রবিবার বেলা দশটা পর্যন্ত বিছানায় গড়ানোটা আমার চিরকেলে অভ্যাস, ওসময় মোবাইল ফোনটা উৎপাত বিশেষ! তাই আমার সাথে সাথে ওটার ঘুম ভাঙ্গতেও দুপুর গড়িয়ে যায়। পরিচিতেরা মোটামুটি আমার অভ্যেস সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তাই সাধারনত ওইসময়টা কেউ ঘাটায় না যদিও সেদিন নিয়মভঙ্গ হল। সদর দরজায় বেল টেপার শব্দ। ঘাপটি মেরে পরে রইলাম, যেই আসুক না কেন, নিতাই নিশ্চয়ই খেঁদিয়ে বিদায় করবে, যদিও একটু পরে নিতাই এসে কাঁচুমাচু করে বলল –‘জয়ন্তদা এসেছে’। জয়ন্ত এসময়! বেশ অবাক হলাম, এতো সকালে কি ব্যাপার? নিতাই কিছু বলার আগেই অবশ্য জয়ন্ত দরজার সামনে এসে হাজির হয়েছে, আমাকে দেখে দাঁত খিঁচিয়ে বলল –‘যেমন তুই, তেমন তোর চাকর, তখন থেকে বেল টিপছি দরজা খুলতে এতো দেরি কেন? উত্তর দেবার আগে ওই ফের ঝড়ের বেগে বলল –‘এখুনি একবার হাসপাতালে যেতে হবে অমল ভর্তি হয়েছে’।
অপ্রত্যাশিত সংবাদে উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলাম –‘সেকি! অ্যাক্সিডেন্ট হল নাকি’?
-‘অ্যাক্সিডেন্ট বলে অ্যাক্সিডেন্ট, রাতে ফিনাইল খেয়েছে। তারপর সহ্য করতে না পেরে নিজেই অ্যাম্বুলেন্স ডেকে এমার্জেনসীতে গিয়ে সেধিয়েছে’। অগত্যা শয্যার মোহ ত্যাগ করে জয়ন্তর সঙ্গে বেড়িয়ে পরলাম। অমলটা চিরদিনই খামখেয়ালি গোছের, তবে এমন হঠকারিতা করবে ভাবতে পারিনি। আবার মনের মধ্যে একটু গ্লানিবোধও যে হচ্ছে না এমনটা নয়। অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও এর পিছনে আমার ভূমিকা কিছুটা রয়েছে। বছর খানেক ধরে এক সুন্দরীর পিছনে জোঁকের মতো লেগে অবশেষে নিমরাজি করিয়ে অমলের যখন মনে হয়েছিল যুদ্ধ জয় করা হয়েই গেছে তখনই দারুণ একটা বোকামো করে বসল। বন্ধুদের সামনে বারফাট্টাই মারতে গিয়ে বান্ধবী পিংকিকে হাজির করল একেবারে সোজা আমাদের আড্ডায়। মেয়েটাকে দেখতে নেহাত মন্দ নয়! যেমন চালাক চালাক চেহারা তেমন চাবুকের মতো কথাবার্তা। এ জিনিস যে অমল বেশিদিন ধরে রাখতে পারবে না তা দেখামাত্র বুঝে গেছিলাম। এরপর যা হবার তাই হল। পিংকি অমলের লক্ষণরেখার তোয়াক্কা না করে উঁচু লাফ মারল, আর এসে পড়ল একেবারে আমার ঝুলিতেই। আমি প্রচুর ন্যাকামো করে ছিটকে সরে যেতে পারতাম কিন্তু তাতে আখেরে লাভ কিছুই হত না, কলকাতায় বাপের অঢেল টাকা আর বাড়ি-গাড়ি ওয়ালা লোকের কি অভাব আছে কিছু? মাঝখান দিয়ে শুধুশুধু খেসারৎ দিতে হত। পিংকিদের ধৈর্যের বড়োই অভাব অমলকে পেছুছাড়া করতে নরম গরম দিতে একটুও দেরি করল না। অমল চিরকেলে ভাবপ্রবণ মানুষ, ওই কবিগুলো যেমন হয় আর কি। কাল রাতেও ফোন করে কাঁদুনি গাইছিল বারকয়েক আত্মহত্যার কথাও তুলেছিল, ফালতু বকছে ভেবে পাত্তা দিইনি। সেই অমল সত্যি সত্যি! এখন ও যদি মরেই যায় তাহলে দারুণ লজ্জায় পরে যাব। বিকেলের শোতে আইনক্সে দুটো টিকিট বুক করা আছে। পিংকির সঙ্গে যাবার কথা, কিন্তু সেসময় বোধহয় মর্গ আর শ্মশানের মাঝে ছোটাছুটি করেই হয়রান হতে হবে। মেজাজটা গেল খিঁচড়ে।
অমল হাঁসপাতালের জেনারেল ওয়ার্ডের একটা নোংরা বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছিল আমাকে দেখে একটা চিরকুট হাতে ধরিয়ে দিল, বলল –‘এটা পিংকির হাতে তুলে দিস, ও পড়েছে জানতে পারলে অন্তত মরার আগে একটু শান্তি পাব’। কি আর করি কাগজটা হাতে ধরে বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। এবার রিসেপসন থেকে তলব এলো, বেড ভাড়া আর ওষুধের টাকা চুকিয়ে রুগিকে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। এতো তাড়াতাড়ি? বাড়ি গিয়ে অমল যদি অসুস্থ হয়ে পরে তখন কি হবে? ডাক্তার বিরক্ত হয়ে বললেন –‘দুচামচ ফিনাইল খেয়ে কেউ মরে না, পেট ওয়াশ করে দিয়েছি, কটা-দিন লাইট খেয়ে থাকবে, তেল মশলা কিচ্ছু নয়’। বিল দেখে অমল কাতর দৃষ্টে আমার দিকে চাইল, ভাবখানা এই আমার তো ট্যাঁক ফুটো এখন তোরাই কিছু ব্যাবস্থা কর। বেশ কিছু খসল। কি আর করা যাবে, বন্ধুত্ব সম্মন্দে একটা ইংরেজি প্রবাদবাক্য স্মরণ করে অমলকে নিয়ে রওয়ানা দিলাম।
(২)
কয়েকদিন পর সময় পেতে অমলের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। ওকে দেখে মনে হল গলা ছেড়ে কাঁদতে বসবে তবে সেটা ফসকানো প্রেমের দুঃখে যতো না তার থেকে অনেক বেশি ঢেঁকুরের উৎপাতে! নাক কুঁচকে বলল –‘কি জ্বালা বল তো! মাত্র তিন চামচের এমন তেজ যে রাতে দিনে সবসময় হাতুড়ি মার্কা ফিনাইল এক্স ঢেঁকুরে প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে’। বললাম –‘কষে গোটা-কয়েক কবিতা লেখ না তাহলে ঢেঁকুরের কথা ভুলে যেতে সুবিধা হবে’। হতাশ ভাবে মাথা নেড়ে অমল বলল –‘সে চেষ্টা কি করিনি! কিন্তু যে মুহুর্তে মাথায় একটা ছন্দ আসছে, সাথে সাথে উটকো ঢেঁকুর দুটো চলে আসছে। বাপরে! কি বিকট গন্ধ! তক্ষুনি ছন্দটন্দ সব হাওয়া’। অমলের ওপর বেশ রাগ হল বললাম –‘খেলিই যখন ওটুকু কেন বাবা? বোতলে কি আর ফিনাইল ছিল না’? অমল দুর্বল স্বরে বলল –‘সাহসে কুলায় নি। আসলে মরতে যতোটা ইচ্ছে করছিল ভয় করছিল তার থেকে বেশি’।
পিংকিকে প্রচুর কাঠখড় পুড়িয়ে কাটাতে পেরেছি। চালাকির দ্বারা আমার স্বর্গীয় পিতৃদেবের রেখে যাওয়া রাজত্বের রানী হতে না পেরে বিশ্রী সব গালাগাল দিয়ে তবেই বিদায় নিয়েছে। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া অগাধ সম্পত্তিটাই হচ্ছে আমার ইউ-এস-পি যা রঙিন ফুলের মতো মৌমাছিদের আকৃষ্ট করে নিয়ে আসে আর আমি হচ্ছি ওর ডালে ঝুলে থাকা মাকড়সা যে ফাঁদে পড়া মৌমাছিগুলোর রস চুরি করে খাই, যাইহোক এরমধ্যে দুটো খবর কানে এসেছে এক অমলের বিদঘুটে ঢেঁকুরটা বিদায় নিয়েছে আর দুই ফেসবুক থেকে ও একজন নতুন বান্ধবী জুটিয়েছে। খবরটা শুনে খুশি হলাম, মনের মধ্যে যেটুকু অপরাধবোধ ছিল তা কেটে গেল।
কিছুদিন হল অমলের বাড়ির রাস্তা মাড়ানো ছেড়ে দিয়েছি। কেননা ও জানিয়েছে নতুন বান্ধবী সোমার উদ্দেশ্যে ডজন খানেক কবিতা লিখেছে যেগুলো আমাদের পেলেই শোনাবে। কবিতাকে আমার ভীষণ ভয় বিশেষ করে অমলের কবিতা। অমল আগুনখোর বিপ্লবী কবি, তার এক একটা কবিতা এক একটা পেটোর সমান, যেগুলো আবার রেলগাড়ির মতো চলতেই থাকে, এর কোথা থেকে শুরু হয়ে কোথায় যে শেষ, কিছুই মাথায় ঢোকে না। দেখা হলে ভাবছি বলেই দেব, যার উদ্দেশ্যে লেখা তাকেই গিয়ে শোনাক না, খামোকা আমাদের শুনিয়ে এঁটো করা কেন। সেদিন পরপর পাঁচটা মিসড্ কল দেখে পাল্টা ফোন করতে বাধ্য হলাম। ওপার থেকে অমলের কাঁদো কাঁদো স্বর কানে এলো। আর এই স্বার্থপর জগতে বেঁচে থাকতে চায় না। কি হল আবার! যা আশংকা ছিল তাই হয়েছে। সোমা ভেগেছে!
অমলের হা-হুতাশ থামতেই চাইছে না, দেখে গা জ্বলে গেল। এই কি পুরুষমানুষের লক্ষণ? চড়া স্বরে বললাম –‘অমল একটা মেয়ের জন্য এতো ন্যাকামি করাটা কিন্তু খুব চীপ ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে’। অমল রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বলল –‘হাঁসি-কান্না অন্তরের বহি:প্রকাশ, মনের মণিকোঠায় আঘাত লাগলে বাইরে তার বুদবুদ উঠবে না, কি যে বলিস’? -‘তাহলে কি এই নাকি কান্না চলতেই থাকবে’। অমল দীর্ঘশ্বাস ফেলল –‘কেউ যখন আমার কদর করবেই না তখন আর বেঁচে থেকে কিবা লাভ’।
বিরক্তি চড়ছিল, কড়া স্বরে বললাম –‘দ্যাখ অন্তত আগের বারের মতো লোক হাসাস না। সেবারে ভাগ্যি ভালো ছিল তাই হাসপাতাল থেকে পুলিসে খবর দ্যায় নি নাহলে তোর কপালে কিন্তু বিস্তর দুর্ভোগ ছিল। মরতেই যদি হয়, তাহলে সিরিয়াসলি মর, নাহলে ওইসব ফালতু চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফ্যাল’। অমল চিন্তিত স্বরে বলল -‘তাইত! কিভাবে সিরিয়াস হয়ে মরা যায় বল তো’?
-‘কেন রেল লাইনে গিয়ে চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাপিয়ে পর না! বেঁচে ফিরত আসার কোন চান্সই থাকবে না’। অমল চিন্তিত স্বরে বলল –‘কিন্তু তাহলে তো সাংঘাতিক লাগবে! একটা বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার হবে, তুই আর একটু ভদ্রস্থ কিছু ভেবে বল’।
আমি এবার একটু চিন্তা করে বললাম –‘দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে চেষ্টা করলে মরাটা তেমন ব্যাপার নয়। যেমন ধর আজকের কাগজে বেড়িয়েছে, একজন নিজের স্ত্রী আর মেয়েকে বিষ খাইয়ে নিজেও আত্মহত্যা করেছে, এখন ভেবে দ্যাখ দুজনকে মেরে ফেলার পর লোকটার যদি সাহস উবে যেত তাহলেও ওর না মরে আর কোন উপায় থাকত না মরতে এখন ওকে হতোই, তুইও তেমন কিছু করে ফ্যাল, যেমন ধর কোন পলিটিকাল মাতব্বরকে পাবলিক প্লেসে, সবার সামনে কলার ধরে একটা থাপ্পড় কষিয়ে দে, এরপর তোর সামনে তিনটে রাস্তা খোলা রইল! প্রথমে থানা পুলিশ জেল হাজত এসবের ঝামেলা সেখান থেকে কোনোক্রমে বেচে গেলেও গুণ্ডাদের ধোলাই হান্ড্রেড পারসেন্ট বরাদ্দ। অমল হাঁসফাঁস করতে করতে বলল –‘আর তিন নম্বর রাস্তা’? বিজ্ঞের মতো বললাম –‘সেটাই সব থেকে সহজ রাস্তা ভাই, সমস্ত ঝক্কি ঝামেলাকে পাশ কাটিয়ে সোজাসুজি সিলিং ফ্যানে দড়ি খাটিয়ে ঝুলে পরা, পৃথিবীর কোন আইনেই আর তোর কিচ্ছুটি করে উঠতে পারবে না’।
অমল নখ চিবুতে চিবুতে বলল –‘তাই বলে ফস্ করে নামীদামী লোকের গালে চড় কষিয়ে দেওয়াটা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে’?
-‘হবে না, আরে সেইজন্যই তো বলছি উটকো চিন্তা ঝেড়ে কাজের কাজ কর, ব্যাটাছেলের মতো বাচ’। অমলকে ভালোমতো জ্ঞ্যান দিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম। ডোজটা বোধহয় একটু কড়া হয়ে গেল, যাকগে!
বাড়ি ফিরতেই নিতাই বলল –‘জয়ন্তদা ঘন্টাখানেক হল বসে অপেক্ষা করছে’। জয়ন্ত সাধারণত আগাম না জানিয়ে আসে না, তাই একটু অবাক হলাম, নিতাইকে কফির অর্ডার দিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে দেখলাম জয়ন্ত চিন্তিত মুখে বসে রয়েছে, আমাকে দেখে বলল –‘একটা সমস্যা হয়েছে, তুই একটু হেল্প কর, ওই সোমা মেয়েটা একেবারে ঘাড়ে চেপে বসেছে, বলছে হয় বিয়ে করো নাহলে মিথ্যে কেসে ফাঁসিয়ে দেব’। এবারে বেশ খানিকটা অবাক হলাম। জয়ন্তর নতুন বান্ধবী হয়েছে আগে তো বলেনি। বললাম –‘এই সোমাকে আবার কোত্থেকে জোটালি’? জয়ন্ত ইতস্তত করে বলল –‘মানে জুটিয়েছে অমল! কিন্তু সোমা আবার আমাকেই বেশি পছন্দ করল কিনা’। চোখ কপালে উঠল! ছিঃ ছিঃ শেষে কিনা বন্ধুত্বের মধ্যে এমন বিশ্বাসঘাতকতা! জয়ন্ত পারল? মানে আমিও আগে একবার পেরেছি, কিন্তু সে তো অমলের ভালোর জন্যে! ওই পিংকিকে সামলে চলার ক্ষমতা অমলের ছিল না মাঝখান থেকে গোটা জীবনটাই যেত বরবাদ হয়ে, কিন্তু তাই বলে সোমা? সে তো তেমন কিছু আহামরি মেয়ে নয়! ওকে অমলের জন্য ছেড়ে দেওয়াই যেত সেখানে কেন জয়ন্ত নিজের লোভী হাত বাড়াবে? ধিক্কার দিতে মন চাইল, মুখে বললাম –‘ছিঃ জয়ন্ত তোর কাছে এমন আশা ছিল না, তোর কি বিবেক বলে কিছুই নেই’। জয়ন্ত কাঁচুমাচু হয়ে বলল –‘আসলে না ব্যাপারটা হঠাৎ ঘটে গেল, মেয়েটা এমন লাইন দিচ্ছিল বুঝতেই পারছিস, যা হবার হয়ে গেছে ভবিষ্যতে আর এমনটা হবে না কথা দিচ্ছি, এবারটার মতো আমায় বাচিয়ে দে ভাই’। গম্ভীর ভাবে বললাম -‘জয়ন্ত তোকে বন্ধু বলে ভাবতে আমার ঘৃণা হচ্ছে, আজ তোর জন্য অমলের এই দুর্দশা, যাই হোক পুরনো বন্ধু যখন, পায়ে তো ঠেলতে পারব না, ভেবে দেখি তোর জন্য কি করতে পারি’।
(৩)
জয়ন্তর সমস্যার সমাধান হয়েছে, সোমা আরও বড় কোন ঘাটে নোঙর ফেলে ওকে বাচিয়েছে। অমলও সামলে উঠেছে, আমার ব্যাবসাটা আজকাল বেশ ভালোই চলছে, এছাড়া নতুন একটা বান্ধবীও জুটেছে। আমরা তিনজনেই বেশ আনন্দে আছি, মানে কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিলাম, হঠাৎ এরমধ্যে কোথা থেকে করোনা নামে উড়ে এসে জুড়ে বসা একটা বিদঘুটে অসুখ আমাদের চেনা ছকের জীবনটাকে একেবারে তছনছ করে দিল। আজকাল আর ঘর থেকে বেরনো হয়না, নিতাই রোজ সকালে বাজার করে নিয়ে আসে আর ভালোমন্দ রেধে খাওয়ায়, আর আমি টিভির চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লে ঘুমানো প্র্যাক্টিস করি। কিছুদিনের মধ্যে প্রাণ একেবারে হাঁপিয়ে উঠল, কাঁহাতক আর টিভি দেখা যায়, এরমধ্যে অমল হঠাৎ আমাদের রাতের খানাপিনায় নেমন্তন্ন করে বসল। উপলক্ষ্যটা আর কিছুই নয় অমল সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবার থেকে সে ব্যাটাছেলের মতো বুক বাজিয়ে বাঁচবে নাহলে মরদ বাচ্ছার মতো মরবে মাঝমাঝি আর কিছুই নয়। শুনে প্রীত হলাম, আমার দেওয়া জ্ঞ্যান যে এমন ভাবে একটা মানুষের জীবনের ধারা বদলে দিতে পারে ভেবে নিজেকে একটা কেউকেটা মনে হতে লাগল।
কিন্তু কথা হচ্ছে এই লকডাউনে গাড়ি বাস সব বন্ধ। অমল থাকে নাকতলায় আর আমরা ভবানীপুরে, মাঝের এই রাস্তাটুকু আমার গাড়িতে করে পাড়ি দেওয়াটা কোন ব্যাপারই নয় কিন্তু জয়ন্ত জানাল ঝামেলার সম্ভবনা প্রবল, রাস্তায় পুলিসকে যথোপযুক্ত কারন দেখাতে না পারলে নাকি গাড়ি আটক করা হচ্ছে, তার থেকেও যেটা মারাত্মক সেটা এই যে অত্যুৎসাহী কিছু পুলিসপুঙ্গব নাকি সুযোগের সদ্যব্যাবহার করার জন্য মুখিয়েই রয়েছে, পরিস্থিতি বুঝে দু-চার ঘা দিতেও এদের বাঁধছে না। তাহলে উপায়? তবে কি গেট টু গেদারের পরিকল্পনা বাতিল করতে হবে? সে ব্যাবস্থাও অবশ্য জয়ন্তই করল ওর ছোটমামা পুলিসে চাকরি করেন, ভদ্রলোকের ডিউটি এখন হাজরা মোড়ে, সেখান থেকে সন্ধ্যে নাগাদ কাজ সেরে গড়িয়ায় বাড়ি ফিরবেন পথে তিনি আমাদের নাকতলায় ছেড়ে দেবেন, পরদিন সকালে কাজে যোগ দেবার সময় উনিই আবার আমাদের হাজরা অবধি ফিরত এনে দেবেন। সেই মতোই সব হল। বিকেলের দিকে দুজনে দুটো বাজারের থলে হাতে করে ভবানিপুর থেকে হাজরা মোড়ের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলাম। মামা আমাদের হাতের ব্যাগ দেখে মুচকি হাসলেন, যদিও মুখে কিছু বললেন না, এরপর পুলিশের জীপে চড়ে অমলের ফ্ল্যাটে এসে হাজির হলাম।
অমল এলাহি আয়োজন করেছে। মাটন চাপ আর চিকেন কষার গন্ধে ঘর মঁ মঁ করছে, সবকিছু বলল নাকি নিজের হাতে রেধেছে, সঙ্গে আবার সফট ড্রিংক সহযোগে স্কচ অবধি! জয়ন্ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল –‘কঞ্জুসটার মাথা ঠিক আছে তো’? আমি মনে মনে হাসলাম, মুখে অবশ্য কিছু বললাম না। প্রথমেই বোতল খুলে সোমরস গ্লাসে ঢালা হল। মৌতাত জমে যেতে বেশি সময় নিল না। অমল হাঁসি হাঁসি মুখ করে স্কচ আর চিকেন পাকোড়া এগিয়ে দিতে লাগল। আমরাও খেতে কার্পণ্য করার মানুষ নই। জয়ন্ত হঠাৎ বলে বসল –‘কি ব্যাপার অমল, আজকাল কি কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছিস নাকি’? অমল শুকনো মুখে বলল –‘নাঃ একটা লিখেছি, শেষের কবিতা, পরে শোনাব’। জয়ন্ত দরাজ স্বরে বলল –‘যা দারুন খাওয়ালি তাতে একটা কেন তোর সাত খুন মাফ! মানে সাতখানা অবধি কবিতা আমি হজম করব, কথা দিচ্ছি’। আমি তাড়াতাড়ি বললাম –‘ঠিক আছে ওসব পরে হবে এখুনি শুনলে পরে নেশা কেটে যাবে’। আমাদের অবাক করে অমলও কোনরকম জাড়িজুড়ি করল না।
প্রচুর খাওয়াদাওয়া হল। সব থেকে ভালো হয়েছে চিকেন কষাটা। দুর্দান্ত স্বাদ। জয়ন্ত তো মন খুলে অমলকে একটা উপাধি অবধি দিয়ে ফেলল, কবিকিঙ্কর! অবশ্য সেটা অমলের পছন্দ না হওয়ায় ওটাকে পালটে কবিরঞ্জন অথবা কবিশ্রেষ্ঠ করা যায় কিনা সে প্রস্তাব নিয়ে আমাদের মধ্যে একচোট বাকবিতণ্ডা পর্যন্ত হয়ে গেল। এদিকে বিস্ময়ের ওপর বিস্ময়! অমল তেমন কিছুই মুখে তোলেনি। বলছে নাকি পেট খারাপ! ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘর ছুইছুই। অতিরিক্ত খাওয়ার ফলেই বোধহয় মাঝে মধ্যে পেটের মধ্যে কেমন গুড়গুড় করে উঠছে। অস্বস্তিতে পেটে হাত বোলাচ্ছিলাম, অমল তীক্ষ্ণদৃষ্টে চেয়ে ছিল বলল –‘কি ব্যাপার প্রবাল! পেট কামড়াচ্ছে’।
বললাম –‘হ্যা খাওয়াটা একটু বেশি হয়ে গেছে, ও তেমন কিছু না’। অমল এবার জয়ন্তর খোজ নিল –‘সব ঠিক আছে তো জয়ন্ত, দরকার হলে আমার কাছে কিন্তু অ্যান্টাসিড রয়েছে’।
জয়ন্ত চওড়া একটা হাঁসি হেসে বলল –‘প্রচুর খাইয়েছিস মাইরি। তবে এখন মনে হচ্ছে একটু হালকা হতে পারলে মন্দ হয় না’। অমল অদ্ভুতভাবে হেসে বলল –‘এবারে তাহলে এই মধ্যরাত্রিতে এক-রাউন্ড কবিতা হয়ে যাক কি বল’?
-‘সে আর বলতে’। আমরা সমস্বরে বললাম –‘নিয়ে আয় তোর কবিতা, গলা অবধি খেয়ে চোখ এমনিই জুড়িয়ে আসছে, এর ওপর কবিতা কানে গেলে ঘুমটা তোফা হবে আশাকরি’।
অমল প্যান্টের পকেট থেকে একটা চিরকুট বের করে নিজের চোখের সামনে মেলে ধরল, তারপর ভাষণ দেবার ভঙ্গিতে বলল –‘ঠিক আছে বন্ধুরা, প্রারম্ভের কটি কথা, তোমাদের থেকে আমি অনেক কিছু শিক্ষা করেছি, কঠিন এই জীবনের মোকাবিলা করার ক্ষমতা যেটুকু আমার হয়েছে তা এই তোদের থেকেই পাওয়া। এই ব্যাপারে আমি বিশেষ করে প্রবালের কাছে কৃতজ্ঞ। আজকের এই সুন্দর সন্ধ্যেটা আমি প্রবালকে উৎসর্গ করলাম’। আমি ডাইনিং টেবিল চাপড়ে সাধুবাদ দিলাম –‘সাবাশ বেটা এই তো চাই’!
অমল বলল –‘হাতে সময় আর বেশি নেই বন্ধুরা, মানে আমার আছে তোমাদের নেই, তাই আর ভূমিকা না করে শুরু করছি । অমল কবিতাপাঠ শুরু করল।
মৃত কবির আর্তনাদ
কবিকে খোজ যদি তবে পাবে,
শ্মশানের চিতাভষ্মে, অথবা পাবে কবরের অন্দরে
অতৃপ্ত আত্মা তার চাইছে এক ঢোঁক মদ,
আর গলা ভর্তি ইলিশের ঢেঁকুর তুলে চাঁদনী রাতে সুন্দরী পিঙ্কির সাথে
বাবুঘাটে লঞ্চবিহার করতে, অপাপবিদ্ধা পিঙ্কি যাকে এক দুরাত্মা নিল কেড়ে
হারাবার জ্বালাটা রয়ে গেল বুকের পাঁজরে
এবারে এলো সোমা যার ছিল অঙ্গ ভরা বসন্তের সুবাস মন কাড়া
আর এক হারামী দিল মাঝখানে পা বাড়া, পচা দুর্গন্ধে সুঘ্রাণ হয়ে গেল কাছ-ছাড়া
কবি তিলে তিলে মরেছে কিন্তু মরে জেগেছে, এবার কবি মারবে ফের মরবে
করবে না কোন দয়া। বিশ্বাসঘাতক তোরা শুনে রাখ এইবেলা,
কবির রোষানল ঝলসাবে তোদের মাথা, ভোগে যা বদ্ শালারা যা কেওড়াতলা।
-উফঃ, হঠাৎ বিকট শব্দ করে জয়ন্ত বাথরুমের দিকে ছুট লাগাল। মদের নেশা আমার কেটে গেছে। মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুরছে, জীবনে এই প্রথম অমলের কবিতা কান দিয়ে প্রবেশ করে সরাসরি মাথায় ঢুকেছে। পেটের মাঝখানটায় লম্বা চওড়া মোচড় শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে এখুনি একবার বাথরুমে না গেলেই নয়। আমি কাতরাতে কাতরাতে বললাম -‘খাবারে কি ছিল’?
অমল ঠান্ডা স্বরে বলল –‘মিক্সচার, তুতে আর জিংক ফস্ফেট’।
এদিকে এবাড়িতে বাথরুম একটাই জয়ন্ত ঢুকেছে দরজা পেটাতে পেটাতে বললাম -‘অমল তোর মনে এই ছিল’। অমল ভারি স্বরে বলল –‘তুই তো আমাকে বলেছিস প্রবাল মরিয়া হয়ে মরতে, তোদের খুনের দায়ে জেল খাটার থেকে মৃত্যু অনেক সহজ হবে। এবারে আমি কিন্তু সিরিয়াস আর মরিয়াও’।
জয়ন্ত বেড়িয়েছে। আমি মুহুর্তটাক সময়ও নষ্ট না করে কোমডের দখল নিয়ে চিৎকার ছাড়লাম –‘অ্যামবুলেন্সে ফোন কর কুইক’। শরীর থেকে অনেকটা জল বেড়িয়ে গেল, শ্রান্তভাবে বের হতে না হতেই জয়ন্ত অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় পাশ কাটিয়ে ভিতরে সেধিয়ে গেল।
-‘ফোন করেছিস’?
জয়ন্ত কাতলা মাছের মতো ঘাই মেরে বলল –‘অ্যামবুলেন্স পাওয়া যাবে না, বলল নিজে থেকে পৌছবার ব্যাবস্থা করো’। নিম্নচাপ আবার গুঁতো মারল ওদিকে জয়ন্ত অবিবেচকের মতো গোটা প্যান জুড়ে বসে রয়েছে। ভাগ্যে দরজাটা খুলেই কাজ সারছে নাহলে এতক্ষনে মেঝেতেই বসে পরতে হত। বেসিনটা দেখলাম বেশ উঁচু জায়গায়, নাগালের বাইরে। আবার মোক্ষম একটা মোচড় পরতেই বাথরুমের মেঝেয় গিয়ে বসে পরলাম। জয়ন্ত কোমোডে বসে চোখ পিটপিট করে দেখল, আপত্তি জানাল না।
আমরা রাস্তা দিয়ে ছুটছি, এই লকডাউনের মাঝরাতে কোথাও একটা ট্যাক্সি, অটো কিছু চোখে পড়ছে না, ঘরে বসে মরার চেয়ে ভালো শেষ চেষ্টা করে দেখা যাক। সব থেকে কাছের হাসপাতালটাও তিন কিলোমিটার দূরে। জয়ন্ত তিড়িং করে লাফ দিয়ে নর্দমার ধারে বসে পড়ল। আমি চোখে অন্ধকার দেখলাম যা হবার হয়ে যাক, সময় নষ্ট করে লাভ নেই। হয়েও গেল! মরুকগে! ভেজা প্যান্ট নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় এখন নয়।
পিছন থেকে পরিচিত কণ্ঠের আহবান শুনে দুর্বলভাবে ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখলাম অমল ছুটতে ছুটতে আসছে। অমলকেও আমাদের মতোই বিধ্বস্ত লাগছিল। অমল হাঁপাতে হাঁপাতে বলল –‘পারলাম না রে! এতকিছুর পরেও পারা গেল না। পেয়ালা আর ঠোঁটের ফাঁকটা যে এতো বড় হতে পারে আগে ভাবিনি। নিজেকে যে কতোটা ভালোবাসি তা আজ আবার নতুন করে জানলাম’। অমলের লেকচার অসহ্য লাগছিল, যদি এযাত্রা বেঁচে ফিরত আসি তাহলে ওর কপালে যে ভালোরকম দুঃখের ব্যাবস্থা করব সেটা নিশ্চিত। হাসপাতালটা আর কতদূর? তীরে এসে তরী না ডোবে! আমি প্রাণপণ ছুট দিলাম, অমল খানিক পিছিয়ে পরেছিল, বড় বড় পা ফেলে আমার পাশে এসে দৌড়তে লাগল। আবার শুরু হল অমলের অমূল্য বাণী -‘আচ্ছা প্রবাল এবার কি হবে? আজ বিকেলের ফিস্টের জন্য পাড়ার মস্তান হাতকাঁটা দুলের থেকে তিনহাজার টাকা ধার নিয়েছি, সুদ সমেত চার হাজার শোধ দিতে না পারলে হাতকাঁটা চোখ খুবলে নেবে বলে আগাম শাসিয়েছে। তাছাড়া তোদের খুনের দায়ে পুলিশ কি আমাকে খুব পেটাবে? মার খেয়ে আমার কি দশা হবে বল তো? আমি জীবনে কখনো মার খাইনি, আমার ভীষণ ভয় করছে, ভয়ে আমার হাত পা কাঁপছে।
অমলের কথার জবাব দেওয়ার ফুরসৎ নেই আমরা ছুটছি। ছুটেই চলেছি।
লেখক পরিচিতি: সঞ্জয় ভট্ট্যাচার্য, পদ্মপুকুর রোড , কলকাতা।