আজ অফিসে পেন্ডিং কাজ ছিলো বহু। সে সব সেরে সুরে বেড়াতে বেড়াতে প্রায় ন’টা বেজে গেলো।পাহাড়ী এলাকায় এটা বেশ রাতই।আশেপাশের দোকানের সব ঝাপ পড়ে গেছে।ঘর বাড়ীর দরজা জানলাও সব আঁটা। রাস্তায় কোনো লোকজন নেই।যাকে বলে একদম শুনশান।অবশ্য এইসব অঞ্চল এরকমই হয়।এটা পাহাড়ী এলাকা।সেটা তো আগেই বলেছি।তার ওপর মফসসল এলাকাও।আবার এখন ডিসেম্বররের মাঝামাঝি চলছে। রাত নটা এখানে বেশ রাতই।
চারপাশটা এখন ঘন কুয়াশার চাদরে মোড়া।আশেপাশে দু’একটা স্ট্রিট লাইট আছে।সেই স্ট্রিট লাইটগুলি একদম টিমটিম করছে।এই ঘন কুয়াশার জন্যে।বুক পকেট থেকে সেল ফোনটা বের করলাম। তার টর্চের আলো এদিক ওদিক মেরে দেখলাম।যদি কোনো ভাড়ার গাড়ী টারী পাই।না কোনো গাড়ী টারী নেই।ঘন কুয়াশায় ভালো দেখাও যাচ্ছে না।তাই ‘গাড়ী গাড়ী’ বলে বেশ কয়েক বার হাঁক দিলাম।না কারোরই কোনো সাড়া টাড়াও নেই।একেই পাহাড়ী গাঁ এলাকা।তার ওপর শীতের রাত।গাড়ী না পাওয়ারই কথা।
তাই আর দেরী না করে অগত্যা হাঁটতে শুরু করে দিলাম।এখান থেকে আমার অফিস কোয়াটার্স কিমি দু’য়েক হবে।এমনিতে আমি হেঁটেই ফিরি।কিন্তু এত রাতে এই নির্জন রাস্তায় একা একা হাঁটা। একটু কেমন কেমন লাগে এই যা।মেন রোডটা ছেড়ে বাঁ পাশের পায়ে চলা পথটা ধরতেই সেই গন্ধটা নাকে এলো।পোড়া সিগারেটের।বিদেশী নামি ব্যান্ডের দামি সিগারেট।যেটা কেবল আমি রানাদাকেই ঠোঁটে গুঁজে স্মার্টলি টানতে দেখতাম।যখন রানাদা লন্ডন থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ী আসতো। তো সেই রানাদা বছর দু’য়েক থেকে নিঃখোজ।পুলিশ ডিটেকটিভ দিয়ে কত খোঁজ খবর নিয়েছেন জ্যাঠামহাশয়।মানে রানাদার বাবা।কিন্তু এতদিন হয়ে গেল কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।রাঙাদাকে কী কেউ অপহরণ করলো?নাকী নিজের ইচ্ছায় কোথায় হারিয়ে গেল?নাকি অন্য কিছু? কিজানি রাঙাদা কোথায় হারিয়ে গেল!এতদিন পর্যন্ত আমরা কেউ কিছু এতটুকুও জেনে উঠতেই পারলাম না।
সেই সিগারেট পোড়ার গন্ধটা বেশ কিছুক্ষণ থেকেই আমার নাকে আসছে।এদিক ওদিক চোখ,ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুঁজছি এই গন্ধটার উৎস।কিন্তু ঠিক কোথা থেকে আসছে বুঝে উঠতে পারছি না একদম।তবে গন্ধটা চলন্ত।এটা বলাই বাহুল্য।কারণ আমি যে চলতে চলতে একইভাবে গন্ধটা পেয়ে যাচ্ছি।
আরে!আরে! কে যাচ্ছে ওটা।ঐ যে মাথায় যেন একটা বড় হ্যাট ! ঘন কুয়াশায় অস্পষ্ট।ভালো দেখা যাচ্ছে না লোকটাকে।বুকটা ছ্যাত করে উঠলো কেমন।ওরকম হ্যাটতো আমাদের রানাদাও মাথায় দিত।অনেকদিন আমি রানাদার মাথায় ওরকম বিদেশী হ্যাট দেখেছি।রানাদাকে জিজ্ঞেস করায় বলেছিল লন্ডন থেকে কেনা।আমাকেও একটা গিফ্ট করেছিল। তাহলে কী—-
এত শীতেও আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করে দিয়েছে।
আমি জোরে জোরে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছি।ঐ অস্পষ্ট লোকটাও বেশ জোরে জোরে হাঁটছে।মনে হচ্ছে আমার হাঁটার বেগ বাড়ার সাথে সাথে লোকটাও হাঁটার বেগ বাড়াচ্ছে।কারণ আমাদের দু’জনের মাঝের দূরত্বটা একই থেকে যাচ্ছে যে।
কে ও! আমাকে জানতেই হবে যে।ঐতো ও !আর একটু জোরে জোরে যেতে পারলেই ধরে নেব ওকে।
আমি রীতিমতো দৌড়াতে শুরু করে দিয়েছি।আর একটু হলেই ওকে ঠিক ধরে নেব।
যাঃ!ও হঠাৎ ডান দিকে বেঁকে যাওয়ায় সামনের পাহাড়টার আড়াল হয়ে গেল।আমিও দৌড়িয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ডান দিকে বাঁক নিলাম।কিন্তু একি ! সামনে যে এক গভীর খাত।আমার সেলফোনের টর্চের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।রাস্তাটা এখানেই শেষ।ইংরাজীতে যাকে বলে দি এন্ড।আমি এপাশে- ওপাশে ,চারপাশে পাগলের মতো আমি টর্চের ফেলতে লাগলাম।টর্চের আলো ফেলে তন্ন তন্ন করে আমি খুঁজলাম।হ্যাঁ অনেক অনেক খুঁজলাম।কোনো জনপ্রাণীর চিহ্ন পর্যন্ত নেই।পোড়া সিগারেটের সেই বিশেষ গন্ধটা এখানে বেশ তীব্র।আমি দাঁড়িয়ে পড়েছি চুপচাপ।এমন সময় পায়ের দিকে চোখ গেল।একটা লালচে লালচে আলো না পায়ের কাছে !
হাতের মোবাইল ফোনটার টর্চের আলো ফেলে দেখি একটা পোড়া সিগারেটের টুকরো পড়ে।যাকে বলে কাউন্টার পার্ট। পাথরের খাঁজে আটকিয়ে আছে ওটা।ধিকি ধিকি জ্বলছে ওটা। তখনও একটু একটু ধোঁয়া উঠছে।
লেখক পরিচিতি : কাজল মণ্ডল, খাগড়া, মুর্শিদাবাদ।