রবিবার। সপ্তাহের এই একটা দিন, বৃষ্টির পরিচিত সবার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। কিছু কথা বলবার অবশ্য সেভাবে কোন সুযোগ হয়না, লাইব্রেরিতে কথা বলা বারণ। ভেতরে ঢুকলেই, অসংখ্য প্রিয় বইয়ের সম্ভার, থাকে থাকে আলমারিগুলোতে সাজানো রয়েছে ।এর মধ্যে থেকে ,পছন্দসই বই বেছে নেওয়াটা সত্যিই কঠিন, কোনটা ছেড়ে কোনটা নিই। ইস্, কেন যে মাত্র একটা বই নেওয়া যায়,বৃষ্টি ভাবে। বিধাননগরের ফুটবল মাঠের পিছনে ছাত্রসংঘ ক্লাব, তারই পাশেই সরলাবালা স্মৃতি লাইব্রেরি। লাইব্রেরিয়ান গোরাদা বইপাগলা মানুষ। কোথা থেকে সব অমূল্য বই খুঁজে পেতে জোগাড় ক’রে আনে। নতুন বইও অবশ্য অনেক কেনা হয়, তার জন্য ছোট একটা ফান্ড আছে। রবিবার সকালে ঘন্টাতিনেকের জন্য লাইব্রেরি খোলা থাকে। এই তিন ঘণ্টায় তিনশো জনের বই বেছে নেবার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যায় । কেউ ব’সে নীচের তাক দেখছে, তো কেউ তার পিঠে চেপে উপরের তাক ,দুর্বিষহ অবস্থা। তবুও, যতই ঝড়-বৃষ্টি-তুফান থাকুক না কেন, রবিবার বৃষ্টির লাইব্রেরি যাওয়া চাই’ই।এই লাইব্রেরির প্রতি ওর ভাললাগার কোন শেষ নেই। ভিড় হলেও, প্রিয় বইয়ের সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়ার মজাটাই আলাদা। নতুন বইয়ের গন্ধটা কি মনমাতাল করা, আর কিছুর সঙ্গে কোন তুলনাই চলে না।সেজন্যই তো এত কষ্ট সহ্য করে বই খোঁজা।তবে যেদিন ‘বুদ্ধদেব গুহ’ ঠিক করে যায়, হাতে সেদিন আসে ‘নীললোহিত’। এক ঘন্টা ঘুরে হয়রান হয়ে, শেষে নির্দিষ্ট আলমারির কাছে যাও বা ঠেলেঠুলে পৌঁছতে পারল, তো দেখল, যে বইগুলো খুঁজছিল সেগুলোই নেই, আর যেগুলো প’ড়ে আছে, সব পড়া। ‘সঞ্জীব’, ‘শীর্ষেন্দু’, ‘সমরেশ’, ‘সত্যজিৎ’-সব এক অবস্থা, আলমারি ফাঁকা। নিরাশ হয়ে, কোন কোন দিন বৃষ্টি বই নেয়ই না। ও প্রায়ই ভাবে, একদিনের বদলে যদি লাইব্রেরিটা সপ্তাহে দু’দিন খোলা থাকত, কি ভালই না হত! গোরাদাকে বলতে, বলে, ‘না গো, এই একদিনেরই হিসেব মেলাতে জীবন বেরিয়ে যাচ্ছে। তারপর অন্য সব দিন তো আমার অফিস রয়েছে।’ কথাটা ঠিকই, গোরাদার তো সম্পূর্ণ এটা বেগার খাটনি, শুধু ভালবাসা আর নেশা থেকে। নইলে ক’টাকাই বা চাঁদা ওঠে!
রবিবার নিয়ম করে, বৃষ্টির লাইব্রেরি যাবার আর একটা কারণ হল অয়ন, ওর সঙ্গেও দেখা হয় যে। আসার পথে কিছুটা সময় একসাথে পথ চলা , সাধারণ কিছু কথা হয়,ব্যাস।বাকি সময়টা, বেশীরভাগই অয়ন তার নিজের বন্ধুদের ভিড়ে হারিয়ে থাকে। মনটা খারাপ হয়ে যায় বৃষ্টির,আবার এক সপ্তাহ পর দেখা হবে! অয়ন কখনও তার নতুন কবিতা প’ড়ে শোনায়।কখনও বা কোন পত্রিকায় অয়নের লেখা ছাপা হলে , সবাই সেটা কাড়াকাড়ি ক’রে পড়ে। বৃষ্টি অবাক হয়ে শোনে। কবিতায় এত কথা বলা যায়! সব তার মনের কথা।বৃষ্টি তো এত সুন্দর করে লিখতে পারে না, অয়ন পারে। মাঝে মাঝে বৃষ্টি ভাবে,থাক, কি আর হবে অয়নের কথা এত ভেবে, ও তো ওর কেউ নয়, হবেও না। নিজেকে এসব বোঝালেও, অয়নকে কাছ থেকে দেখার লোভটা ও ছাড়তে পারে না। টি-শার্ট আর জিন্স প’রে, স্ট্রীটক্যাট সাইকেল চালিয়ে যখন ও আসে, বৃষ্টির মনে হয় ছুটে চলে যায়, অয়নের হাতটা ধ’রে বলে, ‘কবিতা এনেছ আজ? নতুন?’ কিন্তু অয়নের যে অনেক ফ্যান, তারা সব ঘিরে থাকে ওকে। বৃষ্টি আড়াল থেকে দু’চোখ ভ’রে দে’খে যায় শুধু।
বুদ্ধদেব গুহর ‘বাবলি’ উপন্যাসটা দুপুরে শু’য়ে শু’য়ে পড়ছিল বৃষ্টি ।এই সময়টা ওর একান্ত নিজের। বই পড়তে পড়তে,ও এক নিজস্ব গোপন ভাবনার জগতে বিচরণ করে। উপন্যাসের কোন কোন চরিত্র যেন ও নিজে , আবার কোনটা যেন অয়ন। শুধু এই প্রেমের গল্পগুলো যদি বাস্তবেও সত্যি হত! যদি ওর দিকে অয়ন একটু ফিরে তাকাত! আর পাঁচজনের একজন করে নয়, যদি একটু আলাদা চোখে দেখত ! বৃষ্টি জানে অয়নের গুনমুগ্ধ-মুগ্ধার অভাব নেই। পড়াশোনাতেও দারুন, বড় ফ্যামিলির ছেলে। অয়ন সবার থেকে আলাদা।ওর লেখা যেন বৃষ্টির মনের কথা, চোখের ভাষা, জীবনের সব অনুভবের খোলা চিঠি। ওর বেস্টফ্রেন্ড শম্পা মজা করে বলে ‘দিবানাপন’।এসব ভাবতে ভাবতেই, কখন যেন ওর চোখটা লেগে গিয়েছিল।
সেই সরলাবালা স্মৃতি লাইব্রেরি, সেই রোববার ।আজও সেই একই অবস্থা ,কোন আলমারি ছোঁয়ার উপায় নেই। আজ ও এসেছে, অয়নের লেখা বইটা নেবে বলে।অয়ন বসুর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাতের বলভি’, কেউ তুলে নেবার আগেই ওকে নিতে হবে। অয়নের কবিতা ওর আগে, কেউ যেন না পড়তে পারে। যে অয়ন ওর বুকের ভেতর, যখন-তখন দপ্ দপ্ করে জ্বলে ওঠে, তার বই হাতে নিয়ে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে পড়ার রোমান্টিকতা, আর সবকিছুর থেকে আলাদা।জাস্ট, ছাড়া যায় না। এ যেন অয়নকেই নিজের করে পাওয়া। সেদিন অয়নই ওকে ফোন করে বলেছিল, ‘জান, আমার কবিতার বই বেরিয়েছে।’
-সত্যি?কি নাম?
-তুমি জান না?
-রাতের বলভি?
-হ্যাঁ,তোমাকে দেব।
-কিভাবে দেবে? তুমি তো এখন টাটায়।
-তাতে কি? যাচ্ছি তো বইমেলায় । তখনই তোমার হাতে দেব।
‘ঠিক আছে’ বৃষ্টি বলেছিল।সেই থেকে বৃষ্টি তিন দিন ধরে অপেক্ষা ক’রে রয়েছে, কবে রোববার আসবে, লাইব্রেরি খুলবে। তাই আজ সকাল-সকালই পৌঁছে গেছে লাইব্রেরিতে। অয়নের কবিতার বই, লাইব্রেরির ভিড় ঠেলে ,অনেক বই খুঁজে, নিরাশ হয়ে,শেষমেষ যখন হাতে পাবে আর সেই অক্ষরগুলো উজ্জ্বলভাবে বইয়ের ওপর লেখা থাকবে, অয়ন বসুর ‘রাতের বলভি’,সেই আবিষ্কারের মজাই আলাদা। তখনই চিৎকার করে ও বলে উঠবে, ‘কার্ড নম্বর একশো সাত, বৃষ্টি সরকার। অয়ন বসুর বইটা নেব।‘ সবাই সব বই খোঁজা বন্ধ করে,ঈর্ষায় ওর দিকে তাকিয়ে থাকবে। মনে আছে অয়ন একদিন বলেছিল, ‘একমাত্র তুমিই একান্ত নিজস্ব ক’রে আমার কবিতা পড়।’ সে কথা আজও ভোলেনি ও।ওকে যে কটা কবিতা অয়ন দিয়েছে,তা তো ওর কাছে শুধু কবিতা নয়,এক একটা প্রেমপত্র।মাঝে মাঝেই লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ে বৃষ্টি,একান্তে। যখন ওর খুব মন খারাপ করে, এইভাবেই অয়নকে খুঁজে নেয় বুকের মধ্যে,জড়িয়ে ধরে অষ্টেপৃষ্ঠে।
আর সেইজন্যই, বইটা পাবার জন্য বৃষ্টি এত উদগ্রীব। লাইব্রেরি খুলতেই,ভিড় ঠেলে, প্রথম আলমারির কাছে গেল। সেখানে স্বপ্না, বুলিদি, শেখরদা সবাই বই খুঁজছে। ওদিকের আলমারিগুলোতে রাজা, অঞ্জন, শর্বরী আরো অনেকে। স্বপ্না বলে উঠল, ‘ওই এল, বুদ্ধপ্রেমিকা।’ বৃষ্টি বলল, ‘না না ,আজ নেবোনা।’ শেখরদা বলল , ‘হঠাৎ? ভদ্রলোকের দোষটা কোথায়?’ বৃষ্টি বলল, ‘ওনার দোষ হবে কেন? তবে আজ অন্য বই।’ বুলিদি বলল, ‘বাবা, তুই এত রোমান্টিক বই, পারিসও বটে পড়তে।’ ওদিক থেকে রাজীবদা বলল,’শর্বরী ,কি বই খুঁজছ? সমরেশ মজুমদার না দিব্যেন্দু পালিত?’ ‘না গো । আজ নতুন কোন বই। পেলেই বলব ।’
এরই মধ্যে, বৃষ্টি পাগলের মত খুঁজে চলেছে সেই বইটা।এত হাজার হাজার বইয়ের মধ্যে কোথায় খুঁজবে অয়নের বই?যেমন হাজার হাজার মানুষ, ফুটপাতের ভিড়, ঠেলাঠেলি, হাঁকাহাঁকি, কেজো বাজারি ব্যস্ততার মধ্যে, হারিয়ে ফেলেছে অয়নের মনটা ।খুঁজে কি পাবে তাকেও? ইস্, আজ যদি অয়ন থাকত, নিজে এসে খুঁজে দিত।’ঐ তো , ঐ আলমারীটায়।ঐ যে, নীল রঙের বইটা। সাদা হরফে লেখা। দেখতে পাচ্ছ না? আরে ঐ তো তিন নম্বর আলমারির দ্বিতীয় তাকে।ওঃ, ডান দিকের কোণে।’ নাঃ, অয়ন কোথায়! খুঁজে পাওয়া চিরকালই কঠিন প্রিয় জিনিসগুলোকে,প্রিয় মানুষকেও। মঞ্জুদিকে জিজ্ঞেস করল, ‘কোনো নতুন বই এসেছে দিদি?’ মঞ্জুদি বলল,’আসার তো কথা।গোরা এখনও এসে পৌঁছয়নি ।’ আবার খুঁজতে লাগল বৃষ্টি। যে বইগুলো অন্যবার হাতেই আসেনা, সেগুলো এবার সহজেই পেয়ে যেতে লাগল। বুদ্ধদেবের ‘পামরি’,সুনীলের ‘সুখের দিন ছিল’, শীর্ষেন্দুর ‘দূরবীন’, এমনকি জয়ের ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’ পর্যন্ত ।কিন্তু কোথায় অয়ন বসুর ‘রাতের বলভি’ ?এখনো আসেনি নাকি? অনেকেই বই পেয়ে গেল, ইস্যু হচ্ছে। আবার অনেকে না পেয়ে হতাশ। রাজা আর নীলাদ্রির তো ঝগড়াই হয়ে গেল বই নিয়ে, কে আগে নেবে সঞ্জীবের ‘অচেনা আকাশ’। হঠাৎ ওর মনে হল, কেউ নিয়ে নেয়নি তো অয়নের বইটা? ভাবতেই হতাশ লাগল, আর খুঁজতে ইচ্ছে করল না। তিনটে আলমারি পরে শর্বরী দাঁড়িয়ে। ও’ও ঘেমে গেছে, তবু খুঁজে চলেছে ।না পেয়ে কেমন যেন কাঁদো-কাঁদো ভাব! হালকা হলুদ চুড়িদারে ওকে খুব সুন্দর লাগছে। ওদিকে অনন্যা আর বেলা বৌদি হেসে হেসে কথা বলছে। গোরাদা নেই বলে, আজ সবারই একটু গা-ছাড়া ভাব, কথাবার্তাও চলছে টুকটাক ।দুই বৌদিরই হাতে বই। বৃষ্টি ভাবল, একবার ওদের বলে, ‘খুঁজে দেবে আমার বইটা? একা তো আর পারছি না।’ পরক্ষণেই ভাবে, না ,ওদের বলবে না, ওদের হাতে প্রথম উঠবে অয়নের বই! না ,কাউকে ওর আগে হাত দিতে দেবে না বইটায়।বরং শর্বরীকেই জিজ্ঞেস করা যাক ,যদি নিজের বই খুঁজতে খুঁজতে কোথাও দেখে থাকে।
ওর কাছে যেতেই বৃষ্টির হাতটা টেনে ধরে শর্বরী, মুখটা ফ্যাকাশে, চোখদুটো জলে ভরে গেছে। ‘পেলাম না রে ,জানিস কিছুতেই পেলাম না। অন্য দিন যে সব বইগুলো খুঁজি, সেগুলোই হাতের কাছে ঘুরছে।’ বলে নীচের ঠোঁটটা দাঁতে ক’রে অল্প চেপে ধ’রে, ওর দিকে তাকায়। বৃষ্টি বলল, ‘আমারও সেই একই অবস্থা রে।দেখ, পেয়ে যাবি ঠিক।’ ও একটা কষ্টের হাসি হাসল ।বৃষ্টি বলল,’কি বই খুঁছছিস?বল না,যদি দেখে থাকি।’ ‘আরে গত বুধবার শুনলাম….’,বলতে না বলতেই ,অভীক ওপাশ থেকে শর্বরীকে ডাকল। ওদিকে ইন্দ্র আর রাজা ব্যাস্ত হচ্ছে, ‘কিরে ,হয়েছে তোর বই খোঁজা?’ বৃষ্টি বলল,’না রে’ ‘ওঃ,কি যে এত খুঁজিস, কে জানে । হ’লে বাইরে আসিস, কথা আছে।’ বৃষ্টি মাথা নাড়ল। ওরা দু’জনে বাইরে চলে গেল।
তখনই ছুটতে ছুটতে শম্পা এসে পৌঁছল। ‘কখন?পেলি? এসেছে?’ একসঙ্গে সব প্রশ্ন ।কোন প্রশ্নেরই উত্তর নেই বৃষ্টির কাছে। ওর চোখটা ছলছল করে উঠল। মুখটা ঘুরিয়ে নিল, কি এক অভিমানে । অয়নের ফোনের কথা শম্পা জানে। ওর নিজের অবশ্য বইয়ের ব্যাপারে অত বাছবিচার নেই।খোঁজাখুঁজি না ক’রে, সোজা সামনের আলমারিটার কাছে চলে গেল। তুলে নিল একটা বই ।তারপর চলে গেল মঞ্জুদির কাছে ইস্যু করতে। মঞ্জুদি বলল, ‘কি ব্যাপার ? তুমি আজকাল আর বই খুঁজে নাও না। এসেই যা হাতের কাছে পাও,নিয়ে তখুনি চলে যাও!’ শম্পা হাসতে হাসতে বলে, ‘কি লাভ বল, এরকম মারপিট করে বই খুঁজে? একদিন না একদিন তো সবার পড়া হয়ে যাবে। সেদিন না হয় পড়ব।‘
এমন সময় গোরাদা এসে হাজির ।দু’হাতে অনেক বই ।টেবিলে রেখেই, ধপ করে চেয়ার টেনে বসে পড়ল। শর্বরী প্রায় ছুটে,বৃষ্টিকে ঠেলে টেবিলের কাছে চলে গেল ।টেবিলে সব নতুন চকচকে বই ছড়িয়ে পড়েছে, অয়নের বইটা রয়েছে নাকি ওর মধ্যে? ওদিকে মঞ্জুদি বইগুলোতে নাম্বার লিখতে শুরু করে দিয়েছে,স্ট্যাম্প মারছে। হঠাৎ তারই মধ্যে চোখটা আটকে গেল বৃষ্টির।ঐ তো বইটা, ‘রাতের বলভি’! নীল রঙের বই, ফুলের ছবি, পাশে সাদা হরফে লেখা সেই নাম, অয়ন বসু। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস হচ্ছে না বৃষ্টির, এক ভালোলাগার আনন্দে-আবেগে গলাটা বুঁজে এল। বলতে চাইল ‘বৃষ্টি সরকার, কার্ড নাম্বার একশো সাত। আমি নেব…’ কিন্তু তার আগেই শর্বরী বলে উঠল, ‘আমি অয়ন বসুর বইটা নেব। কার্ড নাম্বার একশো তিয়াত্তর’। বৃষ্টি অবাক হয়ে চেয়ে থাকে শর্বরীর মুখের দিকে ।শর্বরী হেসে বলে, ‘এই বইটাই খুঁজছিলাম রে। জানিস,অয়ন নিজে বলল ফোন করে…’ বৃষ্টির কানে সেসব কথা ঢুকল না।মাথা নীচু করে আস্তে আস্তে টেবিল থেকে সরে গেল। ওর আর কোন বই নেবার নেই ।গোরাদা শর্বরীর কার্ডটা হাতে নিয়ে, বইটা ইস্যু করছে। অয়ন যেন হারিয়ে যাচ্ছে,লুঠ হয়ে যাচ্ছে ওর থেকে। না,ও এ জিনিস সহ্য করতে পারবে না, ওর দেখতে কষ্ট হবে। চোখটা জলে ভরে উঠল।দূরে, আরো দূরে সরে যেতে লাগল ও ।সমস্ত লাইব্রেরির সবকটা বই যেন ওর দিকে বিদ্রুপ করে হেসে উঠল।কখন যে শম্পা এসে ওর হাত ধরল আর আলতো চাপ দিল, ওর মনে নেই ,বুকটা ভেঙে গেছে । বিশ্বাস হচ্ছে না শর্বরীর হাতে অয়নের বই! রাতের বলভি তবে কার??? শম্পার দিকে চোখ পড়তেই দেখে, ওর হাতে জ্বলজ্বল করছে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের সেই বইটা, ‘ভাঙা ডানার পাখি’।
স্বপ্নটা দেখতে দেখতে কেঁদেই ফেলেছিল বৃষ্টি ।স্বপ্ন তো নয়,দুঃস্বপ্ন। চোখদুটো মুছে দেখে বুদ্ধদেবের ‘বাবলি’ বইটা তখনও খোলা, বইটা বন্ধ করে পাশে তুলে রাখে। এ কি স্বপ্ন দেখল আজ? অয়নকে কি ও ভালোবেসে ফেলেছে ?
সেদিনের পর থেকে, অয়নের প্রতি বৃষ্টির অনুরাগ-আকর্ষণ-মোহ সবই যেন আরও বেড়ে গেল। লাইব্রেরি থেকে ফেরার সময়, বাড়ী ফেরার পথেই পড়ে বৃষ্টির বাড়ি। রাস্তার শেষটুকু, গল্প করতে করতে দু’জনে একসঙ্গে হাঁটে।অয়ন সাইকেলে চাপে না,হেঁটেই যায়।এক এক দিন ওর নতুন লেখা কবিতাও দেয় বৃষ্টিকে, বাকি সবাই অন্য পথে চলে যাবার পর।অয়নের মনে হয় বৃষ্টির সঙ্গে পথ চলার সময়টা এত কম কেন?একদিন মেঘ ক’রে এসেছে, বৃষ্টি আসছে ব’লে , অয়ন ওর স্ট্রীটক্যাট সাইকেলের সামনে, বৃষ্টিকে বসিয়ে নিয়েছিল। দু’জনে একসঙ্গে এত কাছাকাছি,বৃষ্টি যেন নিঃশ্বাস ফেলতেও ভুলে যাচ্ছে। অয়নের ঠোঁটের কাছেই বৃষ্টির ঠোঁট,শরীরে শরীর ঠেকে যাচ্ছে ঝাঁকুনিতে।অয়নের বাহুপাশে বৃষ্টির নরম শরীর,বৃষ্টির চুল হাওয়ায় উড়ছে।অয়নেরও সারা শরীরে তখন যেন আগুন ছুটছিল,কি সুন্দর বৃষ্টির গায়ের মেয়েলি গন্ধ। ও প্রাণপনে বৃষ্টিকে কিছু বলতে চাইছিল সে সময়। বৃষ্টিও কি শুনতে চাইছিল কিছু? অয়নের কবিতার লাইনে লাইনে যে ভালবাসার জনের কথা, সে আসলে কে? বৃষ্টির খুব জানতে ইচ্ছে করছিল সেদিন।কিন্তু পথটা শেষ হয়ে গেল বেশ তাড়াতাড়ি,বৃষ্টি নামার আগেই।
সেই প্রথম,আর সেই শেষ। আর এগোল না ওদের অব্যক্ত প্রেম।অয়ন তো পড়াশোনাতে বরাবরই ভাল ছিল, ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করতে না করতেই, এক রবিবার সবার হইহুল্লোড়-আনন্দের মধ্যে বৃষ্টি জানতে পারল,অয়ন টাটায় একটা ভাল কোম্পানিতে, চাকরি পেয়ে গেছে। ওর স্বপ্নের কথাটাই যেন সত্যি হয়ে উঠল।অয়ন টাটা চলে যাবে?আর কি দেখা হবে না ? খুব কষ্ট হচ্ছিল বৃষ্টির,খুব অভিমান।মন মানছে না । ওকে আলাদা ক’রে কিছুই বলেনি অয়ন।লাইব্রেরি থেকে ফেরার সময় শুধু বলেছিল, ‘চিন্তা কোরো না, আমি আবার ফিরে আসব।’ বৃষ্টির সেদিন যেন আর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছিল না, মনে হচ্ছিল এই সময়টুকু যেন আর শেষ না হয়। কোনদিনও ও বিদায় দিতে পারবে না অয়নকে। অয়নও তো কোনদিন মুখ ফুটে, কিছু বলেনি । শুধু ‘ফিরে আসব’ সেই ছিল অয়নের শেষ কথা, মিথ্যে কথা। আর কোনদিনও কেউ ফেরেনি।
বৃষ্টিরও জীবন অবশ্য থেমে থাকেনি, পিসির দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের হঠাৎ ভাল লেগে যায় ওকে, বিয়ের কথাবার্তা চলতে থাকে। অন্যদিকে কবি-লেখক হিসেবে তখন অল্পস্বল্প নাম করেছে অয়ন, টাটায় নতুন চাকরি, মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরলেও বৃষ্টির সঙ্গে বিশেষ দেখা হয়না, লাইব্রেরিতেও যায় না।ও তখন কবিতা-গল্প নিয়েই মেতে রয়েছে।নানা পত্র-পত্রিকায় বেরোতে শুরু করে দিয়েছে সেসব লেখা। মাঝে মাঝে চোখে পড়ে বৃষ্টিরও। যে অয়নের কবিতা, ওর মুখ থেকে শুনত,বা হাতে লেখা চিরকুট পেত, এখন সেসব কাগজের পাতায় পড়তে হয়।বৃষ্টির মনটা উদাস হয়ে থাকে। অবশ্য বৃষ্টি আর বেশিদিন অয়নের কথা ভেবে, চোখের জল ফেলবার সময় পেল না। ক’দিনের মধ্যেই ওর বিয়ের ব্যবস্থা পাকা করে ফেলল, দুই পরিবারের লোকজন ।অয়ন নামের অধ্যায়টা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে গেল বৃষ্টির জীবনের বই থেকে। বিয়ের পরে সাউথ ক্যালকাটা থেকে ওর আর সরলাবালা স্মৃতি লাইব্রেরিতে আসাও সম্ভব হত না ।তাই লাইব্রেরিটাও ওর জীবন থেকে বাদ পড়ে গেল বরাবরের মত।
বছর দশেক পরের কথা ।অয়ন এখন যথেষ্ট নামকরা সাহিত্যিক।কত গল্প, উপন্যাস নিয়মিত প্রকাশ হয় বড় বড় সব পত্র পত্রিকায়।এ বছরই বেরোল ওর প্রথম উপন্যাস ‘সরলাবালা স্মৃতি লাইব্রেরি’, এক প্রথিতযশা পাবলিশিং হাউজ থেকে। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তার বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানও হয়ে গেছে। খবরের কাগজে রিপোর্টও বেরিয়েছে ওর প্রথম বইয়ের ব্যাপারে, প্রচুর প্রশংসাও।এক নতুন লেখকের প্রথম উপন্যাসে প্রেম ভালবাসার উপলব্ধি আর জীবনবোধের গভীরতার জয়জয়কার,চারিদিকে সাড়া পড়ে গেল। অয়নের এই মহান কীর্তিতে উৎসাহিত হয়ে, ওর পুরোনো বন্ধুরা সবাই মিলে ঠিক করল ,ওকে একটা সংবর্ধনা দেবে। নতুন বইয়ের প্রোমোশনে ও তখন বাড়ি এসেছে, সামনেই বইমেলা ।অয়নও রাজি হয়ে গেল।বইয়ের নাম যা, সেই সরলাবালা স্মৃতি লাইব্রেরিতেই অনুষ্ঠানটা হবে। যদিও লাইব্রেরিটা এখন ধুঁকছে,বই পড়ার লোক কোথায়?আজ আর মঞ্জুদি নেই,বিয়ে হয়ে গেছে। গোরাদাও আজকাল আর বিশেষ আসে না,নতুন কি একটা চাকরি জয়েন করেছে।তবু পাড়ার লাইব্রেরির নাম এইভাবে অয়নের বই থেকে সবাই জানতে পারল,এই বা কম কি?
অনুষ্ঠানে সুন্দর বক্তব্য রাখল অয়ন।এই পাড়া,এই লাইব্রেরির সঙ্গে ওর যোগাযোগ, বেড়ে ওঠা,ওর লেখায় তার প্রভাব,অনেক কিছুই বলল।বৃদ্ধ সাহিত্যানুরাগী কালিপদবাবু ওকে উত্তরীয়,মানপত্র ও পুষ্পস্তবক তুলে দিলেন।সঙ্গে উপহার হিসেবে অনেক বই।হ্যাঁ,বই আজও পড়ে অয়ন,আগের থেকেও বেশি,কিছু ভালবাসার শখের পড়া আর কিছু সাহিত্যিক হিসেবে পড়াশোনা,যা করতেই হয়।লাইব্রেরিটা ঘুরে দেখল অয়ন।সেইসব বইগুলো আজ পুরোনো হয়ে গেছে, ধুলোয় ভরে গেছে, একদিন ওদেরই হাতের স্পর্শ ছিল এসবে।সব একইরকম আছে,শুধু সেই দিনও নেই, আর সেই সব মানুষগুলোও নেই। নতুন জেনারেশনটা টিভি আর স্মার্টফোনেই ডুবে আছে,বই পড়ার সময় কোথায়? অনুষ্ঠানের শেষে ওর বেশ কিছু বইতে সই করে দিতে দিতে অয়নের মনে পড়ছিল,এই সেই লাইব্রেরি, একদিন ওর বন্ধুদের নিয়ে কত সময় কাটিয়েছে,কত পছন্দের বই পড়েছে।সেই সব অনেক পুরোনো বন্ধুও আজ হাজির।সেই ইন্দ্র, রাজা, অঞ্জন,শম্পা । সবার সঙ্গে পুরোনো গল্পে গল্পে বৃষ্টি, স্বপ্না, শর্বরীর কথাও উঠল। সবার কার কোথায় বিয়ে হয়ে গেছে, সব চুটিয়ে সংসার করছে।আর কারো সঙ্গে কারো তেমন যোগাযোগ নেই ।ইন্দ্র বলল,’ফোন নাম্বার আছে ।কথা বলবি?’ অয়ন তেমন উৎসাহ দেখায় না, কি আর হবে? শুধু বলে, ‘বৃষ্টির নাম্বারটা একটু দিস তো ।’ ইন্দ্র দুষ্টু হেসে বলে, ‘শুধু বৃষ্টি? কেন রে?’ অয়ন মৃদু হাসে।ইন্দ্র বলে,’হ্যাঁ রে,তোর উপন্যাসের অভি তো আসলে তুই নিজে,না?’ অয়ন কোন উত্তর দেয় না, ওর মুখে একটা যেন বেদনার ভাব ফুটে ওঠে।
অনুষ্ঠানের শেষে এক কপি বই, ইন্দ্রকে আলাদা করে দেয় অয়ন। বলে, ‘বৃষ্টির কাছে পৌঁছতে হবে বইটা,পারবি?’ ইন্দ্র বলে,’ঠিক আছে, আজই ওর কাকার থেকে ঠিকানা জেনে, দিয়ে আসব এখন। তুই লিখে দে।’ অয়ন লিখে দেয় সুন্দর ক’রে। ওর উপন্যাসেরই একটা লাইন লেখে। ‘জানলার কপাট ডিঙিয়ে, বৃষ্টির জলের সাথে বহুদূর ভেসে ….’ নীচে তারিখসহ সই করে দেয়। লেখার সময় হাতটা যেন ওর একটু কাঁপছিল। এতদিন পরে বৃষ্টিকে কিছু দেওয়া,কিছু লেখা। সেই বৃষ্টি,যে ওর প্রথম যৌবনের, প্রথম প্রেমের মুগ্ধতা হয়ে, ঐ দিনগুলোতেই চিরকালের জন্য স্থির হয়ে রয়ে গেছে। অয়নের ভাল লাগা, ভালবাসা , আড়ালে লুকিয়ে বৃষ্টিকে দেখা,ওর না বলতে পারা অনেক কথা, জেগে ঘুমিয়ে সত্যি-স্বপ্ন-সবেতেই শুধু ছিল বৃষ্টি।অবশ্য, কোনদিন মুখ ফুটে বলতে পারেনি, তাই বৃষ্টিও জানতে পারেনি । আর সে সুযোগও পেল না বেশিদিন। বৃষ্টির বিয়ে হয়ে গেল হঠাৎই, বড় তাড়াতাড়ি। আসলে, নতুন চাকরি,নতুন শহরে নিজেকে খাপ খাওয়ানো, আর তার পরেই বৃষ্টিকে হারানো-সেইসময় সবকিছু এমন দ্রুত ঘটে যাওয়ায়, অয়ন ভীষণভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল। বাঁধভাঙা ভালবাসা হারানোর যে কি যন্ত্রণা,সেটা তখন ও বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু তখন বড় দেরি হয়ে গেছে।
তাই এ উপন্যাসের লাইনে লাইনে ফুটে বেরিয়েছে শুধু বৃষ্টি,ওর প্রতি অয়নের অনুরাগ,অভিমান আর গোপন আকাঙ্খা। বৃষ্টির প্রতি ওর অব্যক্ত ভালবাসা, যা সেদিন জানাবার সুযোগ পায়নি,যা ফোটার সুযোগ পায়নি, আজ ও তাকে প্রাণ মন খুলে নিবেদন করেছে বৃষ্টির স্মৃতির কাছে।বৃষ্টি যেমন ছিল ওর প্রথম প্রেম,সাহিত্যচর্চাও তেমনই ছিল ওর জীবন।তাতেই শেষে সঁপে দিয়েছিল মনপ্রাণ। যৌবনের সেই অনুভূতি ,সেই রোমান্স, বৃষ্টির সেই সান্নিধ্য, আজ ও লিখেছে। শুধু নামটাই রাখতে পারেনি ‘রাতের বলভি’,যা বৃষ্টির ইচ্ছে ছিল। ‘সরলাবালা স্মৃতি লাইব্রেরি’ নামটা দিয়েছে ইচ্ছে ক’রে।বৃষ্টি কথা রাখেনি,তাই ও’ও রাখবে না।আর তাছাড়া এই লাইব্রেরিতেই তো ওদের প্রথম পরিচয়,প্রথম প্রেম। বৃষ্টি যদি অন্ততঃ একবার বইটা পড়ে, তাহলেই অয়ন শান্তি পেত।
আবার ইন্দ্রর দেওয়া নাম্বারটায় অয়ন ফোন করে, লাগে না। বেশ ক’দিন ধরে, বেশ ক’বার ফোন , এসএমএস, ফেসবুক, ইনবক্স ইত্যাদি করেও কোন যোগাযোগ করতে পারে না।বৃষ্টি এত চুপচাপ কেন? ওর কি অয়নের সঙ্গে যোগাযোগ করার আর কোন ইচ্ছেই নেই? বৃষ্টি তো এমন ছিল না! যে বই এত ভালবাসত, অয়নের প্রথম বইয়ের খবর শুনে, তার তো দারুন খুশি হবারই কথা। সেই সুখবরটা দেবে না অয়ন? বৃষ্টির বন্ধুরাও ওর বিশেষ কোন খবর দিতে পারে না ।শুধু বলে, বৃষ্টি নাকি ভবানীপুরে থাকে, বিয়ের পরে সুখের সংসার। ওর বরের নাকি কিসবের ব্যবসা। বৃষ্টি এখন মন দিয়ে সংসারটাই করে, আর ছেলে মানুষ করে। বাইরে বিশেষ বেরোয় না। ফেসবুক , হোয়াটসঅ্যাপও করে না। ফোনটাও নাকি ওর নিজের নয়, বরের।ওদিকে ইন্দ্রও হতোদ্যম হয়ে বলে, ‘বই পাঠিয়ে দিয়েছি, আর কিছু জানি না।’ অয়ন একটু দমে যায়। বরং,ও তো ভেবেছিল, ঠিক উল্টোটাই হবে।ও নিজে হাতে বইটা তুলে দেবে বৃষ্টির হাতে। ও তো কতই বলত, ‘তোমার বই বেরোলে, সবার আগে আমাকে দেবে কিন্তু।’ আজ ওর উপন্যাস ‘সরলাবালা স্মৃতি লাইব্রেরি’র প্রথম এডিশন প্রায় শেষ, দ্বিতীয় এডিশনের কথা চলছে। নানা পত্র-পত্রিকা,সোশাল মিডিয়ায় শোরগোল।বৃষ্টি কি জানেনা কিছুই?
অবশেষে একদিন বিকেলে হঠাৎ একটা ফোন এল অয়নের, ফেসবুক মেসেন্জার কল।নামটা দেখে ‘বৃষ্টি সিনহা’।অয়ন তো অবাক এতদিন পরে, বৃষ্টির ফোন। তড়িঘড়ি দুরুদুরু বুকে ফোনটা রিসিভ করে । বলে,’আরে, তুমি? এতদিন পরে…..’। কিন্তু অয়নের সমস্ত আগ্রহ, উৎসাহ আর উত্তেজনা পরমুহুর্তেই নিভে যায়। বৃষ্টি অচেনা,কঠিন গলায় বলে, ‘আপনি কি অয়ন বসু বলছেন? আমি বৃষ্টি সরকার বলছি।’ অয়ন তো অবাক, ‘আপনি’ করে বৃষ্টি কেন কথা বলছে! কিন্তু তারপর বৃষ্টি যে কথাগুলো বলল, যে ভাবে ,যে টোনে, সেটার জন্য অয়ন মোটেই প্রস্তুত ছিল না। বৃষ্টি রীতিমত ধমকে বলে ‘আপনি কি মনে করেছেন বলুন তো? আপনি আমার পেছনে কেন পড়ে আছেন? বয়স তো অনেক হয়েছে ,নিজে বিয়ে-থা-সংসার করুন না। আমার স্বামী-ছেলে আছে । আমাকে এভাবে বিরক্ত করতে, আপনার লজ্জা করেনা?’ অয়ন তো চূড়ান্ত অপ্রস্তুত ।’আপনি’ করে কথা বলছে বৃষ্টি,ওকে দোষারোপ করছে। তবুও সামলাতে চেষ্টা করে,’ তুমি মানে আপনি এ কি বলছেন? আমি তো আসলে বইটা দিতে চেয়েছিলাম শুধু, আর তো কিছু নয় ….’ ‘থামুন, আমি বুঝতে পারিনা ? বারবার ফেসবুক বা ফোনকল করছেন ,মেসেজ করছেন, আমার বাড়িতে লোক পাঠিয়ে বাড়ি অব্দি ধাওয়া করেছেন। আমি তো চাই না এসব করতে। আমার যদি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করার ইচ্ছা থাকত,অনেক আগেই করতে পারতাম ।আপনি বুঝতে পারছেন না, যে আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চাই না?’ অয়নের বুকটা ভেঙে যায়, এ কি কথা শুনছে বৃষ্টির থেকে? এই বৃষ্টি সম্পূর্ণ অচেনা। এ ধরনের কথা তো ও আশাই করেনি। এরকম অপমান করার কারণটা কি? কি এমন অন্যায় করেছে ও, যে এই সমস্ত কথা শুনতে হচ্ছে? বৃষ্টি থামে না, বলেই চলে, ‘একে কি বলে জানেন? একে বলে ছেনালি করা।আপনি আমার ব্যক্তিগত জীবনে প্রবেশ করতে চাইছেন, একজন ভদ্র, বিবাহিতা মহিলার ।আমি কিন্তু এবারে স্টেপ নিতে বাধ্য হব। আপনি বিপদে পড়ে যাবেন।‘ অয়ন তো তো করতে থাকে, এই আক্রমণের উত্তরে ওর সব আত্মপক্ষ সমর্থনের বা বোঝানোর চেষ্টা খড়কুটোর মত উড়ে যায়।তবু আত্মরক্ষা করার জন্য বলে,’ আমি তো শুধু বইটা দিতে..’ ‘রাখুন আপনার বই। দরকার হলে আমি কিনে নেব বা জোগাড় করে নেব। আপনাকে দিতে হবে না। আমার বাড়িতে পৌঁছতে কে বলেছে?আপনার এত বড় সাহস হল কি করে? আর যেন কোনদিন আপনাকে এই সমস্ত করতে না দেখি। তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।‘ অয়ন একটু ঘাবড়ে যায়, এ কি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ল রে বাবা। বৃষ্টি, এত বদলে গেছে! এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না অয়ন। আর একটাও কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে।কোন রকমে অয়ন শুধু এইটুকু বলতে পারে, ‘ঠিক আছে, আমার ভুল হয়ে গেছে ।আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি আর আপনাকে কোনদিনও বিরক্ত করব না।’ ‘ঠিক আছে, মনে থাকে যেন।’ কর্কষ সুরে ব’লে,ফোনটা কেটে দেয় বৃষ্টি। ফেসবুক কল শেষ হবার পরে স্তম্ভিত হয়ে,মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে অয়ন।যেন কেঁদেই ফেলবে।পৃথিবীটা উল্টে গেছে,কষ্টে ওর বুকের ভেতরটা একেবারে মুচড়ে উঠছে, ফেটে যাচ্ছে এই অযাচিত আঘাতে। একি হল! সময়ের নিয়মে , সংসারের পাকে দুজনে আজ আলাদা ।কিছু করারও ছিল না কারো । সে তো পুরোনো কথা, যা হবার হয়ে গেছে।অয়ন তো কোনভাবেই ওকে আর বিরক্ত করেনি। শুধু একটা বই দিতে চেয়েছে মাত্র। তার জন্য এত আক্রোশ,এত রাগ দেখানোর সত্যিই কি কোন প্রয়োজন ছিল? উত্তর খুঁজে পায়না অয়ন। তলিয়ে যেতে থাকে পুরনো দিনগুলোর স্মৃতিতে, মেলাতে পারে না তার সঙ্গে আজকের বৃষ্টিকে।
ফোনটা কেটে দেবার পর,বৃষ্টি ওর ফেসবুক অ্যাকাউন্টটা ডিলিট করে দিল।আর তাকে কেউ কোথাও খুঁজে পাবে না।চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল অয়নের বইটার ওপর, যার শেষ দুটো পাতা তখনও খোলা :-
“ বৃষ্টি হচ্ছে। ছাদের ঘরে ওরা দুজনে, মুখোমুখি বসে আছে। কেউ কোন কথা বলছে না। তবু,শুধু এই ভেবে তিস্তার আনন্দ হচ্ছে, যে অভি ওর অনেক কাছে আছে। ঠিক তখনই অভি ওর দিকে তাকাল, তিস্তা একটু অপ্রস্তুতে পড়ে গেল। উঠে জানলার কাছে গিয়ে ,বাইরে তাকিয়ে বলল, ‘বৃষ্টির ছাঁট আসছে, জানলাটা বন্ধ করে দিই?’ অভি ওর পাশে এসে দাঁড়াল, কাঁধে হাত রেখে শুধু বলল, ‘না’। এই ‘না’ , যেন কত ‘হ্যাঁ’ হয়ে, তিস্তার কানে বাজতে লাগল। চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেছে।আজ আলো জ্বালা হয়নি, অভির সান্নিধ্যে সব ভুলে গেছে তিস্তা। তবুও মৃদু আলোয় ,স্পষ্ট দুজনে দুজনকে দেখতে পাচ্ছে। অভি অনেক কথা বলে গেল, কিন্তু তিস্তার কানে সেসব কিছুই ঢুকছিল না।শুধু মুগ্ধ হয়ে ওকেই দেখে যাচ্ছিল। ঝড় বৃষ্টির জোর বাড়ল।তিস্তা ভাবছিল, অভি যদি একটু জড়িয়ে ধরত ওকে, তাহলে ওর বুকে একটু মুখ লুকোতে পারত।অনেকদিনের অনেক কান্না, জমে আছে মনে। অভি তিস্তার কাছে ঘেঁষে এল।তিস্তার চুল হাওয়ায় উড়ছে,অভির চোখে-মুখে তারই স্পর্শ,কি এক মাদকতাময় গন্ধ।অভি তিস্তার হাতটা টেনে নিল হাতে। আর ঠিক তখনই দমকা হাওয়ায় হঠাৎ জানলাটা আছড়ে পড়ল। সাড় ফিরল তিস্তার।দেখল কোথায় অভি,কেউ কোথাও নেই! শুধু একরাশ এলোমেলো হাওয়ার সাথে, বৃষ্টির জলের ফোঁটা ভিজিয়ে দিতে লাগল ওকে। হাওয়ার দাপটে,ওর ভাবনাগুলোও সব এলোমেলো হয়ে গেল। জানলার কপাট ডিঙিয়ে, বৃষ্টির জলের সাথে, বহুদূর ভেসে গেল সেই সব কল্পনা । পড়ে রইল শুধু একটা শীতল,নিঃস্ব অনুভূতি।
জানলা দিয়ে বাইরে সব ধোঁয়া ধোঁয়া,দূরে কিছুই প্রায় দেখা যায় না।সব যেন হারিয়ে যেতে চাইছে। অভিও হারিয়ে গেছে,চিরকালের মত।তিস্তাই ওকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।নইলে এই দামাল ,মনকেমন করা ডাক ওকে পাগল ক’রে দিত।তিস্তাকে যে বাঁচতে হবে।
একনাগাড়ে বৃষ্টি হয়েই চলেছে, ছাদে জল জমেছে, ঘরেও জল ঢুকেছে ।ঠাণ্ডা হাওয়ায় তিস্তার শীত করতে লাগল, চাদরটা জড়িয়ে নিল ভাল ক’রে। চারিদিকে ফিসফিসে স্তব্ধতা। দূরে, যতদূরে দেখা যায়, কেউ নেই, কোথাও নেই। অভিই তো নেই। একটা দলছুট সন্ধ্যাপাখি একা একা ঘরে ফিরছে, ডাকতে ডাকতে পশ্চিমে উড়ে গেল। রাস্তায় দু’তিনটে কুকুর ডেকে উঠল, কার বাড়িতে যেন রেডিওতে খবর পড়া হচ্ছে, কান পেতে শোনা যায় দূরে ট্রেন যাবার শব্দ ।হঠাৎ খুব কান্না পেয়ে গেল তিস্তার। নিজের ওপর বড় অভিমান হল,ওর যে কোথাও যাবার নেই,রাস্তাও সব শেষ হয়ে গেছে । এই দু’দিনের জীবনে কি পেল, আর কি হারাল? নিজের কোন কথাটাই যে ও আজ পর্যন্ত , ঠিকঠাক গুছিয়ে বলে উঠতে পারল না। শুধু একবার দেখতে চাইল অভিকে, এছাড়া ওর আর কিছুই চাইবার নেই । কিন্তু অভি তো কখন চলে গেছে ওকে ছেড়ে।ওই অভিকে মুক্ত করে দিয়েছে, ওর জীবন থেকে।স্বাধীন আকাশে অভিকে অনেক ডানা মেলতে হবে,দুনিয়া ওর জন্য অপেক্ষা ক’রে বসে আছে।তিস্তা আজ তাই নিজের সব শূণ্য ক’রে দিয়ে দিয়েছে ।
শুধু পড়ে রয়েছে বোকা শহরটা।তবে,আজ আর ওখানে কোন অবুঝ ,অব্যক্ত প্রেম জমে ওঠে না।কেউ কারো জন্য অপেক্ষা করে না পাগল মন নিয়ে,কবিতা নিয়ে। অভির বাড়ির পাশে, ইউক্যালিপটাস গাছটা এখনও একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ভাল ক’রে লক্ষ্য করলে, ওর পাতার ফাঁকে দেখা যাবে একটা সাদা রঙের কাটা ঘুড়ি। হয়তো উড়ে কোথাও যেতে চেয়েছিল, পারেনি। আর কোনদিন পারবেও না ।এখানেই পড়ে থেকে, তিলে তিলে, ক্ষয়ে ক্ষয়ে, শেষ হয়ে যাবে একদিন। সেই সঙ্গে অনেক কথাও, যা সে বলে যেতে পারেনি কখনও, যে কথা বলা যায় না।
তিস্তার গায়ের চাদর কখন লুটিয়ে পড়েছে ,মেঝেয় গড়াগড়ি খাচ্ছে। সেই সঙ্গে ওর যত ভাবনাও, যা অভিকে দেবে ভেবেছিল। ওর ভাঙ্গা ঘরে, ভিজে রাত নামল। হঠাৎ মনে হল, অভির গলা দূর থেকে ভেসে আসছে। ও যেন বলছে, ‘আমি ফিরে এসেছি। চল, ঘরে যাই।‘ কিন্তু তিস্তা জানে এ মিথ্যে। কারণ জলভাসি পৃথিবীতে,একাকী নিঃসঙ্গ তিস্তার আসলে কোন রাতের বলভি নেই।“

কলমে শুভায়ন বসু, দুর্গাপুর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here