ছবি : কৌশিক রায় চৌধুরী

পূর্ব বর্দ্ধমান জেলার অন্তর্গত কেতুগ্রাম থানার খাটুন্দি গ্রামের সাত বাড়ির দুর্গা পুজো বেশ আকর্ষণীয় ও অনেকটা ব্যতিক্রমীও বটে। এক উঠোনের মধ্যে সাত সাতটি দুর্গা পুজো একত্রে হয় (বর্তমানে ছ’টি পুজো)। মাঝে কেষ্ট রাই এর মন্দির এবং সেখানে কালো কষ্টিপাথরের রাধা কৃষ্ণের যুগল মূর্তিটি বিরাজিত থেকে বৈষ্ণবের সঙ্গে শাক্তর এক অপূর্ব মিলন ক্ষেত্র রচনা করেছে। এই গ্রামেরই ভূমিপুত্র রামগোপাল ভট্টাচার্য আজ থেকে প্রায় সাড়ে ছশো বছর আগে এই সাত বাড়ির দুর্গা পুজো প্রচলন করেন। তখন একটা দুর্গাতেই পুজো করা হত। পরবর্তী কালে একই মন্ডপে বিভিন্ন শরিকানায় বিভক্ত হ’তে হ’তে বর্তমানে সাত বাড়ির দুর্গা পুজোয় পরিণত হয়েছে। তবে এই সাত বাড়ির দুর্গা সম্পর্কে বলার আগে চৈতন্যদেবের দীক্ষা গুরু কেশবভারতীর কথা এখানে আনতেই হবে। কারণ লোক ইতিহাস বলছে যে ওনার সাথে এই গ্রামের এক নিবিড় সম্পর্ক ছিল এবং ঐ কেষ্ট রাই তাঁরই প্রতিষ্ঠিত।
কেশব ভারতীর জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে বিস্তর গন্ডগোল আছে। নানা মুনি নানা মত পোষণ করে থাকেন। বেশির ভাগ গবেষকের মতে তিনি মন্তেশ্বর থানার দেনুড় গ্রামে জন্মেছিলেন তো আবার অন্যান্যদের দাবী যে তিনি কাটোয়ার পাশে আউরিয়া গ্রামেরই ভূমিপুত্র। আবার এও জনশ্রুতি আছে যে তিনি নাকি আলোচ্য খাটুন্দি গ্রামেই জন্মগ্রহণ করেন। দেনুড় গ্রামে যে ওনার জন্ম হয়েছিল তার সপক্ষে দেনুড় গ্রামেরই লোক
চৈতন্য জীবনীকার বৃন্দাবন দাসের লেখনী থেকে পাওয়া যায়:

বাল্যকালে কেশবের দেন্দুরাতে স্থিতি।
বৃন্দাবন দাসের হয় যেথায় বসতি।।

আবার আউড়িয়ার ভারতী সম্প্রদায়ের তরফ থেকে দাবি করা হয় যে কেশবভারতী আউড়িয়ার ছেলে। তাঁর পিতার নাম মুকুন্দমুরারী বা রামগোপাল ভট্টাচার্য। এনার দুই ছেলে বলভদ্র ও রামভদ্র। বড় ছেলে বলভদ্র বিবাহিত ছিলেন; এঁর আবার মদন ও গোপাল নামক দুটি পুত্র ছিল। কিন্তু বলভদ্রের অনুজ রামভদ্র অকৃতদার ছিলেন ও পরবর্তী কালে তিনি দশনামী ভারতী সম্প্রদায়ের নিকট দীক্ষা নিয়ে সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করেন ও নাম হয় কেশব ভারতী। দেনুড় ছিল তাঁর মামার বাড়ি।
কিন্তু এদিকে খাটুন্দির ভট্টাচার্য পরিবার দাবি করেন যে কেশবভারতী খাটুন্দি গ্রামেই জন্মেছিলেন। পিতার নাম ছিল রাম গোপাল ভট্টাচার্য। তাঁর দুই উত্তরাধিকারীর নাম পাওয়া যায় উমাপতি আর নিশাপতি। এঁরা দুজনেই বিবাহিত ছিলেন। এঁদের সঙ্গে কেশব ভারতীর কী সম্পর্ক ছিল তা স্পষ্ট করে কিছু জানা যায় না। কেউ কেউ বলেন উমাপতি নিশাপতিরা কেশবের উত্তরসূরি। যাই হোক এগুলো সবটাই লোকশ্রুতি।
যদি কেশবভারতীর জন্ম ‘খাটুন্দি’ গ্রামে হয়ে থাকে তাহলে তো ল্যাটা চুকেই গেল কিন্তু তা যদি না হয় তাহলে এই গ্রামের সাথে কেশবভারতীর নাম কেমন করে এল তা গবেষণার বিষয়। খাটুন্দির রামগোপাল ভট্টাচার্য আর কেশবের পিতা রামগোপাল ভট্টাচার্য কি একই ব্যক্তি না দুজন আলাদা? ভবিষ্যত বলবে সে কথা।
খাটুন্দি গ্রামখানি একটি প্রাচীন জনপদ সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই। ঈশানী নদী স্থানীয় নাম কাঁদর গ্রামটিকে অর্ধবৃত্তাকারে ঘিরে রেখেছে। বল্লাল সেনের তাম্রশাসনে এই ঈশানী নদীর উল্লেখ আছে ‘সিঙ্গোটিআ’ নামে। গবেষকদের একাংশ মনে করছেন যে তাঁর দেনুড় বা আউড়িয়া গ্রামেই জন্ম। সাধনার জন্য খাটুন্দি গ্রামের ঈশানী নদীর তীরে তিনি প্রথম আশ্রম স্থাপন করেন এবং পরবর্তীতে তিনি কাটোয়ার ভাগরথী তীরে আশ্রম স্থানান্তরিত করেন।
জনশ্রুতি আছে খাটুন্দি গ্রামের দক্ষিণ- পশ্চিম দিকে আচার্য পুকুর পাড় নামক স্থানে কেষ্ট রাই এর মন্দিরটির অবস্থান ছিল। এখন তা কালের গর্ভে বিলীন। যেহেতু কেশব ভারতী কেষ্টরাই এর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাই ধরা যেতেই পারে ওখানেই কেশবভারতীর আশ্রম খানি শোভা পেত। আর তারও আগে খাটুন্দি ও কুলাই গ্রামের মাঝখানে যে ঠাকরুণ পুকুর মাঠ ও কদমতলির মাঠ আছে ঐখানে কোথাও রামগোপাল ভট্টাচার্য মহাশয় প্রথম দুর্গা পুজো শুরু করেছিলেন। অর্থাৎ আগে ওখানে বসতি ছিল। বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্যে উক্ত জায়গা গুলি বেশ ডাঙা। বন্যার সময় এলাকাগুলো ডোবে না। এর থেকে ধারণা করা যায় যে আগে ওখানে গ্রাম বসতি ছিল। নইলে রামগোপাল মশাই খামোখা মাঝ মাঠে কিসের জন্য দুর্গা পুজো আনতে যাবেন? পরবর্তী কালে বর্গী হাঙ্গামার ভয়ে হোক বা অন্য কোন অজানা কারণে হোক খাটুন্দি গ্রামটা বর্তমান জায়গায় উঠে চলে আসে। নিশাপতি ভট্টাচার্য নাকি দুর্গা ও কেষ্ট রায়কে বর্তমান স্থানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

কৃষ্ণ রাই এর মন্দিরের ভিতর

এবার পুজোর কথায় আসা যাক।প্রতিপদের দিন ঘট ভরা হয় এবং ছ’খানা পুজোর ছ’টা ঘট ঈশাণী নদী থেকে ভ’রে এনে কেষ্টরাই এর মন্দিরে রাখা হয়। এদিন থেকেই একরকম পুজোর তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। প্রতিপদ থেকে দশমী পর্যন্ত প্রতিদিন কৃষ্ণের মন্দিরে স্থিত এই ঘটগুলোর আগে পুজো হয়, তারপর দুর্গা পুজো করা যায়। এছাড়া ছ’টি দুর্গার নিজস্ব আলাদা আলাদা ঘট ভরা হয় সপ্তমীর দিন ভোরবেলা নবপত্রিকার সাথে এবং এইগুলিকে দুর্গা মন্ডপে রাখা হয়। এখানকার বিশেষত্ব হল আগে কেষ্ট রায় অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের পুজো হয় তারপর মা দুর্গার পুজো শুরু হয়। ছয়টি পরিবারের প্রত্যেকের (গ্রামের) বাড়িতে কেষ্ট রাইকে নিয়ে গিয়ে অন্নের ভোগ দেওয়া হয়। ভোগ হয়ে গেলে কেষ্ট রায়কে আবার মন্দিরে ফিরিয়ে আনা হয় এবং শয়ন করিয়ে দেওয়ার পর মা দুর্গার ভোগারতি শুরু হয়। কৃষ্ণকে বাদ দিয়ে কোন কিছু করা হয় না।
বছর কুড়ি হল এখানকার একটি পুজো কাটোয়ায় স্থানান্তরিত হয়েছে। বিপদতারণ ব্যানার্জি কাটোয়ার চাউল পট্টিতে তাঁর নিজ বাড়িতে নিয়ে গিয়ে এই পুজো চালাচ্ছেন। তাই নামে সাত বাড়ি হলেও খাটুন্দিতে এখন ছয় বাড়ির ছ’টি পুজো অনুষ্ঠিত হয়। তবে সেই মন্দিরটিতে মূর্তি না আনা হলেও নবমীর দিন ঘটে পুজো দেওয়া হয়। কারণ হিসেবে জানা গেল যে পরপর দুবছর মহাষ্টমীর দিনই দুজন পথ দুর্ঘটনায় নিহত হন। সেই ভয়ে বা মনের দুঃখে বিপদতারণ বাবু কাঠামো এখান থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে কাটোয়ায় স্থাপিত করেছেন।
দুর্গা সর্বপ্রথম একটাই ছিল একথা আগেই বলেছি। এবার ভাগ হয়ে এতগুলো হল কী করে? কথিত আছে নিশাপতি ভট্টাচার্যের তিন নাতির মধ্যে শরিকানা নিয়ে ঝগড়া বাঁধে। বিবাদের ঝড়ে মা দুর্গাও প্রথমে তিনটে হয়ে যায়। বড় ভট্টাচার্য, মেজো ভট্টাচার্য ও ছোট ভট্টাচার্যের পৃথক পৃথক তিনটে দুর্গা। পরবর্তীকালে মেজ ভট্টাচার্যের ঠাকুর দুটুকরো হয়। মোট হল চারটে। ছোট ভট্টাচার্যের ঠাকুর দৌহিত্র সূত্রে ব্যানার্জিরা পান। সেটিও দুভাগ হয় যার মধ্যে একটি কাটোয়াতে পুজিত হচ্ছে। পাঁচটা দুর্গায় পরিণত হল। এখানকার এক শরীক অশোক ব্যানার্জির মতে বাকি দুটি ঠাকুরের মধ্যে একটি গ্রাম্যসূত্রে মুখার্জিরা আনতে শুরু করেন। এটি পুরোপুরি বৈষ্ণব মতে পুজো হয়। কোন বলি হয় না। আর অন্যটা পুরোহিত সূত্রে চ্যাটার্জিরা নিয়ে আসেন।

ছ’খানা পুজো ছ’টা আলাদা পরিবারের হলেও বেশ সম্প্রীতির সঙ্গে এবং একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই অনুষ্ঠিত হয়। পরিবারে সব থেকে যিনি বয়স্ক আছেন তাঁর কথা মান্য করেই সমস্ত পুজো অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধিপুজোর সময় বলি একই সময়ে হওয়ার নিয়ম কিন্তু এখানে ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়। এখানে সন্ধিপুজোর সময় বয়ঃজ্যেষ্ঠের দুর্গা মন্দিরে সবার আগে পাঁঠা বলি হয়। একমাত্র এনার ঠাকুরের পাঁঠা বলিটা সন্ধিক্ষণে সম্পন্ন হয়। তারপর অন্যান্যরা বলি দেওয়ার অনুমতি পান।

কৃষ্ণ বা কেষ্ট রাই এর নাটমন্দির, খাটুন্দি

বিজয়া দশমীর সন্ধ্যায় বিসর্জনের আগে সমস্ত দুর্গা মূর্তি গুলোকে কেষ্ট রাই এর নাট মন্দিরে এনে পাশাপাশি রাখা হয়। মাঝখানে রাধা কৃষ্ণকে বসানো হয়। কৃষ্ণ যেন তাঁর ছয় বোনকে হাসিমুখে বিদায় জানায়। এরপর কেষ্ট রাইএর সন্ধ্যারতি হয়। যে পঞ্চ প্রদীপ দিয়ে রাধা কৃষ্ণের আরতি হয় সেই পঞ্চ প্রদীপ দিয়ে বাড়ির বউরা দুর্গাকে বরণ করে নেন, উলুধ্বনি দেন, সিঁদুর মাখেন। তারপর একে একে বিসর্জন দেওয়া হয়। এখানেও শিষ্টাচার মেনে চলা হয়। বয়ঃজ্যেষ্ঠের প্রতিমা সবার আগে বের হয় তারপর যিনি বয়সে বড় তাঁর প্রতিমা বের হবে নিরঞ্জনের জন্য।
একসময় বাঙলায় শাক্ত ও বৈষ্ণবদের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধিতা দেখা যেত। তাতে ধর্মের আসল উদ্দেশ্যটাই ব্যাহত হত। সেই সময়ের নিরিখে দাঁড়িয়ে খাটুন্দির ভট্টাচার্য পরিবার কৃষ্ণ ও দুর্গাকে পাশাপাশি রেখে পুজো করে যে এক সমন্বয়ের বার্তা দিয়েছিলেন ও আজও দিয়ে আসছেন তা বলাই বাহুল্য।

তথ্য ঋণ: কৌলাল পত্রিকা – স্বপন কুমার ঠাকুর।
এছাড়া অশোক ব্যানার্জি, নিরঙ্গ মন্ডল, তারাশঙ্কর ভট্টাচার্য।(খাটুন্দি)

কলমে কৌশিক রায় চৌধুরী, পূর্ব বর্দ্ধমান

পেশায় প্রাথমিক শিক্ষক। ক্ষেত্র সমীক্ষা করে লোক ইতিহাস ও লোক সংস্কৃতি উপর লিখতে ভালোবাসি।



1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here