ঘন্টার পর ঘন্টা জলে সাঁতার কেটেও ক্লান্তি নেই তার। পায়ের কাছে মাছগুলো এসে যখন কিলিবিলি কাটে, এক ডুবে ওদের হাতের মুঠোয় বন্দি করতে চায় মঙ্গল। ঝক ঝকে রূপোর টুকরো হাতে খিল খিল করে হেসে ওঠে সে। চলে মাছেদের সাথে লুকোচুরি খেলা। পুকুর থেকে বাড়ি ফেরার পথে ডাক পাখিদের তাড়া করে রোজ। পাখিও উড়ছে, মঙ্গল উড়ছে। এগাছ থেকে ওগাছ। ক্লান্ত ডাক পাখিটা। মঙ্গলের কিন্তু ক্লান্তি নেই। সুযোগ বুঝেই গুলতির সুতোয় টান দেয়। যে দিন নিশানা লেগে যায়, সেদিন ডাক পাখিটা জুটে যায় কপালে। বাড়ি ফিরে ভুড়ি ভোজ। ভিজে গায়ে, পাখি কাঁধে, হাতে গুলতি তাক করতে করতে ঘরে ফেরে মঙ্গল। মাটির দাওয়ায় বসা বিল্লুর ঘাড়ে চেপে গোল গোল চোখ পাকায়, “কি রে খাবি নাকি ?’’ বিল্লুর চোখের সামনে দুলাতে থাকে ডাক পাখিটা। থাবা উঁচিয়ে যেই এগিয়ে আসে বিল্লু, ছোট মঙ্গল ছুট্টে পালায় মায়ের কাছে। বিল্লু ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার করে।
“নিজেরা খেতে পাইনে, কুকুর টারে ছেড়ে দিতে পারিস না।”
মায়ের আঁচল জাপটে ধরে মঙ্গল। “ভাত দে মা। আর পাখিটা রাখ দিকি। রাতে মাংস খাবো সবাই মিলে। ”
স্নেহের সুরে ধমকে ওঠে মালতি,”ভাত হয় নাই। চাল এনেছিলি? তুই কি শুধরাবি না! কতবার নিষেধ করেছি ওপাশের পুকুরে যাবি নাই, যাবি নাই। ঠাকুর এল বলে। ওদের জলটা ছোট জাতের নয় রে।
আর করবি নে। যা দিকি এক পোয়া চাল নিয়ে আয়।”
‘দে দিকি দশটা টাকা। বাকিতে দিবে না আর সরকারের দোকানে, সেদিন বললাম না তোকে। ”
মালতি চুপ করে থাকে।
“আজ তোর এক দিন কী আমার একদিন। আবার সেন পুকরে নেমেছিস বাগদি ছোঁড়া।”
লাঠি উচিয়ে দাওয়ায় উঠে এসেছে মনিব ঠাকুর। বিল্লু এক লাফে ঝাঁপিয়ে পড়ে মনিব ঠাকুরের লাঠির উপর। চলতে থাকে দমাদম লাঠির বারি।
“হারামজাদা কুকুর আজ তোর একদিন কি আমার একদিন। ”
মঙ্গল ছুটে পালিয়ে যায়। ছুটতে ছুটতে আলপথ, পুকুর, চাষ জমি পেরিয়ে বুড়ি বাগানের মাঠ। হাঁপিয়ে গেছে সে। একটা বড়ো অশথ গাছ। শিকড়বাকড় জড়ানো গাছের কোটর। ধপ্ করে বসে পড়ে। ভেজা প্যান্ট, হাতে গুলতি।
মাঠের ধারে ইস্কুলের ঢং ঢং ঘণ্টা বাজছে। কও ছেলে মেয়ে। থালা হাতে খেতে যাচ্ছে। বড্ড খিদে পাচ্ছে মঙ্গলের। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায় পাঁচিলের ধারে। ওরা মেঝেতে বসে ভাত খাচ্ছে। ইস্কুলে লেখাপড়া করলে বুঝি ভাত খেতে পাওয়া যায়। চক চক করে ওঠে মঙ্গলের কালো চোখ দুটো। খিদেটা বেড়ে যায় হঠাৎ। পেটের মধ্যে মোচর দিতে থাকে। কে যেন খালি পিঠে হাত রেখেছে মঙ্গলের। ভয়ে জড়সড় সে। দৌড়ে পালাতে যাবে।
“কি রে খিদে পেয়েছে ? খাবি ?’’
ভয়ে ভয়ে মাথা নেড়ে দিদিমণি কে হ্যাঁ বলে মঙ্গল।
‘আয়, খাবি আয়। একটা শালপাতায় ভাত, কলাইয়ের ডাল, তরকারি। চোখ দুটো হেসে ওঠে তার। থালার ভাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে। চেটে পুটে খেয়ে নেয়। এত পেট ভরে রোজ তো ভাত জোটে না। মা টা জমিতে জন খাটে। যখন কাজ পায় তখন কুমড়ো, আলু, মাঝে মাঝে ডিম খেতে পায় ভাতের সাথে। কাজ না পেলে শুধু ফ্যান ভাত। তবে আজ তো মাংস হবে রাতে। মায়ের কথা মনে পড়ে মঙ্গলের। বিল্লুর কথাও। কি জানি মা খেল কিনা।
‘কি রে পেট ভরলো ?’ দিদিমণির কথায় নড়ে ওঠে সে।
‘হ্যাঁ ভরছে গো,’ আঙ্গুল চাটতে চাটতে বলে সে।
‘কি রে ইস্কুলে পড়িস ?’
না তে ঘাড় নাড়ে মঙ্গল।
‘পড়বি ?’
‘রোজ ভাত দিবে তোমরা ?’
‘হ্যাঁ রে ভাত, ডাল, তরকারী, মাঝেমাঝে ডিমও পাবি। মাংস হয় দু’মাসে একবার।’
কালো মুখে ঝকঝকে দাঁতের পাটি। খুশিতে ঘাড় নাড়ে সে।
‘কবে আসব তবে ইস্কুলে ?’
‘তোর বয়স কত রে ?’
‘মা বলে চৈত্তি মাসে ছয় বছর আগে পিদিম জ্বলেছিল ভিটায়। ঐ দিন নাকি জন্মেছিলাম আমি।’
দিদিমণি স্নেহের হাত মাথায় রাখেন। ‘বেশ কাল মাকে নিয়ে ঠিক সকাল দশটায় চলে আয়।’
আবার দে ছুট, দে ছুট, দে ছুট। হাতে গুলতিটা খোলা হওয়ায় ছুঁড়ে একবার লুফে নেয় সে। মাঠের ধারের খাস জমিতে লুটোপুটি খেয়ে নেয় খানিক।
না দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এল। মা’ টার জন্য মন কেমন করছে। সে বোধহয় ভাত পুড়িয়ে থালা নিয়ে বসে আছে।
মা মা বলে ডাকতে ডাকতে দরজা দিয়ে ভিতরে ঢোকে মঙ্গল।
‘কিরে বিল্লু কই গেলি ?’
“শোন কাল থেকে ইস্কুলে যাবো। মা ও মা, কই গেলি ? দিদিমণি ডেকেছে যে তোকে।’
মালতি বসে আছে আলু থালু। পায়ের কাছে বিল্লুর রক্তাক্ত নিথর দেহটা।
“কি হয়েছে ? বিল্লু ওঠ। বিল্লুর কী হয়েছে মা ? কাল ইস্কুলে যাবি না ? ওঠ বলছি, মাংস খাবি না ? ওঠ ! কি রে ওঠ বলছি।
বিল্লু ওই বিল্লু!
কলমে বর্ণালী রায়, কলকাতা
বর্ণালী রায়।পেশা শিক্ষকতা।নেশায় ভ্রামণিক।বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখির সাথে সাথে ব্লগিং,ইউটিউব,পডকাস্টিং এর মতো আধুনিক প্রযুক্তিতেও ভালোবাসা। ২০১৯ সালে বাঁকুড়া বীরভূম নিয়ে জেলাভিত্তিক একটি বই “ভ্রমণযাপন-১” প্রকাশিত হয়েছে।