ছবি : মন ও মৌসুমী

আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে। কাল খুব ভোরে ওঠা। টুকাই হাঁকডাক শুরু করে দিলো, ভাই বিট্টুকে বলে দিল সিঙ্গাড়ার ব্যবস্থা করতে। সেন বাড়ির গিন্নী- টুকাই বিট্টুর মা, কুহেলি অনুমতি দিয়েছে বন্ধুদের আসতে কাল ভোরে। সেই আনন্দে তারা দুজনেই মেতেছে। কাল মহালয়া। ভোর চারটে তে উঠে মুখ ধুয়ে পাড়ার বন্ধু আর বাড়ির সকলে মিলে একসাথে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র মহাশয়ের পাঠে মহালয়া শোনার আনন্দই আলাদা। মহালয়া মানেই পূজো পূজো রব। দারুন আনন্দের কটা দিন।
মা আর ঠাম্মা যাবে গঙ্গা স্নানে। সাথে বাবা কে নিয়ে যাওয়ার খুব ইচ্ছে , বাবা কিন্তু কিন্তু করছে । সেই শুনে ঠাম্মা টুকাই কে যেতে বললো। টুকাই শুনে খুব খুশি। কতদিন গঙ্গার ঘাটে যায় নি সে। পড়াশোনার চাপ। কলেজ থেকে ফিরে সব সেরে তার আর যাওয়াই হয় না। সকালের গঙ্গার আলাদা রূপ আছে।
স্নিগ্ধ ,মায়াবি!! একমনে বসে থাকা যায়, হালকা হিমেল স্পর্শে। কিন্তু কাল তা হবে না, সবাই তর্পণ করবে, স্নান করবে। বেশ কোলাহল থাকবে ঘাটে। তার আবেশ বেশ অন্যরকম। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যে কেটে গেল কখন টুকাই বুঝতেই পারে নি।
হঠাৎ দিদি ডাক শুনে সে চমকে উঠলো। বিট্টু এসে বললো-
” দিদি চল, মা খেতে দিয়েছে”
–“তুই যা, আমি আসছি”।
এই বলে টুকাই মনে মনে কালকের স্বপ্ন বুনে খাওয়ার টেবিলে হাজির। চটপট ডিনার সেরে মোবাইলে এলার্ম সেট করে শুয়ে পড়লো।
নির্ধারিত সময়ে মোবাইলে বেজে উঠলো। একটু গড়িয়ে সে উঠে পড়ল। ততক্ষনে মা বাবা ঠাম্মা সবাই উঠে পড়েছে। কিন্তু বিট্টু কই, সে তখন পরে পরে ঘুমোচ্ছে।
—“ভাই ওঠ, এখুনি সবাই এসে পড়বে। মহালয়া শুরু হয়ে যাবে”।
— “উঠছি উঠছি”!!
–“হ্যাঁ, ওঠ। সিঙ্গাড়া ও আনতে যাবি তো”।
যাচ্ছি যাচ্ছি বলে বিট্টু উঠে পড়ল। পাড়ার দোকানে বলা ছিল, সিঙ্গারাও রেডি ছিল। টুক করে গিয়ে নিয়ে এলো সে। ততক্ষনে বন্ধুরাও এসে গেছে। যথা সময়ে মহালয়া শুরু হলো। এই অসাধারণ পাঠ, মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। সবাই একমনে মহালয়া শুনছে। শঙ্খ ধ্বনি দিয়ে শুরু হলো “ইয়া দেবী”. . .
কি করে যে দের ঘন্টা কেটে যায় বোঝাই যায় না। গায়ে কাঁটা দেওয়া পাঠ। নিদারুণ ভালো লাগা বাঙালির হৃদয় জুড়ে। সব শেষে চা সিঙ্গাড়া খেয়ে হৈ হৈ করে কিছু সময় কাটলো। বন্ধুদের সাথে মিলে মহালয়া শোনার অভিজ্ঞতাও বেশ রমরমে।
প্যাঁক প্যাঁক শব্দে জানান দিলো রিক্সা নিয়ে এসে গেছে কালুদা। তিনজনে রিক্সায় বসে গঙ্গার দিকে এগোলো।
গঙ্গার ঘটে পৌঁছে টুকাইএর মনে এক অন্য ভালোবাসা জন্ম নিল। অবিররাঙা আকাশে পেঁজা তুলোর মতই কিছু মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘাটের সিঁড়ি গুলো যেন অবলীলাক্রমে নেমে গেছে জলে বিলীন হতে। পৈতে হাতে কেউ তর্পনে নিমগ্ন। কেউ কেউ তর্পণ করতে চলেছে কোমর জলে। অনেকে স্নান সেরে সূর্য প্রণাম করছে। দূরে নৌকা গুলো ভেসে চলেছে মাছের খোঁজে। সারি দেওয়া অনেক গাছের মাঝেও গন্ধরাজ গাছটা টুকাই এর প্রিয়। বেশ মোহময় পরিবেশে ঘোরের মধ্যে ছিল টুকাই। হঠাৎই মনে হলো কেউ যেন তার দিকে এগিয়ে আসছে। চেনা চেনা লাগছে দূর থেকে কিন্তু ঝাপসা খুব। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে এখন পুরোপুরি স্পষ্ট , সামনে।
— “টুকাই তুই !! সত্যিই তুই টুকাই তো?”
–“ঠিকই চিনেছো বুবুনদা। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না”।
–“কেন? আমাকে দেখে তুই কি খুশি হোসনি?”
অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে টুকাই। বাকহীন ভাবে মাথা নেড়ে খুশির জলে জানান দিলো। কিছুক্ষন মান অভিমানের পালার পর তারা দুজনেই এখন আবার চার বছর আগের সেই দিন গুলোতে ফিরে গেল। গৃহ শিক্ষক হিসেবে একদিন তার বাড়িতে এসেছিল বুবুন। খুব মেধাবী ভালো ছেলে। টুকাইও ভালো ছাত্রী। অঙ্ক করতে করতে কখন যেন নিজেরাই ভালোলাগার ইকুয়েশনে পরেছিল। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই চাকরি সূত্রে বিদেশ পাড়ি দিলো সে। যে কোনো ভাবেই হোক যোগাযোগ হয় নি এই কটি বছর। আবার আজ এই মহালয়ার সকালে শিশির ভেজা ঘাটের সিঁড়িতে বসে হালকা হাওয়ার মৃদু দোলায় ভালোবাসার প্রাণদান হলো। গন্ধরাজের গন্ধে আজ মিশে গেল ভালোবাসার রঙিন আতর। দেবী বন্দনার সাথে তারা একে অপরের সঙ্গোপনে থাকার পরশ নিলো মনে। এখনো মহালয়ার হালকা সুর ভেসে আসছে দূর থেকে “বাজলো তোমার আলোর বেনু”. . .

 

কলমে দীপিতা চ্যাটার্জী, মুম্বাই

লাবণ্য পত্রিকার সম্পাদিকা, তাঁর লেখায় ইতিমধ্যে অলংকৃত হয়েছে অনেক অন্তর্জাল ম্যাগাজিন এবং পত্রিকা। সাম্প্রতিক প্রকাশিত হয়েছে তার লেখা কাব্যগ্রন্থ ‘মেঘ বৃষ্টির উপখ্যান’.



1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here