(১)

অন্ধকারের চাদর নিজের চারিপাশে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে তাকে দেখছে সে, তার দৃষ্টিপথের সামনে আবরণহীন দাঁড়িয়ে রয়েছে ন্যাড়া জানালা, প্রতিদিন ভোরে যে জানালার সামনে রাখা ছোট্ট একখানি টবে বোগেনভিলিয়া ফুটে থাকে।

সে বুঝে পায় না, কেন এতো জায়গা থাকতে টবে বোগেনভিলিয়া ফুটিয়েছেন শুভময়, সাধারণত এই গাছ বাগানে ঝোপের মতো ফুটে থাকে, ফুটে থাকে প্রাচীর জুড়ে, কখনো বা ছাদ থেকে ঝালরের মতো নেমে আসে তার রঙিন কঙ্কাল, কিন্তু এখানে…

অবশ্য শুভময় মানুষটাই বড্ড বেয়াড়া, প্রচলিত রীতিনীতির বিরুদ্ধাচারণ করাই তাঁর বরাবরের অভ্যেস। ঠিক যেমন এখন, কোলকাতা শহরের অন্যতম বর্ধিষ্ণু এই পাড়াখানা নিদ্রাদেবীর সাধনায় রত, পৌষমাসের এক কুয়াশামাখা হিমেল রাত হওয়ায় একখানা পথকুকুরের দেখা নেই আশেপাশে। কিন্তু শুভময় ঠিক বসে রয়েছেন জানলার পাশে লেখার টেবিলখানায়, খসখস শব্দে চলছে কলম। হয়তো সৃষ্টি হচ্ছে কোনো যুগান্তকারী উপন্যাস।

নিজের দীর্ঘ নখ দিয়ে ঘাড় চুলকোয় সে, ঠান্ডা হাওয়ায় স্বল্প শীতবস্ত্র ঠিকঠাক উষ্ণতা ছড়িয়ে উঠতে পারে না, পদ্মকাঁটা ফুটে ওঠে পোশাকের গভীরে। এই পদ্মকাটার ওপরে বড্ড লোভ শুভময়ের, অতিরিক্ত উত্তেজনা অথবা ঠান্ডার ফলে রোমকূপে গজিয়ে ওঠা এই অদ্ভুত শিহরণ নিয়ে রয়েছে তাঁর গোটা একটা উপন্যাস। পাঠকরা বড্ড পছন্দ করেছেন এটি। কেউ না জানলেও সে জানে, তার শরীরের গলিঘুঁজির সন্ধান রয়েছে সেখানে। একটা আস্ত মানুষ নগ্ন হয়ে শুয়ে রয়েছে বইটির পাতায় পাতায়, খবর রাখেনি কেউই।

রিয়ালিজম অথবা বাস্তবিকতা, এটাই শুভময়ের উপন্যাসের প্রধান উপকরণ। কোনো উপন্যাস লেখার আগে তার প্রধান চরিত্রকে যেন নিজের জীবনে গেঁথে নেন শুভময়, তাঁর শয়নে স্বপনে জাগরণে তখন ঘোরাফেরা করে সেই চরিত্র। বিদেহী নয়, জলজ্যান্ত দেহযুক্ত মানুষ। উপন্যাস লেখা শেষ হলেই মর্যাদা ফুরোয় তাদেরও, অত্যন্ত নির্মমভাবে নিজের জীবন থেকে তাদের ছেঁটে ফেলতে দ্বিধা করেন না তিনি। তাদের ক্লেশ, প্রতিবাদ, কান্না কোনোকিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায় না তাঁর কাছে। তারা তখন মৃত, তাঁর চোখে মূল্যহীন আবর্জনা। নতুন চরিত্রের সন্ধানে তখন অন্ধ শুভময়, জনজীবনের ভীড়ে তাঁর বিগত চরিত্রগুলি কোথায় হারিয়েছে জানার প্রয়োজনবোধ করেন না তিনি।

সেও তেমনই এক হারিয়ে যাওয়া চরিত্র। বইএর তাকে নতুন বইএর ভীড়ে চাপা পড়ে যাওয়া পুরানো বই। হয়তো পোকায় কাটা, হয়তো বা নয়, যার শরীর জুড়ে এখন শুধুই ন্যাপথলিনের গন্ধ।

এই জানলার ধারে দিনের পর দিন তার দুই হাত ধরে বসে রয়েছেন শুভময়, শুনিয়েছেন কতো মন ভোলানো অবোধ কথামালা। প্রিয় সাহিত্যিকের স্বপ্নের অংশ হতে পারার গর্ব তখন তার চোখজুড়ে, মনের ভেতর হাজার তারার ঝিলিমিলি। শুভময়ের খাতার পাতায় তখন সেজে উঠছে শব্দেরা, সমাজের চোখে কলঙ্কিত এক মানুষের প্রতিটি অস্থিমজ্জা থেকে শোষিত রস পুষ্টি জোগাচ্ছে সেই শব্দদের। আর সেই মানুষটা! শুভময়ের মিথ্যে আদর মেখে সে শুয়ে রয়েছে তাঁর শয্যায়, স্বপ্ন দেখছে এক অপার্থিব ভবিষ্যতের।

স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার পরে আমরা বাস্তব সম্পর্কে অতিমাত্রায় সচেতন হয়ে উঠি, সেও উঠেছে। দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করেছে সঠিক সময়ের, আজ শেষপর্যন্ত অবসান হয়েছে তার অপেক্ষার। আজ হয়তো তার যোগ্যতা তাকে শুভময়ের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে, কিন্তু যন্ত্রণা! তার যে ফুরোবার কোনো নামই নেই। সে অবোধ, চুড়ান্ত খুশির মুহূর্তে চোখ ছাপিয়ে গলে পড়ে। সব বাস্তবিকতা এক মুহূর্তে ধূলিস্যাৎ, পড়ে শুধু কিছু স্বপ্নের ছাই। নির্বিকল্প ভষ্মাধারে।

নিঃশব্দে জানলার কাছে এগোয় সে, পায়ের তলায় শুকনো পাতা পড়ে স্বল্প শব্দ হয়, তাতেই চমকে খাতার পাতা থেকে মুখ তোলেন শুভময়, বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন তার দিকে। চোখে খেলা করে অজস্র সন্দেহ, নাকি ভয়!

” কি ব্যাপার! আজ এতোদিন পরে!”

ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করেন শুভময়।

খিলখিল করে হেসে ওঠে সে। আজও কেমন প্রভুত্বমাখা শুভময়ের কণ্ঠস্বর, এতোগুলো বছরে এতটুকু বদলায়নি তাঁর ব্যক্তিত্ব। সাধে কি আর মোমবাতির শিখার আকর্ষণে ছুটে আসা পতঙ্গের মতো তাঁর আকর্ষণে চরিত্ররা ছুটে আসে! মৃত্যু হবে জেনেও ভয় পায় না এতটুকু!

” কেন! পুরানো হয়ে গেলে কি একবারও আসতে নেই!”

নিজের স্বভাবসিদ্ধ কমনীয় ভঙ্গিমায় জবাব দেয় সে।

” কিন্তু এতো রাতে আসার তো কোনো কারণ নেই। শুনেছি, বড্ড নাম করেছো তুমি। মানুষের ক্রমশ শেষ হয়ে আসা রুচির বড়োই লাভ ওঠাচ্ছো তুমি। এরপরেও আমায় আর কি প্রয়োজন তোমার!”

ঠোঁটের কোনে হালকা হাসি ফুটিয়ে তিক্তস্বরে বলেন শুভময়। তাঁর কথার অন্তরের শ্লেষ যেন চাবুকের মতো আছড়ে পড়ে তার পিঠে৷ অজান্তেই যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে সে, শুভময়ের চেহারায় আশ্চর্য প্রশান্তি ছেয়ে যায়।

” কি মনে করে এসেছো? “

খাতা বন্ধ করে আবার প্রশ্ন করেন তিনি।

” শুধু একটিবার দেখতে চেয়েছিলাম। “

মাথা নীচু করে নিজের গায়ের চাদরের উল আঙুলে জড়াতে জড়াতে নীচুস্বরে জবাব দেয় সে। যতোই নিজেকে এতোগুলো বছরে শক্ত হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করুক, আজ শুভময়ের সামনে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছে সে, ঠিক কতখানি দুর্বল তার আহত হৃদয়। একলহমায় একটি কথা তাকে সম্পূর্ণ ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলতে পারে। রক্তাক্ত হতে পারে তার সযত্নলালিত অস্তিত্ব।

চশমার কাঁচের আড়াল থেকে নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন শুভময়। তার কম্পিত শরীর, আনত দৃষ্টি তাঁকে অদ্ভুত তৃপ্তি দেয়। নিজের অন্যান্য চরিত্রদের চেয়ে এই চরিত্রটির প্রতি কিঞ্চিৎ দুর্বলতা রয়েছে তাঁর। এই চরিত্রটি তাঁকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। আজকাল খবরের কাগজ খুললেই এর নাম দেখতে পান শুভময়। সত্যি বলতে, হিংসে হয় খানিক, অপমানবোধও হয় বৈকি! তাঁর একান্ত অনুগত একটি চরিত্র, যাঁকে ব্যবহার শেষে ছেঁড়া কাগজের মতো আছড়ে ফেলেছিলেন আবর্জনায়, সে যখন সমশক্তি নিয়ে তাঁর দিকে ফিরে আসে, আশ্চর্য লাগে ঠিকই৷

তবে আজ বড্ড শান্তি পেয়েছেন তিনি। কোনো অনিশ্চয়তা নয়, কোনো হিংসা নয়, প্রাণের আরাম। আজও চাইলেই তিনি ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলতে পারেন এই চরিত্রটিকে, আজও তাঁকে এক ঝলক দেখার আশায় হা পিত্যেশ করে একটি জ্বলজ্যান্ত মানুষ, তাঁর কথার অভিঘাত শেলের মতো বিদ্ধ করে তাকে ; আত্মতৃপ্তি হয় বৈকি!

” পেছনের দরজা খুলে দিচ্ছি, চুপচাপ ভেতরে এসো৷ একটাও শব্দ করবে না। নয়তো ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবো। “

দাঁতে দাঁত চিপে কথাগুলি বলে জানলার পাশের টেবিল ছেড়ে উঠে যান শুভময়, অন্ধকারে মিশে সেও বাড়ির পেছনের দিকে সরে আসে।

ঘরের ভেতরে প্রবেশ করা মাত্র তাকে আঁচড়ে কামড়ে অস্থির করে তোলেন শুভময়, এক হিংস্র শ্বাপদ যেন হঠাৎ আছড়ে পড়ে তার শিকারের ওপরে। অব্যক্ত বিদ্বেষ যেন শুভময়ের প্রতিটি আঁচড়ে মিশে থাকে, তার প্রতিটি মাংসপেশি অবশ হয়ে যায়।

” কি ভেবেছো! নাম করবে! মানুষের ভালোবাসা পাবে! কেন! কি অধিকার রয়েছে তোমার! একটা সমাজের নোংরা, তাকে আবার মাথায় তুলে নাচছে… অন্ধকার ছাড়া কেউই তোমার আপন নয়, বুঝেছো!”

তীব্র হাসির সঙ্গে তাকে ফালাফালা করতে করতে বলেন শুভময়। এই প্রথম তাঁর হাসি বড়োই কুৎসিত মনে হয় তার। যেন একতাল মাংসপিণ্ড থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, ভনভন করছে মাছি। এই হাসিতে কি করে মন মজেছিল তার, জানে না সে। তবে আজ, এতোগুলো দিন পরে এই হাসি দেখেই ঘেন্নায় বমি পায় তার, শরীরের যন্ত্রণা বড্ড তুচ্ছবোধ হয় এই অবর্ণনীয় ঘেন্নার কাছে।

ধীরে ধীরে পকেট থেকে কালো তারখানা বের করে সে, তার ওপরে বিদ্বেষ ছড়াতে থাকা শুভময় টের পান না কখন সেই কালো তার চেপে বসেছে তাঁর গলায়। যতক্ষণে টের পান ততক্ষণে আর প্রতিরোধ করার শক্তি নেই, শ্বাস আটকে ঘন নীলবর্ণ ধারণ করেছে মুখমণ্ডল। কিছুক্ষণ পরেই বসন্তে খসে পড়া পাতার মতো তার পায়ের কাছেই আছড়ে পড়ে শুভময়ের নিথর দেহ। চোখদুটি তখনো খোলা, ঘোর অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রয়েছে তার দিকে। টেবিলে ফরফর করে উড়ছে অর্ধেক শেষ হওয়া উপন্যাস, বোগেনভিলিয়া ফুলের ওপরে একফোঁটা রক্ত পড়ে রয়েছে৷ এই রক্ত তার, শুভময়ের ঘৃণার ফসল।

পকেট থেকে পরিস্কার রুমাল বের করে টেবিলটা ভালো করে মুছে নেয় সে, মুছে নেয় দরজার হাতল, মেঝে। খাতাটি বন্ধ করে রাখার প্রয়োজনবোধ করে না, না দেখতে পায় লাল ফুলের গায়ে লেগে থাকা লাল রক্ত। কালো তারটা পকেটে নিয়ে সে আবার মিশে যায় অন্ধকারে, পেছনে পড়ে থাকে এক প্রখ্যাত সাহিত্যিকের লাশ ; স্বপ্নপোড়া লাশ।

(২)

” আপনার কি মনে হয় স্যার! আততায়ী বোকা নয়! চতুর্দিকের হাতের ছাপ মুছে ফেলেছে, কিন্তু রক্তের ফোঁটা যে ফুলে পড়ে আছে খেয়াল করেনি। “

থানার বড়বাবু অভিজ্ঞান পাকড়াশির সামনে দাঁড়িয়ে তীর্যক হেসে মন্তব্য করে কনস্টেবল বংশীরাম।

মন দিয়ে ময়নাতদন্তের ফাইল খুঁটিয়ে পড়ছিলেন অভিজ্ঞান, একটু আগেই ফাইলটি এসে পৌঁছেছে তাঁর টেবিলে। প্রখ্যাত সাহিত্যিক শুভময় মৈত্র খুন হয়েছেন নিজের বাড়িতে। স্বাভাবিকভাবেই থানার ওপরে সংবাদমাধ্যম ও ওপরতলার চাপ বেড়েছে৷ যতো শীঘ্র সম্ভব খুঁজে বের করতে হবে খুনীকে৷ অমন সম্ভ্রান্ত পাড়ায় খুনের ঘটনা এই প্রথম, স্বভাবতই আতঙ্কে রয়েছেন ওখানকার বাসিন্দারা৷ ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী খুন হয়েছে ভোর তিনটের আশেপাশে। বাড়ির চারিপাশে কোনো ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা না থাকায় আততায়ীর পরিচয় জানা যায় নি৷ অন্ধকারে পথ হাতড়াচ্ছে পুলিশ ও প্রশাসন।

” আসলে তা নয় বংশী, আততায়ী বোকা নয়, আনাড়ি। এটাই সম্ভবতঃ তার প্রথম খুন। তাই তাড়াহুড়োয় রক্ত খেয়াল করা হয়ে ওঠেনি তার। আর একটা জিনিস লক্ষ্য করো, শুভময় বাবুর দাঁতে ও নখে রক্ত ও চামড়ার কোষের হদিশ মিললেও দেহে ধস্তাধস্তির কোনো চিহ্ন নেই। দরজাও ভাঙা হয়নি। তারমানে খুনি তাঁর পূর্ব পরিচিত। অত রাতে কাউকে আঁচড়াচ্ছিলেন কেন শুভময়?”

ফাইলে চোখ রেখেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন অভিজ্ঞান।

” হতে পারে যখন আততায়ী তাঁর গলায় তার পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করে তখন তিনি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পেরে ওঠেননি!”

একগাল হেসে নিজের সন্দেহ ব্যক্ত করে কনস্টেবল বংশীরাম।

” হতে পারে। এই শুভময় মৈত্র সম্পর্কে কিছু খোঁজখবর নিয়েছিলাম। ভদ্রলোক ভালো লিখতেন ঠিকই, তবে চারিত্রিক দিক থেকে মোটেই সুবিধের লোক ছিলেন না৷ অনেকের সর্বনাশ করেছেন, কিন্তু তাঁরা কেউই লোকলজ্জা অথবা ভয়ে প্রকাশ্যে আসেননি৷ এমনকি ভদ্রলোকের স্ত্রীও এই বিষয়ে একটিও কথা বলতে চাননি৷ তাঁদের কারোরই এই কাজ নয় তো!”

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বলেন থানার বড়বাবু।

” হতে পারে স্যার। নেটওয়ার্ক কোম্পানিগুলোয় খোঁজ নিয়েছিলাম। সেই সময়ে কোনো সন্দেহজনক নম্বর ওই এলাকায় চালু ছিল না৷ পাড়ার মোড়ের ফুটপাথে যে ভিখারিটা রোজ শুয়ে থাকে সেও কাউকে দেখেনি। খুনের পরে তিনদিন কেটে গিয়েছে, আমরা এখনো অন্ধকারে রয়েছি স্যার। “

ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে বলে কনস্টেবল।

” কেসটা বড়োই অদ্ভুত, বুঝলে বংশী! সম্ভাব্য আততায়ী অনেকেই, কিন্তু প্রমাণ কিচ্ছু নেই একফোঁটা রক্ত ছাড়া। রক্তের গ্রুপ বি নেগেটিভ। অর্থাৎ বড্ড বিরল প্রজাতির রক্ত। খোঁজ নাও, এমন কে কে রয়েছেন এই শহরে যাঁদের রক্তের গ্রুপ বি নেগেটিভ। থানায় ডাকো সকলকে৷ দেখা যাক এর ভেতরে আমাদের খুনীকে পাওয়া যায় কিনা!”

হাত তুলে কনস্টেবল বংশীরামকে চলে যেতে ইশারা করেন অভিজ্ঞান। রক্তের গ্রুপ ধরে খুনী খোঁজা আর খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজা একই ব্যাপার, পাওয়া যাবেই এমন কথা বলা যায় না। আবার অসম্ভবও নয়৷ এমনও হতে পারে যে কোনো ব্লাড ব্যাঙ্কের কাছেই তথ্য পাওয়া গেলো না, যাঁদের নাম পাওয়া গেলো তাঁরা খুনীই নন৷ হাসপাতালেও কোনো সন্ধান মিলবে কিনা বলা মুশকিল। এতো বড় শহরের কোন কোণে আততায়ী লুকিয়ে রয়েছে কে বলতে পারে! তবু চেষ্টা ছাড়লে হবে না।

টেবিলের ওপর থেকে আরেকটি সাদা ফাইল তুলে নেন অভিজ্ঞান পাকড়াশি৷ শুভময় সম্পর্কিত অজস্র তথ্য রয়েছে এই ফাইলে। রয়েছে তাঁর নানা বইএর কথা। কৌতুহলবশতঃ এই কদিনে শুভময়ের একটি বই পড়ে দেখেছেন তিনি, বড়োই বাস্তব মনে হয়েছে ঘটনাগুলিকে, যেন লেখকের চোখের সামনেই ঘটে গিয়েছে ঘটনাগুলি। প্রতিটি চরিত্রকে নিয়ে নির্মমভাবে কাটাকুটি খেলেছেন শুভময়। হয়তো এইজন্যই তাঁর এতো নামডাক, বইএর এতো বিক্রি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফাইলটি বন্ধ করে সরিয়ে রাখেন অভিজ্ঞান। কপালের রগগুলো দপদপ করছে তাঁর, এই কেসের জন্য প্রিয় বন্ধু অগ্নিভের সঙ্গে কথা হয়নি তিনদিন৷ বেচারী অভিমান করলো কিনা কে জানে! অভিজ্ঞান ছাড়া তার যে কেউ নেই!

সহসা ফোন বেজে উঠতেই ঘোর কাটে অভিজ্ঞানের, তড়িঘড়ি ফোন তোলেন তিনি৷ ওপার থেকে রিনরিনে কণ্ঠস্বর ভেসে আসতেই মন ভালো হয়ে যায় তাঁর, নরম গলায় প্রশ্ন করেন তিনি,

” কি হয়েছে? মন খারাপ?”

ওপার থেকে কি উত্তর ভেসে আসে বোঝা যায় না, তবে অভিজ্ঞানের মুখে চিন্তার ভাঁজ পড়ে৷ তড়িঘড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান তিনি৷ থানা থেকে বেরোতে বেরোতে বলেন,

” তুমি বোসো, আমি এখুনি আসছি। কোথাও যাবে না, কিচ্ছু করবে না৷ আমি আসছি৷ “

কোলকাতা শহরের ব্যস্ত ট্রাফিকের বুক চিরে তাঁর জিপ তড়িঘড়ি ছুটে চলে, অজানা আশঙ্কায় ধুকপুক করে তাঁর মন৷ অবেলার সূর্য ম্লান আলো ছড়ায় পশ্চিম আকাশে, একটুকরো কালো মেঘ ভেসে চলে অজানার উদ্দেশ্যে।

(৩)

” আমি ভাবতে পারছি না এতোকিছু তুমি লুকিয়ে রেখেছো আমার থেকে। কেন অগ্নিভ! কেন আগে বলো নি আমায়!”

মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে সামনে কাঠের চেয়ারে গোঁজ হয়ে বসে থাকা গোলগাল মানুষটির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেন অভিজ্ঞান। রাগে ও চিন্তায় মাথার শিরা দপদপ করে তাঁর। নিজের এই বন্ধুটিকে বড়ো ভালো করে চেনেন তিনি৷ নিতান্ত নিরীহ গোবেচারা মানুষ, লেখক হিসাবে ভালোই সুনাম রয়েছে তার। কিন্তু আজ তার অবস্থা দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছেন তিনি। এতগুলি ক্ষতচিহ্ন লুকিয়ে কিকরে সে বসে রয়েছে এতদিন বুঝতে পারেন না তিনি৷ সহানুভূতিতে মন ভরে যায় তাঁর।

” অগ্নিভ, তুমি জানো আমি কোনোদিন তোমার বিচার করিনি, আগামীতেও করবো না৷ কিন্তু আমার মতে তোমার এবার সুস্থ জীবনযাপন করা উচিত৷ আর কতদিন অতীতের ক্ষতের হাত থেকে রক্ষা পেতে বর্তমানকে ক্ষতবিক্ষত করে চলবে! তুমি যা, মানুষ তোমায় সেভাবেই ভালোবাসে, বুঝতে পারো না তুমি!”

বন্ধুর হাতে হাত রেখে নরম গলায় বলেন অভিজ্ঞান।

” মানুষ আমায় ভালোবাসে না অভি, ভালোবাসে আমার সাহিত্যকে, আমার বিতর্কিত জীবনচর্যাকে। তারা রগরগে গল্প পছন্দ করে, রক্তের আঁশটানি গন্ধ ভালোবাসে, কিন্তু ক্ষতে ওষুধ লাগাতে পছন্দ করে না একদম। তাতে যে ব্যথার মর্যাদা কমে যায়!”

রিনরিনে স্বরে মন্তব্য করে চেয়ারে উপবিষ্ট মানুষটি।

” কিন্তু আমি তোমায় এভাবে দেখতে পছন্দ করি না অগ্নিভ৷ আমি চাই তুমি সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করো বাকি সকলের মতো। এটা তোমার অধিকার৷ আর তোমার সঙ্গে এমন যে করেছে তার নাম বলো আমায়, কথা দিলাম তাকে ছাড়বো না আমি। “

ওষুধের বাক্স ঘাঁটতে ঘাঁটতে মাথা নীচু করে বলেন অভিজ্ঞান, টের পান না একফোঁটা জল কখন গড়িয়ে পড়েছে চেয়ারে বসা গোলগাল মানুষটির চোখ বেয়ে। তিনি লক্ষ্য করার আগেই তড়িঘড়ি চোখের জল মুছে অন্যদিকে মুখ ঘোরায় সে, তার শরীরের ক্ষতে ওষুধের স্পর্শ পড়তেই প্রবল জ্বালা করে, তড়িঘড়ি চোখ বোজে সে। ঠোঁট চেপে দমন করতে চায় গলা বেয়ে ঠেলে আসা আর্তনাদ।

” একটা গল্প শুনবে অভি? আমার লেখা নতুন গল্প?”

ধীরগলায় বলে সে।

” আজ পর্যন্ত তোমায় কোনোকিছুতে না বলেছি আমি! বলো, শুনবো। “

অগ্নিভের ক্ষতস্থানে ফুঁ দিতে দিতে নরম গলায় বলেন অভিজ্ঞান। অজস্র আঁচড় কামড়ের দাগ ভরা অগ্নিভের শরীরে, বেসামাল রাত্রিযাপনের ফসল৷

” আজ থেকে অনেকবছর আগে এক পাড়াগ্রামে বাস করতো একটা বোকা ছেলে। নিজের প্রিয় সাহিত্যিকের সঙ্গে দেখা করবে বলে টিউশনের টাকা জমিয়ে এসে পড়েছিল শহর কোলকাতায়। হঠাৎ করে এক চায়ের দোকানে দেখা হয়ে গিয়েছিল সেই সাহিত্যিকের সঙ্গে, ভক্তিতে গদগদ ছেলেটির সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগায় তাকে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সেই সাহিত্যিক। নিজে উদ্যোগ নিয়ে ভাড়াবাড়ি জোগাড় করে দিয়েছিলেন তাকে। বদলে শর্ত ছিলো একটাই, হতে হবে তাঁর পরবর্তী উপন্যাসের চরিত্র। হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো অবাক হয়ে রাজি হয়েছিল ছেলেটি। প্রিয় সাহিত্যিকের উপন্যাসের অংশ হবে সে, ভাবতেই কেমন যেন শরীরে শিহরণ খেলে গিয়েছিল তার৷ কিন্তু সে ভাবতে পারেনি, প্রিয় সাহিত্যিক আদপে বিকৃতমনষ্ক, সবরকমভাবে তাকে ব্যবহার করে একদিন ছুঁড়ে ফেললেন রাস্তায়। বাড়ি ফেরার পরে ছেলেটি টের পেলো, বন্ধ হয়েছে বাড়ির দরজা৷ শুরু হলো তার জীবনসংগ্রাম, ফিরে এলো আবার সে এই বিচ্ছেদের শহরে৷ পরিচয় হলো অনেকের সঙ্গে, মিললো কাজ, মাথার ওপরে আচ্ছাদন। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালো সে, লিখতে শুরু করলো তার জীবনের কথা৷ মানুষ অল্পদিনেই বিখ্যাত করে দিলো তাকে, কারণ সে বাস্তব বিক্রি করতে শুরু করলো শব্দে৷ কিন্তু তার মন থেকে মুছে গেলেন না সেই সাহিত্যিক, মুছে গেলো না প্রতিশোধ, তাই শেষমেশ আট বছর পরে…”

অগ্নিভের কথার জাল ছিঁড়ে যায় অভিজ্ঞানের পকেটে বাজতে থাকা ফোনের শব্দে, তড়িঘড়ি ক্ষমা চেয়ে ফোন ধরেন তিনি, কনস্টেবল বংশীরামের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে,

” খোঁজ পেয়েছি স্যার, মোট বারোজনের রক্তের গ্রুপ বি নেগেটিভ…”

গড়গড় করে সকলের নাম বলে যায় সে, কিন্তু একজনের নাম শুনে আটকে যান অভিজ্ঞান, কপালে ফুটে ওঠে বিন্দু বিন্দু ঘাম। অগ্নিভ মুখোপাধ্যায়!

” আমি তোমায় পরে ফোন করছি বংশী, ফোন রাখো। “

কথাগুলি বলে তড়িঘড়ি ফোন কাটেন অভিজ্ঞান, চোখ বড়বড় করে তাকান তাঁর প্রিয়তম বন্ধুর দিকে, কোনোক্রমে গলা চিরে শব্দ বের হয় তাঁর,

” তারপর?”

” তারপরের ঘটনা এতক্ষণে তুমি বুঝে গিয়েছো অভি, তবুও বলছি শোনো। আটবছর আগে করা পাপের মূল্য দিয়েছেন সাহিত্যিক শুভময় মৈত্র। তুমি জানতে চাইতে না কার জন্য আমার এই অবস্থা, কেন কারো ওপরে বিশ্বাস করে উঠতে পারি না আমি! কেন বেসামাল জীবনযাপন পছন্দ আমার! এইজন্য, কারো প্রতি কখনো বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি আমি, না পেরেছি ভালোবাসতে৷ তবে আজ বড্ড হালকা বোধ হচ্ছে আমার৷ জানি, আমায় গ্রেফতার করবে তুমি, বাকি জীবনটা কেটে যাবে অন্ধকারে। তাতে আমার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। কেন জানো? কারণ শুভময় মৈত্রকে তাঁর প্রাপ্য শাস্তি বুঝিয়ে দিয়েছি আমি। এই ক্ষতগুলিও তাঁরই দান। অনেকদিন পরে নিজের পুরাতন খেলনাকে দেখে নিজেকে সামলাতে পারেননি তিনি, বুভুক্ষের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। গলায় কখন পেঁচিয়ে গিয়েছে তার টের পাননি। ভেবেছিলাম, কখনো কাউকে বলবো না এই কথা। কিন্তু তোমার কাছে লুকোতে ইচ্ছে করেনি। তাই, আজ তিনদিন নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করার পরে ডাক দিয়েছি তোমায়। বসার ঘরের ড্রয়ারে রয়েছে তারটি, বাকিটা আমি নিজেই স্বীকার করে নেবো আদালতে। চলো যাওয়া যাক। “

দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায় অগ্নিভ, চেয়ারের হাতল থেকে টেনে নেয় পরনের শার্টখানা।

” দাঁড়াও। যতদূর জানি, তুমি কখনো রক্তদান করোনি৷ তবে তোমার রক্তের গ্রুপ খুঁজে কিকরে পেলো বংশী?”

অগ্নিভের হাত ধরে তাকে থামিয়ে প্রশ্ন করেন অভিজ্ঞান।

” আটবছর আগে যখন শুভময় মৈত্র আমায় ছুঁড়ে ফেলেছিলেন শারিরীক ও মানসিকভাবে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিলাম আমি। ভর্তি হতে হয়েছিল হাসপাতালে, নিতে হয়েছিল রক্ত। তখনই হয়তো…”

অভিব্যক্তিহীন স্বরে বলে অগ্নিভ।

” তুমি জানো আমি পুলিশ, তাও আজ আমায় ডেকে স্বীকার করলে কেন এসব! তুমি না বললে হয়তো এতো সহজে তোমায় সন্দেহ করতাম না আমি। কেন বললে আমায়?”

অগ্নিভের মাথার চুল ঘেঁটে দিয়ে নরম গলায় বলেন অভিজ্ঞান।

” তোমায় বিশ্বাস করি, হয়তো বা… যা কখনো কাউকে বলিনি, তা তোমায় বলেছি অনায়াসে, আমায় ঘেন্না কোরো না অভি। “

অগ্নিভের কণ্ঠস্বর কেমন কাতরোক্তির মতো শোনায়৷ তার কাঁধ ধরে আবার তাকে চেয়ারে বসান অভিজ্ঞান, নিজে হাঁটু মুড়ে বসে পড়েন মেঝেতে৷ চোখে চোখ রেখে বলেন,

” একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে আমি যা করতে চলেছি তা সরকারের কাছে ক্ষমার অযোগ্য, কিন্তু একজন মানুষ হিসাবে আমি নিজের সিদ্ধান্তে গর্বিত৷ শুভময় মৈত্র তাঁর কৃতকর্মের শাস্তি পেয়েছেন, ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার নেই তাঁর৷ যখন তাঁর পরিবারের তেমন কোনো আগ্রহ নেই তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে তখন সংবাদমাধ্যম ও বাকিদের ভুলে যেতে বেশি সময় লাগবে না৷ শুভময় মৈত্র’র মৃত্যুরহস্য কখনো উদঘাটন হবে না, খুনীর পরিচয়ও প্রকাশ পাবে না৷ সেই কাজটা আমি করবো। আর রইলো তোমার কথা, কথা দাও এবার থেকে স্বাভাবিক জীবনযাপন করবে, তোমার প্রতিটি পদক্ষেপে আগামীতে আমি থাকবো, একলা চলতে হবে না আর তোমাকে৷ “

চেয়ারে বসা মানুষটির চোখ বেয়ে জল গড়ায়, হাত বাড়িয়ে তার চোখ জল নিজের বুড়ো আঙুল দিয়ে মুছিয়ে হাসেন অভিজ্ঞান৷ এই কেস ধামাচাপা দিতে অনেকটাই পরিশ্রম করতে হবে তাঁকে, তবু এক অসহায় মানুষের শাস্তির চেয়ে এটাই জরুরী মনে হয় তাঁর৷ হয়তো এক পুলিশ অফিসার হেরে যাবেন আজকের পরে, কিন্তু জিতে যাবেন এক মানুষ, যিনি এক দোষীর মৃত্যুতে কুম্ভিরাশ্রু বিসর্জন করেন না৷ শুভময় মৈত্র’র বিচার পাওয়ার অধিকার নেই, কোনোদিন ছিলো না।

” আচ্ছা, শুভময় মৈত্র তোমায় নিয়ে যে উপন্যাসটি লিখেছেন তার নাম কি?”

কৌতুহলী হয়ে জানতে চান অভিজ্ঞান।

” পদ্মকাঁটা। এক সমকামী মানুষের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার গল্প। “

বিড়বিড় করে বলে অগ্নিভ। তার দুইহাত নিজের মুঠিতে শক্ত করে চেপে ধরে রাখেন অভিজ্ঞান৷ প্রতিটি নিকষ রাত্রির পরে সকাল আসে, সেই সকাল মুছিয়ে দেয় যাবতীয় কলুষতা ও ভয়।

জীবন মর্মান্তিক হলেও সুন্দর, শুধু তাকে বাঁচতে জানতে হয়।।

কলমে রিয়া ভট্টাচার্য

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here