একটি ছোট্টো সবুজ গোল ফুটকি বলে দেয় আমি জীবিত না মৃত।
আমার জগৎ বলতে আমার বাড়ির ভিতর ছোটো একটা ঘর, হাতে মোবাইল ফোন। ঐ ফোনটিই এখন আমার জগৎ, আমার বন্ধু, আমার আত্মীয়-পরিজন.. সব। কথা খুব একটা বলি না কারো সাথে,, আসলে প্রয়োজন (!) হয় না… যা কিছু দরকার সব ঐ ফোনের মাধ্যমে।
বন্ধু ছিল, আত্মীয় ছিল। হাসি মজা দু:খ ঝগড়া-খুনসুটি মারামারি আড়ি-ভাব যাওয়া-আসা আদান-প্রদান খোলা আকাশ সবুজ ঘাস সবই ছিল, কিন্তু- ডিজিটালের সম্মোহন ছিল না। না:, এখন আর তেমন যোগাযোগ নেই… রাখতে পারিনি… অঢেল সময় অথচ ইচ্ছের অভাব। আমি নিজেই কারো খোঁজ খবর নিই না। শামুক হয়ে গেছি। একটা খোলের ভিতর নিজেকে গুটিয়ে রেখেছি।
কে বললো বন্ধু নেই! প্রোফাইল খুললেই দ্যাখা যাবে বন্ধুর সংখ্যা পাঁচ’শ-হাজার-দুহাজার ছাপিয়ে গেছে। বেশিরভাগকেই দেখিনি কখনো, কথাও হয়নি, তবু ‘বন্ধু’। ভোর থেকে রাত্রি উইশের ছড়াছড়ি… কত রকমের ছবি, ইমোজি… সকলেই ডিজিটাল বন্ধু, এই ডিজিটাল গ্রহে আমরা প্রত্যেকে এক একটি নম্বর মাত্র। সবুজ আলো জ্বলে, যতক্ষণ জেগে থাকি।
মনে পড়ে, পুজোর আগে পোস্টকার্ড, ইনল্যান্ড, খাম এসব গোছা গোছা কিনে এনে রাখতাম, বিজয়ার শুভেচ্ছা জানানোর একমাত্র মাধ্যম ছিল। প্রণাম-আশীর্বাদের কাঁচা-পাকা হাতে লেখা আন্তরিকতার ভারে লাল বাক্সগুলোকে কখনো ন্যুব্জ হতে দেখিনি। হঠাৎ যেন এক ইউ. এফ.ও র মতো ধেয়ে আসা ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্সের প্রবল হাওয়ায় আমরা প্রকৃতি থেকে নিক্ষেপিত হয়ে ভার্চুয়াল জগতে থিতু হলাম। বলা ভালো, বিকেন্দ্রীকরণ বা বিচ্ছিন্নতার পথে আরও একধাপ এগিয়ে গেলাম। ফলত: বান্ধবহীন , শক্তিহীন হয়ে পড়লাম। অসহায়তা ক্রমশ গিলে খেতে লাগলো। এক শ্রেণীর মানুষ এটাই চায়- যত একাকী হবে, আক্রমণ তত সুবিধেজনক হবে…
প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, ভালবাসা প্রভৃতি শব্দগুলো ক্রমশ মিউজিয়ামে স্থান নেবে।
মানবিকতাকে আমরা অনেক দিন আগেই হারিয়েছি। একটা আবর্তে আমরা সকলেই ঘুরছি, ফিরে দ্যাখার সময় নেই কারও। তাই আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যুর দিনে পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে শেষ শ্রদ্ধা বা ভালবাসাটুকু জানাতে ভুলে যাই। অন্তর নিংড়ে যে বা যাঁরা যতদিন পেরেছেন, দূরে থেকেও খোঁজ নিয়েছেন, সেই মানুষটিকে বা তাঁদেরকে মুহুর্তের মধ্যে ভুলে গিয়ে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ি।
পরপর কতকগুলি মৃত্যু আমাকে বড় যন্ত্রণা দিয়ে গেলো। তারা প্রত্যেকেই আমার পরম আত্মীয়। কেউ বয়সে ছোটো, কেউ বা বয়োজ্যেষ্ঠ। ভীষণ ভালবাসতেন আমাকে, আমার পরিবারকে…।
অতীতে, কেউ মারা গেলে শববাহকের অভাব হতো না। বলতেও হতো না কাউকে, তারা ঠিক জুটে যেতো, তারাই সব ব্যবস্থা করে কাঁধে নিয়ে হেঁটে শ্মশানে যেত এবং দাহ করতো। এখন শববাহী শকট এসেছে- শব কাঁধে নেওয়ার লোক কোথায়! বৈদ্যুতিক চুল্লি হয়েছে। দাহও হয়ে যাবে। সবই ডিজিটাল।
সবুজ ফুটকি, -একটি মেসেজ।
সাদা কাপড়ে মোড়া স্তব্ধ প্যান্ডেল, একটি কি খুব বেশী হলে দুটি মুণ্ডিতমস্তকের আচমন থেকে পিণ্ডদান। ধূপ-ধুনো-গীতাপাঠ, সমুখে একটু উঁচু সাদা কাপড়ে ঢাকা টেবিল বা চেয়ারের ওপর একটি ফোটো। ফুলের মালায় ঢাকা পড়ে বোঝা যাচ্ছে না তিনি আমায় দেখে হাসলেন কি না।
আমার চোখ চলে গেলো তাঁর ঠিক পিছনের সাদা কাপড়ের ওপর, কি আশ্চর্য, একটা সবুজ ফুটকি জ্বলজ্বল করছে..! ঐ তো, উনি হাসছেন! হা:হা: করে আমার দিকে তাকিয়ে উনি…
আমারও পালা আসবে। পাশে কেউ নেই! একটা অসহ্য অব্যক্ত যন্ত্রণা আমার গলাটাকে চেপে ধরে রেখেছে…!
হয়তো ততদিনে অত্যাধুনিক ডিজিটাল শববাহী গাড়ি তৈরী হয়ে যাবে। একটি মেসেজ,- বাড়ির সামনে গাড়ি এসে দাঁড়াবে, ভ্যাকুয়াম সিস্টেমে লাশ টেনে নেবে মূল যন্ত্রে। হাড় এবং মাংস আলাদা করে নিয়ে, হাড়গুলো পাউডারের মতো গুঁড়ো হয়ে যাবে আর আমার বাকি অংশটা অন্তর্ধূমপাতনে বিলীন হয়ে যাবে। গাড়ির ড্রাইভার রিসিপ্ট দিয়ে পেমেন্ট নিয়ে ফিরে যাবে। কোনো দূষণ ছড়াবে না। সমস্ত প্রক্রিয়াটায় মাত্র পনেরো থেকে কুড়ি মিনিট সময় লাগবে।
আমি আর নেই। আমার ঘর শূন্য। আমার উত্তরসূরী ঐ ঘর দখল নেবে
সবুজ ফুটকিটা জ্বলেই থাকবে….
কলমে সুশান্ত সিংহ, হুগলি