খুঁটি পুজো হয়ে গেল। বাতাসে পূজার গন্ধ আর আকাশ জুড়ে ইতিউতি সাদা মেঘের দল।
বিষ্ণুপুর যুগের যাত্রী ক্লাবের পূজার থিম নির্ধারণের রুদ্ধদ্বার মিটিং চলছে ক্লাবের বড় হল ঘরটায়।
ক্লাবের সবচেয়ে বড় উপদেষ্টা হলেন স্থানীয় বরফ কলের মালিক উমেশ পোদ্দার। তিনিই ক্লাব প্রেসিডেন্ট।
তাঁর মতে, এবারের থিম হোক ‘যুগের ত্রাস করোনা ভাইরাস’। এক্কেবারে হাতে গরম লেটেস্ট থিম। ফার্স্ট প্রাইজ বাঁধা।
যোগেনের মনঃপুত হয় না থিমটা। করোনার ত্রাসে এমনিতেই জন জীবন এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যস্ত। পূজা প্যাণ্ডেলেও সেই করোনার মহামারি চিত্রায়ণ মনে ধরে না যোগেনের।
যোগেন সেন হলো যুগের যাত্রী পূজা কমিটির মূল শিল্প উপদেষ্টা।
চালচিত্র নামের স্থানীয় আঁকার স্কুলের শিক্ষক সে। সাকুল্যে গোটা পঞ্চাশেক ছাত্রছাত্রী। তার মধ্যে অর্ধেক বিনি পয়সার খোদ্দের।
যোগেন মাস্টারের মতে টাকা পয়সা দিয়ে শিল্প শিক্ষা বেচা যায় না।
যাদের ভিতর শিল্পের প্রতিভার অঙ্কুর ঘুমিয়ে থাকে, টাকা থাক বা নাই থাক তারাই শিল্প শিক্ষা লাভের আসল হকদার।
যোগেনের বয়স কম। আবেগ বেশি।
সে বলে, তার চেয়ে থিম হোক ‘কল্পতরু’।
আড় চোখে উমেশ পোদ্দারের মুখ ভার মেপে নিয়ে ক্লাবের সেক্রেটারি জনার্দন পারুই হাঁ হাঁ করে ওঠেন, ‘সে কেমন শুনি। করোনাই লেটেস্ট। আর ওটাতে আমারও সায়।’
যোগেন বলে, ‘শুনলে বুঝবেন কল্পতরুও এক্কেবারে হাতে গরম টপিক।’
সর্ব সম্মতিক্রমে যোগেনের ‘কল্পতরু’ ফুলমার্কস পেয়ে পাস হয়ে যায়।
উমেশ পোদ্দার হাত তুলে নেয়। ‘ওহে জনার্দন এবারকার মতো তোমাদের পূজার খরচপাতি তোমরাই সামলিও তবে।’
একরোখা যোগেন বলে,
‘মা চাইলে সব সম্ভব। জয় মা ভক্তবাঞ্ছা কল্পতরু!’
যোগেন মাস্টারের আঁকার স্কুলের সামনের বল খেলার মাঠের এক অংশ চট দিয়ে আড়াল করে জোর কদমে চলে চিন্ময়ী প্রতিমার মৃন্ময়ী রূপদান পর্ব।
পঞ্চমীর দিন থেকে লোক ভেঙে পড়েছে প্যাণ্ডেলে।
সবাই মায়ের কাছে মনোবাঞ্ছা জানাতে হাজির।
লকডাউনে বহু মানুষ কর্মহীন। ঘরে ঘরে অভাবের চড়াই বাসা।
মাইক্রোফোনে ঘোষণা চলছে, ‘আমাদের মা ভক্ত মনোবাঞ্ছা কল্পতরু। আপনারা জানেন, মা এক আর তাঁর লাখো সন্তান। আপনারা আপনাদের অভাবটুকু পূরণের জন্য মায়ের কাছে আর্জি জানান। কাউকে ফেরাননা মা জগজ্জননী দয়াময়ী।’
লাল পাড় সাদা শাড়ি পরিহিত মায়ের অতি সাধাসিধে প্রতিমা। মুখখানি পরম মমতামাখা। দুই ছেলে আর দুই মেয়ে সাথে।
আর মাথার উপর ডালপাতা ছড়িয়ে সামিয়ানার মতো দাঁড়িয়ে কল্পতরু।
তার অসংখ্য ডাল থেকে ঝুলছে অন্ন , বস্ত্র, মোক্ষ, প্রসাদ, আশীর্বাদ লেখা চিরকুট।
লাইন দিয়ে প্রবেশের পর যে , যে চিরকুট বাচছে। সে তাই পাচ্ছে।
ঢালাও প্যাণ্ডেলের একধারে ঢিপি করে রাখা আছে , শাড়ি, ধুতি, চাল ডাল আলুর প্যাকেট, প্যাঁড়া প্রসাদের প্যাকেট।
আর ভক্তি মোক্ষ ও আশীর্বাদ চাইলে তাকে বাইরের আলাদা প্যাণ্ডেলে যোগকেন্দ্রে যাবার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।
এলাকার ক্ষমতাবানরা এই মহতি প্রচেষ্টায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
যোগেনও তার সর্ব সামর্থ দিয়ে লড়ে গেছে দশমীর দিন পর্যন্ত। কিছু ধারকর্জও করতে হয়েছে শেষ পর্যন্ত। যদিও তা কাউকেই জানতে দেয়নি সে।
নবমীর রাত গড়িয়ে গেল দশমীর সকালে। বিজয়ার সন্ধ্যায় মায়ের বিদায় বেলায় ছলছল চোখে যোগেন বসে আছে প্যাণ্ডেলের ভিতর কাঠের বেঞ্চিতে।
ভাসানের আরণ বরণ শেষে মায়ের পায়ে প্রণাম সেরে সবে যোগেন উঠে দাঁড়িয়েছে।এমন সময় কোথা থেকে এক ময়লা ধুতি পরা বুড়ো মানুষ এসে যোগেনকে ধরে,
‘হ্যাঁ গো বাবা, তোমাদের মা না কি কল্পতরু! পরশু মেয়েটার বিয়ের পণ তুলে দিতে হবে পাত্র পক্ষের হাতে। এখনো হাজার পঁচিশেক জোগাড় করতে বাকি।’
হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে থাকে এক কন্যা দায়গ্রস্ত পিতা।
‘পাগল নাকি!’
হাঁহাঁ করে তেড়ে আসে ক্লাবের ছেলেরা।
যোগেন ওদের থামিয়ে বলে, ‘বাবা এই মুহূর্তে না হলেও, আগামী পরশু আমার বাড়িতে আসুন। কিছু একটা ব্যবস্থা করবেন মা।’
বিজয়া দশমী সমাপন হয়েছে।
একাদশীর দিন সন্ধ্যায় এলাকার কাছারির মাঠে বিশাল আনন্দানুষ্ঠান শুরু হতে চলেছে।
এখানেই সেরা পূজার ঘোষণা এবং পুরস্কার প্রদান করা হবে। এলাকার সব ক্লাবের দুর্গাপূজার কমিটির মাতব্বররা হাজির। অষ্টমীর দিন কলকাতা থেকে আসা বিচারক মণ্ডলীর আট সদস্যের এক দল প্যাণ্ডেলে প্যাণ্ডেলে ঘুরে তাঁদের রায় জানানো খামবন্ধ ফলাফল জমা রেখে গেছেন স্থানীয় সমাজসেবী সংঘ ‘ভালোবাসার হাত’এর সম্পাদকমশাইয়ের কাছে।
নাম ঘোষণা হয়ে গেল।
জনার্দণ পারুই বলে, ‘যোগেন এ পুরস্কারের আসল হকদার তুমি। তুমিই মঞ্চে ওঠো হে।’
‘না জনাদা, এ আমাদের সবার পুজো। তাই সবাই আমরা একসাথে নেব এ পুরস্কার।’
মঞ্চের পাশের অন্ধকার পেরিয়ে মঞ্চের এক্কেবারে মাঝখানে আলোর বৃত্তে এসে দাঁড়ায় যোগেন। আর তার পিছু পিছু ক্লাবের সবুজ বাহিনী তরুণরা।
‘ভালোবাসার হাত’এর পক্ষ থেকে সম্পাদকমশাই, ষাটোত্তীর্ণ রমেন পাঁজা পুরস্কারের সাদা খাম তুলে দেন যোগেন সেনের হাতে। নগদ পঁচিশ হাজার টাকা।
চোখের জলে ঝাপসা যোগেন ,রমেন পাঁজাকে প্রণাম করে।
তার মনের ক্যানভাসে তখন পঞ্চমী থেকে দশমী পর্যন্ত অগুণতি অসহায় মানুষের অন্ন, বস্ত্র প্রাপ্তির তৃপ্ত হাসি মুখের ছেঁড়া ছেঁড়া দৃশ্য কোলাজ ।আর সেই কোলাজের মধ্যমণি হয়ে জুড়ে বসে থাকে দশমীর দিন বিচলিত মুখে দৌড়ে আসা অসহায় নিরুপায় কন্যা দায়গ্রস্ত এক বাবার করুণ মুখ।
যোগেনের ভিতরটা অস্থির হয়ে ওঠে, কখন সে এই টাকার খাম তুলে দিতে পারবে সেই বৃদ্ধ মানুষটার হাতে!
যোগেনকে ঘিরে থাকা ছেলেদের হিপহিপ হুররে, আর দর্শকদের আবছা হয়ে যাওয়া হাততালির শব্দের মধ্যে যোগেন শুনতে পায় বিগত দুই মাসে একটা একটা করে টাকা জোগাড়ে তার অক্লান্ত পরিশ্রমগুলো তার পিঠ চাপড়ে বলছে সাব্বাশ!
কলমে এণাক্ষী কয়াল মণ্ডল, ডায়মন্ড হারবার।
বর্তমানে দক্ষিণ ২৪পরগণার আমতলার বাসিন্দা। যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে গণিতে এম.এস.সি। বর্তমানে বিদ্যানগর বালিকা বিদ্যালয় (উচ্চ মাধ্যমিক) এর প্রধান শিক্ষিকা। ছোট্ট বেলা থেকেই লেখালেখি করতাম। মায়ের অনুপ্রেরণায় মায়ের দেওয়া নীল রঙের ডায়রিতে ছড়া লিখে প্রথম লেখার সূত্রপাত।
বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিন, পত্রিকা ,গল্প সংকলন এবং ওয়েব ম্যাগ এ আমার লেখা প্রকাশিত হয়েছে।