“ঊষা কুঞ্জ ” বারাকপুরে অবস্থিত ছোট্টো একতলা কিন্তু ভালোবাসায় ভরপুর একটি বাড়ি। সবুজ সতেজ গাছপালা দিয়ে ঘেরা বাড়িটিকে দেখে অনেকেই বলতো কপিল মুণির আশ্রম। অনেক ঝড়, ঝঞ্ঝা, বিপদ কাটিয়ে পরম যত্নে নিজেদের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে অঞ্জু আর বিমল একটু একটু করে গড়ে তুলেছিলো তাদের স্বপ্নের এই বাড়িটিকে। ঊষা মানে ভোর। সত্যিই এই ভোরের আলোর কবোষ্ণ পরশটা বিমল পেয়েছিলো তার শাশুড়িমার কাছ থেকে। ছয় মাস বয়সে মাতৃহারা হয়েছিলো বিমল। তাই মায়ের স্নেহ, আদর, ভালোবাসা বলতে যা বোঝায় ঊষা সবটা তার একমাত্র জামাইকে প্রাণ ভরে দিয়েছিলো। আর মেয়ে জামাইয়ের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য আর্থিক সাহায্য ও করেছিলো। ভাগ্যবশত বাল্যবিধবা ঊষা সরকারি হাসপাতালের সেবিকা ছিলেন। সেই সময় দুই মেয়েকে নিয়ে স্বল্প আয়ে সংসার চালানোটাই বিমলের কাছে বড় দায় ছিলো, তার উপরে আবার বাড়ি তৈরি। বিমল বারাকপুরে লাটবাগান পুলিশ ডিপার্টমেন্টে ক্লারিকাল পোস্টে চাকরি করলেও মাইনে ছিলো যৎসামান্যই। তাই শাশুড়িমায়ের সেই আর্থিক সাহায্য তাকে নিতেই হয়েছিলো। সংসারের অভাব মেটাতে এবং সাধের বাড়ি বানাতে গিয়ে অঞ্জু আর বিমল দুজনকেই হিমশিম খেতে হয়েছিলো। পয়সা বাঁচানোর জন্য বিমল মিস্ত্রীদের সাথে সমস্ত রকম জোগালের কাজ করতো। তাতে একেক দিনের জোগালে খরচটা বেঁচে যেত,আর সেই বেঁচে যাওয়া অর্থ দিয়ে একদিনের মিস্ত্রীর খরচটা হয়ে যেত। সরকারি চাকুরিরতা বিধবা মায়ের একমাত্র আদুরে মেয়ে তায় আবার গুহ রায় বাড়ির ছোটো বউ অঞ্জুকেও কারখানায় গিয়ে কাজ করতে হয়েছিলো স্বপ্ন পূরণের তাগিদে। যাই হোক তিনজনের অটুট ভালোবাসার বন্ধনে তৈরী হয়েছিলো বাড়িটা। অবসর গ্রহণের পর ঊষাকে বিমল তাদের কাছে এনেই রেখেছিলো। বিমল তার শাশুড়িমাকে নিজের মায়ের মতোই ভালোবাসতো। ঊষার ছোটো ছোটো আব্দার মেটানো, অসুখের সময় ছেলের মতো পাশে থাকা এ সবই বিমল খুব ভালো বেসেই করতো। অবসর গ্রহনের পর মেয়েজামাইয়ের অভাবের সংসারের আরো কিছুটা আর্থিক স্বচ্ছলতা এনে দেওয়ার জন্য ঊষা বারাকপুরে আশা নার্সিং হোমে আবার সেবিকার পদে চাকরি নিল। প্রথম মাসে মাইনে পেয়েছিলো তিনশত টাকা। সেই টাকা দিয়ে কিনে এনেছিল চাবি দেওয়া ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজে এমন একটা দেওয়াল ঘড়ি।
এই দেওয়াল ঘড়িটা ছিলো শাশুড়ির কাছ থেকে পাওয়া বিমলের আরেকটি প্রিয় উপহার। ঘড়িটা ওদেরই শোওয়ার ঘরে পায়ের দিকের দেওয়াল টাতে রাখা ছিলো। যাতে ভোর বেলা চোখ মেলেই বিমল দেখতে পায় কটা বাজে। কারণ বিমল ছিলো ভীষণই নিয়মানুবর্তী ও শৃঙ্খলাপরায়ণ একজন মানুষ। নিয়ম করে সব কাজের মধ্যে পরম যত্নে ঘড়িটাতে চাবি দিতে কিন্তু বিমলের কখনোই ভুল হতো না। ঘড়ির কাটা ঘোড়ার সাথে সাথে অনেকটা সময় ও অতিক্রান্ত । “সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়” । বিমল আর অঞ্জুর দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। দুই জামাই আর দুই মেয়ের ঘরে দুই নাতিকে পেয়ে দুজনেই খুব খুশী। নাতিদের পেয়ে নিজেদের ছেলে না হওয়ার দুঃখটা কিছুটা মিটেছে। বিমল চাকরি থেকে অবসর নিয়েছে। বাড়িতে এখন তিনজন মানুষ একে অপরকে ভরসা করে বেঁচে আছে। আধঘণ্টা, একঘন্টা অন্তর ঢং ঢং করে বেজে যাওয়া ঘন্টাটা কিন্তু জানান দিচ্ছে সময়টা খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাচ্ছে । ২০১৬ সালের ৮ই ডিসেম্বর বিমল আর অঞ্জু তাদের প্রাণের চেয়ে প্রিয় মানুষটাকে হারিয়ে ফেলল। ঊষার কিরণ নিভে গেল।
দেওয়াল ঘড়িটাতে চাবি দেওয়ার সময় বিমল যেন তার শাশুড়িমার পরশ পেত। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়।বিমল আজ ৮১ বছরের বৃদ্ধ। বেশ কয়েক বছর ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগছে। তার প্রিয়তমা অঞ্জু অনেক যত্ন ও ভালোবাসায় বিমলের সবটুকু জুড়ে আছে । শারীরিক যত কষ্টই থাকুক না কেন ঐ উঁচু দেওয়ালে রাখা ঘড়িটাতে নিয়ম করে চাবি দিতে কিন্তু বিমল কখনো ভোলে না। কিন্তু হঠাৎ একদিন ঘড়িটার যে কী হলো…কিছুক্ষন চলার পর বন্ধ হয়ে যেত। আবার চাবি দিলে আবার চলতো…আবার বন্ধ । আসলে ঘড়িটাও যে অনেক কিছু বোঝাতে চাইছিলো। বলতে চাইছিলো সময় শেষ হয়ে আসছে। যে হাত দুটো পঁয়ত্রিশটা বছর ধরে তার পরিচর্যা করে আসছিলো, সেই হাতদুটোর পরশ আর সে পাবে না। সব ঘড়ির দোকানে দেখানো হলো, বাড়িতে লোক ডেকে আনা হলো… সবাই একই কথা বললো, এ ঘড়ি আর সারাই করা যাবে না। তবু বিমল হাল ছাড়লো না, চাবি দিয়েই গেলো। একদিন মাঝ রাত্রিতে হঠাৎ বিমলের ঘুম ভেঙে গেল। খুব কষ্ট হচ্ছিল, কান্না পাচ্ছিলো। সারাদিন সংসারের কাজ, বৃদ্ধ ও অসুস্থ স্বামীর সেবা করে অঞ্জু ক্লান্তিতে ঘুমাচ্ছিলো। বিমল তাকে আলতো করে হাত দিয়ে ডাকলো ” অঞ্জু, অঞ্জু “। অঞ্জু সেই ডাকে লাফ দিয়ে উঠে বলেছিলো ,”কী হয়েছে তোমার”? বিমল অনেক কষ্টে কান্না চেপে বলেছিলো,”আমার মনটা খুব খারাপ লাগছে গো, ঘড়িটা বারে বারে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।” অঞ্জু বললো, “কী করবে? অনেক তো চেষ্টা করলে। জল খাবে?” বিমল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে না বলে ডানহাতটা আলতো করে তার থেকে প্রায় কুড়ি বছরের ছোটো ৬২ বছরের
সহধর্মিনীর গায়ের ওপরে রাখলো। একটু কাছে টেনে নিয়ে বললো,”কতোদিন তুমি আমার কাছে আসোনা”। অঞ্জু পাশ ফিরে তার প্রায় ৮২ বছরের বৃদ্ধ স্বামীকে আদর করে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো,
“কী যে বলো তুমি, আমি তো সাতচল্লিশ বছর ধরে তোমার কাছেই আছি সর্বক্ষণ।” পরেরদিন ঘড়িটার ঢং ঢং করে ঘন্টা পরার আওয়াজ টাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। আর ঠিক তার পরের দিন ২৪ শে ফেব্রুয়ারি (২০২০) সোমবার সকাল নয়টা নাগাদ হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেল বিমলের হৃদস্পন্দনের ধুক্ পুক্ ধুক্ পুক্ শব্দটাও।
আজ “ঊষা কুঞ্জ ” তে প্রিয়জনদের হারিয়ে অঞ্জু একা।আর সেই দেওয়াল ঘড়িটার জায়গায় স্থান পেয়েছে অঞ্জুর বড়ো জামাইয়ের কিনে দেওয়া আরেকটি ব্যাটারির দেওয়াল ঘড়ি। জানিনা সেই ঘড়িতে কী ভালোবাসার বন্ধনের কোনো স্মৃতি জড়িয়ে থাকবে??
লেখিকা পরিচিতি : ববিতা সরকার (গুহ রায়)