“লেন্স” এবং “পরিচয়”: অনুগল্প

0
750

১.লেন্স

কলকাতা শহরবাসীর ঘুম কেড়ে নিয়েছে এখন একটাই খবর, রাতের কালো ছায়া সরে যাওয়া মাত্র পাওয়া যাচ্ছে লাশের ঢের। সকাল হতেই প্রিন্সেপ ঘাটের পাশে এই নিয়ে পঞ্চম ডেড্ বডি, পুলিশের উচ্চপদস্থ অফিসারদের চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাই বলে কি শহরের সব কিছুই সাদা কালো, এমনটা নয়….
অগ্নি কে সাক্ষী রেখে পণ্ডিতমশায়ের মন্ত্রপাঠ অনুসারন করে চলেছে সামনে বসে থাকা টোপর মাথায় পাত্র ও লাল বেনারসি শাড়িতে, বিউটি-পার্লার সাজে সজ্জিত পাত্রী। বাকি সব ক্রিয়াকলাপ শেষ করে এখন সিঁদুর-দান পালা। এক হাতে ক্যামেরা চোখের কাছে ধরে অন্য হাতে লেন্সের ফোকাস ঠিক করতে করতে সজাগ হয়ে গেলাম। আসছে সেই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, যা কীভাবে ক্যাপচার করছেন ধরে রাখবে একজন ওয়েডিং ফটোগ্রাফার-এর কেরিয়ারের অবিচ্ছেদ্য মান। লেন্সের চোখ অনুসরণ করছে দুটি আঙুলের মাঝে দৃশ্যমান এক চিলতে সিঁদুরকে। একটা হাফ্ সারকুলার মোশানে হাতটা ঘুরে পৌছে যায় পাত্রীর সিঁথিতে। উলুধ্বনি,শঙ্খধ্বনি ও ক্যামেরার শাটারের শব্দে ভড়ে যায় চতুর্দিক।
তাহলে ক্যামেরাবন্দী হল কি সেই পারফেক্ট শট্ ?….. নাহ্! হবে কি করে, সিঁদুরের ছিটে এখনো পাত্রীর নাকেই পড়েনি,
“এই আরেকবার …. এবার সিঁদুর ঢালার সময় একটু হাতটা ঝাঁকিয়ে নেবেন।”
কোন বাংলা সিনেমার ডিরেক্টারের মত করেই কথাটা বেরোলো।
পন্ডিত মশাইও কিছুক্ষণ মন্ত্রপাঠ থেকে বিরতি নিয়ে অপেক্ষা করলেন, জানেন এখনকার সুখী দাম্পত্য জীবনের অন্তঃসার লুকিয়ে মন্ত্র পাঠের চেয়েও এই ওয়েডিং ফটো গুলোর সৌন্দর্য্যে।
কোন এক বইতে পড়েছিলাম… “এটি সর্বজনস্বীকৃত, যে ভাগ্যের অধিকারী যেকোনো পুরুষ অবশ্যই স্ত্রীর কামনা করে।” একথা যতটা সত্য, আজকাল মহিলাদের দিকে তাকালে মনে হয় একজন স্বামীর কতটা প্রয়োজন তা হয়ত জানা নেই তবে প্রী,পোস্ট ওয়েডিং শুট্ বাধ্যতামূলক।
ফটোগ্রাফির এই শখ শুরু বাবার দেওয়া কোড্যাক ক্যামেরার হাত ধরে। আজকাল সব ডিজিটাল যতই হোক, সেই একা অন্ধকার রুমে ফিল্ম ডেভেলপ করার মজাটা আমার কাছে আজও অপূরণীয়। আর হয়ত এই কারনেই, পুরনো কোড্যাক ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে এক্টিভায় চেপে বেড়িয়ে পরি রাতের অন্ধকারে । রাতের কলকাতা এক আলাদা রূপ শান্ত-স্নিগ্ধ, মায়াবী।
(সকালে কাগজের হেডলাইন….)
“ফিরে এলো রাতের বিভীষিকা !”….
কালিঘাট ব্রিজের নিচে ষষ্ঠ খুনের সাক্ষী থাকল কলকাতা। রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশ মোতায়েনের সত্ত্বেও কি করে এমন ঘটনা ঘটছে, তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। আগের খুন গুলির প্যাটার্ন মেনেই মৃতদেহের মাথা পাথর দিয়ে পিষে, পড়নের সব কাপড় খুলে, লিওনার্দো দা ভিঞ্ছির ‘দি ভিট্রুভিয়ান ম্যান’ আকারে রাস্তার মাঝ বরাবর রেখে দেওয়া হয়। পুলিশ ক্লু স্বরুপ পাশের ঝোপ থেকে একটা কোড্যাক ক্যামেরা উদ্ধার করেছে, তাদের ধারনা ছেলেটি শিকার হওয়ার আগে আক্রমণকারীর ছবি তুলে ঝোপের ভিতর ক্যামেরাটা লুকিয়ে দেয়। এখন এই ধারণা কতটা ঠিক বা ভুল তা জানার যন্য আমাদের সময়ের আপেক্ষা করতে হবে……

২.পরিচয়

এলোমেলো কিছু প্রতিচ্ছবি সঙ্গে নিয়ে অন্ধকার চোখ মেলতে… এক অপারেশন থিয়েটারের মাঝামাঝি প্রতীয়মান একমাত্র আলোক উৎসের নিচে দেখতে পেলাম…  কিছু জুনিয়ার ডাক্তার, দুজন নার্স ও এক সারজেন্টের আপ্রাণ প্রচেষ্ঠা। পাসে দাঁড়িয়ে থাকা উজ্জ্বল E.C.G মেশিনের বুকে ভেসে ওঠা প্রতিটি রেখার ভাঁজ বলে চলেছে, বিছানায় অধিশায়িত নিষ্প্রাণ দেহের নিরন্তর সংগ্রাম কাহিনি।
কিছুটা এগিয়ে নিয়ে গেলাম নিজেকে।
ঘরের বাইরে বেশ কিছু মানুষের ভিড়। কয়েক জন দাঁড়িয়ে দরজার সামনে, কেউ বসে দেওয়ালের ধারে রাখা কাঠের বেঞ্চিতে, কাউকে মনে হলো হেঁটে বেড়াতে করিডোর অঞ্চলে। উপস্থিতি এবং স্থান নির্ধারণের পার্থক্য নির্বিশেষে একমাত্র দিক যা সবাইকে একই ছাদের নীচে একত্রিত করে তা হ’ল, এক অনুরূপ ফ্যাকাশে অভিব্যক্তি।
অপরিচিত ভিড়ের ফাঁকে চোখ পরলো এককোণে বসে থাকা ছোট খাটো মাতৃসুলভ একজন মহিলা। পড়নে সাদা ধুলোমাখা শাড়ি, উশকো শুষ্ক চুল, এক হাতে জড় করা কিছু হাসপাতালের কাগজ আর অন্য হাতে আঁচলের পার দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে দেওয়াল ঘড়ির কাঁটার দিকে চেয়ে বসে আছেন তিনি। মুখে বিষন্নতার ছায়া।
পৃথিবীতে আপন বলতে যে একমাত্র ছিল, কথা দিয়েছিল একদিন সব দুঃখ,সব কষ্ট সে দূর করে দেবে….
“মা!… তোমায় আর বাড়ি বাড়ি কাজ করতে হবে না গো… আমার চাকরিটা হয়ে গেছে…. আর কিছুদিনের অপেক্ষা, তারপর আর এই ভাড়া বাড়িতেও থাকতে হবে না আমাদের….।”
…. নিমেষে কোথায় হারিয়ে গেল সেই হাসি …চুরমার হয়ে গেল এক চিলতে স্বপ্ন……
ফিরে আসলাম সেই অপারেশন থিয়েটারে…
দুঃখ্য-বেদনা-ব্যাথা-কষ্ট এই অনুভূতি কোনোটাই আর আমার জানা নেই, তবুও জানিনা কেন, সামনে শুইয়ে রাখা রক্তে লিপ্ত কাটা-চেড়া শরীরটা দেখে বড্ড মায়া লাগছে।
অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে… এবার ফিরে যাওয়ার পালা… কোথায় যাচ্ছি জানতে চাইছো ?
শেষ বারের মত নিজের পরিচিত দেহকে বিদায় জানিয়ে মিলিয়ে গেলাম শূন্যে …….হতে পারে সম্পূর্ণতার সন্ধানে…. হয়ত বা কোথাও না….।
দূর থেকে ভেসে এলো ….
আপন হারাবার আর্তনাদ …।
Pritam Ghosh

লেখক পরিচিতি :প্রীতম ঘোষ, অফিস ফাঁকে অজানার খোঁজে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here