জীবন মানে বেঁচে থাকা, আর বেঁচে থাকার জন্য একটি সহজ বা কঠিন লড়াই। কারোর জীবন খুব সহজ ভাবেই এগিয়ে চলে কারোর একটু আঁকাবাঁকা- বন্ধুর। তবে বাইরে থেকে কেউ অন্যের জীবনের সুখ-দুঃখ ভালো মন্দের পরিমাপ সঠিক ভাবে নির্ধারণ করতে পারে না, আর পারার কথাও না , কারণ ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠ জীব সবথেকে বুদ্ধিমানও বৈকি।
কিছু মানুষ সারাটা জীবন কিছু উদ্দেশ্য পূরণের আশায় অসন্তুষ্ট জীবন ব্যয় করে, কেউ উদ্দেশ্যর খোঁজ রাখতে নারাজ, কেউ আবার উদ্দেশ্যহীন। জীবন যে সব সময় অর্থপূর্ণ হতেই হবে আর তাতেই আমরা শান্তি-সুখ খুঁজে পাবো এমন কথার গ্যারান্টি না থাকলেও, দার্শনিক ইড্ডো ল্যান্ডাউ এর মতে ‘একটি অর্থপূর্ণ অস্তিত্বের জন্য আমাদের যা কিছু প্রয়োজন তা আমাদের কাছেই রয়েছে।’ এখন তার ব্যবহার আপনি কিভাবে করবেন, না করবেন না সেটা একান্ত আপনারই হাতে।
প্রতিটি জীব একদিন অন্তিমে মিশে যাবে, তা বলে একটা জীবন উদ্দেশ্যহীন আর কিছু আফসোসের সাথে বয়ে নিয়ে যাওয়ার থেকে কিছু একটা কাজে বা পরিণামে কাটালে মন্দ হয় না বোধহয়। যে কাজ নিজেকে আনন্দ দেয়, যে কাজে নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়, যে কাজ করলে শেষ জীবনে আফসোস থাকে না, যে কাজ এনে দেয় আত্মোপলব্ধি।
খুব সহজে যদি ভাগ করা যায়, যেটুকু বুঝেছি- মানুষ দু ধরণের- প্রথম, যার নিজস্বতা আছে- মত আছে – মতামত আছে- ভিড়ে হারাতে চায়না। আর দ্বিতীয়, যারা সবার মাঝে হারিয়ে যেতে ভালোবাসে। দ্বিতীয় প্রকারের মানুষগুলি ভারী সুখী আর শান্তিপ্রিয়- মত নেই, তাই বিতর্ক নেই তাদের জীবনে, নেই কোনো প্রকরণ বা পরিবর্তন। আর প্রথম ভাগের মানুষগুলির দর্শন থাকে, তাই এদের জীবন রঙীন- রুক্ষ আবার কখনো চোখ ঝলসানো আলো। মত থাকে বলেই এদের থাকে অনেক ভালোবাসার পক্ষ অথবা বিদ্বেষী প্রতিপক্ষ। জন্মগতভাবে মানুষ ঠিক এই দুপ্রকার হয় নাকি তা গবেষণা সাপেক্ষ্য এবং আমার আলোচনার ঊর্ধে, তবে দুই শ্রেণীর মানুষই আমাদের সমাজকে বাঁচিয়ে রেখেছে, এবং এগিয়ে নিয়ে চলেছে।
তবে প্রথম শ্রেণীর কিছু মানুষ যখন নিজস্বতায় বেশিমাত্রায় নিবেদিত হয়ে পড়েন, তখন না চাইতেও তারা জীবনে আফসোসকেই ডেকে আনে। কারণ কেউ কেউ জীবনের উদ্দেশ্য পূরণে এতটাই মেতে ওঠেন, যে ভুলে যান জীবনকে সে ভোগ করছে না, বরং চাহিদা তাকে গ্রাস করছে ক্রমাগত। তাই উদ্দেশ্যহীন জীবন যেমন ভালো বলে মেনে নিতে পারিনা তেমন কোনো কিছু পাওয়ার চাহিদাতে জীবনকে ভুলে যাওয়াও একটি চূড়ান্ত বোকামির কাজ বলে মনে হয়। কারণ যতই হোক, জীবনের শেষ দিনে আফসোস চাই না, চাই শুধু পরিতৃপ্তি।
এই বিষয়ে বলতে, অস্ট্রেলিয়ান একজন জনপ্রিয় লেখিকা এবং পেশাগতভাবে নার্স, ব্রোনি ওয়ারের কথা না বললেই নয়, যিনি বেশ কয়েক বছর একটি হসপিটালে কাজ করার পর উপলব্ধি করেন, যে তার দেখা প্রতিটি মৃতপ্রায় রোগী শেষ নিঃশ্বাসের সাথে নিয়ে চলেছেন আফসোসের দীর্ঘশ্বাস। অসংখ্য রোগীকে এভাবে মারা যেতে দেখেন তিনি। তাদের সাথে কথা বলে, তিনি শেষমেশ এই সিদ্ধান্তে আসেন যে তার দেখা অজস্র রোগীর আফসোসগুলোকে যদি একটা শ্রেণীবদ্ধ আকার দেওয়া হয়, তাহলে দেখা যায় ঠিক কয়েকটি প্রাথমিক কারণেই তাদের আফসোসের জন্ম। অর্থাৎ কোটি কোটি মানুষ- অগুনিত কষ্ট আর দুঃখ- কিন্তু প্রাথমিক আফসোস কয়েকটিই।
আমরা ছোটবেলায় ভাবি কবে বড় হবো, তাহলে বড়দের মতো সব জিনিস উপভোগ করতে পারবো, আবার বড়বেলায় বা যৌবনে ভাবি শৈশব কি ভারী মধুর ছিল। এই ভাবনাতে আমাদের কোনো লাগাম নেই কারণ এটা সহজাত। কিন্তু যৌবনে আমরা যথেষ্ট মানসিকভাবে পরিপক্ক হয়ে যায়, যখন আমরা আমাদের জীবনকে একটু সতর্কে সাজালেই বার্ধক্যে বা মৃত্যুলগ্নে অন্তত কিছু আফসোসকে সাথে বহন করতে হয়না।
জানি কথা গুলো খুব জ্ঞানের, আর জ্ঞান সবাই দিতে পারলেও তাকে নিজ জীবনে প্রয়োগ করে দেখানোর ইচ্ছে বা চেষ্টা খুব কম মানুষেরই থাকে। তবুও বলবো , কিছু আফসোস , যা আপনাকে আপনার মধ্যবয়সে একটু হলেও নাড়া দেয় , তা অবশ্যই বয়েসের সাথে আরো শিকড় বিস্তার করবে আপনার পরবর্তী জীবনে। তাই সময় থাকতে একটু সময় নিজেকে দিতে আপত্তি কোথায় – আপত্তি কোথায় নিজের জন্য – নিজের মনের জন্য ভাবতে। লোকে কি ভাববে – সে লোকেই ভাবুক না!! কারণ যে লোকেদের কথা ভেবে আমরা নিজের জীবনের অনেক ইচ্ছে – অনেক মত প্রকাশ করতে পিছপা হই , জীবনের শেষে – আপনার মৃত্যুযাত্রায় সেই লোকেদের একজনকেও আপনি পাবেন না, এটা একশত ভাগ সত্যি।
তাই আফসোসের জীবন নয় – জীবন হোক স্বাভাবিক – চলমান আর স্বতঃস্ফূর্ত। জীবন হোক আপনার , একান্ত আপনার।
কলমে মৌসুমী কুণ্ডু