সন্ধ্যা ৬.৪৫, দমদম স্টেশনে ভিড় থিক থিক করছে। এইমাত্র অ্যানাউন্স হলো আপ কৃষ্ণনগর লোকাল এক নম্বর প্লাটফর্মে আসছে। স্টেশনের বাইরে, একটা চায়ের দোকানে কোনরকমে তাড়াতাড়ি চা টা শেষ করেই দৌড় লাগালো সুশান্ত। এই ট্রেনটা তাকে ধরতেই হবে, নাহলে আবার সেই এক ঘণ্টার অপেক্ষা। প্লাটফর্মে ঢুকেই ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল সুশান্ত, ট্রেন ঢুকছে। হ্যান্ডেল ছেঁড়া পুরনো ব্যাগটাকে বা হাতে আঁকড়ে ধরে সুশান্ত রেডি, সারাদিনের ক্লান্তি আর জুনের পচা গরমে জামাটা ভিজে গায়ের মধ্যে সপ সপ করছে। ট্রেন থামার আগেই গুটিকয়েক লোক নেমে পরল, এইবার শুরু যুদ্ধ, প্রায় জনা পঞ্চাশেক লোক গেটের মধ্যে হামলে পড়ল কে আগে উঠবে। মিনিট দুয়েক চঞ্চলতা, তারপর ট্রেন আবার সাইরেন বাজিয়ে ছুটল আপন গতিতে।কোনরকমে পাদানিতে পা রেখে ডান হাতটা দিয়ে ভিতরের হ্যান্ডেল ধরে সুশান্ত আপ্রাণ চেষ্টা করছে ভিতরে ঢুকবার। আরেকটু ,আর একটু ঢুকলেই মোটামুটি সেফ। পিছনের পোস্টগুলো একটার পর একটা মৃত্যুকে ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে। সদ্য ঘনিয়ে আসা অন্ধকার চিরে ট্রেনটা এগিয়ে চলেছে আপন লক্ষে।
গত ছয় মাসের মধ্যে সুশান্ত এই নিয়ে তিনবার চাকরির জায়গা বদলালো। কোথাও মালিকের সঙ্গে বনিবনা হয় না, আবার কোথাও বা একদমই পয়সা কম। এদিকে বাজারে জিনিসপত্রের দাম আগুন। শেষমেষ পাড়ার বলাইদা কে ধরে এই চাকরি জুটিয়েছে সুশান্ত। সুশান্তর একটি ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে আছে, নাম হিতৈষী। আড়াই বছরের ছোট বাচ্চাটা যখন সুশান্তর গলা জড়িয়ে ধরে বাপি বলে ডাকে, সমস্ত দুঃখ বেদনা ক্লান্তি কোথায় যেন হাওয়া হয়ে যায়। বড় মায়া জড়ানো ওই মুখে। এই ট্রেনটা ধরার আরও একটা কারণ, তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছানো যাবে। ছুটি হলে পরে সুশান্তর মন যেন আর কোথাও টিকতে চায় না। আজ ঠিক করেছে মেয়েটার জন্য একটা সুন্দর ডান্সিং ডল কিনে নিয়ে যাবে। মেয়ের হাসি মুখের কথা ভেবে সুশান্তর মনটা আনন্দে ভরে উঠলো। 

এই নৈহাটি স্টেশন ছেড়ে ট্রেনটা আবার যাত্রা শুরু করলো।এখন ভিড়টা অনেকটা হালকা হয়েছে, ধারের একটি সিট খালি হতেই সুশান্ত কোনরকমে বসার জায়গা পেল। ট্রেনে হকাররা বিভিন্ন রকম পসরা সাজিয়ে উঠেছে রোজকার মত, পকেট হাতরে 5 টাকা দিয়ে একটা বাদামের প্যাকেট কিনলো। মেহুলি বাদাম খেতে বড় ভালোবাসে। বিয়ের পর থেকে একটানা সংসারের জোয়াল টেনে চলেছে, ঘরের বাইরের সমস্ত কাজ একাই সামলায় সে। এত কষ্টের মধ্যেও মুখে কি করে হাসিটি লেগে থাকে আজো বুঝে ওঠে না সুশান্ত। 
রাত প্রায় ন’টা, কৃষ্ণনগরের আগের স্টেশনে নামবে সে। অণামী স্টেশন, গুটিকয়েক লোকের আনাগোনা। আস্তে আস্তে স্টেশনে ট্রেন ঢুকলো, আনমনে ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে সুশান্ত কেমন করে জানি হঠাৎ ট্রেনের আর স্টেশনের মাঝখানের গ্যাপটা তে পড়ে গেল । হায়রে অদৃষ্ট! অনেক চেষ্টা করে ছটফট করতে করতে সুশান্ত আপ্রাণ চেষ্টা করছে ওইখান থেকে বেরোনোর, কিন্তু, কিছুতেই পেরে উঠছেনা চারিদিকে হৈ চৈ, সবাই চেষ্টা করছে তাকে কোনরকমে বাঁচানোর, কিন্তু হায়রে বিধির লিখন! ড্রাইভার এর কান অব্দি পৌঁছালো না সে আকুতি।
 “জিন্দেগী এক সফর হ্যয় সুহানা”-
ড্রাইভার এর কানের হেডফোনে বেজে চলেছে সেই  বিখ্যাত গান। নিয়মমাফিক সাইরেন দিয়ে সিগন্যাল হতেই ট্রেনটা এগিয়ে চলল, চাকার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেল কিছু মাংসের দলা, কিছু রক্ত, কিছু স্বপ্ন।ট্রেন চলে যেতেই আশেপাশের মানুষ ভিড় করে দাঁড়ালো, খোঁজ চলল কোথাকার লোক ইনি। কিছু স্বহৃদয় মানুষের চেষ্টায় একটি আউটগোয়িং কল গেল  সুশান্তর মোবাইল থেকে, শেষ ফোন।

 সবার অলক্ষ্যে বাদামের প্যাকেটটা ছড়িয়ে আছে স্টেশনে এক কোণে, একটা ইঁদুর সে প্যাকেটটা নিয়ে দৌড় দিল, নিজে না খেয়ে কার জন্য নিয়ে গেলো কে জানে।
আত্মা  –    তার স্বভাব চঞ্চল, স্মৃতিহীন, প্রাণের আধার খুঁজে সেখানে প্রাণসঞ্চার করাই তার উদ্দেশ্য। সুশান্ত আত্মাও মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই খুঁজে নিয়েছে নিজের আধার। 
কিছুক্ষণ আগেই মাছির ডিম থেকে প্রস্ফুটিত হয়েছে একটি নতুন প্রাণ। ঘণ্টা দুয়েক তার জৈবিক বিকাশ এর পর অন্য মাছিদের সাথে বেরিয়েছে খাবারের সন্ধানে। ও জানে না কিছুক্ষণ আগে  ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা। উড়তে উড়তে খাবারের সন্ধানে মাছিটা এসে বসেছে ঠিক রেললাইনের উপর, মাঝখানে। এই প্রথম রক্ত, পচা গন্ধ , মাংসের সাথে প্রথম পরিচয়। বেশ উপাদেয়।
গভীর আত্মমগ্ন হয়ে খাবারের রস, স্বাদ, গ্রহণ করছিল মাছিটা। হঠাৎ তীব্র আওয়াজ। রেললাইনে তীব্র কম্পন। মাছির দুচোখ জুড়ে ট্রেনের হেডলাইটের জোরালো আলো। মাছিটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। নিজেকে বাঁচাবার জন্য ডানা মেলে উড়বার আগেই, কি যেন একটা দানবীয় বস্তু তাকে পিষে দিয়ে চলে গেল নিজের গন্তব্যে।
হ্যাঁ, একই কষ্ট, একই যন্ত্রণা, একই আর্তনাদ। আগেরটা শুনতে পাওয়া গেছিল, আর এটা নীরব।
আর আত্মাটা আবার খুঁজে নিয়েছে নতুন প্রাণের আঁধার, এখন সে হয়তো বা আমার আপনার আশেপাশের খুব পরিচিত কেউ। কে জানে।
জিন্দেগী এক সফরমাছি ——–

সন্ধ্যা ৬.৪৫, দমদম স্টেশনে ভিড় থিক থিক করছে। এইমাত্র অ্যানাউন্স হলো আপ কৃষ্ণনগর লোকাল এক নম্বর প্লাটফর্মে আসছে। স্টেশনের বাইরে, একটা চায়ের দোকানে কোনরকমে তাড়াতাড়ি চা টা শেষ করেই দৌড় লাগালো সুশান্ত। এই ট্রেনটা তাকে ধরতেই হবে, নাহলে আবার সেই এক ঘণ্টার অপেক্ষা। প্লাটফর্মে ঢুকেই ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল সুশান্ত, ট্রেন ঢুকছে। হ্যান্ডেল ছেঁড়া পুরনো ব্যাগটাকে বা হাতে আকড়ে ধরে সুশান্ত রেডি, সারাদিনের ক্লান্তি আর জুনের পচা গরমে জামাটা ভিজে গায়ের মধ্যে সপ সপ করছে। ট্রেন থামার আগেই গুটিকয়েক লোক নেমে পরল, এইবার শুরু যুদ্ধ,প্রায় জনা পঞ্চাশেক লোক গেটের মধ্যে হামলে পড়ল কে আগে উঠবে। মিনিট দুয়েক চঞ্চলতা, তারপর ট্রেন আবার সাইরেন বাজিয়ে ছুটল আপন গতিতে।কোনরকমে পাদানিতে পা রেখে ডান হাতটা দিয়ে ভিতরের হ্যান্ডেল ধরে সুশান্ত আপ্রাণ চেষ্টা করছে ভিতরে ঢুকবার। আরেকটু ,আর একটু ঢুকলেই মোটামুটি সেফ। পিছনের পোস্টগুলো একটার পর একটা মৃত্যুকে ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে। সদ্য ঘনিয়ে আসা অন্ধকার চিরে ট্রেনটা এগিয়ে চলেছে আপন লক্ষে।
গত ছয় মাসের মধ্যে সুশান্ত এই নিয়ে তিনবার চাকরির জায়গা বদলালো। কোথাও মালিকের সঙ্গে বনিবনা হয় না, আবার কোথাও বা একদমই পয়সা কম। এদিকে বাজারে জিনিসপত্রের দাম আগুন। শেষমেষ পাড়ার বলাই দা কে ধরে এই চাকরি জুটিয়েছে সুশান্ত। সুশান্তর একটি ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে আছে, নাম হিতৈষী। আড়াই বছরের ছোট বাচ্চাটা যখন সুশান্তর গলা জড়িয়ে ধরে বাপি বলে ডাকে, সমস্ত দুঃখ বেদনা ক্লান্তি কোথায় যেন হাওয়া হয়ে যায়। বড় মায়া জড়ানো ওই মুখে। এই ট্রেনটা ধরার আরও একটা কারণ, তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছানো যাবে। ছুটি হলে পরে সুশান্তর মন যেন আর কোথাও টিকতে চায় না। আজ ঠিক করেছে মেয়েটার জন্য একটা সুন্দর ডান্সিং ডল কিনে নিয়ে যাবে। মেয়ের হাসি মুখের কথা ভেবে সুশান্তর মনটা আনন্দে ভরে উঠলো। 

এই নৈহাটি স্টেশন ছেড়ে ট্রেনটা আবার যাত্রা শুরু করলো।এখন ভিড়টা অনেকটা হালকা হয়েছে, ধারের একটি সিট খালি হতেই সুশান্ত কোনরকমে বসার জায়গা পেল। ট্রেনে হকাররা বিভিন্ন রকম পসরা সাজিয়ে উঠেছে রোজকার মত, পকেট হাতরে 5 টাকা দিয়ে একটা বাদামের প্যাকেট কিনলো। মেহুলি বাদাম খেতে বড় ভালোবাসে। বিয়ের পর থেকে একটানা সংসারের জোয়াল টেনে চলেছে, ঘরের বাইরের সমস্ত কাজ একাই সামলায় সে। এত কষ্টের মধ্যেও মুখে কি করে হাসিটি লেগে থাকে আজো বুঝে ওঠে না সুশান্ত। 
রাত প্রায় ন’টা, কৃষ্ণনগরের আগের স্টেশনে নামবে সে। অণামী স্টেশন, গুটিকয়েক লোকের আনাগোনা। আস্তে আস্তে স্টেশনে ট্রেন ঢুকলো, আনমনে ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে সুশান্ত কেমন করে জানি হঠাৎ ট্রেনের আর স্টেশনের মাঝখানের গ্যাপটা তে পড়ে গেল । হায়রে অদৃষ্ট! অনেক চেষ্টা করে ছটফট করতে করতে সুশান্ত আপ্রাণ চেষ্টা করছে ওইখান থেকে বেরোনোর, কিন্তু, কিছুতেই পেরে উঠছেনা চারিদিকে হৈ চৈ, সবাই চেষ্টা করছে তাকে কোনরকমে বাঁচানোর, কিন্তু হায়রে বিধির লিখন! ড্রাইভার এর কান অব্দি পৌঁছালো না সে আকুতি।
 “জিন্দেগী এক সফর হ্যয় সুহানা”-
ড্রাইভার এর কানের হেডফোনে বেজে চলেছে সেই  বিখ্যাত গান। নিয়মমাফিক সাইরেন দিয়ে সিগন্যাল হতেই ট্রেনটা এগিয়ে চলল, চাকার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেল কিছু মাংসের দলা, কিছু রক্ত, কিছু স্বপ্ন।ট্রেন চলে যেতেই আশেপাশের মানুষ ভিড় করে দাঁড়ালো, খোঁজ চলল কোথাকার লোক ইনি। কিছু স্বহৃদয় মানুষের চেষ্টায় একটি আউটগোয়িং কল গেল  সুশান্তর মোবাইল থেকে, শেষ ফোন।

 সবার অলক্ষ্যে বাদামের প্যাকেটটা ছড়িয়ে আছে স্টেশনে এক কোণে, একটা ইঁদুর সে প্যাকেটটা নিয়ে দৌড় দিল, নিজে না খেয়ে কার জন্য নিয়ে গেলো কে জানে।
আত্মা  –    তার স্বভাব চঞ্চল, স্মৃতিহীন, প্রাণের আধার খুঁজে সেখানে প্রাণসঞ্চার করাই তার উদ্দেশ্য। সুশান্ত আত্মাও মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই খুঁজে নিয়েছে নিজের আধার। 
কিছুক্ষণ আগেই মাছির ডিম থেকে প্রস্ফুটিত হয়েছে একটি নতুন প্রাণ। ঘণ্টা দুয়েক তার জৈবিক বিকাশ এর পর অন্য মাছিদের সাথে বেরিয়েছে খাবারের সন্ধানে। ও জানে না কিছুক্ষণ আগে  ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা। উড়তে উড়তে খাবারের সন্ধানে মাছিটা এসে বসেছে ঠিক রেললাইনের উপর, মাঝখানে। এই প্রথম রক্ত, পচা গন্ধ , মাংসের সাথে প্রথম পরিচয়। বেশ উপাদেয়।
গভীর আত্মমগ্ন হয়ে খাবারের রস , স্বাদ ,গ্রহণ করছিল মাছিটা। হঠাৎ তীব্র আওয়াজ। রেললাইনে তীব্র কম্পন। মাছির দুচোখ জুড়ে ট্রেনের হেডলাইটের জোরালো আলো। মাছিটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। নিজেকে বাঁচাবার জন্য ডানা মেলে উড়বার আগেই, কি যেন একটা দানবীয় বস্তু তাকে পিষে দিয়ে চলে গেল নিজের গন্তব্যে।
হ্যাঁ, একই কষ্ট, একই যন্ত্রণা,,,,, এক ই আর্তনাদ।আগেরটা শুনতে পাওয়া গেছিল, আর এটা নীরব।
আর আত্মাটা আবার খুঁজে নিয়েছে নতুন প্রাণের আঁধার, এখন সে হয়তো বা আমার আপনার আশেপাশের খুব পরিচিত কেউ। কে জানে।
জিন্দেগী এক সফর হ্যয় সুহানা…

কলমে কৃষ্ণেন্দু দে, রহড়া, কলকাতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here