“মনে পড়ে সেই গল্প আমার
তোমার সাথে ছেলেবেলায়,
মুড়ির মোয়া চুপি চুপি
খাওয়াতে দুপুরবেলায়।
তোমার হাতের সেই মিষ্টি ছোঁয়া
বড় যে ভালোবাসি
কে বলে ঠাকুমা তোমার
বয়স পেরিয়ে গেছে আশি!…”
একবছর আগে স্কুল থেকে পাস করা প্রাক্তন ছাত্র ময়ূখের গানে স্কুলের অডিটোরিয়াম হাততালিতে ভরে উঠল। প্রতিবছর মহালয়ার এক সপ্তাহ আগে এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ময়ূখের গান বাঁধাধরা ছিল। তাই স্কুল থেকে পাস করে গেলেও teachers আর junior students ময়ূখকে ছাড়তে চায়নি। ময়ূখ নিজেও চেয়েছিল স্কুলের এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে নিজেকে যুক্ত রাখতে। আর মহালয়ার আগে এই অনুষ্ঠানটা প্রতি বছর হয় একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে – বস্ত্র বিতরণ। কোনো বছর অনাথ আশ্রম, আবার কোনো বছর কাছাকাছি কোনো গ্রাম কিংবা বস্তির মানুষজনকে নতুন বস্ত্র দেওয়া হয়। দশবছর হল এই উদ্যোগটা শুরু হয়েছে স্কুল কমিটি আর ছাত্রদের সহযোগিতায়। এবছর আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ‘স্বপ্ননীড়’ বৃদ্ধাশ্রমের মানুষজনকে। গান, নাচ, আবৃত্তি, নাটক এর পর সবশেষে সবাইকে বস্ত্র দান করে অনুষ্ঠান শেষ হয়।
ময়ূখের গানই শেষ গান ছিল অনুষ্ঠানের। ভীষণ মন ছুঁয়ে যায় সবার। বাসবী দেবীর দুচোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। বড় ভালো গাইল ছেলেটা। নামটা কী যেন announce করেছিল মাইকে! খেয়াল করেননি। অন্য সব ছাত্র আর শিক্ষকদের সঙ্গে সবার হাতে একটা করে নতুন কাপড় আর মিষ্টির প্যাকেট তুলে দিচ্ছে। দূর থেকে খুব পরিষ্কার দেখতে না পেলেও ছেলেটার হাসি মাখা মুখটা ভীষণ ভালো লাগে ওনার।
সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়েছেন ওনারা। বাসবী দেবী সবার শেষে আছেন। সামনের সবাই এগিয়ে গেছেন। ধীর পায়ে উনিও এগিয়ে গেলেন। কাছাকাছি আসতেই ভালো ভাবে দেখতে পেলেন ছেলেটাকে। চমকে উঠলেন বাসবী দেবী। অনেকটা সমরেশ এর মতো দেখতে নাহ!
“নাও ঠাম্মা পুজোয় পরবে কিন্তু। পছন্দ হয়েছে?” হেসে জিজ্ঞেস করে ময়ূখ।
কিছু বলতে পারেননা উনি। অবাক চোখে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করেন, “তোমার নাম কি ময়ূখ?”
“হ্যাঁ গো ঠাম্মা, ময়ূখ চ্যাটার্জী।”
ওকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন বাসবী দেবী। ষোলো বছর আগে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলেন বৃদ্ধাশ্রমে। তখন ময়ূখের বয়স সবেমাত্র তিন বছর। বড় হলেও ছোট্টবেলার সেই মিষ্টতা ভাবটা এখনও রয়েছে মুখে। আর দেখতেও হয়েছে পুরো ওনার ছেলের মতো।
“একি ঠাম্মা, আজ এত আনন্দের দিনে তুমি কাঁদছ?”
নিজেকে ধাতস্থ করতে একটু সময় লাগল বাসবী দেবীর। কেমন আছে সমরেশ? একটুও কি মনে পড়ে না এই বুড়ো মায়ের কথা? আর অঞ্জলি? ওকে তো বৌমার চেয়ে নিজের মেয়ে ভাবতেন বেশী। ও কি এখনও সেই আগের মতোই পার্টিতে যায়? ডিস্কে যায়? একটু আপত্তি করতেন উনি এই পার্টি ডিস্ক নিয়ে, রাতের বেলা drunk হয়ে বাড়ি ফেরা নিয়ে। ছেলেকেও অনেক বারণ করেছিলেন। ময়ূখ তখন দুধের শিশু। ঐ টুকু বাচ্চাকে রাতে ওনাকেই সামলাতে হতো। তাও শেষের দিকে উনি মানিয়ে নিয়েছিলেন। বাড়ির সব কাজও উনি করতেন। বলা ভালো করানো হতো। কিন্তু তাঁর নামে মিথ্যে বলে ছেলের কাছে বৌমার অহেতুক নালিশ আর তারপর দুজনে মিলে তাঁর গায়ে হাত তোলা… নিত্যদিনের এই মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার এবং অসম্মান আর সহ্য হল না। একদিন ভোরে কাউকে কিছু না জানিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন এই বৃদ্ধাশ্রমে। নাহ, ওরা কেউ আর খোঁজ খবর করেনি। বুঝেই গেছিলেন ‘সবচেয়ে কম দামী ছিলাম একমাত্র আমি’। ষোলোটা বছর সন্তানহারা এক মায়ের মতো কাটিয়ে দিলেন আরো কিছু সন্তানহীন মা বাবার সঙ্গে।
“এই নাও ঠাম্মা, একটু জল খাও। কী হয়েছে তোমার?”
বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না বাসবী দেবী। কী হবে বলে? বললে যদি এই ক্ষণিকের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা মেশানো ছোঁয়াটুকু পাল্টে যায়? কিন্তু মা তো! মায়ের মন ‘ছেলে ভালো আছে’ কথাটা শুনতে যে বড্ড ইচ্ছে করছে। আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে বললেন,
“ঠিক তোমার মতো দেখতে আমার এক নাতি ছিল দাদুভাই, তার কথা মনে পড়ে গেল। খুব আনন্দ পেলাম তোমাকে দেখে। ভালো থেকো, বাবা মাকে ভালো রেখো কেমন!”
“আমার তো বাবা মা নেই ঠাম্মা” ম্লান হেসে উত্তর দেয় ময়ূখ।
বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল বাসবী দেবীর।
“বাবা মা নেই মানে?”
“আড়াই বছর হল ওনারা মারা গেছেন।”
এই বৃদ্ধ বয়সে ‘ছেলে ভালো আছে’ শোনার পরিবর্তে ছেলের মৃত্যু সংবাদ সহ্য হল না ওনার। মুহুর্তের মধ্যে ময়ূখের বুকের ওপর ঢলে পড়লেন, আর কোনো জ্ঞান রইল না।
(২)
আশ্রমের জানালার পাশে খাটের ওপর বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছেন বাসবী দেবী। চোখের পাতা ভিজে। শরীর খুব দুর্বল হয়ে গেছে। দুদিন কোনো জ্ঞান ছিল না। ডাক্তার ডাকতে হয়েছিল। আজ ভোরে sense এসেছে। তখন থেকে ক্রমান্বয়ে শুধু কেঁদেই গেছেন। সবাই জানতে চেয়েছে কান্নার কারণ কী। কাউকেই সেভাবে খুলে কিছু বলেননি বাসবী দেবী। কোনোমতে শুধু বলেছেন ওনার ছেলে বৌমা আর নেই। অনেকেই বিভিন্ন ভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু উনি কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছেন না। হাজার হোক, মা তো! ছেলে বৌমা যতই অত্যাচার করুক, কিন্তু তাই বলে মা হয়ে এরকম একটা খবর শোনার পর কী করে নিজেকে স্থির রাখবেন!
এক মুহূর্তের জন্যও কখনো ওদের খারাপ চাননি উনি। আশ্রমের উঠোনে তুলসী মঞ্চে রোজ সন্ধ্যাবেলা মোমবাতি জ্বালতেন, প্রার্থনা করতেন ওদের জন্য। ষোলোটা বছরে একদিনও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তারপরেও সব কেমন যেন তছনছ হয়ে গেল। আচ্ছা, ময়ূখ সত্যিই ওনার নাতি তো? নাকি উনি ভুল করছেন? মনের মধ্যে একটা ভীষণ অস্থির ভাব চলে। মা হয়ে নিজের একমাত্র ছেলের ছেলেকে চিনতে পারবেন না! ময়ূখ যে একদম ওর বাবার মতো দেখতে হয়েছে। মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছে ময়ূখ একটা অন্য ছেলে হলেই ভালো হয় আবার তারপরেই বুকের ভেতর থেকে কে যেন বলছে ময়ূখ ওনার নাতিই হোক। অবুঝ মন যে কী চাইছে নিজেও বুঝতে পারেন না বাসবী দেবী।
“ঠাম্মা আসব?”
চমকে উঠে দরজার দিকে তাকালেন বাসবী দেবী। ময়ূখ দাঁড়িয়ে। হাতে ফলের প্যাকেট। ওনার অনুমতি ছাড়াই ঘরে এসে টেবিলের ওপর প্যাকেটটা রাখতে রাখতে বলল,
“ডাক্তার তোমাকে বেশি করে ফল খেতে বলেছেন ঠাম্মা। ভাবতে পারো দুদিন তুমি পুরো senseless হয়েছিলে! ভাগ্যিস সেদিন তোমাকে আমি পড়ে যাওয়ার সময়ে ধরে ফেলেছিলাম, নাহলে কী হতো বলো তো! এই দুদিন রোজ কলেজ থেকে ফেরার পথে তোমাকে দেখে যেতাম। আজ ভোরে আশ্রম থেকে ফোন করে জানালো তোমার জ্ঞান ফিরেছে। জানো, আমি এসেছিলাম সকালের দিকে, দেখলাম তুমি ঘুমোচ্ছ। ডাক্তারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। বলেছেন ভয়ের কিছু নেই। তবে আনন্দে থাকতে বলেছেন উনি তোমাকে, বুঝলে?”
বাসবী দেবী কিছু বলতে পারেন না। একদৃষ্টে চেয়ে থাকেন ময়ূখের দিকে। ছেলেটা ওনাকে চেনে না জানে না, তাও কতকিছু করেছে এই দুদিনে! আশ্রমের গন্ডি পেরিয়ে এই প্রথম কোনো বাইরের এক মানুষের থেকে ভালোবাসা পেলেন উনি।
“তোমার ঘরের বাকি ঠাম্মা, দাদুরা কোথায়? খেতে গেছে নিশ্চয়ই? তুমি যাওনি কেন তবে?” খাটের ওপর বাসবী দেবীর পাশে বসে পড়ে জিজ্ঞেস করে ময়ূখ।
“আমার ইচ্ছে করছে না খেতে, দাদুভাই” কাপড়ের খোঁটা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললেন উনি।
“তা বললে হবে? জানো তোমার শরীর কত weak! এখন তো বেশি করে খেতে হবে তোমার।”
চুপ করে থাকেন বাসবী দেবী। সকালে একরকম জোর করেই একটু গরম দুধ আর পাঁউরুটি খেয়েছেন। দুপুরে খেতে যেতে আর ইচ্ছে হয়নি। গেলেও কি খাবার তাঁর গলা দিয়ে নামত!
“সেদিন কি তোমার শরীরটা প্রথম থেকেই খারাপ লাগছিল ঠাম্মা? হঠাৎ ওভাবে অজ্ঞান হয়ে গেলে!” ময়ূখ জিজ্ঞেস করে।
“তাই হবে হয়তো” মিথ্যে করে বলেন বাসবী দেবী। তারপর কথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করেন,”তুমি তাহলে একাই থাকো?”
“আমি তো ছোট্ট থেকে একাই থাকি ঠাম্মা। বাবা মায়ের সান্নিধ্য সেরকমভাবে কখনো পাইনি। হোস্টেলে বড় হয়েছি। জানো, যখন ছোট ছিলাম দেখতাম স্কুলের গেটে কত বাবা মা ভিড় করে আছেন ছুটির সময়ে। ছোট ছোট বাচ্চাগুলো দৌড়ে যেতেই ওদের কোলে তুলে নিত, চুমু খেত, কত আদর করত! আমার তো মনেও পড়ে না আমি কখনো রাতে মা বাবার মাঝে শুয়েছি। গরমের ছুটিতে আর পুজোর সময়ে সবাই যখন বাড়ি ফিরে যেত, হস্টেলে আমি একা থাকতাম। কোনো কোনো বছর মা এসে নিয়ে যেত। তাও কটা দিনের জন্য। আমাকে যে দেখাশোনা করার জন্য কেউ থাকতো না বাড়িতে। বাবা প্রায়ই অফিস ট্যুরে যেত। আর মা দুপুরে shopping, friends meeting নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। রাতে দুজনেই পার্টিতে যেত। আমি আমার ঘরে একা একা ঘুমিয়ে পড়তাম।” গলা টা ধরে এল ময়ূখের।
একটু থেমে আবার বলতে থাকল, “মা বাবার সঙ্গে সেভাবে bonding টাই তৈরী হয়নি কখনো। জানো ঠাম্মা, হস্টেলে আমার যে রুমমেট ছিল, অনিল নাম ওর, ও দুর্গাপুরে থাকে। ওর থেকে শুনতাম ওর মা বাবার কথা, ওর ঠাম্মার কথা। বাড়িতে ঠাম্মার কাছে শুয়ে শুয়ে কত রূপকথার গল্প শুনত! আমার তো সেটাও ছিল না।”
বাসবী দেবীর চোখ দিয়ে আবার জল গড়িয়ে পড়ে। ময়ূখ জানেও না যে উনিই ওর ঠাম্মা, নিজের ঠাম্মা। ওনার সেই বিয়ের ছবি ছাড়া আর তো ছবিও নেই কোনো।
“কে বলল তোমার ঠাম্মা নেই দাদুভাই? এই তো আমি আছি। তোমার ঠাম্মা।”
ম্লান হাসে ময়ূখ। উদাস চোখে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলে, “জানো , সেদিন যখন তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলে, মনে হচ্ছিল তুমি আমার ভীষণ আপন। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক feeling হচ্ছিল, যা আগে কখনো হয়নি। মা বাবা কখনো এরকম ভাবে বুকে জড়িয়ে ধরেছে বলে মনেও পড়ে না। ওদের সময়ই ছিল না আমার জন্য।”
বাসবী দেবীর মনে হয় বুকের ভেতর কোথাও যেন দুজনের কষ্টটা একইরকম। পরিবার থেকেও না থাকার কষ্ট। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করেন,
“তোমার বাবা মায়ের কী হয়েছিল যে এভাবে ওনারা দুজনেই চলে গেলেন?”
“Accident. ভোর রাতে হস্টেলে খবর এসেছিল। আমি তখন ইলেভেন এ পড়ি। Drunk অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরছিল রাতে। ব্যাস… Spot dead.”
শিউরে উঠে দুহাতে মুখ ঢেকে বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠলেন বাসবী দেবী। উনি এই ভয়টা পেয়েই ওদের বারণ করতেন। কিন্তু কেউ শুনত না ওনার নিষেধাজ্ঞা। বেশী বলতে গেলে মারধর করত।
“এই দ্যাখো, তুমি আবার কাঁদছ? শরীর খারাপ করবে তো ঠাম্মা! কি অদ্ভুত নাহ! আমার মাকে বাবাকে তুমি চেনো না, তাও ওরা নেই শুনে তোমার কষ্ট হচ্ছে। আমি তো সেইভাবে কিছুই feel করিনি।”
চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বসে রইলেন বাসবী দেবী। ময়ূখের হাতের ছোঁয়ায় আগের থেকে এখন অনেকটা শান্ত লাগছে। এই হাতটা সারাজীবন ধরে রাখতে মন চাইছে।
“তোমাকে একটা কথা বলব, ঠাম্মা?” একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করে ময়ূখ।
“কী দাদুভাই?”
“তুমি আমার কাছে থাকবে? আমার বাড়িতে? আমার বাড়িটা পুরো ফাঁকা পড়ে আছে। বাবা মা চলে যাওয়ার পর হস্টেলের খরচ দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। আর ওরাও সেভাবে কিছুই savings রেখে যায়নি। সব টাকা যে উড়িয়ে দিত party, drinks আর shopping করে। ভালো student ছিলাম তো। তাই tuition পেতে সমস্যা হয়নি। অনেক students পড়াই আমি। আর bank থেকে loan নিয়ে নিজের পড়ার খরচটা চালাই। তুমি থাকবে আমার কাছে? আমার কিন্তু কোনো problem হবে না। বরং ছোটবেলার দাদু, ঠাম্মা, মা, বাবার অভাব টা পূরণ হয়ে যাবে।”
ময়ূখের কাছ থেকে এই কথাটা একেবারেই আশা করেননি বাসবী দেবী। ভাগ্যের কী পরিহাস নাহ! নিজের ছেলে ওনাকে চাইতেন না আর তাঁর নাতি ওনাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য আবদার করছে। মুখে কিছু বলতে পারলেন না। শুধু ময়ূখের হাতটা আরো শক্ত করে ধরে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালেন।
“আমি তাহলে আজই অফিস ঘরে গিয়ে কথা বলছি। জানো অনিল বলত আমাকে ওর ঠাম্মা ওকে নারকেল নাড়ু, আমের আচার কত কিছু করে খাওয়াতো ছুটিতে! আর কতরকম গল্প বলত! তুমি আমাকে ওগুলো করে খাওয়াবে? আমাকে গল্প বলবে তো?”
(৩)
আজ মহালয়া। আজই ময়ূখের সঙ্গে বাসবী দেবী এসেছেন তাঁর ষোলো বছর আগে ছেড়ে চলে যাওয়া শ্বশুরবাড়িতে। ঘরের প্রতিটা কোণে ওনার ভালোবাসার ছোঁয়া। খুব যত্ন করে গড়ে তুলেছিলেন নিজের সংসারকে। মনে পড়ে যায় একদিন এই বাড়িতেই তিনি বউ হয়ে এসেছিলেন। আর আজ এসেছেন ময়ূখের ঠাকুরমা হয়ে।
“তুমি ঘরে গিয়ে বসো ঠাম্মা, আমি সরবত করে আনি। আর তোমার ব্যাগ গুলো ঘরে রেখে দিয়ে আসছি। একদম সংকোচ করবে না। নিজের বাড়ি মনে করে থাকবে। ঠিক আছে তো?” হেসে চলে যায় ময়ূখ রান্না ঘরের দিকে। ছেলেটা বড় খুশি আজ।
খুশি বাসবী দেবীও কম না। কিন্তু তাঁর চোখের জল আজ কিছুতেই বাঁধ মানছে না। অতীতের দিনগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে। মনে পড়ছে সমরেশ – অঞ্জলির কথা, ওনার স্বামী সুনীত এর কথা। নাহ, সুনীত বাবুকে বেশী কষ্ট পেতে হয়নি। ছেলের হাতেই যেটুকু লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে। বৌমার কাছে আর অসম্মান অপমান পেতে হয়নি। সমরেশ এর বিয়ের এক বছর আগেই ওনার heart attack হয়ে যায়।
নিজের bed room এ আসেন বাসবী দেবী। ঘরের রঙ, furniture change হয়েছে, জানালায় ঝুলছে নতুন পর্দা। শুধু দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে সমরেশ এর সেই পুরোনো ছবিটা – প্রথম চাকরি পাওয়ার পর তুলেছিল অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে। সেই ছবির দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। কী দোষ করেছিলেন উনি? সব তো মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। সমরেশ নিজেই পছন্দ করে এনেছিল অঞ্জলিকে। উনি আপত্তি করেননি। নিজের মেয়ে না থাকায় ওর মধ্যেই মেয়েকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। পাননি। পেয়েছেন শুধু অবজ্ঞা আর অবহেলা।
নাহ, তার জন্য মনে একটা সুপ্ত যন্ত্রনা থাকলেও এখন আর কোনো ক্ষোভ নেই। ষোলোটা বছরে অনেক প্রলেপ পড়ে গেছে ক্ষতদাগের ওপর। কিন্তু ছেলে বৌমা যে আর নেই এটা কিছুতেই মন মানতে চাইছে না। হতে পারে অনেক অন্যায় অনেক অত্যাচার ওরা করেছে ওনার ওপর, কিন্তু… ঐ যে একটা কথা আছে নাহ ‘কুপুত্র যদিবা হয়, কুমাতা কদাপি নয়।’ মা হয়ে এই মৃত্যুশোকটা কী করে মেনে নেবেন এত তাড়াতাড়ি?
ট্রে তে করে দু গ্লাস সরবত নিয়ে ঘরে ঢোকে ময়ূখ।
“ওটা আমার বাবার ছবি। মায়ের ছবিও আছে। সেটা পাশের ঘরটায়। বাবা মায়ের বিয়ের একটা ফটো আর বেড়াতে যাওয়ার একটা ফটো – দুটো collage করে একটা ফ্রেমে বাঁধানো।”
“জানি” আস্তে করে বললেন বাসবী দেবী।
“জানো?” ভ্রু কুঁচকে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে ময়ূখ।
চমকে উঠলেন বাসবী দেবী। মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেলেছেন। না, ময়ূখকে উনি কিছুই জানাননি এখনো। থাক না, নাইবা জানল ময়ূখ যে ওর বাবা ওনারই সন্তান। ছেলেটার সঙ্গে ওর বাবা মায়ের কোনোদিনই সেরকম ভাবে bonding ছিল না। উনি আর নতুন করে দূরত্ব বাড়াতে চান না। আর তাছাড়া, যারা আর নেই এই পৃথিবীতে, তাদের সম্পর্কে খারাপ একটা impression অকারণে তৈরী করে কী হবে? হাজার হোক, ওরা তো ছেলেটার জন্মদাতা। কী দরকার ছেলেটার মনে ওর গর্ভধারিণী মা আর জন্মদাত্রী পিতার প্রতি একটা অশ্রদ্ধা ভাব জাগিয়ে তোলার? ময়ূখ তো এই কদিনে ওনাকে নিজের ঠাম্মার চেয়ে কম কিছু ভালোবাসেনি। তাহলে উনি আর নাই বা দিলেন ওনার পরিচয়!
নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে উত্তর দিলেন,
“হ্যাঁ দেখলাম ঐ ঘরে ছবিটা। তখনই বুঝেছি ওনারা তোমার মা বাবা।”
“ওহ আচ্ছা, দেখেছ? আমার সঙ্গেও একটা ফটো আছে, ঐ এক দেড় বছর বয়সে তোলা। ওটা রয়েছে আমার ঘরে। ছোট্টবেলায় ছুটিতে মাঝেমধ্যে যখন বাড়ি আসতাম, তখন মাকে বাবাকে তো পেতাম না রাতে। ঐ ছবিটাই বুকের ওপর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। আর বাবা মা তখন থাকত অনেক দূরে, কোনো এক পার্টিতে।”
মুখ নামিয়ে চুপ করে থাকলেন উনি। নিজের মনে এক অব্যক্ত যন্ত্রণা নিয়ে আরেকজন মানুষের অব্যক্ত যন্ত্রণার কী সান্ত্বনা দেবেন! একজন সন্তানহারা আর অন্যজন মা – বাবা হারা।
“আচ্ছা ঠাম্মা, স্কুলে ঐ programme এর দিন তুমি বলেছিলে আমার মতো দেখতে তোমার এক নাতি আছে। সে কোথায় থাকে গো?”
“সে থাকে… সে থাকে হচ্ছে…বিদেশে” মুখ ফুটেও সত্যি কথাটা বলতে পারলেন না উনি।
“ওহ।” তারপর হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে বাসবী দেবীর পাশে বসে পড়ে ওনার হাত দুটো ধরে বলে, “আচ্ছা ওরা যদি তোমার খোঁজ করে?”
“কারা?” অবাক হলেন উনি।
“তোমার নাতি, নাতবউ, তোমার বাড়ির সব লোকেরা গো। তোমাকে যদি ওরা নিয়ে যেতে চায়…?”
“পাগল ছেলে” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আমিও তোর মতোই দাদুভাই, একা নিঃসঙ্গ। কেউ নেই আমার। শুধু তুই ছাড়া।”
“তাহলে promise করো তোমার এই নাতিকে ছেড়ে তুমি কোথাও যাবে না! আর হ্যাঁ, আরেকটা কথা, তোমার শরীর খারাপ। Full bed rest এ থাকবে তুমি। গীতা মাসি একটু পরেই আসবে। ওকে বলে দিও তুমি যা খাবে। ঠিক আছে? “
“গীতা মাসি কে?”
“আমার জন্য দুবেলার রান্না করে আর ঘর পরিষ্কার করে দিয়ে যায়। আমি তো একা থাকতাম। পড়াশোনা কলেজ সামলে সবকিছু করে উঠতে পারতাম না। তাই পাশের বাড়ির কাকিমাই গীতা মাসিকে ঠিক করে দেয়। মাসি খুব ভালো। তুমি ওকে বলে দিও তোমার যা যা লাগবে। কেমন!”
“পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে তার সাথে” হেসে বললেন বাসবী দেবী।
“হ্যাঁ ঠিক তাই।”
“তা নাতবউ এর কথা যে বললি দাদুভাই, কেউ আছে নাকি ওরকম?” চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করেন উনি।
“ইসসস কি যে বলো নাহ! না আমার ওসব কিছু নেই” লজ্জা পেয়ে বাসবী দেবীর কোলে মুখ লুকোয় ময়ূখ।
ওর অগোছালো চুলগুলো আরো ঘেঁটে দিলেন বাসবী দেবী। কদিন আগেও ভাবতেন ‘আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম’। আর এখন! তাঁর পুত্রভাগ্য ভালো ছিল না, কিন্তু নাতিভাগ্য সত্যিই ভালো। আর কদিন পরেই মা দুর্গা আসছেন। বাতাসে পুজোর গন্ধ। সবার মনে খুশির রেশ। সেই খুশি একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ছে ঠাম্মা – নাতির মনেতেও।
কলমে চন্দ্রলেখা মুখার্জী , বারাসাত
খুব ভালো।
Thank you so much. 😊
খুব ভাল
Thank you.
খুব সুন্দর একটা পরিবেশনা। আগামীর জন্য অনেক শুভকামনা রইল। ধন্যবাদ।।
Many many thanks for your wishes.
দারুন
খুব সুন্দর লেখা
Thanks a lot.
Awesome storyline. Very well written.
Thanks a lot.
খুব ভালো
Darun likhechis….brilliant….sobdo chayan khubi sundor….
Thank you so so much for your comment.
ফিরে পাওয়া গল্পটি হৃদয় ছুঁয়ে যায়। লেখিকা এরকম লেখা আরো লিখতে থাকুক।
Many many thanks.
Touching Story!
Thanks.
Khub valoo❤️❤️..sundar👍
Thanks a lot.
অসাধারন
Thank you.
খুব ভালো হয়েছে। আগামীর জন্য শুভকামনা রইল।
Thanks for your wishes.