ভৈরবী নদীর পশ্চিম পাড়ে একঘর অশিক্ষিত সৎ খেটে খাওয়া মানুষ গুলোর বাস।এযাবৎ ওদের মনে বেঁচে থাকার জন্য কারো কাছে কোনো অভিযোগ নেই। নদীর চড়ার বিস্তীর্ণ জায়গায় ছিন্নমূল হয়ে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত মানুষদের স্থায়ী বসবাস সেখানে। নিজেদের ইচ্ছে মতো কাঁচা পথের রেখা টেনে নিজেরাই নির্মাণ করেছে হঠাৎ কলোনী।ওদের বেশির ভাগটাই নদীতে মাছ ধরে,শহরের হাটে বাজারে গিয়ে বেচে আসে। তারপর সারাটা দিন চরকীর মতো ঘুরে, কিংবা গাছের ছাওয়ায় জায়গায় জায়গায় দল বেঁধে, গোল হয়ে বসে তাস পেটাই। চাষ আবাদ করে কিছু ঘর। সবটাই নদীর পলি মাটিতে সবজির ,ফল মূলের চাষ। হাট- জমি – ঘর এই হলো ওদের জীবনের বিস্তার। কেউ কেউ এটা সেটা টুকরো টাকরা কাজ করে দিব্যি আছে । ওদের মধ্যে কারো কারো ছেলে পুলে গুলো দূরের কোন স্কুলে যায় ! আর কোন ক্লাসে পড়ে ওরা কেও খবর রাখেনা। একনজরে স্থান টাই চোখ পড়লে মনে হবে রূপকথার অঞ্চল। এখনো আধুনিকতার আলো সেখানে খুব সামান্যই পড়েছে। আর ওখানেই ,নদীর ধারে খানিকটা পরিত্যক্ত সমান্তরাল জায়গার পাশে বেমানান ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা উঁচু টিলা। ছোট খাটো গাছ গাছালি , ঝোঁপ ঝাড় আকীর্ন সেই টিলায় কারো পায়ের ছাপ সেরম পড়ে না। প্রতি সকালে সূর্য্যের প্রথম আলো এসে পড়লে আচমকাই সেই দৃশ্যে একটা মায়াবী আকর্ষণ লক্ষ্য করা যায়। সবটা মিলিয়ে চাপা চাপা শান্তি রয়েছে ওদের ছোট ছোট ঘরের দুয়ারে দুয়ারে।
দুপুর বেলা মাধব কোত্থেকে এক বারো- চোদ্দ বছরের মেয়ে ধরে এনে কলোনীতে ঢুকল। চলার সময় মাধবের জন্ম পঙ্গু পা টার কারণে , সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে। সনাতন সে দৃশ্য দেখে ,এগিয়ে এসে বলে — এ কে কোথায় পেলি ? তোর তো সংসারে কেউ নেই জানি ! এ কে রে মাধব?
মাধব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে — মেয়েটির পোড়া কপাল ভাই ! ওর বাপটা আমার সঙ্গেই ট্রেনে ভিক্ষে করতো। গত কয়েকদিন আগে তাড়াহুড়ো করে ট্রেন বদল করতে গিয়ে রেলে কাটা পড়েছে! দুটো ভাতের জন্য এই পোড়ামুখী লোকের পায়ে পায়ে ঘুরছিল ।তাই মায়া হলো ! মা- বাপ কোন ছোট বেলায় হারিয়েছি! ওই ভাবে চেয়ে চিন্তে আমিও মানুষ। কথা গুলো মনে পড়তে নিয়ে এলাম !
তা ভালো করেছিস ! ও থাকবে কোথায় ?– জিজ্ঞাসা করলো সনাতন ।
–কেন ! আমার কাছে , আমার ঘরে থাকবে।
— হম ! ওই কুঠুরী তে জায়গা হইবে ?
— ও আমাদের বাপ বেটির জন্য , ও অনেক বড় জায়গা ! কিরে মা হবে না থাকা ?
মেয়েটি মাথা নাড়লো ।
তোমার নাম কি মা ? –জিজ্ঞাসা করলো সনাতন।
মুখ উজ্জ্বল করে মেয়েটি উত্তর দিলো — পূর্ণিমা !
ঘরে উঠতেই কয়েকদিনের মধ্যেই মাধবের কুঁড়ে ঘরের রূপের অনেকটাই বদল হলো । পূর্ণিমার নিয়মিত ঝাঁট ঝাটা আর ঝাড় পোঁচে কুঁড়ে ঘর যেন যৌবন ফিরে পেল। ঘরের বাম দিকে একটা চালা ফেলে মাটির দেয়াল উঠে দেখা দিল রান্না ঘর। ঘরের তাকে উঠে পড়ল দেবতার ছবি। তাতে সক্কাল সন্ধ্যে ধূপ বাতিতে জেগে উঠলো ভক্তি ভাব। যে মাধবের খাওয়া দাওয়ার ঠিক ছিল না সে মাধবের বাড়ি পূর্নিমা এসে পৌঁছালো অন্নপূর্ণা হয়ে। মাধব মাঝে মধ্যেই পূর্ণিমার মাথায় হাত রেখে বলে — কোন জন্মের মা তুই আমার ?
পূর্ণিমা একগাল হেসে জবাব দেয় — এই জন্মের !
হঠাৎ কলোনীর মাঝখান দিয়ে একটা মেঠো পথ দুই ভাগে ভাগ করে দিয়ে গেছে দুই সমাজকে। একপ্রান্তে হিন্দু পাড়া আর ওপাশটা মুসলমান সমাজ। ভেদা ভেদ শুধু ওই পথ টুকুই। তাও পূর্ণিমা আসার পর থেকেই সেটাও বুঝি আর নেই। খুব ভোরবেলা , মাধব ট্রেনে ভিক্ষা করতে বেরিয়ে পড়ল ,সে ছুটে ছুটে চলে। সব ঘরে ,সব মানুষের মনেই ওর অধিকার। ওসমান চাচার ঘরে ঢুকে কখনও কোরান পাঠ শোনে , তসবিহ তেলওয়াত এনে হাতে গুঁজে দেয় । হাসান হোসেন আর দুলদুল ঘোড়ার কাহিনী শুনিয়ে ওসমান হাঁপিয়ে উঠলেও, পূর্ণিমার যেন মন ভরেনা। আবার কখনও ভট্টাচার্য মশায় এর ঘরে ঢুকে লক্ষ্মী পুজোর দুর্বা ,ফুল তুলে, মালা গেঁথে দেয়, পাটায় চন্দনও ঘষে দেয়। তারপর পুজো শেষ হলে ঠাকুর দেবতার গল্প শুনবার জন্য জেদাজেদি করে। একদিন পূর্ণিমা
ভট্টাচার্য মশায়কে জিজ্ঞাসা করে — আচ্ছা ! তুমি কোনদিন ঠাকুর দেখেছো ?
ওর দিকে চেয়ে ভট্টাচার্য মশায় বলল — দেখেছি কি রে ! আমি মা এর সঙ্গে কথাও বলি ?
এ কথা শোনার পর পূর্ণিমা অবাক দৃষ্টি নিয়ে বলে — আমাকে দেখাও ! আমিও কথা বলবো !
ভট্টাচার্য মশায় জোরে হাসি ছেড়ে বলে — ওরে আমার পাগলী রে , তুই তো আমার মা !
এই উত্তরে পূর্ণিমা রেগে বেরিয়ে চলে যায়।
রাস্তার মোড়ে সুজন বৈরাগীর চা এর দোকান । সকাল সন্ধ্যে মানুষজনে একপ্রকার গিজ গিজ করে সর্বদা। বয়েসে অল্প সুজনকে পূর্ণিমা দাদা পাতিয়েছে। একছুটে সেখানে গিয়ে উঠতেই, সুজন ওর রাগি মুখ খানা দেখে বলে — কি রে চটছিস কেন ?
— দেখো না সুজন দা ! ভট্টাচার্য মশায় আমাকে বলে কিনা আমিই ওর লক্ষী মা ?
সুজন একগাল হেসে ফুটন্ত গরম জলে চিনি দিতে থাকে। বেঞ্চে বসা বিশু হালদার বলে ওঠে — ভুল বলেছে ঠাকুরমশাই !
পূর্ণিমা ওদিকে ঘুরে বলে — দেখোনা বিশু কাকা , লোকটা কেমন পাগল !
বিশু একটু মিচকি হাসি দিয়ে বলে — তুই লক্ষ্মী মা না রে তুই মা কালি !
দোকান শুদ্ধ লোক সকলে হেসে উঠল ,পূর্ণিমা রাগে ফুলে ,ভেংচি কেটে , উঠে এক ছুটে বেরিয়ে , দূরে মিলিয়ে যায়। ওর এরম মনের অবস্থা হলে ও নদীর জলে পা ডুবিয়ে বসে।
পূর্ণিমা এখানে মাধবের হাত ধরে এসে নতুন জীবন পেয়েছে। এরা সকলেই তার আপন। কবেকার চেনা মুখ গুলো যেন। আগের জন্মের কিংবা স্বপ্নের মধ্যে এদের সকলকেই সে বুঝি দেখেছে আগে। কলোনীর লোক গুলোরও পূর্ণিমা কে না দেখলে বুঝি চলে না। ওই হয়ে উঠেছে সকলের হৃদয় বন্ধনের সেতু।ওর ছুটে ছুটে চলা, ওর সরল মনে সকলকে আপন করে নেয়া , এসবে নতুন করে প্রাণ পেয়েছে হঠাৎ কলোনী। পূর্ণিমার কাছে হঠাৎ কলোনী টা খুব ছোট একটা পরিবারের মতো। সেখানে কোন ভাবেই ভেদাভেদ নেই।
মাস খানেক পড় কলোনীতে সাজো সাজো রব উঠলো। সব থেকে বড় উৎসবের আয়োজনে কলোনীতে সুব্রত বাবুদের ঘন ঘন পা এর ছাপ পড়তে লাগলো। রং বেরং এর পতাকায় আর হোডিং এ ঢেকে যেতে লাগলো পথের বাঁক বাঁক। রাত হলেই ফোয়ারা উঠলো মদের। এ কটা মাস আর নদীতে মাছ ধরা নেই ! জমিতে হাল পড়লেও কালেভদ্রে ! এখন প্রয়োজন জমায়েত। এ শহর , সে শহর দূরে কোথাও ,সুব্রত বাবুএখন জামাই আদর করে, হঠাৎ কলোনীর লোকেদের নিয়ে যাবে। হাতে পয়সা আর খেতেও দেবে । কাজ খুব কঠিন নয় !বাঁশের ব্যারিকেডের ভেতর বসে থাকতে হবে ঘন্টার পর ঘন্টা মঞ্চের দিকে চেয়ে। কখনও সখনো রাস্তায় পতাকা ধরে হেঁটে যেতে হবে। একবার দুবার রাজনৈতিক স্লোগান আউড়াতে হবে। এছাড়া তাদের কিছু বলবার বা করবার নেই । এমনকি বুঝবারও নেই। কেবল মিছিলে পা মেলাও, ভিড় বাড়াও ।
মাধব এসবে পা মেলায় না। সে যেন এক অন্য ধাতুতে গড়া।সেদিন সন্ধ্যে বেলা ওসমান মাধবের কুঁড়ের সামনে এসে বলে — মাধব আছো নাকি হে ?
মাধব তখন কুঁড়ের পিছনে শুকনো কাঠ ভাঙছিল রাতের রান্নার জন্য ।পূর্ণিমা চৌওকাঠের সামনে থেকে ছুটে কুঁড়ের পিছনে যায়। তারপর বলে — বাবা ! ওসমান চাচা ডাকছে !
পূর্ণিমা মাধবকে বাবা বলেই ডাকে। এ ডাকে দুজনেরই তৃপ্তিতে বুক ভরে যায়।মাধব ফিরে এসে বলে — আরে ওসমান ভাই! বসো বসো ! কি ব্যাপার ?
পূর্ণিমা ঘরে চলে যায়।তারপর কেরোসিনের বাতি খানি এগিয়ে দেয় উঠোনে। উঠোনে বসে ওসমান বলে — ভাইজান ! জানোই তো ভোটের খেলা ! প্রতিবার ওই এক ! দিন কে দিন আমারা সকলে পড়ে থাকছি অন্ধকার, নোংরা বস্তিতে আর ওই সুব্রত বাবুদের দল, ভোটের মুখে কটা টাকা আর মদের লোভ দেখিয়ে ভোট কিনে নিচ্ছে। না আছে ইলেক্ট্রিকের আলো , রাস্তা, না আছে জল ! জানোয়ারের মতো বেঁচে আছে এখানে সকলে।
মাধব বললো — সবই তো জানি । কিন্তু আমরা দুজনে করবো কি ? ওই পাড়া শুদ্ধ লোক ভোটের আনন্দে নাচছে !
— দেখো ভাইজান ! তোমার বাইরে যাতায়াত আছে , পাঁচ টা লোক তুমি দেখেছো। ভালো মন্দের বিচার এই বস্তির লোক গুলোর থেকে তুমি ভালোই বোঝো ! একটু উঠে পেড়ে লেগে পড়। এবার এর একটা বিহিত চাই!
— কিন্তু আমি ঐ সুব্রতবাবুদের সঙ্গে লড়াই করি কেমনে ?
–লড়তে তোমায় হবে না ! পরশু নদীর ধারে ওই টিলার কাছে মিটিং আছে। শুনছি বিরাট জমায়েত হবে। উঁচু দরের নেতারাও আসবে । সেখানে সুব্রতবাবু ভোটের কথা বললে, তুমি আমি উঠে গিয়ে আমাদের অভাব গুলো বলবো। আর এও বলবো ,এসব না হলে ভোট এবারে দিচ্চিনা আর ভোটের কাজে কেউ যাবেও না এই কলোনী থেকে।
— কিন্তু আর সব লোকজন এর কি মতামত , সেটা জানার দরকার ! তারা যদি বেঁকে বসে তবে আমি আপনি শত্রু হয়ে পড়বো যে !
— সে কারণেই তো এসেছি । কাল সকালে কলোনীর লোকজন কে নিয়ে আমরা একবার সুজনের চা এর দোকানে বসবো। ভালো মন্দের তফাৎ দুজনে সকলকে বোঝাবো। দেখিনা কি ফল হয়! তারপর পরশু ভোটের মিটিং এ যা বলার বলবো।
— সবাই রাজি হলে আমার আপত্তি নেই !
— আরে হবে হবে ! এতোদিন এই মানুষ গুলোকে কেউ বোঝায় নি তো ! মাটিতে মুখ দিয়েই চলেছে। দেখিই না দুজনে চেষ্টা করে। কি বলো ?
— আপনি সাথে থাকলে , চিন্তা কি ?
— আছি আছি ! এখন আসি ভাইজান।
— চলে যাচ্ছেন ! পূর্ণিমা কে বলি একটু মুড়ি মেখে দিক ?
— না ভাই অন্য কোনদিন । আজ তারা আছে।
পূর্ণিমা আড়ালে দাঁড়িয়ে সব কথা গেলে।
পরদিন সকালে সুজনের চা এর দোকানের পাশে পাড়ার লোক জনের মিটিং বসে। সকলের ঘর ঘুরে ঘুরে ডেকে নিয়ে আসে ওসমান। উপস্থিতি অনেক কম। কারণ সকলেই চলে গিয়েছে কাজে। যে কয়েকজন উপস্থিত ছিল তারা মাধব ওসমানের কথায় সায় দেয়। সুব্রতবাবুরা তাদের উন্নতি না করে দিলে মিছিলে যাবে না সেও ঠিক হয়। তবে এসব কথা আরও পাঁচ জনকে বুঝিয়ে ভোটের মিটিং এর দিন জোট বাঁধতে হবে বলে ওসমান। ফাঁপা মাথায় ভারী পাথরের মতো কথা গুলো বসে যায় সকলের । পরশু মিটিং এর দিন সুব্রতবাবুরা দলবল নিয়ে এসে পৌঁছালে , দেখে লোকে ভরে গেছে ভৈরবী নদীর পাশের ফাঁকা জমি। মানুষ জায়গা না পেয়ে টিলার খানিকটা ওপরেও চড়ে বসেছে। জমায়েত দেখে সুব্রতবাবুরা খুশি মনে বক্তৃতা শুরু করলে , জনগনের মধ্যে ফিসফিসানি থেকে কোলাহল উঠতে উঠতে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায়। তীব্র কোলাহল শুনে পূর্ণিমা এক ছুটে নদীর ধারে পৌঁছে দেখে মানুষের ঢল নেমেছে। ভীষণ উত্তেজনায় এতো গুলো মানুষ যেন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ওর ভয় হয়? কোথায় তার বাবা ? মাধবের কোনো চিহ্ন নেই। উঁচু উঁচু মাথার সারিতে তার বাবাকে খুঁজতে পূর্ণিমা উঠে পড়ে টিলায়। গাছ ঝোঁপ ঝাড় পেরিয়ে উঠে যেতে যেতে দেখে টিলার ওপরে একটা কবেকার ভাঙা কয়েকটা দেয়াল।সেই ভাঙা চোরা দেয়ালের ধার ধরে সে এগিয়ে গিয়ে দেখে, দেয়ালের পিছনে লুকিয়ে রয়েছে জনা দশেক অস্ত্রধারী মানুষ। যারা এক মুহূর্তে মিছিলে ঝাঁপিয়ে পড়ার পরিকল্পনা করছে। হঠাৎ ওদের মধ্যে থেকে একজনের পূর্ণিমার দিকে চোখ পড়ায়, দ্রুত ওর দিকে তেড়ে আসে। ভয়ানক বিপদের আঁচ পেয়ে, পূর্ণিমাও দিকবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে প্রাণ ভয়ে ছুটতে থাকে নিচের দিকে। তারপর পাগলের মতো মিছিলে ঢুকে লোকজনদের , সে সব কথা জানালে, জঙ্গল ভেদ করে সকলে দল বেঁধে উঠে গিয়ে উদ্ধার করে বেশ কত গুলি আগ্নেয় অস্ত্র আর বাক্স ভর্তি বোমা। দুষ্কৃতীরা সকলেই পালিয়ে গেছে। পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে সুব্রত বাবু এসব শুনে, অস্ত্র গুলি দেখে বলে ওঠে — বুঝেছি ! এসব আমার বিরোধী পার্টির নেতা তরুণ বাবুর কাজ। আমার মিছিলে হামলা চালিয়ে মিটিং পন্ড করতে চাইছিল। এক টা কেউ ছাড়বো না। সব কে শেষ করবো।
তারপর জনগণের উদেশ্য বলেন — ভয় নেই আপনাদের ! আমি যত দিন বেঁচে আছি কেউ কিছু করতে পারবে না। কিন্তু এসব ধরলো কে ?
ভিড় থেকে একজন বলে উঠল– পূর্ণিমা!
এরপর পূর্ণিমা ভিড় ঠেলে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এসে সুব্রত বাবুর কাছে গেলে ,সুব্রত বাবু তার মাথায় হাত রেখে বলেন — কত লোকের প্রাণ যে তুই বাঁচালি মা ! তোর উপকার আমি কিছুতেই ভুলতে পারবো না ! কি চাস তুই বল ?
পূর্ণিমা বলে ওঠে — এখানে আলো চায় ! জল চাই ! রাস্তা চাই !
একথা শুনে জনগণ হাততালি তে ফেটে পড়ে। মাধব আর ওসমানের মুখ ভিড়ের মাঝ খান থেকে চক চক করে ওঠে।
সুব্রত বাবুর ভুরু কুঁচকে উঠলো। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার ডান হাত রাজুকে আস্তে আস্তে বললেন — কে শেখাল এসব একে ?
রাজু তেমন ভাবেই উত্তর দিলো — শুনলাম , মাধব আর ওসমান ! ওরা কালকে লোকজন দের আমাদের বিরুদ্ধে উস্কেছে। বলছে এসব না পেলে মদ আর টাকায় আর এদের ভোলানো যাবে না !
— বুঝেছি! মুখে বুলি ফুটেছে ! মাধব , ওসমান নেতা হতে চাইছে ? ব্যবস্থা একটা করতে হবে দেখছি।
এরপর সুব্রতবাবু মেকি হাসি ছেড়ে বললেন — আচ্ছা ! ঠিক আছে। সব দেবো। এই আমি পূর্ণিমা মা এর মাথায় হাত রেখে কথা দিয়ে গেলাম।
ওদিকে টিলার থেকে পালিয়ে গিয়ে ওরা তরুণ বাবুর বাড়িতে গোপনে পৌঁছায় । তরুণ বাবু ওদের এভাবে আসতে দেখে আনন্দের সঙ্গে বলে ওঠেন — কি ! সব খতম ?
একজন বলে ওঠে — না স্যার ! সে সুযোগ আর পেলাম কোথায় ?
— কি ! পারিস নি ! দূর হ এখান থেকে ! তোদের দিয়ে আর কিছু হবে না দেখছি। এক একটা দিন কে দিন গরু গাধায় পরিণত হচ্ছিস !– রেগে বললেন তরুণ বাবু।
দ্বিতীয় জন বললো — কিছু করার আগেই তো দেখে ফেললো। তারপর লোক জন ডেকে এনে প্ল্যান টাই শেষ করে দিলো।
— কে সে ?
— মাধবের মেয়ে পূর্ণিমা !
— ওই পুঁচকি মেয়ে টা ?
— হ্যাঁ ! স্যার !
— না ! শান্তিতে আর বাঁচতে দিলো না দেখছি। অন্য রাস্তা নিতে হবে দেখছি।– চিন্তা গ্রস্থ ভাবে বললেন তরুণ বাবু।
পূর্ণিমা মাধব আর ওসমানের জয় জয়কার পড়লো কলোনী তে। একরত্তি মেয়ে তাদের অভাব অভিযোগ , সুযোগ বুঝে সুব্রতবাবুর কানে যেভাবে সকলের সামনে তুলেছে , তাতে কাজটা আরো পাকা পোক্ত হয়েছে। ওসমান বা মাধব এসব বললে বোধহয় সুব্রত বাবুকে এভাবে চুপ থাকতে দেখা যেতনা। সবচেয়ে বড় কথা পূর্ণিমার সাহস । যেভাবে ছুটে এসে সকলের প্রাণ সে রক্ষা করলো, ওর জায়গায় অন্য কেউ থাকলে বোধহয় এ কাজ করতে পারতো না। আগে নিজে পালিয়ে বাঁচতো কিংবা ভয়ে জ্ঞান হারাতো।
পার্টি অফিসে পৌঁছে রাগে গজরাতে থাকেন সুব্রত বাবু। চিৎকার করে বললেন — ওই টুকু একটা মেয়ে সকলের সামনে কি রকম অপদস্থ টাই না আমাকে করলো ! আমার রাজনৈতিক জীবনে এরম অবস্থা আমার কোনোদিন হয়নি !
রাজু বলে উঠলো — দাদা ! আসল নাটের গুরু ওসমান আর মাধব। ওদের ইশারায় গোটা পাড়া নাচছে।
— ওই ওসমান আর মাধবের খুব মিল হয়েছে না রে ?
— হ্যাঁ দাদা ! দুজনে যা শুরু করেছে হঠাৎ কলোনী বোধ হয় হাত থেকে চলে যাবে? মিছিলের লোক আর পাবো কোথায়?
— দাঁড়া দাঁড়া আমাকে ভাবতে দে ! কিছু একটা ইমিডিয়েট না করলে বিপদ আসন্ন ! আচ্ছা ওই এক রত্তি মেয়ে টা হামলার খবরটা আঁচ করলো কি করে ডিটেলস বলতো?
— আরে দাদা ! নদীর পাশের টিলায় উঠে ছিল ,ওই মেয়ে টা। মিটিং দেখবে বলে।তারপর ওখানেই ভাঙা পাঁচিল এর পিছনে তরুণের লোকজন অস্ত্র নিয়ে লুকিয়ে ছিল। সেটা ও দেখে ফেলে ছুটে এসে জানিয়েছে।
— ওখানে কিসের পাঁচিল রে ? ওখানে তো কেউ ওঠে না !
— জানি না দাদা কিসের পাঁচিল !
এরপর সব্রত বাবু খানিক ক্ষন চুপ করে থেকে হঠাৎ একটা ক্রুর হাসি হেসে ওঠেন। চোখ দুটো একটা অভিশাপের মতো জ্বলজ্বল করে ওঠে। বীভৎস , ভয়ংকর পরিণতির , মনের মধ্যে একটা ফন্দি এঁটে সকলের উদেশ্য বলেন — তোরা জানিস ওটা কিসের পাঁচিল?
সকলে সমস্বরে বলে ওঠে না দাদা !
সুব্রত বাবু বললেন — আমি জানি ওটা কিসের পাঁচিল ?
রাজু বললো — কিসের পাঁচিল দাদা ?
–ওই পাঁচিলটার দুটো নাম ! আর পাঁচিলটা কে আমাদের নামিয়ে আনতে হবে হঠাৎ কলোনীতে।
রাজু বললো — কি বলছো কি দাদা ! কিছুই তো বুঝতে পারছি না। ওই পাঁচিল নামাবো কি করে?
— ও পাঁচিল খুব ঠুনকো রে রাজু। একটু তেই নেমে পড়ে। তোরা খালি ওসমান কে গিয়ে বল ওই ভাঙা পাঁচিল মসজিদের আর সব কিছু পরিষ্কার করে , নতুন পীর বাবার দরগা বানিয়ে দেবে বলেছে দাদা । আর আরেকবার ভট্টাচার্য মশায় কে গিয়ে বল ওই টিলার পাঁচিল টা ছিল কোনো পুরোনো মন্দিরের। ভোট আমার দিকে পড়লে আমি মন্দির বানিয়ে দেবো। ব্যাস ! এই টুকু করতে পারলে ওই পাঁচিল আফসে আপ নেমে দাঁড়িয়ে যাবে হিন্দু আর মুসলমান পাড়ার মাঝখানে ।
ব্যাপারটা সকলের কাছে জলের মতো পরিষ্কার হলে , রাজু বলে ওঠে — তোমার বুদ্ধির জবাব নাই দাদা। এই জন্য আমরা তোমার এতো ভক্ত। এখন পা টা বাড়াও। তোমার পায়ের ধূলো নিয়ে আজ রাতেই কাজে লেগে পড়ি।
মাধব ভোর রাতে ভিক্ষে করতে ট্রেন ধরতে চলে যায়। টিলার ওপরে ভগ্ন দেয়াল পীর বাবার , এই কথাটা কানে উঠতেই ওসমান সকাল বেলা উঠে সেই দিকেই হাঁটা দেয়। তারপর টিলায় পৌঁছে দেখে ভাঙা ইঁটের স্তূপের ওপর পাতা রয়েছে একটা লাল কাপড়। অতি দ্রুত সেখান থেকে নেমে তার জাত ভাইদের উদেশ্য বলে — ভাই সকল ! ওই টিলার ওপরে পীর বাবার কবর রয়েছে। আমি জানা মাত্র সেখানে চাদর চড়িয়ে এসেছি। চলো সকলে সেই জঙ্গল সাফ করে ,ভোটের আগেই সেখানে দরগা গড়ে তুলতে হবে। শোনা মাত্র লোকজন একত্রিত হয়ে কোদাল , কুড়াল , হেসো হাতে ছুটে যায় সেপথে। কথাটা ভট্টাচার্য মশায় এর কানেও উঠেছিল। সকালে ওসমানদের ওদিকে ছুটে যেতে দেখে ঘটনাটা সংক্রমণ এর মত ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত হিন্দু পাড়ায়। ভট্টাচার্য মশায়ও লোকজন সমেত সেই পথে ছুটে যায়। পৌঁছে , লাল কাপড় পড়ে থাকতে দেখে হুঙ্কার দিয়ে বলেন — খবরদার ! ওই বস্ত্রে কেউ হাত দেবে না ! আমি গত রাত্রে স্বপ্নাদেশ পেয়েছি ওই কাপড়ের টুকরো সন্তোষী মাতার । মায়ের ইচ্ছে এখানে তার মন্দির পুনর্নির্মাণ করা হোক। ভাই সকল এই জায়গার দখল নাও।
কোন্দল বাড়লে দুই পক্ষই অস্ত্র হাতে নিজ নিজ মালিকের নাম মুখে উচ্চারণ করে মার মুখী হয়ে উঠলো। এমন সময় পাঁচিলের পিছন থেকে একটা তীব্র আর্তনাদ ফুটে ওঠে । সকলে সেই শব্দ লক্ষ্য করে ছুটে গিয়ে বিস্ফারিত চোখ নিয়ে থ বনে যায়। সেখানে পড়ে রয়েছে পূর্ণিমার মৃতপ্রায় বিবস্ত্র শরীর টা। দেখলেই বোঝাযায় কিছুক্ষণ আগে কে কারা তাকে ধর্ষণ করে ফেলে দিয়ে গেছে। খাপি খেতে খেতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ,শেষ বারের মতো পূর্ণিমা বলে ওঠে — ওই কাপড় আমার !
উপস্থিত সকলের হাতের অস্ত্র মাটিতে শব্দ করে পড়ে যায়। ওসমান আর ভট্টাচার্য মশায় সকলের অলক্ষ্যে কোথায় মিশে গিয়েছিল, কেউ টের পায়নি।
কলমে আশিষ চক্রবর্তী, মুর্শিদাবাদ
খুব সুন্দর একটা গল্প পড়লাম l খুব ভালো লাগলো l
Darun golpo
Mind blowing,👍👌
রহস্যময়
পূর্ণিমার মতো মেয়েরাই আমাদের জীবনের অমাবস্যাকে দূর করতে পারেন ।
বর্তমান সময়ের সঙ্গে আনুসঙ্গিক গল্প। খুব ভালো লাগলো।
Valo hoye6ee
“সব চরিত্র কাল্পনিক “গল্পটির পল্ট,কাহিনী,যথাযথ ও বাস্তবের সঙ্গে সাযুজ্যপুর্ণ
এবং চরিত্র গুলি নিজেদের কর্মকান্ডের ভিত্তিতে জীবন্ত।আর এই সূত্রেই পূর্ণিমা যেন গল্পের প্রাণশক্তি রূপে উদ্ভাসিত হয়েছে।তবে পূর্ণিমা চরিত্র টির সেভাবে মনস্তাত্ত্বিক বিবর্তনের পূর্ণতা এখানে সম্পূর্ণ রূপে উহ্য।এছাড়াও ওসমান ও মাধব চরিত্র দুটি অনবদ্য কিন্তু ওসমান চরিত্র টি ধর্ম নামক অফিমে নিমজ্জিত।অন্যদিকে মাধব চরিত্রটির গল্পের মধ্যে একটি ছাপ থাকলেও গল্পের শেষে পূর্ণিমার মৃত্যুতে তার যেন অপমৃত্যু ঘটলো।
গল্পের সংলাপের কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই মুগ্ধ করে লেখকের পরিবেশের বর্ণন।যা ছবির মতো প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। এবং কাহিনীর পরিসমাপ্তিতে গল্পের সংলাপ এক অন্যমাত্রা লাভ করে।যেমন সুব্রত বাবু ও তরুণ বাবু চরিত্র দুটি সংলাপের জন্যই জীবন্ত।
এবার গল্পের গঠনশৈলীর কথা বলতে গিয়ে প্রথমে মনে হয়েছে যে সাধারণ গল্প হিসাবে গল্পটি অসাধারণ হলেও ছোট গল্প হিসাবে প্রাথমিক ভাবে ছোটো গল্পের বৈশিষ্ট্য কে ক্ষুন্ন করে।
এবং পরিসমাপ্তিতে পূর্ণিমার মৃত্যু গল্পের নাটকীয় মোচড় আনলেও(যা ছোট গল্পের বৈশিষ্ট্য) গল্পের শেষ তিন লাইনের ক্রোড় অংশ সেই ব্যঞ্জনা কে ক্ষুন্ন করে।
গল্পের শুরু যেখান থেকে পূর্ণিমার মৃত্যু যেন সেখানেই গল্পকে শেষ করে,রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেন –শান্ত দীঘির জলে একটুকরো ঢিল ছুড়লে যে অস্থিরতার সৃষ্টি হয় তা এখানে সৃষ্টি করেছে।
তবুও সব দিক দিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে সব চরিত্র কাল্পনিক গল্পটি অনবদ্য, বাস্তবিক,যুগানুতিক্রমী।