দোতলার মেল-ওয়ার্ডের রোগীদেরকে দেখা শেষ করে চলে যাওয়ার সময় ডাক্তার ঘোষকে ডাকলেন সিনিয়র নার্স।
— স্যার, ও ঘরের ২৭ নম্বর আপনার সঙ্গে একবার দেখা করতে চায় !
— কিন্তু কেন ? ও তো ….
— জানি স্যার ! ও আপনার পেশেন্ট নয়। কিন্তু হাতে-পায়ে ধরে কাকুতি-মিনতি করছে, স্যার ! শুধু আপনার সঙ্গেই একটি বার দেখা করতে চায় !
— ইন্টারেস্টিং ! চলুন তো দেখি !
বারো নম্বর রুমের ২৭ নম্বর বেডের সামনে এসে দাঁড়ান ডাক্তার কুশল ঘোষ। তারপর রোগীর দিকে তাকান — অস্থি-চর্মসার চেহারা, এক মুখ দাড়ি, উস্কোখুস্কো চুল আর একজোড়া উজ্জ্বল চোখ নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে বসে রোগী। ডাক্তার ঘোষ তার কেস-হিস্ট্রিটা দেখেন — টিবি রোগী, লাস্ট স্টেজ ! নাম হরিপদ হালদার।
— কি ব্যাপার ! একেবারে শেষ করে এনেছো শরীরটাকে !
জবাবে কোনও উত্তর না দিয়ে বেডের পাশে ঝোলানো ঝোলাটা হাতড়ে দু’টো খাতা আর একগোছা টাকা বের করে হরিপদ। তারপর ডাক্তারকে সেগুলো দিতে যায় ।
— এ’সব কি ! খাতা ! টাকা !
হাঁফাতে হাঁফাতে বহুবার দম নিতে নিতে হরিপদ যা বলে তার সারার্থ হলো এই যে — সে বুঝতে পেরেছে তার সময় শেষ হয়ে এসেছে। তাই সে তার সারা জীবনের লেখা কবিতাগুলো কবি কুশল ঘোষকে অর্থাৎ ডাক্তারবাবুকে দিয়ে যেতে চায় ! মনে বহু আশা নিয়ে সে কলেজ-স্ট্রিট এসেছিল ! প্রকাশকদের দরজায় দরজায় ধর্ণা দিয়েছিল কবিতার বই প্রকাশ করবার জন্য — সাড়ে পাঁচ হাজার টাকাও দিতে চেয়েছিল ! কিন্তু সবাই তাকে একপ্রকার ভাগিয়ে দিয়েছে। হতাশায়, দারিদ্র্যে, রোগে, আধপেটা খেয়ে এবং না খেয়ে সে এখন মৃতপ্রায় ! তাই সে মৃত্যুর আগে সেগুলো ডাক্তার কুশল ঘোষ-এর কাছে দিয়ে যেতে চায়। তাঁর সম্পর্কে হরিপদর অনেক উঁচু ধারণা ! হরিপদ জানে যে কুশলবাবু একজন স্বনামধন্য কবি — তাঁর অনেকগুলো কাব্যগ্রন্থও রয়েছে !
— কিন্তু শরীরের এই হাল কেন তোমার ? না খেয়ে কি কবিতা লেখা যায় ? কি করো তুমি ?
হরিপদ-র কথা থেকে জানা যায় সে মফঃস্বলের একজন রিকশা-চালক । কিন্তু কবিতার “ঘোড়া-রোগ” তাকে কোনদিনও ছাড়ে নি ! তাই খেয়ে, না খেয়ে, আধপেটা খেয়ে সে রিকশা চালিয়েছে ! কবিতার বই প্রকাশ করবার জন্য টাকা জমিয়েছে ! কিন্তু অনাহার-অর্ধাহার কতদিন সইবে সে ! তাই শরীর উপযুক্ত প্রতিশোধ নিয়েছে !
— ইস্ ! এমনটাও কেউ করে ! তুমি তোমার কবিতার জন্য জীবনটা যে দিতে বসেছো সে খেয়াল আছে ?
হরিপদর শুকনো-শীর্ণ গাল বেয়ে নেমে আসে চোখের জলের ধারা ! ভীষণভাবেই ডাঃ ঘোষকে কাকুতি-মিনতি করতে থাকে সে। তার একান্ত কাকুতি-মিনতিতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও পান্ডুলিপি দু’টো হাতে নেন ডাক্তার কুশল ঘোষ। কিন্তু টাকাটা ফিরিয়ে দেন। হরিপদর চোখে তবু যেন জ্বলে ওঠে কি এক আশার আলো !
কোয়ার্টারে ফিরে কবিতার খাতা দু’টো একপ্রকার ফেলেই দিয়েছিলেন, কিন্তু কি মনে হতে ডাক্তার ঘোষ খাতা দু’টো তুলে নেন। তারপর পাতা উল্টাতে উল্টাতে চমকে ওঠেন ডাক্তার কুশল ঘোষ ! একি ! এ যে মহাকাব্য ! এ যে জীবন থেকে নিঃড়ে নেওয়া পদ্ম-পাতার উপরে টলটলে জল ! এ কী অসামান্য লেখা ! ডাক্তার কুশল ঘোষও এই রকম লেখা কোনও দিন লিখতে পারবেন কিনা সন্দেহ ! একটা অপরাধবোধ ডাক্তার কুশল ঘোষের মনে ভর করে। নাঃ ! খুব দেরি হয়ে গেছে ! হরিপদকে বাঁচাবার একটা শেষ চেষ্টা করতেই হবে ! খাতা দু’টো হাতে নিয়ে তিনি ফের ছুটে যান দোতলার ১২ নম্বর রুমে — তারপর দ্রুত পায়ে ২৭ নম্বর বেডের সামনে আসতেই চমকে ওঠেন — সাদা চাদরে আবৃত হরিপদর দেহ ! ডাক্তারের হাত থেকে পান্ডুলিপির খাতা দু’টো পড়ে যায় মেঝেতে। ফ্যানের হাওয়ায় ফড়-ফড় করে উড়তে থাকে খাতার পাতাগুলো।
একজন ডাক্তার হওয়া সত্বেও ডাঃ কুশল ঘোষ-এর গলার কাছে একটা কষ্টের দলা উঠে এসে আটকে থাকে যেন ! হরিপদ কবি হতে চেয়েছিল ; কিন্তু এখন শুয়ে আছে ২৭ নম্বর বেডে একটা লাশ হয়ে ! কিন্তু না , হরিপদর জীবন-যন্ত্রণা ছেঁচে আনা মুক্তোগুলো তো মিথ্যা নয়, মিথ্যা হতে পারেনা ! হরিপদ বাঁচবে ….. হরিপদ বেঁচে থাকবে তার কাব্যগ্রন্থে …. বেঁচে থাকবে তার সৃষ্টির মধ্যে ! এবার তাই ডাক্তার কুশল নন, কবি কুশল ঘোষ পরম মমতায় পান্ডুলিপির খাতা দু’টো তুলে নেন মেঝে থেকে, তারপর আস্তে আস্তে নিয়ে আসেন বুকের কাছে, আর মনে মনে উচ্চারণ করেন —“একদিন হরিপদর এই কবিতার স্থান হবে মানুষের বুকে, মানুষের হৃদয়ে !”