের করে শরীরের শক্তি ব্যয়ের মাধ্যমে শরীর সুস্থ রাখতে হবে।

● বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগের প্রতিষেধক ঔষধ আবিষ্কার এর চেয়েও বেশি পরিমাণ নজর দিতে হবে কি করে সেই রোগের কারণ বা উৎস দমন করা যায় তার উপর।

● মানসিক সুস্থতা যেহেতু সুস্থ জীবনযাপনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাই অত্যধিক চাপ গ্রহণ ,নিজের ভেতরে দীর্ঘদিন কোন কথা চেপে রাখা – এই সমস্ত বিষয়গুলি পরিহার করতে হবে। এক্ষেত্রে বড়দের সাথে আলোচনা করে উদ্দিষ্ট সমস্যার সমাধানের উপায় খোঁজাই শ্রেয়। বিশেষ পরিস্থিতিতে চিকিৎসকের পরামর্শও নিতে হবে।

● যেকোনো কাজের ক্ষেত্রে নিজেকে সর্বদা পজিটিভ এনার্জি তথা অনুপ্রেরণামূলক তথ্য এবং দৃষ্টান্ত দিয়ে ঘিরে রাখতে হবে।

● বিভিন্ন নেশাকর পদার্থ যেমন গাঁজা, মদ, ড্রাগস, গুটকা , খৈনি প্রভৃতি সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করতে হবে।

● মানসিক অস্থিরতার জন্য একটি অত্যন্ত সফল এবং গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো মেডিটেশন। একে সাধারণভাবে ধ্যান করা বলা যেতে পারে । সুস্বাস্থ্যের উদ্দেশ্যে তাই রোজ নিয়ম করে মেডিটেশন করা উচিত।

● দৈনিক খাবার গ্রহণের সময় যতটা সম্ভব একই রাখার চেষ্টা করা উচিত । বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন সময়ে খাদ্যগ্রহণ, খাদ্য পরিপাকে বিঘ্নের সৃষ্টি করে।

● আর সমস্ত বিষয়গুলির মতই নেশা না করাকে একটি আইন হিসেবে পাস করতে হবে।

●পরিবেশ দূষণ মানুষের স্বাস্থ্যের অবনতির জন্য একটি অন্যতম প্রধান কারণ । তাই বিভিন্ন কল কারখানাগুলি পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস হওয়ায় দূষণমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে । ব্যবসায়িক স্বার্থের আশায় এই আইন যাতে কোনোভাবেই লঙ্ঘিত না হয় সে বিষয়ে কড়া নজর রাখতে হবে।

● বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্প করে সুস্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তা এবং সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার উপায় গুলি সামগ্রিকভাবে জনসমক্ষে আলোচনা করতে হবে।

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংস্থার দ্বারা বহুদিন ধরে গবেষণা করে জানা গেছে উপরোল্লিখিত বিষয়গুলোর মধ্যে যেকোনো একটিও কঠোরভাবে পালন করলে একজন মানুষের আয়ু পাঁচ বছর পর্যন্ত বাড়তে পারে। তাই সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপনের উদ্দেশ্যে ,সুস্বাস্থ্যের উদ্দেশ্যে এই নিয়মগুলিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে এবং দায়িত্ব কর্তব্য হিসেবে পালন করতে হবে। এ বিষয়ে সরকারকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে। তাই বিভিন্ন আইন প্রণয়ন এর মাধ্যমে সরকারিভাবে সুস্বাস্থ্য গঠন এর পক্ষে বেশ কয়েকটা ধাপ এগিয়ে দেওয়া সম্ভব।

বর্তমান চিকিৎসা ব্যবস্থা যথেষ্ট উন্নত । বিভিন্ন জটিল সংক্রামক/অসংক্রামক – সমস্ত রোগেরই ফলপ্রসু চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে এসেছে ‘স্টেম সেল টেকনোলজি’। বর্তমানে শুধু ভারতেই নয়, গোটা বিশ্ব জুড়ে চলছে মহামারী করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টা। ইতিমধ্যে ভারতও সফল হয়েছে করোনার প্রতিষেধক ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে। তাই প্রকৃতিতে নিরাশার কোন জায়গা নেই । এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রতিটি বস্তুই আশাবাদী ,আশার পথ নির্দেশক। তাই মানুষের অপারক কিছুই নেই।

“সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই”

মানুষ সবই পারে । সদিচ্ছা এবং চেষ্টা মানুষকে যেকোনো জায়গাতেই পৌঁছে দিতে পারে । তাই সুস্থ জীবনযাপন এর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন নিয়মগুলিকে সঠিকভাবে পালন করতে হবে। বর্তমান সময়ে করোনার মত মহামারীতেও ছিল হয়েছে উচ্চ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং সুস্বাস্থ্যের । তাই সুস্বাস্থ্য গঠন ,রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি – প্রভৃতিকে নিজের অবশ্যপালনীয় দায়িত্ব কর্তব্য হিসেবে গ্রহণ করে তা পালন করতে হবে আর অবশ্যই মনে রাখতে হবে ,যে ” Health is Wealth ” — ‘স্বাস্থ্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ’ । তাহলেই খুব সহজেই এবং খুব তাড়াতাড়িই সম্ভব একটি সুস্থ, সামাজিক ও রোগমুক্ত সমাজ ও দেশ গড়ে তোলা।

কলমে মোঃ সাঈদ ইকবাল

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here