শরৎপল্লীর কোয়েনাদের বাড়ির গলিটা বেশ গা ছমছমে। কিন্তু দু বছরের যাতায়াতে এই ব‍্যাপারটা অনেকটা অভ‍্যেস হয়ে গিয়েছিলো। কোয়েনাকে পড়াতে যেতাম। আর থাকতো সহেলী। ওর সহপাঠী।

নির্জন ও প্রায় অন্ধকার গলিটার ভেতরে ঢুকে পাঁচ-সাত পা হাঁটলেই ডানদিকের বাঁকে সেই বড়ো শিমূল গাছটা। যার তলায় প্রায়ই রাখা থাকতো একটা শববাহি গাড়ি। নিবু নিবু ধূপের ধোঁয়া, আতরের গন্ধ আর শুকিয়ে আসা রজনীগন্ধা কেমন যেন একটা অদ্ভুত দমবন্ধ পরিবেশের সৃষ্টি করতো। রেললাইনের ধার ঘেঁষা কয়েকটি বাড়ির জানলা-দরোজা সন্ধ‍্যার পর কেউ খুলতো না। কদাচিৎ একজন দুইজন লোক হনহন্ করে চলে যেত। আপ-ডাউন ট্রেনের আলোর ঝলকানির সাথে ঝমাঝম্ আওয়াজে গলিটা হঠাৎ মুখরিত হয়ে কেঁপে উঠে আবার চুপ করে যেত।

আপ লাইনের ধারে পানাভর্তি একটা সরু এঁদোজমির বাঁ হাতে কোয়েনাদের বাড়িটা।বহুবছরের পুরোনো, ধূলোবালি-ঝুল আটকে কালো হয়ে আসা দেওয়াল, জং ধরা টিনের চাল, টিমটিমে আলো, কয়েকশো ধেঁড়ে ইঁদুর আর এক ডজন মেছো বিড়ালের মাঝে তিনজনের বাস।

কোয়েনাদের বাড়িতে ঢোকার আগেই ছিলো দশম শ্রেণীর ছাত্রী পূজাদের ছোট্ট একতলা উত্তরমুখী বাড়ি। প্রায়ই ঐ বাড়িটা থেকে ওর মদ‍্যপ বাবার অত‍্যাচারে ওর নিরীহ মায়ের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতো। আর পূজা মন খারাপ করে লোহার রড দেওয়া জানলার সবুজ কপাট খুলে বেশ লম্বা দুটি বেণী ঝুলিয়ে বসে থাকতো। গুণগুণ করে রবি ঠাকুরের বিরহের গান গাইতো। আমার সাথে দেখা হলেই মিটমিট্ করে হাসতো ওর চোখ দুটো। মনে হতো কিছু বলতে চাইছে। একদিনই ওকে প্রাণ খুলে গাইতে শুনেছিলাম,
“দুঃখ যদি না পাবি তো,দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে?
বিষকে বিষের দাহ দিয়ে দহন করে মারতে হবে।”
আহা! কী সুরেলা ছিলো সেই কন্ঠস্বর।

সেদিন শ্রাবণের সন্ধ‍্যা। গলিটা যেন একটু বেশীই শান্ত ছিলো। লোডশেডিংয়ের সাথে অনবরত টিপটিপ বৃষ্টি বন্ধুত্ব পাতিয়েছিলো। গলিটাতে পা রাখতেই বুকের মাঝে যেন হাতুড়ির ঘা শুরু হয়েছিলো। ছাতা মাথায় হনহন্ করে হেঁটে এসে দেখেছিলাম পূজা অমনি করেই বসে আছে জানালার ধারে। আর তেমন ভাবেই মায়ের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে ভেতর থেকে। কিন্তু সেদিন পূজা আমাকে দেখে হাসেনি। ওর চোখে চোখ পড়তেই জানলার সবুজ কপাটটা আস্তে করে বন্ধ করে দিয়েছিলো। মনে হয়েছিলো ওর মনটা আজ যেন একটু বেশীই খারাপ।

সাড়ে সাতটা নাগাদ কোয়েনাদের বাড়িতে পৌঁছে দেখেছিলাম সহেলী এসে গিয়েছে। ওরা দুজনে মোমবাতির আলোতেই পড়ছে। কোয়েনার মা রান্নাঘরে রাতের রুটি বানাচ্ছিলেন। কোয়েনার মুখটা সেদিন বেশ থমথমে ছিলো।
“কী অংক প্র‍্যাকটিস্ হয়নিতো?”
“হয়েছে আন্টি।”
“তাহলে মুখটা এমন কান্না কান্না কেন?”
কোয়েনা খুবই কম কথা বলতো। তাই আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই মাথাটা নামিয়ে নিয়েছিলো। বাংলা বিষয় পড়ানো শেষে কোয়েনার বইয়ের থেকে কয়েকটা অঙ্ক টুকে দিয়ে বইটা উল্টে রেখে ওদেরকে অঙ্কগুলো করে দিতে বলেছিলাম। জানলা দিয়ে বাইরের দিকে চোখ যেতেই অন্ধকার রেললাইনের ধারে একটা কালো বেড়ালের চোখ দুটো জ্বলে উঠতে দেখে গাটা ছমছম করে উঠেছিলো। ম‍্যাঁও করে ডাক দিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো এঁদো জলায়।
“এই যাঃ!”
“কী হয়েছে আন্টি?”
“কিছু না। তোমাদের হলো?”
ইঁদুরগুলোও সেদিন বড্ড ছটফট্ করছিলো। ওদের কিচিরমিচির আওয়াজটা মাঝেমধ‍্যেই ঘরের নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করছিলো। অঙ্ক চেক করতে গিয়ে বইটা উল্টে দেখেছিলাম বইয়ের দুটো পাতা জুড়ে কে যেন কালি ছিটিয়ে দিয়েছে। বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুঁচকে ভাবলাম কোনোকারণে আমার অন‍্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে ওদের দুজনের মধ‍্যে যে কেউ এইরকম করেছে। বকাবকি করতে ওরাও অবাক হয়ে বললো,
“না আন্টি আমরা এইরকম করিনি।”
আর সত‍্যিই ওরা এইরকম করার মতো ছাত্রীও নয়। তবুও বুঝে উঠতে পারছিলাম না কী করে এমন হলো! ধপাস্ করে একটা ইঁদুর বিছানার ওপর লাফিয়ে পড়তেই মোমবাতিটা নিভে গিয়েছিলো। একটা দমকা হাওয়ায় শিরশির করে উঠেছিলো সারা শরীর।
“আন্টিইইইই” আর্তনাদ করে সহেলী খাট থেকে লাফিয়ে আমার গায়ে এসে পড়েছিলো। ওর সারা শরীর থরথর্ করে কাঁপছিলো। ডাউন রানাঘাট লোকাল বাড়িটাকে কাঁপিয়ে দ্রুত গতিতে চলে গিয়েছিলো। কোয়েনার মা জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে ঘরে এসে ঢুকেছিলেন। দেখলাম ওর খাতার সাদা পাতায় বেড়ালের কাদা পায়ের ছাপ। কোয়েনার মায়ের থেকে কিছু কথা শুনে আমার আর সহেলীর শরীর দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গিয়েছিলো। শরীরটা কেমন যেন ভারী হয়ে আসছিলো। ঘনঘন শ্বাস পড়ছিলো।

বৃষ্টি বেশ জোরে পড়তে শুরু করেছিলো। পড়ানোর ইচ্ছেটা আর না থাকলেও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে রাত প্রায় সাড়ে ন’টা নাগাদ কোয়েনাদের বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম ঘন অন্ধকারে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। আমার ডান হাতে ছাতা আর বাঁ হাত দিয়ে সহেলীর হাতটা ধরা ছিলো। যেতে যেতে বন্ধ সবুজ জানলাটায় চোখটা আটকে গিয়েছিলো। একটা পুরুষের চাপা কান্নার আওয়াজও ভেসে আসছিলো বন্ধ জানলার ফাঁক দিয়ে। কয়েক পা এগিয়ে এসেই সহেলী আমার হাতটা জোড়ে আঁকড়ে ধরে ফিসফিসিয়ে কাঁপা গলায় বলে উঠেছিলো, “ও আন্টি পূজা দিদি।”
পা টা আটকে গিয়েছিলো মাটিতে আর দৃষ্টি গিয়ে পড়েছিলো শিমূল গাছের তলায় শববাহী গাড়িটায়। মৃদু সবুজ আলো জ্বলতে থাকা গাড়িটায় লম্বা দুই বেণী ঝুলিয়ে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছিলো ষোড়শী পূজা। চোখে সেই মিটমিটে হাসিটা নেই। কেমন যেন স্থির,ফ‍্যাকাশে! কয়েক মূহুর্তে কে যেন শ্বাসরোধ করে মারতে চাইছিলো আমাদের দুজনকে। দুজন দুজনের হাত শক্ত করে ধরে থাকলেও কে যেন টান মেরে আমাদের মুঠিটাকে আলগা করে দিতে চাইছিলো। সামান‍্য নড়াচড়াও করতে পারছিলাম না আমরা। একটা শব্দও উচ্চারণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলাম। বৃষ্টির জল, চোখের আর শরীরের নোনতা জলে শুধু ভিজে যাচ্ছিলাম। আশপাশ নির্জন, নিস্তব্ধ! শুধু পোড়া ধূপ, আতর, শুকনো রজনীগন্ধার তীব্র গন্ধটা ঘিরে ফেলেছিলো আমাদের। আপ রানাঘাট লোকালের ধেয়ে আসা আলোর সাথে একটানা কর্কশ আর্তনাদ আর রাতের নিমপেঁচার উড়ে যাওয়া ডানার ঝাপটে সম্বিত ফিরে পেয়েছিলাম! ছাতা ফেলে, সহেলীকে আরো আঁকড়ে ধরে চোখ বন্ধ করতে বলে নিজেও চোখ বন্ধ করে এক দৌড়ে পেরিয়ে এসেছিলাম সেই শববাহি গাড়ি!

সেইদিন রাতেই সহেলীকে ধূম জ্বর গায়ে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিলো। বেশ কিছুদিন ও হাসপাতালে ছিলো। আমি কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিলেও আর কোনোদিন কোয়েনাদের বাড়িতে পড়াতে যাই নি। কোয়েনার জন‍্য অন‍্য ব‍্যবস্থা করেছিলাম।

মদ‍্যপ বাবার মুখ থেকেই পূজা আগের দিন রাতে জানতে পেরেছিলো যে পূজা ওদের নিজেদের মেয়ে নয়। ওর পালিত মা ওর পালিত বাবাকে সন্তান দিতে পারেনি বলেই ওর বাবা একটু একটু করে নিজেকে মাতাল বানিয়েছে। যত রাগ ক্ষোভ সব ওর মায়ের ওপরে পুষিয়েছে। পূজাকে আর পালতে চাইছিলো না পালিত বাবা। মেধাবী পূজার লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে চাইছিলো। সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থানাধিকারীর পুরস্কৃত তানপুরাটা আছড়ে গুড়িয়ে দিয়েছিলো। মাকে মেরে মেরে আধমরা করে দিয়েছিলো। আর সহ‍্য হচ্ছিলো না ওর। এতগুলো বছরে প্রতিদিন বাবার অনেক অত‍্যাচার সহ‍্য করেছে। হয়তো নিজের বাবা বলে জানতো বলেই সব মুখ বুজে সয়েছে। কিন্তু পালিত মেয়ে হয়ে আর বেঁচে থাকতে চায়নি। স্নেহপূর্ণা, মমতাময়ী মাকে ওর জন‍্য শুধু শুধু কষ্ট পেতে দিতে চায় নি। তাইতো সেদিন ক্ষতবিক্ষত মনটার জ্বালা জুড়াতে ভোররাতে নিজেরই লম্বা বেণীর ফাঁসে নিজের দমটাকে চিরদিনের মতো বন্ধ করে দিয়েছিলো। আর কোনোদিনই পূজার আনন্দের গান গাওয়া হয়নি। গাওয়া হয়নি, “প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ…”

কলমে: ববিতা সরকার(গুহ রায়)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here