ডানপিটে মেয়ে হিসাবে পাড়ায় একটা বদনাম আছে তিথির।সেদিন বাবার সাথে তাদের পূরানো ভাঙাচোরা বাজাজ এম.এইটিতে চড়ে ব্যাঙ্কে যাচ্ছিল। উ.বি.আই থেকে কন্যাশ্রীতে পাওয়া সামান্য টাকা তুলতেই যাচ্ছিল।বাড়ির যা শোচনীয় আর্থিক অবস্থা তাতে করে তার তার উচ্চস্তরের পড়াশোনা সম্ভব হবে কিনা সে সেটাই ভাবছিল।এরই মধ্যে কখন যে তারা পুরাতন বাজারের ট্রাফিকের সামনে চলে এসেছে তার খেয়াল ছিল না।কিন্তু একি ! এখানে মোটর গাড়ির লম্বা লাইন কেন? তার বাবা বললেন,”যে সব মোটর চালকের গাড়ির বৈধ কাগজপত্র, হেলমেট, দূষণ শংসাপত্র নেই তাদের পুলিশ ফাইন করছে।” কিছুক্ষণ পর তারাও লাইনের সর্বাগ্ৰে পৌছাল ।তার বাবা হেলমেট পরেই এসেছিলেন এবং গাড়ির যাবতীয় কাগজপত্র দেখানো সত্ত্বেও পুলিশরা বলপূর্বক অন্যায়ভাবে টাকা আদায় করতে তৎপর হয়ে উঠলো। দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার বললেন”যদি কেস খেতে না চান চুপচাপ তিনশো টাকা দিয়ে কেটে পড়ুন”।নিরুপায় দরিদ্র মানুষটি কোনরকমে দুশো টাকা দিয়ে করজোড়ে এ যাত্রায় রক্ষা পেলেন ।পুরো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তিথির অন্তরে ভীষণ ছ্যাঁকার মতো আঘাত লাগলো।সে ভাবলো কোনরকম অন্যায় না করে  তার বাবাকে হাত জোড় করতে হবে কেন? মিনিট দশেকের মধ্যে তারা ব্যাঙ্কে পৌঁছে গেল। সেখানেও টাকা তোলার লাইনটা বেশ দীর্ঘ ।লাইনের মধ্যভাগে প্রতীক্ষারতা এক বৃদ্ধ তার অবসন্ন শরীর নিয়ে বসেই পড়েছিল।অসহ্য গরমে সবার অস্বস্তির বহিপ্রকাশ স্পষ্ট।এমন সময় কোথা থেকে খাঁকি পোশাক পরিহিত এক ব্যাক্তি যেন খুব ব্যাস্ততার সঙ্গে হাজির হলো।তিথি চিনতে পারলো,এতো সেই পুলিশ অফিসার।দীর্ঘ লাইনে প্রতিক্ষারত লোকেদের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই পুলিশটি উইথড্রয়াল ফর্মটা পূরণ করেই ক্যাশ কাউন্টারের দিকে অগ্ৰসর হলো।তিথির ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল।সে ভাবলো “আমরা এতক্ষন অপেক্ষা করে আছি,আর উনি এখনি এসেই কোন নিয়ম না মেনে সবাইকে বেপরোয়া করে চলে যাবেন।”  তার অন্তর থেকে পুঞ্জীভূত প্রতিবাদের আগুন যেন স্ফুলিঙ্গের মতো বেরিয়ে এল। ওই ঘুষখোর আইন অমান্যকারীর দিকে সে সবেগে ধেয়ে গিয়ে তার হাত থেকে উইথড্রয়াল ফর্মটা কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দিল।
এরপর আগষ্ট মাসের ঘটনা। কৃতি ছাত্রী হিসেবে তিথির বেশ নাম আছে। এবার উচ্চমাধ্যমিকে সে আশি শতাংশ নাম্বারও পেয়েছে। শুধু তাই নয় ছোটবেলা থেকে সে ভীষণ স্পষ্টবাদী এবং স্বাধীনচেতা। আগষ্ট মাসের পনের তারিখ প্রতিবছরের মতো এবারও তাদের পাড়ার ক্লাবে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন উপলক্ষে অনুষ্ঠান হচ্ছিল। অনুষ্ঠান মঞ্চ অলংকৃত করেছিলেন এলাকার বি.ডি.ও সাহেব এবং ঐ পুলিশ অফিসার সহ আরও অনেক পরিচিত ব্যক্তি।  বিডিও সাহেবকে তাঁর মূল্যবান বক্তব্য রাখার অনুরোধ করা হলো। বিডিও সাহেব করজোড়ে সবাইকে নমস্কার জানিয়ে বলতে শুরু করলেন, ” আজকের এই বিশেষ দিনটিতে কত বিপ্লবীর রক্তে আমাদের দেশ স্বাধীনতা পেয়েছিল। আর আজ আমরা এই স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। কিন্তু স্বাধীন মানে এই নয় যে আমরা যা ইচ্ছা তাই করবো। বিশেষ করে মেয়েদের ছোটখাটো পোশাক পরে বাইরে বেরোনো উচিত নয়। রাতে মেয়েদের ঘরের বাইরে না বেরোনোই শ্রেয়। “
বিডিও সাহেবের ভাষণে মুগ্ধ জনতা করতালিতে ভরিয়ে দিল। ভাষণের তাৎপর্য কি সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো ‘কে ভাষণ দিয়েছে’। তাইতো জনগণ অবুঝের মতো হাততালি দিয়ে যায়। প্রতিবাদ করার মতো বাক স্বাধীনতাটুকুও হারিয়েছে তারা।
এরপর মঞ্চে উঠে এলো তিথি। সে প্রতিবছর এই দিনটিতে বক্তব্য রাখে। সবাইকে নমস্কার জানিয়ে সে বলতে শুরু করলো, ” ‘স্বাধীনতা -হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়?’  অনেকেই জানেন এটা কবি রঙ্গলাল বন্দ‍্যোপাধ্যায়ের লেখা কবিতার লাইন। সত্যিই তো সর্বত্র স্বাধীনভাবে বিচরণের অধিকার বা সুযোগ না থাকলে তা বড় কষ্টদায়ক। আমরা জানি আমাদের দেশ স্বাধীন, কিন্তু এখনও সর্বক্ষেত্রে স্বাধীনতা দুর্লভ। কেন মেয়েরা ওদের পছন্দের পোশাক পরে বেরোতে পারবে না? কেনই বা রাতে তারা নিরাপদে ঘরের বাইরে যেতে পারবে না? স্বাধীন দেশে মানুষের স্বাধীনতা এত ক্ষুণ্ণ এবং দুর্বল কেন?”
তিথির এই প্রশ্নগুলো যেন ঐ বিডিও সাহেবের দিকেই ছুঁড়ে দিয়েছিল। এদিকে বিডিও সাহেব নতমস্তকে নিরুপায় হয়ে সব হজম করে যাচ্ছিলেন। কেননা তিনিও জানেন পদাধিকার বলে  থাকা তাঁর মতো ব্যক্তিও জনগণের স্বাধীনতা রক্ষায় ব্যর্থ।
আর তিথির মতো স্বাধীনচেতা মেয়েরা দেশের শাসনব্যবস্থা এবং পদাধিকারের অপপ্রয়োগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এসছে এবং ভবিষ্যতে করেও যাবে।
একবছর আগের একটা ঘটনা এখনো তিথিকে কুরে কুরে খায়। ওর পিসতুতো দিদি মণিকা একটা  বেসরকারী কোম্পানীতে রিসেপসনিষ্টের কাজ করতো। সেদিন কোম্পানি থেকে বাড়ি ফেরার সময় রাত সাড়ে আটটা হয়ে গিয়েছিল। মণিকা অটোতে আসছিল হাইরোডে ধরে। আর দুজন মদ্যপ বাইক নিয়ে ওকে ফলো করছিল। তারপর জোর করে অটো থামিয়ে মণিকার গায়ে হাত দেয়, ওর শ্লীলতাহানি করে। ভীত কাপুরুষ অটোচালক প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি। বাড়িতে ফিরে আতঙ্কিত মণিকা অসুস্থ হয়ে পড়ে। মানসিক ভাবে ও একেবারে ভেঙে পড়েছিল। সারারাত আতঙ্কে কেঁপে কেঁপে উঠছিল। পরদিন তিথি ঘটনাটা জানতে পেরে মণিকাকে নিয়ে পুলিশ স্টেশনে গিয়েছিল অভিযোগ জানাতে। বাইকের নাম্বার সহ অভিযোগপত্র লিখেছিল। কিন্তু বাইকের নাম্বারটা দেখে থানার ও.সি চমকে উঠেছিলেন।  কেননা বাইক আরোহীদের একজন ছিল স্থানীয় এম.এলের লাটলা ছেলের।  এলাকার মানুষজনের অনেকেই এম.এলের ঐ দুরাচারী বর্বর ছেলের চরিত্রে অবগত ছিলেন। এবার মণিকার মতো সাধারণ বাড়ির মেয়েটাও তার লালসার শিকার হতে যাচ্ছিল। সেদিন থানার ও.সি মাথানত করে মণিকা এবং তিথিকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে শীঘ্রই অপরাধীদের শান্তি দেওয়া হবে। কিন্তু উপর মহলের চাপে তিনি আজও সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেন নি।
তিথিরা তো গর্জে উঠবেই স্বাধীন দেশের এই হাত পা বাঁধা আইনের বিরুদ্ধে,  দেশের শাসনব্যবস্থা নামক স্বেচ্ছাচারী পদাধিকারের বিরুদ্ধে। তিথিরা তো আছে খেতে না পাওয়া স্বাধীন দেশের সেই মেহনতি মানুষদের পাশে। তিথিরা আছে সেই অসহায়া মেয়েদের পাশে যারা রাতের আঁধারে নরপিশাচদের লালসার শিকার হয়। তিথিদের প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় মানুষের স্বাধীনতার অধিকার রক্ষায়। কেননা তিথিদের মতো মেয়েরা বড়ই স্বাধীনচেতা।

কলমে অমিত কুমার জানা, খড়্গপুর, পশ্চিমবঙ্গ



 

SOURCEঅমিত কুমার জানা
Previous articleভুবনমোহিনী
Next articleস্মৃতি কনা
Avatar
Disclaimer: Monomousumi is not responsible for any wrong facts presented in the articles by the authors. The opinion, facts, grammatical issues or issues related sentence framing etc. are personal to the respective authors. We have not edited the article. All attempts were taken to prohibit copyright infringement, plagiarism and wrong information. We are strongly against copyright violation. In case of any copyright infringement issues, please write to us. লেখার মন্তব্য এবং ভাবনা, লেখকের নিজস্ব - কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত..................

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here