অঙ্কন: মৌসুমী কুন্ডু

“আরে এত সকাল সকাল কান মাথা ছালাপালা করতে চলে এলো কারা?”…
বিছানায় শুয়ে শুয়েই চেঁচিয়ে উঠলো ভবানী।
পাশ থেকে জয়া বলল – আরে মাগী আর কত ঘুমাবি? উঠে এসে দেখ।
ঘুম জড়ানো চোখে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে উঠে এল ভবানী। নিচে তখন সে কি জোগাড়।
ঢাক বাজিয়ে শাঁখ বাজিয়ে ধুপ ধুনা নিয়ে কত লোক দাঁড়িয়ে। ভবানীর এখানে বেশিদিন হয়নি ওই আট নয় মাস হবে তার এই পৃথিবীতে ঢোকার। তাই এসব ব্যাপারে বেশি কিছু জানে না সে। চোখ দুটো কচলে নিচে তাকিয়ে ভবানী বলল – তা হ্যাঁ রে। এসব কি? এত আয়োজন করে কি লাগাতে এসেছে?
জয়া ভবানীর মাথায় একটা চাঁটি মেরে বলল – মাগীর খালি ওসব ভাবনা। বসাক বাড়ির দুর্গাপুজো। তাই মাটি নিতে এসেছে। মা দুর্গা কি এখানের মাটি ছাড়া হয়।
– ও বুঝলাম। তাই এত জাঁকজমক। নয়ত এ পাড়ায় তো এদের মুখ ঢেকে আসতে দেখেছি।
– চ’না নিচে যাবি? দেখে আসি। ওই মাটিতে আমাদের ও অধিকার আছে।
– বলছিস? আছে আমাদের অধিকার? চ তাহলে আজ বাওয়াল করব।
– তোর বিশ্বাস নেই। তুই কি করতে কি করবি? থাক তোকে যেতে হবেনা।
– কেন? যাবনা কেন? ওই মাটিতে আমারও অধিকার আছে।
– আজ একটা গন্ডগোল পাকাবে মাগিটা।
জয়ার হাতটা ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিচে নামল ভবানী।
মন্দাকিনী তখন বসাক বাবুর কর্তা সুবিমল বসাককে মাটি দিতে ব্যাস্ত।
এমনিতে ভবানী খুব মুখকাটা মেয়ে। আর মন্দাকিনীর খুব প্রিয় একজন। নিজের মেয়ের মত করে ভালোবাসে মন্দাকিনী ভবানীকে।বাপ বিক্রি করে গেছে মেয়েকে এই আট নয় মাস আগে।তাই মায়া হয় মন্দাকিনির।
– ও মা। এ বাবুরা মাটি নিতে এসেছে। আমাদের কি দেবে?
মন্দাকিনী হেসে বলে – ভবানী এই বাবুদের জন্যই তো এ পাড়ার এত নাম। তা না হলে এনাদের যা কাম। দিনে চার পাঁচটা মেয়ে রেপ হয়ে মরত দেখতিস যদি আমরা না থাকতাম।
ভবানি মুচকি হেসে বসাক বাবুর দিকে তাকিয়ে বলে – এ বাবুকেও তো কতবার ঘরে ঢুকিয়েছি।আর উনি আমার……..
ভবানীকে থামিয়ে দিল বসাক বাবু। – আঃ কি সব বলছে মন্দাকিনী তোমার মেয়ে। একটু মুখে লাগাম লাগাও।
পাশের বসাক বাবুর পরিচিত লোকেরা একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করে আবার মুখটাকে ভবানীর দিকে করে চোখ বের করে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল।
মন্দাকিনী কিছু বলার আগেই আবার ভবানী বসাক বাবুর গালটা টিপে দিয়ে বলল – বাবাহ। এখন বলছে মুখে লাগাম লাগাতে আর বিছানায় আওয়াজ না পেলে ওনার আবার দাঁড়ায় না।
মন্দাকিনী এবার ভবানীকে থামিয়ে বলল – এবার থাম ভবানী। যে কাজের জন্য এসেছে সেই কাজটা আগে সেরে নিতে দে ওনাকে।
ভবানী আর কিছু না বলে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
বসাক বাবু মাটি নিতে নিতে বলল – বাবাহ মন্দাকিনী কাকে মেয়ে করেছ? একটুও বড়দের সম্মান দেয়না।
মন্দাকিনী এবার জোড়ে জোড়ে হেসে উঠল।
– সম্মান? তা এই এক দিনটা ছাড়া আর কোনদিন আপনারা আমাদের সম্মান করেন বসাক বাবু? সম্মান পেলে নাহয় সম্মান করাটা শিখতাম।
বসাক বাবু এবার রেগে বললেন – তা বাপু। কি মুখ হয়েছে তোমাদের? দাও দাও মাটিটা দাও। মায়ের গায়ে এই মাটি লাগবে বলে এ পাড়ায় এলাম। তা না হলে এ পাড়ায় আবার মানুষ আসে নাকি!
বলেই একবার করুণ মুখে মন্দাকিনী ও ভবানীর দিকে তাকিয়ে নিলেন।আর আশে পাশে তাকিয়ে দেখে বুঝিয়ে দিলেন তিনি এই পাড়ায় নতুন।
ভবানী একটু এগিয়ে এসে বলল – বসাক বাবু।বসাক বাড়ির পুজোর অনেক নাম। যখন আমি ওই বাইরের জগতে থাকতাম তখন আপনাদের বাড়ি পুজো দেখতে যেতাম বাবা মায়ের সাথে। এখন তো আমি ভিন গ্রহের অচ্ছ্যুৎ মানুষ। আমাদের মাটির পরিবর্তে একটু সম্মান যদি দেন এবছর অষ্টমীর অঞ্জলিটা আপনার বাড়ির মায়ের সামনে দিতে চাই।
বসাক বাবু তো একেবারে শিব শিব করে উঠলেন। তার সারা শরীর যেন এক ঝটকায় হাই ভোল্টেজ কারেন্ট খেয়ে নড়ে উঠলো।
– একি কথা। সর্বনাশ একটু মাটির এত বড় দাম দিতে হবে? তোমার মাটি তুমিই রাখো মন্দাকিনী। আমি কালিঘাট থেকে মাটি নিয়ে আসব।
মন্দাকিনী ভবানীর দিকে তাকিয়ে বলে – কেন মা এসব? আমাদের কি আর এত সহজে সম্মান দেওয়া যায় বল। আর কেড়ে কি সম্মান নেওয়া যায়?
ভবানী বলে – কেন মা? সম্মানের কি এতই দাম?
– হ্যাঁ মা। সম্মানের অনেক দাম। আর এসব মানুষ তার দাম চোকাতে পারবে না।
ভবানী আর কিছু না বলে কোমড়ে হাত দিয়ে আর একবার বসাক বাবুকে ওপর থেকে নিচে অবধি মেপে নিল।
বসাক বাবু একটা পাঁচশ আর একটা এক টাকার কয়েন বের করে মন্দাকিনীর হাতে দিয়ে বললাম – এই দাম দিলাম। আর কিছু পাওনা রইল না।
মন্দাকিনী হেসে বলল – দাম? কিসের? মাটির না আপনাদের পাপ নেওয়ার বসাক বাবু।এই মাটির দাম কোনদিন মেটাতে পারবেন না আপনারা। কারণ এ মাটি পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র এলাকার মাটি। সারা বিশ্ব থেকে লোক এখানে নিজের পবিত্রতা ঢেলে যায়। বুঝলেন?
বসাক বাবু এবার একটু ইতস্তত হয়ে বললেন – আচ্ছা হয়েছে। এবার আসি তাহলে।
মনে মনে বলল – আবার পবিত্র দেখাচ্ছে। পাপে ডুবে আছে সকলে আবার পবিত্র মারাচ্ছে।
কানে হালকা করে গেল কথাটা মন্দাকিনির।
মুচকি হেসে বলল মন্দাকিনী – এটা মুখের উপর বলার সাহস নেই। তাই না? পাপী আমরা নয় বাবু।পাপী আপনারা। মুখ লুকিয়ে কোন কাজ মানেই পাপ। আমরা বুক ফুলিয়ে শরীর বেচে খাই। আর আপনারা মুখ লুকিয়ে শরীর কিনে যান। আপনারা এখানে পূন্য দিয়ে পাপ নিয়ে যান বাবু। তাই এখানের মাটি এত পূন্য যে মায়ের শরীরে এই মাটি না দিলে তার রুপ আসেনা।

আর কোন কথা বলেনা বসাক বাবু। মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে গিয়েও একবার মুখ ফিরিয়ে মন্দাকিনীকে বলে – অষ্টমীর লুচি আলুর দমটা এবছর আমার বাড়িতেই খেও। নিমন্ত্রণ রইল সবার।
ঢাকের আওয়াজ বেড়ে যায়। শাঁখের আওয়াজ আরও দৃড় হয়। মন্দাকিনী আর ভবানী ভিজে চোখে সম্মানের দিকে তাকিয়ে থাকে।

 

কলমে রাজকুমার মাহাতো, কলকাতা

নিজের লেখার মাধ্যমে আপনাদের মন জয় করতে চাই। আপনার সাথে থাকবেন পাশে থাকবেন।

নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার ২০২০ তে দ্বিতীয় পুরস্কার জয়ী। 


 

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here