রবীন্দ্রবলয়ে যে সব মহিলা সাহিত্য সাধনার মাধ্যমে বাংলাসাহিত্যাঙ্গনে সমহিমায় ভাস্বর তাদের মধ্যে সরলাদেবী (জন্ম ৯ সেপ্টেম্বর ১৮৭২ ও মৃত্যু ১৮ আগস্ট ১৯৪৫ সাল) অন্যতমা। তিনি পত্রিকা সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক হিসাবে আপন প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। দীর্ঘসময়ের জন্য তিনি তিন দফায় ঠাকুরবাড়ির ভারতী পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করেন । ভারতী পত্রিকার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা পনেরো বছর বয়স থেকে। পনেরো বছর বয়স থেকেই ভারতী পত্রিকাতে লেখালেখি শুরু করেন। ভারতীতে তিনি চল্লিশ বছর লিখেছেন। অন্যান্য পত্রিকাতেও লিখেছেন অনেক।লেখালেখির সূত্র ধরেই তিনি এক সময় ভারতী পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব পান। প্রথমবার হিরন্ময়ীদেবী ও সরলাদেবী যুগ্মভাবে তিন বছর, দ্বিতীয়বার নয় বছর এবং তৃতীয়বার তিন বছর। তৃতীয়বার ভারতী পত্রিকার শেষ সম্পাদক হিসাবে ১৩৩১ থেকে ১৩৩৩ এর কার্তিক পর্যন্ত দায়িত্বে থাকেন।ভারতী পত্রিকা সম্পাদনা ও লেখালেখি ছাড়্ওা তিনি সঙ্গীতাঙ্গনে এবং দেশাত্মবোধ, স্বদেশপ্রেম ও নারীশিক্ষা প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।সরলাদেবী রবীন্দ্রনাথের ভাগিনেয়ী ও স্বর্ণকুমারীদেবীর কন্যা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ বেথুন কলেজ থেকে ইংরেজি অনার্সে মেয়েদের মধ্যে প্রথম হওয়ায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে পদ্মাবতী স্বর্ণপদক প্রদান করে। সংখ্যার দিক থেকে তিনি ছিলেন সপ্তম মহিলা গ্রাজুয়েট।রবীন্দ্রনাথের বোন স্বর্ণকুমারীর গুণবতী দুই কন্যা হিরন্ময়ী ও সরলা ঘোষাল বংশের মেয়ে হয়েও ঠাকুরবাড়ির মেয়ে হিসাবেই সর্বজনপরিচিত ছিলেন। বড় বোন হিরন্ময়ী দেবীর মতোই সরলাদেবী জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির শিল্প ,সংস্কৃতি , শিক্ষাদীক্ষা আর সাহিত্যের পরিমন্ডলে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। স্বর্ণকুমারীর মধ্যে যে রাজনৈতিক চেতনা ও দেশভক্তির উন্মেষ দেখা দিয়েছিল তার পূর্ণ বিকাশ ঘটে তাঁর মেয়ে সরলার মধ্যে। সাহিত্য, সঙ্গীত-স্বাদেশিকতার ত্রিধারাকে তিনি বইয়েছিলেন এক খাতে, তবে মনে হয় সঙ্গীত ও সাহিত্য দুটোই তাঁর স্বদেশচেতনার অনুগামী।সরলাদেবীর সাহিত্য সাধনাকে দু’ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এক ভারতী পত্রিকা সম্পাদনা, আর দুই নিজের সাহিত্যকর্ম। এ দুটোতেই তিনি নিজের মেধা, মনন, চিন্তা চেতনা আর সৃজনশীলতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। প্রথমেই ভারতী পত্রিকা সম্পাদনায় তার বিচক্ষণতা ও কৃতিত্বের উপর আলোকপাত করা যেতে পারে।ভারতী এর যুগ্ম সম্পাদিকার পদ থেকে সম্পাদকের দায়িত্ব পাবার পর সরলাদেবী ভারতীকে সার্থক পত্রিকায় রূপদান করতে নিজেকে উৎসর্গ করেন। ভারতী এর জন্য রবীন্দ্রনাথকে একটি সামাজিক প্রহসন লিখতে সরলাদেবী যে সাহসিকতার পরিচয় দেন তার মধ্যেই নিহিত আছে ভারতী এর শ্রীবৃদ্ধিতে তার অবদানের কথা। রবীন্দ্রনাথের সম্মতি না নিয়েই সরলাদেবী কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে বসেন -আগামী মাসে শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি সামাজিক প্রহসন লিখবেন। কাগজ পড়ে রবীন্দ্রনাথের তো চক্ষুস্থির। সে কী! তিনি তো কিছুই জানেন না আর বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়ে গেল! রবীন্দ্রনাথ বকাঝকা করতে লাগলেন,- কেন তুই আমাকে না জানিয়ে বিজ্ঞাপন দিলি? আমি লিখব না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে লিখতেই হলো। সরলা ভারতী এর নতুন সম্পাদিকা, তাঁকে বিপদে ফেলতে তাঁর মন চাইল না। তিনি লিখে ফেললেন তার বিখ্যাত প্রহসন চিরকুমারসভা। এ জন্য সরলাদেবীকে দোষ দেয়া যায় না,কারণ তিনি বালক, সাধনা,পুণ্য এর মতো ‘ভারতী’ শুধু ঠাকুরবাড়ির কাগজ হয়ে থাকুক সেটা চান নি। সম্পাদিকা হিসাবে ভারতী এর উৎকর্ষতা সাধনের জন্য তিনি সচেষ্ট হন মনেপ্রাণে। লেখকদের সম্মানী ভাতা দেবার প্রথা চালু করেন। তিনি যশষী লেখকদেরকে খুঁজে বের করতে কুন্ঠাবোধ করেন নি। এ প্রসঙ্গে এখানে একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। শরৎচন্দ্র তখন বর্মায় থাকেন। গল্প লেখা শুরু করেছেন। সে সময তিনি তার মামা সুরেন গঙ্গোপাধ্যায়ের মাধ্যমে তার লেখা বড়দিদি গল্পটির পান্ডুলিপি প্রবাসী পত্রিকাতে পাঠান। প্রবাসী সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সেটা অমনোনীত রচনা বলে ফেরত দেন। সুরেন গঙ্গোপাধ্যায় গল্পটা ভারতীতে জমা দিলে সরলাদেবী গল্পটা পড়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বললেন,চমৎকার। তিনি বড়দিদি গল্পটি ধারাবাহিক ভাবে ভারতীর বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় সংখ্যায় ছাপালেন । সরলাদেবী ভারতী এর বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, সংখ্যায় গল্পকারের নাম ছাড়াই বড়দিদি গল্পটি প্রকাশের ব্যবস্থা করলেন। অনেক পাঠকই ভাবলেন গল্পটি রবীন্দ্রনাথের লেখা। বিস্মিত রবীন্দ্রনাথ জানালেন লেখক তিনি নন, তবে গল্পটি কোন সৃজনশীল লেখকের লেখা। তিনিও কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। ঔৎসুক্য প্রকাশ করলেন গগনেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ ও আরো অনেকেই। লেখকের নাম না থাকায় বড়দিদি গল্পটি ক্রমশ কৌতূহল বৃদ্ধি করলো এ গল্পের লেখক তবে কে? ভারতী এর আষাঢ় সংখ্যায় গল্পের লেখক হিসাবে শরৎচন্দ্রের নাম ছাপা হলো। ফলশ্রুতিতে শরৎচন্দ্রের প্রতিষ্ঠা সহজ হয়ে গেল। তিনি শুধুমাত্র নতুন লেখকদের লেখায় ভারতীকে ঋদ্ধ করেন নি,ভারতীকে সমৃদ্ধ করেছিলেন কয়েকজন মনীষীর দুর্লভ ইংরেজি রচনার বঙ্গানুবাদ ছাপিয়েও। যাদের ইংরেজি রচনার বঙ্গানুবাদ ছাপানো হয়েছিল তার মধ্যে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, ভগিনী নিবেদিতা, মহাদেব গোবিন্দ রানাডের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।সরলাদেবী ভারতীতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস,রম্য রচনা, সাহিত্য সমালোচনা ,অনুবাদ ও স্মৃতিকথা লিখেছিলেন। তার শেষ জীবনে লেখা জীবনের ঝরা পাতা রচনা তার অসাধারণ স্মৃতি কথা। জীবনের ঝরাপাতাকে সে যুগের দর্পণ বললে বেশি বলা হবে না। তাঁর লেখা সংস্কৃত কাব্য সমালোচনামূলক প্রবন্ধ রতিবিলাপ, মাধবীমাধব, মালবিকাগ্নিমিত্র, মৃচ্ছকটিক ইত্যাদি উচ্চ প্রশংসা লাভ করে। সাহিত্য স¤্রাট বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায় শ্রীশ মজুমদারকে এ প্রবন্ধগুলো দেখিয়ে বলেছিলেন- লেখিকার বয়স বিবেচনা করলে বলতে হয় ও বয়সে আমাদেরও অমন লেখা সহজ হতো না। তাঁর সমালোচনা পড়ে নাটকগুলো আবার পড়ছি।সরলাদেবীর মৌলিক রচনার মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় প্রেমিক সভা— লেখকের নাম হীন লেখাটি বেশ প্রশংসা লাভ করে। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং অভিনন্দন জানিয়ে ভাগ্নিকে লিখলেন- নাম দিসনি বলে তোর এ লেখা ঠিক যাচাই হল। নতুন হাতের লেখার মতো নয়, এ যেন পাকা প্রতিষ্ঠ লেখা। এ যদি আমারই লেখা লোকে ভাবত, আমি লজ্জিত হতুম না। রবীন্দ্রনাথের এ প্রশংসা সরলাদেবীর জন্য বড় পাওয়া তা বলাইবাহুল্য। এ ছাড়াও তিনি বেশ কয়েকটি সুখপাঠ্য উপন্যাস ও গল্প লেখেন। এ প্রসংগে অনাথবন্ধু গল্প ও নববর্ষের স্বপ্ন উপন্যাসের কথা বিশেষভাবে বলতে হয়।সত্যিকথা বলতে আজও সরলাদেবীর সব রচনার কোন সংকলন প্রকশিত হয় নি। তবে সম্প্রতি কলকাতার দে’জ পাবলিকেশন থেকে শঙ্করপ্রসাদ চক্রবর্তীর সংকলন ও সম্পাদনা সরলাদেবী চৌধুরাণী রচনা সংকলন প্রকশিত হয়েছে। প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য বইয়ের দেশ এপ্রিল- জুন ২০১২ সংখ্যায় সরলাদেবী—- সাহিত্য: অস্বচ্ছ ও অপূর্ণ সম্পাদনা নামের প্রবন্ধে উল্লিখিত সংকলনটি সম্বন্ধে বলেছেন,- সরলা দেবীর প্রায় হারিয়ে যাওয়া রচনাগুলি সংগ্রহ হাতে পাওয়া এক বড় প্রাপ্তি। পুরনো বই বা সাময়িকপত্রের পৃষ্ঠা থেকে তুলে আনা এই রচনা সংগ্রহ করা অভিপ্রেত ছিল। কিন্তু অগ্রন্থিত লেখা তো কিছুই সংকলিত হয়নি এই সংগ্রহে।- – – – – সরলাদেবীর কত বিচিত্র অজ¯্র অগ্রন্থিত লেখা ছড়িয়ে আছে বাংলা পত্রপত্রিকায়! ( বইয়ের দেশ — এপ্রিল- জুন ২০১২, পৃষ্ঠা ৩৯ ও ৪১) অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য এ প্রবন্ধের আলোকে বলতে হয় সরলাদেবীর লেখার নিবার্চিত সংকলনের পরিবর্তে তাঁর সমস্ত লেখার পূর্ণাঙ্গ সংকলন প্রকাশ করা আশু প্রয়োজন, তা নইলে অগ্রন্থিত লেখাগুলো চিরতরে হারিয়ে যাবে।সরলাদেবীর সঙ্গীত সাধনা সম্পর্কে আলোচনা না করলে তাঁর বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যাবে না। সরলা দেবী অল্প বয়স থেকেই সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগী ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গানের স্বরলিপি করা ছাড়াও তিনি কয়েকটি গানকে য়ুরোপান্বিত করলে কবি খুশি হন। – সকাতরে ঐ কাঁদিছে গানটিকে সরলা যখন রীতিমতো একটা ইংরেজি বাজনার ‘ ঢ়রবপব’ এ পরিণত করলেন তখন সেটা পুরোদস্তুর ব্যান্ডে বা পিয়ানোতে বাজাবার যোগ্য হল। উৎসাহিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বললেন ‘ নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গে’র পিয়ানো সংগত তৈরি করতে। সেও হল। সরলার বযস তখন মাত্র বারো। কবি তাঁকে জন্মদিনে উপহার দিলেন একটা য়ুরোপীয় গান লেখার খাতা। দিয়ে বললেন,‘ এইতে লিখে রাখ, ভুলে যাবে।’ ( ঠাকুরবাড়ির অন্দর মহল—- চিত্রাদেব , পৃষ্ঠা—১৬৪)রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সরলার সঙ্গীত চর্চায় মুগ্ধ হয়ে তাকে হাফিজের একটি কবিতায় সুর দিতে দেন। এক সপ্তাহ পরে সরলা হাফিজের সেই কবিতায় সুর বসিয়ে মহর্ষিকে গেয়ে শোনালেন। মহর্ষি গান শুনে বিমোহিত হলেন। সরলার গান শুনে শুধুমাত্র খুশিই হলেন না তাকে পুরস্কৃতও করলেন।“ এক হাজার টাকা দামের হীরে—চুনি সেট করা জড়োয়া নেকলেস। ঘরোয়া সভায় নেকলেসটি সরলার হাতে তুলে দিয়ে মহর্ষি বললেন- তুমি সরস্বতী! তোমার উপযুক্ত না হলেও এই সামান্য ভূষণ এনেছি তোমার জন্য।( প্রাগুক্ত—পৃষ্ঠা –১৬৪ ও ১৬৫) গান লেখা, গান সংগ্রহ ও গানে সুরারোপ করায় তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের¯েœহধন্যা ইন্দিরা দেবী তাঁর লেখা রবীন্দ্রসঙ্গীতের ত্রিবেণী সঙ্গমে বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে সরলা বাউল গান ও দক্ষিণ ভারতীয় সঙ্গীতে ভরা একটি গানের ডালি রবীন্দ্রনাথকে উপহার দিয়েছিলেন। কবি সেই গানগুলোকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে অনেক নতুন গান সৃষ্টি করেছিলেন।সরলার দেয়া সুরে রবীন্দ্রনাথ নিজের কথা বসিয়ে যে গান রচনা করেন সেগুলো হচ্ছে, – আনন্দ লোকে মঙ্গলালোকে—-এসো হে গৃহদেবতা, এ কি লাবণ্য, চিরবন্ধু চির নির্ভর ইত্যাদি। নিজের লেখা শতগান বইটিতে সরলাদেবী সঙ্গীতচর্চায় কতটা নিবেদিত ছিলেন তার প্রমাণ মেলে।সরলাদেবীর দেশাত্মবোধ, স্বদেশপ্রেম ও নারীশিক্ষা প্রসারে অগ্রণী ভূমিকার কথা না বললেই এ লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। প্রকৃতপক্ষে, সরলাদেবীর জীবনে সাহিত্য ও সঙ্গীতের চেয়ে সবচেয়ে বড় ছিল স্বদেশপ্রেম। সাহিত্য ও সঙ্গীত তাঁকে স্বদেশ—হিতৈষণার পথে সাহায্য করেছিল। সরলার মধ্যে স্বদেশচেতনার আগ্রহ জাগিয়েছিলেন তাঁর বাব জানকীনাথ এবং মা স্বর্ণকুমারী। জানকীনাথ ছিলেন ভারতীয় কংগ্রেসের অন্যতম নেতা, আর অন্যদিকে, স্বর্ণকুমারী প্রথমে হিন্দুমেলায় যোগ দিয়ে মেয়েদের মধ্যে সর্বপ্রথম স্বদেশিয়ানার সূচনা করেন। সরলা সরাসরি রাজনীতিতে আসেন। ১৮৯৫ সালে ভারতীর মাধ্যমে বাঙালি যুবমানসেকে বীর্যমন্ত্রে দীক্ষা দেবার চেষ্টা করেন। সরলাদেবী স্কুল কলেজের ছেলেদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে বেছে নিয়ে এক একটা দল গড়লেন। ভারতবর্ষের মানচিত্র তাদের সামনে রেখে প্রতিজ্ঞা করাতেন তনু মন দিয়ে ভারতের সেবা করার। শপথ করার শেষে তাদের হাতে একটা রাখি বেঁধে দিতেন তাদের আত্মনিবেদনের সাক্ষী হিসাবে। কয়েক বছর পরে এই লাল সুতোর রাখিবন্ধন দেশময় ছড়িয়ে পড়লো। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের আন্দোলনের দিনে রবীন্দ্রনাথের জন্য রাখিবন্ধন নতুন মাত্রা পেল। হিন্দু মুসলমান নির্বিশষে সবার হাতে তিনি পরিয়ে দিলেন রাখি মিলনের প্রতীক হিসাবে।।ভারতী সম্পাদনার সূত্রে সরলার সাথে পরিচয় হয় স্বামী বিবেকানন্দ ও ভগিনী নিবেদিতার। স্বামীজী চেয়েছিলেন সরলা বিদেশ যাবে ভারতীয় নারীর প্রতিনিধি হয়ে প্রতীচ্যের মেয়েদের শোনাবে প্রাচ্যের আধ্যাত্মিক বাণী। স্বামীজী নিবেদিতার কাছে বারবার সরলার স্বদেশপ্রেমের প্রশংসা করেছিলেন। ভারতের নির্যাতীত, নিপীড়িত মানুষের মুক্তিকামী এক অগ্নিশিখা ভগিনী নিবেদিতার অনুপ্রেরণায় সরলাদেবী কলকাতার প্রতাপাদিত্য উৎসবে সভানেত্রীর আসন গ্রহণ করেন সরলাদেবী। বৃটিশের রাজত্বকালের সেযুগে একজন বঙ্গললনার পক্ষে প্রকাশ্য জনসভায় সভানেত্রীর আসন অলংকৃত করে জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য পেশ করা সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। চরম সাহসিকতা আর মনোবলই এমন কাজে ব্রতী হতে সরলাদেবীকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। সেদিনের সাহসী ভূমিকার জন্য সরলাদেবীকে বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয় নি। বরং কলকাতার খবরের কাগজগুলোতে প্রশংসার বাণী উচ্চারিত হয়েছিল এভাবে— কলিকাতার বুকের উপর যুবক সভার একটি মহিলা সভানেত্রীত্ব করিতেছেন দেখিয়া ধন্য হইলাম।এক পর্যায়ে সরলাদেবী স্বদেশিকতার বিশাল কর্মযজ্ঞে সরাসরি ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯০৫ সালের কংগ্রেস অধিবেশনে তাঁর নিজের গান নমো হিন্দুস্থান গাওয়া হলে প্রবল উদ্দীপনা ছড়িয়ে পড়ে। এ যেন রুদ্রবীণার ঝংকার! বিবেকানন্দের আলমোড়া আশ্রমের অধিনেত্রী মিসেস সেভিয়ার গান শুনে সরলাকে বলেছিলেন- আর কিছু না, শুধু যদি জাতীয় গান গেয়ে ফেরো তুমি ভারতের নগরে নগরে গ্রামে গ্রামে, সমস্ত দেশকে জাগাতে পারবে।সরলাদেবী বিদেশী জিনিস বর্জন করে স্বদেশী জিনিস ব্যবহারের জন্য সক্রিয় আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। অন্যেরা উচ্চবিত্ত শ্রেণির মহিলাদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে তেমন সারা না পেলেও সরলাদেবী কিন্তু তাদের কাছ থেকে ভালই সারা পেয়েছিলেন। তিনি গড়ে তোলেন লক্ষ্মীর ভান্ড্রা স্বদেশী জিনিস ব্যবহার ও প্রচার করার উদ্দেশ্যে। লক্ষ্মীর ভান্ডারে বিক্রির ব্যবস্থা করলেন বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সংগ্রহ করা শুধু মেয়েদের ব্যবহারের জন্য স্বদেশী কাপড় ও জিনিসপত্র। তিনি নিজেও স্বদেশী দ্রব্যসামগ্রী ব্যবহার করতে শুরু করলেন। দেশী তুলট কাগজে ভারতীপত্রিকায় মলাট দেবার ব্যবস্থা করলেন। কোন উৎসবে যেতে হলে সরলাদেবী আপাদমস্তক স্বদেশী বেশভূষায় সেজে লক্ষ্মীর ভান্ডার পরিচালনা উপলক্ষে পাওয়া স্বদেশী মেডেলটি দিয়ে তৈরি করা ব্রোচটি কাঁধের কাছে লাগিয়ে যেতেন। তাঁর সম্পাদিত ভারতী ্এবং সরযূবালা দত্তের ভারত মহিলা পত্রিকা মেয়েদেরকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। স্বদেশী— আন্দোলনে সরলাদেবীদের মতো মেয়েদের গৌরবময় ভূমিকার জন্যই নাটোরের মহারাণী গিরিবালা দেবী, অবলা বসু, সরোজিনী বসু বা বঙ্গলক্ষ্মী, ননীবালা দেবী, দেশবন্ধুর বোন ঊর্মিলা দেবী,শ্রীঅরবিন্দের ভাইঝি লতিকা ঘোষ প্রমুখ এগিয়ে আসেন রক্ত শপথ নিয়ে।সরলাদেবীর বেশি বয়সেই বিয়ে হয়। বিয়ের ব্যাপারে প্রথম দিকে সরলার আগ্রহ ছিল না। স্বদেশপ্রেমিকা তেজস্বিনী মেয়েকে দেশের কাজে কুমারী রাখার আগ্রহ ছিল স্বর্ণকুমারীরও। এমনকি মহর্ষিও প্রস্তাব করেছিলেন সরলার বিয়ে হবে খাপখোলা তলোয়ারের সঙ্গে। ফলে বয়স বাড়ে। ১৯০৫ সালে শেষে যার সঙ্গে সরলার বিয়ে হল তিনি সত্যিই সরলার যোগ্য স্বামী, পাঞ্জাবের বিপ্লবী নেতা খাপখোলা তলোয়ারের মতো তেজস্বী রামভজ দত্ত চৌধুরী। ( প্রাগুক্ত— পৃষ্ঠা ১৬৮) বিয়ের পর সরলাদেবী পরিচিত হন সরলাদেবী চৌধুরাণী হিসাবে। বিয়ের পর সরলাদেবী চৌধুরাণী হয়েও তিনি পাঞ্জাবে স্বদেশী আন্দোলন ও সমাজ সেবামূলক কাজ থেকে বিরত হন নি। লাহরে প্রায় পাঁচশ জন বাঙালি যুবক সংগ্রহ করে তিনি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন। তিনি ওখানে ভারত স্ত্রী মহামন্ডল প্রতিষ্ঠা করেন। নারীর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় এ সংগঠনটি বিশেষ ভূমিকা রাখে। ব্রিটিশ সরকার হিন্দুস্থান পত্রিকার সম্পাদক ও স্বত্বাধিকারী রামভজের ওকালতির লাইসেন্স বাতিল করে দেবার হুমকি দিলে রামভজের উপযুক্ত সহধর্মিণী হিসাবে সরলাদেবী চৌধুরাণী ওই পত্রিকার সম্পাদক ও স্বত্বাধিকারী হন। হিন্দুস্থান পত্রিকার ইংরেজি সংস্করণে সরলা তাঁর জ্বালাময়ী বক্তব্য প্রকাশ করতে থাকেন। রৌলট এ্যাক্ট চালু হলে ‘হিন্দুস্থান’ বন্ধ করে প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হয়। অন্যদিকে ,রামভজকে নির্বসিত জীবনযাপন করতে হয়। একাকিনী সরলা শক্ত হাতে হাল ধরে পাঞ্জাবের বিদ্রোহকে পরিণতির দিকে নিয়ে যান। পাঞ্জাবের ব্রিটিশদের অত্যাচার চরমে উঠে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডে।পরবর্তী পর্যায়ে সরলা মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। চরকা ও খদ্দর প্রবর্তনে তিনি গান্ধীজীর ডান হাত হিসাবে কাজ করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর সরলাদেবী চৌধুরাণী নিজেকে সমাজসেবামূলক কাজে ব্যপৃত করেন।সাহিত্য-সঙ্গীত-স্বদেশিকতার ত্রিধারার এক মূর্ত প্রতীক সরলাদেবীর সমগ্র কর্মকান্ড ও সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা আজকের দিনে একান্ত জরুরী। কালের করালগ্রাসে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারীর জীবনের সাহিত্য-সঙ্গীত-স্বদেশিকতার ত্রিধারা যেন হারিয়ে না যায় এটাই ঐকন্তিকভাবে কাম্য।
কলমে মনোজিৎকুমার দাস, লাঙ্গলবাধ, মাগুরা, বাংলাদেশ।