তিথির গত পরশু ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা শেষ হয়েছে , অনেকদিন পড়াশোনার চাপের পর একটু স্বস্তি | আজ ঠিক করেছে বন্ধুদের সাথে বাইরে দেখা করে একটু আড্ডা দিয়ে রাতে সবাই মিলে ডিনার করে বাড়ী ফিরবে | সেইমতো বাড়ী থেকে বেরোতেই , তিথির ফোনে ওর পিসতুতো দাদার ফোন আসে | তিথির নিজের কোনো ভাইবোন নেই, তাই পিসতুতো দাদা অমিতের সাথে ওর বেশ ভালো সম্পর্ক | অমিতের বাড়ী মেদিনীপুরে, ও যখন কলকাতায় একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি তে চাকরী পেয়েছিলো তখন বছর দুয়েক তিথি দের বাড়ী তেই ছিল | সেইজন্য ভাব টাও দুজনের মধ্যে বেশ বেড়ে গেছিলো , এখন অমিত লন্ডনের বাসিন্দা , ওখানেই কর্মরত, ওখানেই বাবা মায়ের সাথে থাকে অমিত|
বেশ কিছু দিন আগে ওর পিসি ই জানান যে ওর পিসতুতো দাদা এই বছরের শেষে বিয়ে করছে তারই বসের মেয়ে লিজা কে |
লিজার সাথে তিথি র ও আলাপ হয়েছে তবে সেটা ভিডিও কলিং এ | লিজার ঠাকুমা নাকি ভারতীয় ছিলেন , লিজার বেশ সুন্দরী , কিন্তু কথা বলতে গিয়ে তিথির মনে হয়েছে মেয়েটি বেশ অহংকারী |
তিথি ওর দাদাভাই কে এসব কিছু না জানালেও লিজা কে ভীষণ এড়িয়ে চলে ও | আজ ওর দাদাভাই ওকে ফোন করে বলে -” বনু লিজা গত সপ্তাহে ইন্ডিয়া তে গেছে , তোর পরীক্ষা চলছিল তাই তোকে আর বিরক্ত করিনি| ও আর মাত্র তিন দিন থাকবে ওখানে , আজ তুই একটু প্লিজ ওর সাথে শপিং করতে যা ও নাকি বেনারসী কিনবে , প্লিজ বনু “| দাদাভাইয়ের অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে বন্ধুদের সাথে করা প্ল্যান বাতিল করে বেরিয়ে পড়ে |
লিজা বেশ মনের সুখে সারাদিন শপিং করলো , তিথির ধারণা একদম ঠিক লিজা বেশ অহংকারী দাম দিয়ে ও জিনিসের মূল্য বিচার করে , ভারত বর্ষ কে কথায় কথায় ছোট করে , এই নিয়ে দু একবার তিথির সাথে মতো বিরোধ ও হয়ে গেছে | শপিং শেষে রাতের খাওয়া দেওয়ার পর প্রায় 9 টা নাগাদ দুজনে মেট্রো তে ওঠে বাড়ী যাবার জন্য|
ভাগ্য ক্রমে বসার জায়গাও পেয়ে যায়, কিছুক্ষন পর দুজনেই যেন কেমন শীত শীত অনুভব করতে থাকে , কিন্তু এটা তো গরম কাল | হঠাৎ করে দুমিনিটের জন্য মেট্রোর আলো নিভে গেলো মনে হলো একটা ঝাঁকুনি হলো | আলো যখন ফিরে এলো ওরা দেখলো অদ্ভুত ভাবে মেট্রোর পুরো কামরা খালি , মেট্রোর গতি ও যেন বেড়ে গেছে | কি হচ্ছে বুঝতে না পেরে দুজন দুজনের হাত চেপে ধরে |
হটাৎ করে কোনো এক নারী কণ্ঠ যান্ত্রিক গলায় বলে ওঠে “ওয়েলকাম তো ইন্ডিয়া লিজা, কষ্ট করে মনে করোতো আজ কত তারিখ “|
লিজা বলে ওঠে -” কে তুমি? আজ !আজ তো 15ই জুন “| তিথির তো ভয়ে মুখ পুরো শুকনো হয়ে গেছে |
আবার সেই নারী কণ্ঠ বলে উঠলো -” লিজা আজ তো রিমার জন্মদিন , রিমা কে মনে আছে কি তোমার? ” প্রশ্ন করেই একটা তীব্র অট্টহাসি শুরু হলো যা মনে হয় কানের পর্দা ফাটিয়ে দেবে |
লিজার কিছু বলে ওঠার আগেই, তিথির মনে পড়ে যায় রিমা নামে ও একজন কে চিনতো | রিমা দি তো ওর দাদা অমিতের খুব ভালো বান্ধবী ছিলো, অনেকবার ওদের বাড়ী এসেছে , ওকেও বেশ ভালোবাসতো | তিথি বলে উঠে -” তুমি কি রিমা দি?” কিছুক্ষনের নীরবতার পর উত্তর এলো, হ্যাঁ রে তিথি তুই ঠিক চিনেছিস আমায় | কিন্তু, রিমা দি তুমি তো মারা গেছো তিথি বলে উঠলো |
সেই কণ্ঠে জবাব এলো , “আমি মারা যাই নি, আমায় মেরে ফেলেছে রে বোন, আমার মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদের কাউকে ছাড়বো না |” লিজা এতক্ষন চুপ করে ছিলো এবার তীব্র রাগ মিশ্রিত গলায় বলে উঠলো -” কে তুই সামনে আয় ভয় দেখাচ্ছিস কেনো? “
আবার সেই কণ্ঠ শোনো গেলো -” মনে নেই আমার কথা, সেদিনের কথা, বেশ তাহলে সেদিন কি হয়েছিল আবার দেখে নাও “|
হটাৎ করে মেট্রোর দরজা টা খুলে গেলো, সামনে ভেসে উঠলো একটা ক্যাফের দৃশ্য , একটি মেয়ে বসে আছে পুরো রিমা দির মতো দেখতে | মেয়েটা ফোনে বলে চলেছে “প্লিস অমিত এটা তুই করতে পারিস না | আমাদের এতদিনের সম্পর্কের কি হবে ! তুই আয় আমি আমাদের দেখা করার জায়গায় অপেক্ষা করছি | কিছু পরে দুজন ঢুকলো একজনকে হুবহু ওর দাদাভায়ের মতো দেখতে অন্য জন কে লিজার মতোন | ওরা এসে বসে পড়লো , ছেলেটা বলতে শুরু করলো ” রিমা বাচ্ছা দের মতো জেদ করিস না , আমি এখন আর তোকে ভালোবাসি না রে , দেখা এটা লিজা আমি একে ভালোবাসি , তুই প্লিজ আর ঝামেলা করিস না “| তিথি বুঝতে পারে সেদিন যাযা ঘটেছিলো সেটাই ওরা এখন আবার দেখছে |
এবার ওই মেয়েটি মানে রিমা দি বলে ওঠে -” আমার বাড়ী তে তোর কথা জানে তাঁদের আমি কি বলবো? আমি আজই তোর মামার বাড়ী যাবো, দরকার পড়লে তোর বাড়ী যাবো তোকে আমি ছাড়বো না “| এই বলে মেয়েটি বেরিয়ে হনহন করে হাঁটা শুরু করে, তার পেছনে লিজা আর ওর দাদাভাই ও বেরিয়ে যায় | একটু পরে তিনজন ই মেট্রো স্টেশনে পৌছায় , ট্রেন সবে প্লাটফর্মে ঢুকছে , ভীড় ভর্তি | ঠিক এই সুযোগ টাকে কাজে লাগায় লিজা একটা ধাক্কা দেয় রিমা কে , সামলাতে না পেরে রিমা চলে যায় ট্রেনের তলায় | ভীড়ে র মধ্যে হারিয়ে যায় অমিত আর লিজা | এসব দেখে তিথি চিৎকার করে ওঠে খুন ! খুন করা হয়েছে রিমা দিকে , লিজা দি তুমি দাদাভাই সবাই খুনি , আমি বলে দেবো |
মুহূর্তের মধ্যে লিজা চিৎকার করে ওঠে -” হ্যাঁ আমি খুন করেছি তোমার রিমা দি কে , তুমিও যাও তার কাছে , নিজের বেঁচে থাকলে তো সবাইকে বলবে |” এই বলে তিথি কেও টেনে দরজার দিকে নিয়ে যেতে চায় লিজা , সাথে সাথে কোথায় থেকে ঠান্ডা বাতাস এসে তিথি কে ধাক্কা দিয়ে মেট্রোর কামরার ভীতরে ঢুকিয়ে দিলো, আর লিজা কে বাইরে টেনে নিয়ে গেলো |
এরপর তিথির আর কিছু মনে নেই , চোখ খুলে দেখে নিজের বিছানায় শুয়ে আছে সে , পাশে মা বাবা সবাই উদ্বিগ্ন মুখে তাকিয়ে আছেন | তিথি বলে ওঠে -” মা আমি বাড়ী এলাম কিছু করে? ” তিথি র মা বললেন -” একজন মেয়ে ফোন করেছিল তোর ফোন থেকে তোর বাবার ফোনে জানায় তুই তার পরিচিত , তোর খুব জ্বর তুই মেট্রো স্টেশনের বসার জায়গায় বসে আছিস , শীঘ্রই যেন আমরা ওখানে যাই | ফোন পাবার পরই আমরা ছুটে যাই | ওখানে গিয়ে শুনি কোনো একজন নীল চুড়িদার মহিলা তোকে মেট্রোর অফিসে বসিয়ে রেখে যান , সহযাত্রী বলেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন| পরিচিত বলে যে কে ফোন করলো কে জানে !” তিথির মা এর কথা শেষ হতেই ওর বাবা জানতে চায় লিজার কথা সে তো তিথির সাথে ই ছিলো অথচ সিসি টিভির ফুটেছে দেখাচ্ছে তিথি একাই মেট্রো থেকে নামছে | তিথি সাময়িক ধাক্কা টা কাটিয়ে বলে মা প্লিজ একবার দাদাভাইকে ফোন করো আমি তারপর সব বলছি তোমাদের |
কথা মতন ওর দাদাভাই কে ফোন করা হলো কিন্তু কেউই ফোন ধরলো না | তারপর , অগত্যা দাদার বাড়ীর ফনে ফোন করতে হলো | পিসির বাড়ী র কাজের লোক ফোন ধরে যা বললেন টা হলো – গতকাল অফিস থেকে নাকি অমিত ফেরেই নি, বাড়ীর সবাই পুলিশ স্টেশনে |
শুনে তিথি শুধু একটাই কথা বল্লো -” এটাই হবার ছিলো “| ওর কথা কিছু বুঝতে না পেরে বাবা মা দুজনেই ওর কথার মানে জানতে চাইলে তিথি তাঁদেরকে সব কথা খুলে বলে | সাথে এটাও বলে তিথি যে ওর বাবার কে ফোন টা রিমা দি ই করেছে , অবিশ্বাস হলেও এটাই সত্যি , কিছুক্ষন নীরব থাকার পর তিথি র বাবা মা দুজনই ভগবানের উদ্দেশ্য প্রণাম জানালো যাতে এবার অন্তত রিমার আত্মার শান্তি লাভ হয় |