খুবই চিন্তায় রয়েছে ক্রিপ্লিলাস। বিশ্বে যে হারে বৃক্ষ নিধন হয়ে চলেছে, খুব শীঘ্রই মানুষ অক্সিজেন এবং না খেতে পেয়ে মারা যাবে। সে যুগের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হয়েও কিছু করতে পারবে না, ভাবতেই তার মেরুদন্ডে উষ্ণ রক্তের স্রোত বয়ে চলে। কী করে অক্সিজেনের যোগান দেবে ও খাদ্য সরবরাহ করবে তা ভাবতে ভাবতেই ল্যাবে প্রবেশ করে ক্লাসিবিও। ক্রিপ্লিলাস ক্লাসিবিও কে পছন্দ করলেও কিছু বলতে পারে না, ওর সামনে কথা বলতে গেলেই ওর যুক্তি আর কাজ করে না। শুধু ক্লাসির কথাই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে শোনে।ক্রিপ্লিলাস কে চিন্তিত দেখে বলে উঠলো,
“কী হয়েছে ক্রিপ্লি?”
“তুমি কী অনুভব করতে পারছ মানুষ শীঘ্রই তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলবে?”
“এটাই কি তোমার দুশ্চিন্তার কারণ?”
“দুশ্চিন্তা করার জন্য কী কারণটা যথেষ্ট নয়? মানুষ উন্নত মস্তিস্কের প্রাণী। যত বেশী উন্নত হবে তত বেশি বিলুপ্ত হবে। ৫০ বিলিয়ন বছর আগে ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়েছে কিন্তু তেলাপোকা এখনও রয়ে গিয়েছে। ইউনিভার্স থেকে ক্ষুদ্র প্রাণ হারিয়ে যায় না। বৃহৎ প্রাণের অভ্যন্তরে রয়েছে ক্ষুদ্র প্রাণ, এটাকে বলে এন্টি-প্লাজমিকবডি। মৃত্যুর পর বৃহৎ প্রাণ ধ্বংস হলেও ক্ষুদ্র প্রাণ থেকে অ্যামিবা সৃষ্টি হয়ে নতুন করে জীবন শুরু করে। মানুষ তা পারে না। তাই বিলুপ্তির আশঙ্কা মানুষেরই বেশী!”
“হ্যাঁ, তা হয়তো ঠিক। কিন্তু এখনও আমরা হারিয়ে যাইনি। তাই কিছু আশা রয়েছে। তুমি কী বুঝতে পারছ আমি কি বলছি?”
“না, ক্লাসিবিও। আমি কোনো আশা দেখছি না, তাই তোমার কথাও বুঝছি না!”
“গাছ নিঃশেষ হলেও একটা জিনিস কিন্তু ইউনিভার্সে রয়ে গেছে, বাতাস।”
“তো বাতাস দিয়ে কী হবে?”
“দেখ ক্রিপ্লি, বাতাসে কী কী উপাদান রয়েছে?”
“অক্সিজেন(O2), কার্বন(C2 ), নাইট্রোজেন(N2 ), মিথেন(CH4 ), সালফার(S4 ), হাইড্রোজেন(H2), জলীয় বাষ্প, ধোঁয়া, ধূলা এগুলোই!”
“আমরা কী এগুলো দিয়ে কৃত্রিম খাদ্য তৈরী করতে পারি না?”
“কী?”, এটুকু বলতেই থামতে হলো তাকে।
এমন সময় ভেতরে এসে পড়ে গ্লাহ্রিজ। এসেই তান্ডব শুরু করে দিল।
“ইউনিভার্স থেকে নিশ্চিহ্ন হতে চলেছি আমরা বৃক্ষের অভাবে আর তোমরা গল্প করছ?”- রাগে কেঁপে কেঁপে কথা বলছিল সে।“লক্ষ লক্ষ আলোক বর্ষ দূরে নতুন প্রাণের অস্তিত্ব গড়ে উঠবে আর আমাদের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন মনে করে ল্যাবে নিয়ে কাজ করবে। আমরা কী গিনিপিগ?”
গ্লাহ্রিজের কথা শুনে হেসে উঠলো ক্লাসিবিও।
গ্লাহ্রিজ রাগান্বিত স্বরে বলল, “এই মেয়ে তোমার হাসি পাচ্ছে? এটা ল্যাব, কোনো সার্কাস নয়। তুমি তোমার ল্যাবে যাও। হ্রিগা, ফ্লক্সি বা জাল্বান আছে তো। ওরা ক্রিপ্লিকে সাহায্য করতে পারবে।
“দুঃখিত, স্যার।”, আর কথা বাড়াল না ক্লাসিবিও।
আজ দুদিন পর ক্রিপ্লিলাস এবং ক্লাসিবিও ওদের দেখা হয়েছে। ক্রিপ্লিলাস তার কাছে জানতে চাইছিল সেদিন ও কি বলতে যাচ্ছিল?
“ও আচ্ছা, সেদিন – থাক তোমার আর আমার ল্যাব আলাদা, তুমি তোমার মত করে কর। আমি বরং যাই।”
“দাঁড়াও ক্লাসিবিও, যেও না। আমি জানি তুমি রেগে আছ, আর সেটাই স্বাভাবিক। তাও বলছি আমাকে সাহায্য কর।”
একটা সূর্যমুখী ফুল দিয়ে রাগ ভাঙায় ক্লাসির।
“এখন বল।“
“ও, সুবিধা নেওয়ার জন্য এত কিছু!”
“না, না কী যে বল! আমি এমন মোটেই নই।”
“তাহলে এত আয়োজন কেন?”
“কই আয়োজন? একেবারেই তো না! তোমার জন্য যে আয়োজন করতে পারতাম তাই সাহসে কুলোয় না আর এখন আয়োজন করব?”
“কিসের আয়োজন?”
“আরে কিছু না এমনি।”
ক্লাসি বুঝতে পেরে মুচকি হাসি হাসল। তারপর বলল, “তাহলে আমি আর বলছি না। যেহেতু কিছুই না তাই, আমিও কিছুই বলব না। ”
“ আরে বল প্লিজ।”
“ঠিক আছে , দেখ প্রোটিন কি দিয়ে তৈরী?”
“অ্যামাইনো এসিড। যা পাওয়া যায় বাতাসের নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, সালফার ,কার্বন। এগুলো দিয়ে কৃত্রিম প্রোটিন বানাই? N2,O2,H2,S4,C2 তো বাতাসেই আছে, তাই না? আর কার্বোহাইড্রেটের জন্য কিন্তু বায়ুর O2, N2, C2 ব্যবহার করতে পারি! ফ্যাট দ্রব্য বায়ুর বিভিন্ন উপাদানের সংমিশ্রণে বানাতে পারি।”
“কিন্তু তোমার কী মনে হয়, এটা খুব একটা সহজ হবে?”
“হওয়ালেই হবে। তোমার মতো এত হতাশাগ্রস্ত মানুষ দুটো নেই।”, ঈষৎ বকে দেয় ক্লাসি।
“ঠিক আছে, বল, কী করতে হবে?”
“আমরা জানি, মানুষের দেহের শক্তিঘর মাইট্রোকন্ড্রিয়া। এখানে যদি আমরা ATP কে মাইট্রোকন্ড্রিয়াতে সঞ্চয় করে কিন্তু কোষের সকল জৈবিক ক্রিয়া করতে পারি। আমরা মানুষের গড় আয়ু বের করে তার জীবনের জন্য যদি প্রয়োজনীয় ATP – এর ক্যাপসুল দিই তবে কিন্তু মানুষ পুরো জীবনে না খেয়েও প্রয়োজনীয় শক্তি পাবে! মানব অস্তিত্ব টিকে থাকবে এই ইউনিভার্সে।”
“কিন্তু সেটার জন্য তো কোনো যন্ত্র নেই!”
“কিন্তু দেখ, আমরা আমাদের মাইট্রোকন্ড্রিক লাইটিং পয়েন্ট ব্যবহার করতে পারি। আমরা লেসার রশ্মি দিয়ে এর গঠন পরিবর্তন করে দিই। অ্যান্টি ক্লক ওয়াইজ লেসার -৩৬০° দিয়ে করতে পারি, তাইনা?”
যেই বলা সেই কাজ। কিন্তু ওদের জন্য বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় গ্লাহ্রিজ। একত্রে কাজ করায় তার আপত্তি। কারণ ওদের ল্যাব আলাদা। অবশ্য কারণ এটা দেখালেও ক্লাসি জানতো যে গ্লাহ্রিজ তাকে পছন্দ করলেও সে তাকে করে না। তাই ক্রিপ্লিকে ওর সাথে কল্পনাও করতে পারে না। এ জন্যই সে তাদের একত্রে কাজ করতে দিতে চায় না।কিন্তু তারা বাঁধা-বিপত্তিকে পরোয়া করে না সে, কাজে লেগে পরে ।
টানা চার দিন চেষ্টার পর আজ তারা নতুন করে এর গঠনে পরিবর্তন আনতে পেরেছে। তারা মিলিত হয়ে নতুন প্রচেষ্টায় সফল হয়। এখন তারা কয়েনিক বডি তৈরীতে লেগে পরে। সফল হবার এক অদম্য আকর্ষণ তাদের ঘিরে রেখেছে। সফল হতেই হবে।
দশ বছর পর…..
“আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড, এক্ষুনি আমরা সফল হতে পারব, পরবর্তী প্রজন্মকে টিকিয়ে রাখতে পারব।”- বলে উঠল ক্রিপ্লি। আজ ওদের সম্পর্কের মাঝে পরিবর্তন এসেছে। আজ তারা একে অন্যের পরিপূরক। ক্লাসি আজ ক্রিপ্লির সন্তানদের মা। গ্লাহ্রিজ আজ ওদের আর বিষ দৃষ্টিকে দেখে না। ক্রিপ্লির চোখের সামনে আজও ২৫-২৬ বছরের তরুণী ক্লাসির ছবি ভাসে, কাজ করতে করতে তাদের মধ্যে ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা গড়ে ওঠে। আজ তাদের এই সম্পর্ক সবার কাছে স্বীকৃত।
মাইট্রোকন্ড্রিক লাইটিং পয়েন্ট আজ সক্ষম হয়েছে ATP কে সংরক্ষণ করতে। মাত্র সাত-শত ইউনিট সঞ্চয় করে এটি মানুষকে সবসময়ের শক্তির যোগান দেবে। ক্রিপ্লিলাস ও ক্লাসিবিও ওদের যৌথ চেষ্টায় গড়ে উঠেছে এই শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার। মানব সভ্যতার রক্ষক। ওরা এ ক্যাপসুলটার নাম দিয়েছে,
“ মাইট্রোকন্ড্রিক বায়োপ্লাজমিক কয়েন।”
কলমে নাহিয়ান তাসনিম নায়লাহ্, ঢাকা, বাংলাদেশ
নারায়ণগঞ্জ গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্রী