গুরু পূর্ণিমাতে গুরু প্রণাম

0
1285
ছবি : আধ্যা পাল

আজ গুরু পূর্ণিমা। প্রতি বছর এই একটি বিশেষ দিন, যে দিনটি আমরা আমাদের গুরুকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন এর জন্য উৎসর্গকৃত করেছি। শ্রদ্ধা তো সর্বকালের সকল গুরুর জন্য, তবু এই দিনটি বিশেষ।

সর্বযুগে গুরু, শিষ্যদের জীবনে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিরাজমান। মহাভারত এবং অন্যান্য পবিত্র গ্রন্থগুলিতে গুরু এবং শিষ্যের (গুরু-শিষ্য পরম্পরা), বা গুরুর প্রতি একজন শিষ্যের ভক্তির বিশেষ বন্ধন বর্ণনা করে অনেক কাহিনী রয়েছে।এই গুরু পূর্ণিমা হিন্দু সংস্কৃতিতে আধ্যাত্মিক-সংস্কৃতিক-শিক্ষা সম্বন্ধীয় সকল গুরুদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এর একটি ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে সেই অনন্তকাল থেকে।’গুরু‘ শব্দের অর্থ সংস্কৃত ভাষায় যে ভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে তা অনেকটা এরকম, যেখানে ‘গু’ র অর্থ অন্ধকার এবং ‘রু’ র অন্ধকার অপসারণ করা। অতএব, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলো দিয়ে আমাদের জীবনকে আলোকিত করে জীবন থেকে অন্ধকার দূর করতে যারা আমাদের বিশেষভাবে সাহায্য করেন তাঁরাই গুরু।

গুরু পূর্ণিমা বুদ্ধ পূর্ণিমা হিসাবেও পরিচিত, যা ভগবান বুদ্ধের শিষ্যরা উদযাপন করেছিলেন; আবার ব্যাস পূর্ণিমা হিসাবেও পরিচিত যেখানে, মহাভারতের রচয়িতা এবং ভারতীয় দর্শনের অন্যতম সেরা গুরু, বেদ ব্যাসের এর জন্মদিন হিসাবেও পালন করা হয় ; এছাড়া জৈনদের কাছেও এই দিনের বিশেষ তাৎপৰ্য রয়েছে কারণ মহাবীর, তাঁর প্রথম শিষ্য – গৌতম স্বামীকে এইদিন বেছে নিয়েছিলেন।তাই আমাদের দেশে হিন্দু, জৈন এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন।

এতো হলো কি গুরু পূর্ণিমা আর কেন, তার ইতিহাস বা সামান্য কিছু তথ্য।তবে আমার মতে কেউ এই ইতিহাস না জেনেও গুরু কি তা অনায়াসে বলে দিতে পারেন কারণ সবার জীবনের সাথে এই ‘গুরু’ শব্দের খুব বেশিভাবে প্রভাব জড়িয়ে বা ছড়িয়ে আছে। একটি জনপ্রিয় সংস্কৃত বাক্যাংশ এ বলা হয়েছে শিষ্যের জীবনে ‘গুরু পিতাহ গুরু দাইভম‘ আর এখানে গুরু কথাটির ওপর বিশেষ করে জোর দেওয়া হয়েছে, এবং বলা হয়েছে গুরুর সঠিক স্থান কোনটি ,হ্যাঁ, এই সংস্কৃত বাক্য অনুযায়ী জীবনে প্রথমে আসেন মা, পরে পিতা, তারপর গুরু এবং শেষে ভগবান।

‘গুরু ব্রহ্মা গুরু বিষ্ণু
গুরু দেব মহেশ্বর .
গুরু সাক্ষাত পর্ ব্রহ্মা
তাস্মাই শ্রী গুরুরেব নমঃ ..’

মন্ত্রটির সাথে আলাপ অনেক ছোট বয়েসে, যখন মা-বাবা আমাকে আমাদের কুলগুরুর দীক্ষা দেন। তারপর থেকে অজস্রবার এই মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছে দিনে রাতে দুবেলা, সকাল-বিকেল প্রার্থনার সময়। কুলগুরুর এই মন্ত্র যেদিন জপ করতে জানতাম না , তখনও আমার যিনি গুরু ছিলেন, আজও তিনি একক এবং অনন্য। হ্যাঁ, আমার গুরুর প্রথম ও তৃতীয় স্থানে একজনই বর্তমান, আমার মা
আমার জীবনের সর্বোত্তম গুরু ‘আমার মা’। সে সবার মা, সেই অর্থে সকল সন্তানের প্রাথমিক গুরু। প্রথম নিজের পা এ কিভাবে হাঁটতে হবে থেকে প্রথম কথা বলা, খেতে শেখা, সবই তো সবার মা শেখান ( হ্যাঁ সর্বক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম আছে, আমি সেই ব্যাতিক্রমকে উপেক্ষা করলাম)।
অতি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম আমার।বি. এ অনার্স পাশ করে, চাকরি ছেড়ে, বিয়ে করে এসেছিলেন আমার মা এই পরিবারে, এমন একটি পরিবার যেখানে সেভাবে পড়াশোনার মূল্য তখন কেউ বোঝেনি, যদিও পরবর্তী সময়ে আমার ছোটকাকা, আমার মেজো কাকা খুব ভালো পড়াশোনায় ছিলেন।একান্নবর্তী পরিবারে বাবা সরকারি চাকরি করলেও একমাত্র রোজগারের মাথা। তাই ক্লাসে প্রথম-দ্বিতীয হয়েও আমি স্কুলের একটিও নতুন ইউনিফর্ম পাইনি কোনোদিন, অন্য উপহারের কথা তো অনেক দূরের কথা।

কেন মা আমার গুরু !!! সেভাবে বলতে গেলে, জীবনে বেঁচে থাকতে গেলে যা যা শিক্ষণীয়, তা মা আমাকে শিখিয়েছেন।আধুনিক ভাষায় যাকে আমরা ‘ম্যানেজমেন্ট বলে থাকি, তা অনেক ছোট বয়েসে মার কাছ থেকে শেখা !! অতি অভাবে মা শিখিয়েছেন কি ভাবে ৪ জনের খাবার ১০ জনের মধ্যে ভাগ করে সবাইকে খুশি করা যায়, এক সবজি দিয়ে কি কি ভিন্ন পদ রান্না করা যায় ইত্যাদি। এক কাপড়ে বহুদিন কাটিয়ে এক একটা পয়সা জমিয়ে আমাদের নতুন জামা কিনে দেওয়ার একমাত্র চেষ্টা শুধু মা এর ছিল। মমতা একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, যা দেখা যায় না, অনুভব হয়, অন্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলির মতো তাই না, কিন্তু আমার মা সাক্ষাৎ ‘মমতা‘ , তাকে ছুঁয়ে দেখা যায়। খাবার কম পড়লে মা এর মুখে সিনেমার মতো একটি সংলাপ ‘আমার আজ একদম খিদে নেই‘ প্রায় শুনতাম, অনেক পরে তার মর্মার্থ বুঝেছিলাম।

‘দারিদ্র কখনো শিক্ষাকে স্পর্শ করতে পারে না, যদি নিষ্ঠা থাকে চেষ্টা থাকে’ – মা শিখিয়েছিলেন। প্রতিদিন সন্ধ্যেতে রুটি করতে করতে মা তার অতীতকে বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিতেন, আগামীতে আমার কি ভুল না করা উচিত।

প্রত্যাখ্যান আসতো বারংবার, হ্যাঁ একই পড়া যতক্ষণ না নিখুঁত ভাবে বলা হয়ে উঠতো, কখনো কখনো প্রত্যাখ্যান এর শেষ সীমাতে উনুনে পৌঁছে যেত বই। সেই অর্থে পরিপূর্ণতা বা উৎকৃষ্টতা, মা এর থেকে শেখা; সাথে উনুনের লাল দগদগে  আগুনের মতো রাগটাও মা এর অনিচ্ছাকৃত উপহার।

মা এর একটি বড় ছেলে থাকা সত্বেও মা আমাকে ছোট ছেলের মতো মানুষ করেছিলেন, মেয়ের মতো নয় (তথাকথিত মেয়ের সংজ্ঞা যা আমাদের সমাজ জোর করে চাপিয়ে দিয়েছে সেটা নয় আর কি)। পশ্চিমবঙ্গের এক প্রত্যন্ত অচ পাড়া গাঁ তে জন্মেও সেই সময় আমার মা আমাকে ছোট প্যান্ট থেকে শার্ট প্যান্ট পড়াতে দ্বিধা করেননি কোনোদিন। মা আমাকে ‘মানুষে’র সংজ্ঞা শিখিয়েছেন ‘মেয়ে’ হবার তথাকথিত ব্যাকরণ শেখানোর প্রয়োজন মনে করেননি।

শিখেয়েছেন কিভাবে মন দিয়ে মনে প্রাণে মানুষকে ভালোবাসতে হয় বিশ্বাস করতে হয়, তবে ঠকে গেলে কি প্রচন্ড কষ্ট হয় সেটা মা জেনে শুনে শেখাননি, মা এর কথায় বিশ্বাস করে ঠকে যাওয়া ঢের ভালো।
মা আমাকে ‘ভগবান‘ কে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছেন, আবার যারা বিশ্বাস করেননা তার অবিশ্বাসে প্রশ্ন করতে শেখাননি। কষ্ট হলে হাউ হাউ করে কাঁদতে শিখিয়েছেন মা।

অঙ্ক-বিজ্ঞানের স্বল্প জ্ঞান নিয়েও মা-ই সেই ব্যক্তি যিনি শিখিয়েছিলেন সাহিত্য হোক বা বিজ্ঞান কিংবা সেলাই, প্রতি বিষয়ে কিভাবে শতভাগ কেড়ে নিতে হয়, অধ্যাবসায় কাকে বলে তা তো মা জীবন দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন।

চেষ্টা একটি চাবিকাঠি ,নিঃস্ব থেকে সর্বস্ব পাওয়ার ক্ষমতা একমাত্র এই চাবিকাঠির কাছেই আছে। মা নিজের হাতে খুব যত্নে ছাপ রেখেছেন সেই চাবিতে। ধৈর্য্য আর কম কথা বলা,আমার মা এর অন্যতম অস্ত্র। এই দুই বৈশিষ্ট্য কিছুভাবে তিনি আমাকে দিতে পারেননি। চেষ্টা যে করেননি তা নয়, আজও করে চলেছেন অবিরত।

প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত আজও যিনি ছোটবেলার মতো শাসনে, অনুশাসনে আমাকে ধরে বেঁধে রেখেছেন, তিনি আমার মা,যার একজোড়া পা এ লুটিয়ে পড়তে আমার ভাবতে সময় লাগে না, মনে হয় জীবনের সব ভুলের ক্ষমা বোধহয় ওই চরণ দুটিতে মিলবে।
যে মানুষ পরিচালনা-নিষ্ঠা-প্রচেষ্টা-বিশ্বাস-শিক্ষা র অর্থ শেখালো, প্রয়োগ শেখালো, মানুষ কাকে বলে বুঝতে শেখালো, নিজের জীবনকে চোখের সামনে একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ করে বুঝতে শেখালো কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, তিনিই আমার প্রিয়, আমার সর্বশ্রেষ্ঠ গুরু, যার জন্য এক পৃথিবী মানুষের বিরুদ্ধে আমি দাঁড়িয়ে পড়ার সাহস রাখি, যার স্বাস্থ্য অবনতিতে আমি সহজে অভিমান করি ভগবানের ওপর, যিনি আমার কাছে ভগবানের ও ওপরে, সেই ‘মা’ কে আমার প্রণাম। এই গুরু পূর্ণিমার পবিত্র দিনে তার চরণে আমার শতকোটি গুরু প্রণাম।

মা ছাড়াও আরো কিছু মানুষ যারা সত্য অর্থে আমার গুরুর ভূমিকা পালন করেছেন, তাদের মধ্যে , শিশুশ্রেণীতে বাড়িতে এসে পড়ানোর দিদিমনি গীতাদি , যিনি ওই ছোট্ট বয়েসে আমার মতো এক বদ মেয়েকে শিখিয়েছিলেন প্রথম হওয়ার অর্থ ও আনন্দ। এরপর আমার রসায়ন শিক্ষক স্বর্গীয় শ্রী মানিকবাবু এবং অঙ্ক এর শিক্ষক অশোকবাবু, যাদের বিষয় সম্পর্কিত নিখুঁত কৌশল আমাকে এই দুই বিষয়কে হাতের মুঠোতে আনতে শিখিয়েছিলো।বিষয়কে ভয় না পেয়ে ভালোবাসতে শিখিয়েছিলো। এই তিনজন মানুষ আমার জীবনের এক একটি ধাপে এক একটি স্তভ, যতদিন বেঁচে থাকবো, এঁনাদের দান ভোলার নয়।

এই লেখার সাথে আমার ৭ বছরের মেয়ের (আধ্যার) আঁকা ছবি দিলাম যা সে তার ওড়িশি নাচের গুরু মা এর জন্য এঁকেছে।মেয়ে তার মা ও নাচের গুরু মার জন্যও এই প্রথম কার্ড বানিয়ে কিছু প্রিয় কথা লিখেছে। সে এই প্রথম সড়গড় হলো গুরু শব্দের সাথে, তবে জীবনে তার ‘গুরু’ কে বা কারা হবেন, তা হয়তো সে একদিন এভাবেই প্রকাশ করবে। তবু তার তালিকায়, প্রকৃত গুরু হিসাবে নিজের নাম দেখার আশায় থাকলাম।

 

কলমে মৌসুমী কুন্ডু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here