গোয়েন্দার হাতেখড়ি

0
953

জীবন সত্যি রোমাঞ্চকর! আমি ভাগ্যবান, জীবনে এরকম অনেক অনুভূতির সাক্ষী হতে পেরে। কারণ, আমি পেয়েছি সমুদাকে। হ্যাঁ, সমুদা আমার কাকা হলেও, তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক দাদার মতো। ছোটোবেলা থেকেই সে আমার সঙ্গে একজন বড়ো দাদার মতো মিশেছে। আমাকে একবারও বুঝতে দেয়নি যে সে আমার দাদা নয়, আমার কাকা। ফলে, আমার নিজের দাদা না থাকার আক্ষেপটা সমুদা একশো ভাগই মিটিয়ে দিয়েছে। সমুদার পরিচয়, সে হলো গোয়েন্দা সমরেশ দত্ত। তবে এখানে বলে রাখা ভালো, তার উচ্চতা ছয় ফুট হলেও সমুদা কিন্তু আমাদের বইয়ে পড়া আর পাঁচটা গোয়েন্দা চরিত্রর মতো একেবারেই নয়। তার ছোটোবেলা থেকেই খেলাধূলার উপর একটা ঝোঁক রয়েছে। ফলে বলতে দ্বিধা নেই যে তার শরীরের গঠন অনেকটাই ক্রীড়াবিদের মতো। প্রথমদিকে সমুদার এই গোয়েন্দাগিরি ছিল নিছকই শখের, কিন্তু পরবর্তী সময় সেই গোয়েন্দাগিরিই হয়ে উঠল তার পেশা।

সমুদার সম্বন্ধে আরও বলতে গেলে বলতেই হবে তার রয়েছে নানা বিষয়ে প্রচুর জ্ঞান। অনেক ধৈর্য, দারুণ অবজারভেশন ক্ষমতা। অচেনা ব্যক্তিকে একবার সে দেখেই খুব সহজে তার সম্বন্ধে অনেক কিছু বলে দিতে পারত। সমুদার কাছে সেই অর্থে কোনওদিনই পিস্তল জাতীয় কোনও অস্ত্র ছিল না। তার সবচেয়ে বড়ো সম্পদ অর্থাৎ সমুদার কথায় ‘মগজাস্ত্র’ই হল প্রধান অস্ত্র।

ছোটবেলা থেকেই সে ছিল গোয়েন্দা-গল্পের পোকা। আজও সমুদা সময় পেলে বসে পড়ে Edgar Allan Poe-র C. Auguste Dupin-এর গল্প অথবা স্কটিশ লেখক Sir Arthur Conan Doyle-এর লেখা Sherlock Holmes-এর গল্প নিয়ে। বইয়ে পড়া সব নির্মিত গোয়েন্দা-চরিত্রগুলির মধ্যে Sherlock Holmesই হলেন সমুদার কাছে তার আদর্শ চরিত্র।

সময়ের সঙ্গে কবে যে সে এক নামী গোয়েন্দা হয়ে উঠল তা বাড়ির কেউই টের পেল না। সেই বারো ক্লাস থেকে সমুদার সঙ্গে আমার এই অদ্ভুত দুনিয়ায় পথ চলা শুরু। কিন্তু আজও আমি ভুলিনি তার প্রথম তদন্তের কথা। সমুদার বয়স তখন সবে আটাশ পেরিয়েছে আর আমার সতেরো। সেবার বাবা ঠিক করল, আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের জেলা মুর্শিদাবাদ দেখাবেন। আমাদের বাড়ির প্রচলিত নিয়ম ভেঙে তাই বেরিয়ে পড়লাম ১০৭/সি, হরি ঘোষ স্ট্রিট, কলকাতা থেকে আমরা। অর্থাৎ, আমি, সঙ্গে বাবা আর অবশ্যই আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ সমুদা।

ট্রেন ছিল বিকেল পৌনে পাঁচটায়। কিন্তু বাবা দেরি করায় আমরা স্টেশনে এসে পৌঁছালাম ঠিক দশ মিনিট আগে। সমুদা আর আমি ট্রেনে উঠেই সিটে বসে পড়লাম। তবে বাবা চললেন নতুন বন্ধু খুঁজতে। মিঃ বক্সীর সঙ্গে বাবার আলাপ হল। উনি বাড়ি ফিরছিলেন বহরমপুরে। কলকাতার ধর্মতলা চত্বরে ওঁর দোকান রয়েছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে উনি আমাদের কাছে খুবই চেনা একজন হয়ে উঠলেন আর এর মাঝেই ট্রেন চলতে লাগল। শুরু হল আমাদের নতুন যাত্রা, গন্তব্য স্থান মুর্শিদাবাদ।

মুর্শিদাবাদ হল আমাদের পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা যা জুড়ে রয়েছে শুধুই ইতিহাস আর ইতিহাস। মুর্শিদাবাদ নামটা শুনলেই মনে পড়ে যায় সেই পলাশীর যুদ্ধের কথা। মুর্শিদাবাদ মানেই হল নবাবিয়ানা। বহরমপুর স্টেশন পৌঁছোতে আমাদের রাত ন’টা বেজে গেল। বক্সীকাকু স্টেশন থেকেই চলে গেলেন ওঁর নিজের বাড়ি এবং কথা দিয়ে গেলেন আগামীকাল সকালে উনি গেস্ট হাউসে এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করবেন। আমরাও তারপর স্টেশন থেকে একটা ট্যাক্সি করে শিবুদাদুর গেস্ট হাউসে এসে পৌঁছলাম।

দূর থেকে সেই গেস্ট হাউসটা দেখে মনে হচ্ছিল, এ যেন এক জমিদারের পুরোনো বাংলো। কিন্তু পরে বুঝলাম, এটা কোনও জমিদারের বাংলো নয়, এটাই মুর্শিদাবাদের ঐতিহ্য। আমরা রাতের খাওয়া সেরে শুয়ে পড়লাম, কিন্তু সমুদা ঘুমোল না। সে চলল বাংলোর চারদিকটা একটু ঘুরে দেখতে। পরদিন সকালে উঠে জানতে পারলাম যে সেদিন আমরা যাব হাজারদুয়ারি প্যালেস দেখতে।

এদিকে বক্সীকাকুও ওঁর কথামতো গেস্ট হাউসে এসে হাজির হলেন এবং বাবার সঙ্গে উনি উঠে গেলেন ওঁরই আনা গাড়িতে। তবে আমি আর সমুদা একটা আলাদা অনুভূতির স্বাদ পেতে গেলাম টাঙ্গা গাড়িতে। ঘোরার দ্বারা চালিত সেই টাঙ্গা গাড়ির ঝাঁকুনি খেতে খেতে যেতে বেশ মজাই লাগছিল। ওই অল্প সময়ের মধ্যে আমরা ইতিহাস নিয়ে চর্চা শুরু করে দিলাম। সমুদা আমায় বলল, “জানিস বঙ্কু, এই জেলায় এখনও এমন অনেক ইতিহাসই রয়েছে যা মানুষের কাছে আজও অজানা।”

আমি বললাম, “তা সেই ইতিহাস তো নবাব সিরাজের আমলের।”

সমুদা মাথা নেড়ে বলল, “না রে, মুর্শিদাবাদের ইতিহাস যে শুধু ওঁকে ঘিরেই রয়েছে সেটা বললে ভুল হবে। এখানকার ইতিহাসকে দু’ভাগে দেখলে, প্রথমটা বলা যায় পলাশী যুদ্ধের আগে আর দ্বিতীয়টা পলাশী যুদ্ধের পর।”

আমি ঘোড়া ছোটার সেই শব্দকে উপেক্ষা করে সমুদার কথা মন দিয়ে শুনতে লাগলাম। সে আরও বলল, “যেমন ধর, এই হাজারদুয়ারি প্যালেস। এটা কিন্তু অনেক পরেই তৈরি হয়েছে। নবাব নাজিম হুমায়ুন খাঁ-র আমলে এটি তৈরি করেছিলেন Bengal Engineers Corporation-এর এক ইংরেজ আর্কিটেক্ট, যার নাম Colonel Duncan McLeod । এই হাজারদুয়ারি নামটা হয়েছে এই প্যালেসের আসল নকল মিলিয়ে মোট একহাজারটি দরজা রয়েছে বলে। এই প্যালেসের পুরোটাই ইতালিয়ান ও গ্রিক কারুকার্যে ভরা।”

ইতিহাসের কথা শুনতে শুনতে এসে হাজির হলাম সেই বিশাল আকারের প্যালেসটির সামনে। আমরা টাঙ্গা থেকে নামতেই দেখি, বাবা আর বক্সীকাকু সেখানে অনেক আগেই পৌঁছে গেছেন। কিন্তু ওঁদের সঙ্গে আরও একজন ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত রয়েছেন। সামনে যেতেই বাবা আমাদের সঙ্গে ওঁর আলাপ করিয়ে দিলেন এবং জানতে পারলাম ওঁর নাম বিভু মিত্র। কিন্তু কে এই বিভু মিত্র? উনি হলেন বহরমপুরের এক বিশিষ্ট স্বনামধন্য ব্যক্তি। ওঁর নামটা আমার যেমনই অদ্ভুত লাগল ঠিক তেমনই লাগল ওঁকে দেখতে। সমুদাকে দেখলাম, সেও মিঃ মিত্রকে বেশ ভালোভাবেই লক্ষ করছিল। ওঁর বিবরণ দিতে গেলে সবার আগে বলতে হবে ওঁর পাকানো গোঁফের কথা। মাথায় অল্প চুল, প্রায় নেই বললেই চলে। চোখে ছিল কালো মোটা ফ্রেমের একটা চশমা, পরনে ছিল সাদা কুচি দেওয়া ধুতি ও নীলচে রঙের পাঞ্জাবি যার মধ্যে রয়েছে কেমন সাদা রঙের ডিজাইন আর ওঁর হাতে ছিল বহুদিনের পুরনো একটা লাঠি।

মিঃ মিত্রর সঙ্গে আলাপ করতেই উনি আমাদের হাতে একটা করে মিষ্টি তুলে দিলেন। পথে আসতে আসতে আমার একটু খিদেই পেয়েছিল, সুতরাং আমি আর কিছু না ভেবেই টুপ করে মিষ্টিটা খেয়ে ফেললাম। কিন্তু সমুদা? সে ওই মিষ্টি খেলেও তার মাথায় তখন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল ওই সামান্য মিষ্টিকে কেন্দ্র করে।

হাজারদুয়ারিতে ঢুকতেই বক্সীকাকু একজন গাইড ঠিক করলেন আর সেই গাইড আমাদের বোঝাতে লাগল এই হাজারদুয়ারির বিভিন্ন ইতিহাসের কথা। তার থেকেই জানতে পারলাম, এই প্যালেসের নাম আগে ‘বড়কুঠ’ ছিল। ১৯৮৫ সালে এই প্যালেসের দায়িত্ব নেয় Archaeological Survey Of India। হাজারদুয়ারি প্যালেসটা ঠিক ভাগীরথী নদীর ধারে।

আমরা ওই গাইডের কথা এতটাই মন দিয়ে শুনছিলাম যে সমুদার ব্যাপারে কোনও টের পাইনি। আমরা ফেরার পথে দেখি, সমুদা ভাগীরথীর ধারে বসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমি তো দৌড়ে গিয়ে তাকে নতুন সব অজানা কথা জানাতে চাইলাম, কিন্তু সমুদা ওই বিষয়কে কোনও পাত্তাই দিল না। সে তখন কী নিয়ে যেন চিন্তামগ্ন। সমুদাকে পরে এই বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি।

আমরা সেখানকার বেশ কিছু ছবি তুললাম, যার মধ্যে অবশ্যই রয়েছে সেই বিখ্যাত ‘বাচ্চাওয়ালী তোপ’। হাজারদুয়ারি দেখার পর আমরা ইমামবাড়া, ঘড়িঘর ও মদিনা মসজিদ দেখে চললাম বক্সীকাকুর বাড়ি দুপুরের খাওয়ার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। কিন্তু মিঃ মিত্র আমাদের সঙ্গে গেলেন না। ওঁর শরীর ঠিক লাগছিল না বলে উনি ফিরে গেলেন নিজের বাড়ি।

বক্সীকাকুর বাড়ি বহরমপুরে হলেও ওঁর আদি বাড়ি ছিল ঐতিহাসিক পলাশীতে, যেখানে রবার্ট ক্লাইভ বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হারিয়ে বাংলায় ইংরেজ শাসন এনেছিলেন। বক্সীকাকুর বহরমপুরের বাড়িটা বিশাল বড়ো। সে যেন এক প্রাসাদের সমান। সামনে পুকুর, পিছনে বাগান। দু’জন চৌকিদার, একজন মালী এবং দু’জন চাকর। সবকিছুতেই যেন সেখানে ঐতিহ্যের ছোঁয়া। আমরা ওঁর বাড়িতে ঢুকতেই দেখি চারদিক নিস্তদ্ধ, ওঁর ছেলে ও বউমা দু’জনেরই চোখে জল। আমরা জানতে চাওয়ায় তারা আমাদের জানাল যে বক্সীকাকুর প্রপিতামহর বহুদিনের পুরোনো এক ছবি সকাল থেকেই নিখোঁজ। বক্সীকাকু সেই কথা শুনে খুব ভেঙে পড়লেন। সেই ছবি ছিল তাদের বাড়ির ঐতিহ্য এবং বংশের গর্ব। সেই ছবি ছিল বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁর।

হ্যাঁ! নাবাব সিরাজউদ্দৌলার মাতামহর ছবি, যেটি পেয়েছিলেন বক্সীকাকুর প্রপিতামহ। কিন্তু কথা হল, এত বড়ো বাড়ি আর সাত-আটজন লোক বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও কীভাবে ওই বহুমূল্য ছবি সকলের মধ্যে থেকে গেল হারিয়ে? আর এই রোমাঞ্চকর পরিস্থিতিতেই শুরু হল সমুদার মগজাস্ত্রের খেল। সে পুরো ঘটনাটা শুনেই ছুটল ছবি রাখার জায়গাটা দেখতে। বাড়ির দোতলার দক্ষিণদিকের একটা ঘরে রাখা থাকত সেই ছবি। বক্সীকাকুর থেকে জানতে পারলাম, এই ছবি দেখতে বহু ব্যক্তির সমাগম হয় বৈশাখ মাসের অক্ষয় তৃতীয়ার দিন। কারণ, সেই দিন হল বক্সীকাকু ও ওঁর প্রপিতামহর জন্মের দিন।

সব শুনে সমুদার মাথায় এল প্রশ্ন এবং সে ওই প্রশ্ন করতেই বক্সীকাকু কেমন যেন ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে চাইলেন। সেই প্রশ্ন ছিল, “আচ্ছা মিঃ বক্সী, আপনার প্রপিতামহ ঠিক কবে মারা গেছিলেন? মারা যাওয়ার সময় ওঁর বয়সই বা কত হয়েছিল?”

রহস্য আরও দানা বাঁধে যখন মনে প্রশ্ন জাগে যে চোর রাতে চুরি না করে কেন সকালেই এই কাজ করল।

তারপর দুপুরের খাওয়া সারতে আমরা নিচের ঘরে নেমে এলাম। বক্সীকাকুর ছেলে অরুণবাবু ও তার স্ত্রীর আপ্যায়নে আমরা তিনজন বড়োই আপ্লুত হলাম। কিন্তু বক্সীকাকুকে দেখে খুব খারাপ লাগছিল। উনি সত্যিই খুব ভেঙে পড়েছিলেন। আর পড়বেন নাই বা কেন? যখন অমন একটা ঐতিহাসিক জিনিস চুরি যায় তখন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ারই তো কথা।

খেতে খেতেই বাবার মুখে সমুদার বুদ্ধির প্রশংসা শুনে বক্সীকাকু সমুদার কাছে একটা আবদার করে বসলেন। অর্থাৎ, ওঁর এই চুরি হয়ে যাওয়া ছবিটির তদন্তের ভার সমুদাকেই নিতে হবে এবং এর জন্য উনি সমুদাকে সঠিক পারিশ্রমিক দেবেন বলেও ঠিক করলেন।

সমুদা এক কথাতেই রাজি। আর কেনই বা হবে না? যখন ঘুরতে এসে কোনও রোমাঞ্চকর ঘটনা স্বয়ং নিজেই হাজির হয় বাড়ির দোরগোড়ায় আর সে যদি হয় সমুদার মতো একজন, যে এমনই রোমাঞ্চকর পরিস্থিতির জন্য সর্বদা অপেক্ষায় থাকে। সমুদা বক্সীকাকুকে কথা দিল যে সে এই তদন্তের ভার গ্রহণ করল এবং সেই আশ্বাস দিয়ে আমরা ফিরে এলাম গেস্ট হাউসে।

পরদিন সকালে আমাদের যাওয়ার কথা ছিল আরও অনেক জায়গায়। যেমন, মোতিঝিল, কাশিমবাজার রাজবাড়ি ইত্যাদি। কিন্তু সমুদা ঠিক করল, সেদিন আমরা যাব খোশবাগ দেখতে। কবরস্থান! কথাটা শুনেই কেমন গা ভারী হয়ে গেল আমার। বাবা বক্সীকাকুর দুঃখ কিছুটা ভাগ করে নিতে ওঁর বাড়ি গেলেন। সেদিন তাই আমি আর সমুদা দু’জন মিলে ওই কবরস্থানের উদ্দেশে রওনা দিলাম। রাস্তায় যেতে যেতে বুঝতে পারলাম, এটা সমুদারই একটা প্ল্যান। কারণ, সেই কবরস্থান হল তার এই তদন্তের প্রথম ধাপ। সেখানে রয়েছে মৃত বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁ ও সিরাজউদ্দৌলার সমাধি। আমরা নৌকা করে ভাগীরথী নদী পেরিয়ে যখন খোশবাগ পৌঁছালাম তখন প্রায় এগারোটা বেজে গেছে। আমরা পৌঁছেই প্রথমে গেলাম আলিবর্দি খাঁর সমাধি দেখতে।

সেই সমাধি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সেটি বেশ পুরোনো। সেখানকার কিছু লেখা দেখে বুঝলাম, নবাব মারা গেছিলেন ১০ এপ্রিল, ১৭৫৬ সালে। মৃত্যুর সময় ওঁর বয়স হয়েছিল চুরাশি, যা দেখে সমুদার মাথায় এল অনেক প্রশ্ন। আমরা ফেরার পথে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সমাধিও দেখলাম বটে। তবে বলা যেতে পারে সমুদার এখানে আসার মূল উদ্দেশ্য একমাত্র নবাব আলিবর্দি খাঁর সমাধি। আমরা তারপর সেই ঐতিহাসিক স্থান থেকে বেরিয়ে আর গেস্ট হাউসে ফিরলাম না। সেখান থেকেই সোজা গিয়ে হাজির হলাম বক্সীকাকুর বাড়ি।

ওঁর বাড়ি ঢুকতেই দেখি বাবা আর বক্সীকাকুর সঙ্গে মিঃ মিত্রও সেখানে বসে রয়েছেন। বাবা আর বক্সীকাকু আমার থেকে তখন সেদিনের অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলেন। কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই সমুদা বক্সীকাকুকে প্রশ্ন করল, “মিঃ বক্সী, আপনার প্রপিতামহ এই ছবিটা কি সত্যিই পেয়েছিলেন? ঠিক কত সালে উনি মারা যান বলতে পারবেন? ইতিহাস বলে আলিবর্দি খাঁ কিন্তু মারা গেছিলেন চুরাশি বছর বয়সে আর সেটা ঠিক পলাশী যুদ্ধের একবছর আগে।”

সমুদার কথা শেষ হওয়ার আগেই বক্সীকাকু ঘাড় নাড়তে নাড়তে বললেন, “সত্যি ভাই সমরেশ, তোমার প্রশংসা না করে থাকতে পারছি না। তুমি ঠিক ধরেছ। আসলে কাল আমি ছবি হারানোর শোকে কী বলতে কী বলেছি সেটা ধরে বসো না।”

তারপর উনি আমাদের সবটা খুলে বললেন। ওঁর কথায়, মিঃ জেকবস উইজে নামক এক ইংরেজ সৈনিক ওই ছবিটি পেয়েছিলেন। উনি পলাশী যুদ্ধের সময় রবার্ট ক্লাইভের সৈন্যদের মধ্যে একজন ছিলেন। যুদ্ধের পর মীরজাফরের আদেশে প্রাসাদের বহু জিনিস ফেলে দেওয়া হয় আর সেই সকল জিনিসের মধ্যে এই ছবি হল অন্যতম। মিঃ জেকবস সেই ছবি খুঁজে পান এবং যুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে সেটি নিজের কাছেই রেখে দেন। কিন্তু কীভাবে সেই ছবি বক্সীকাকুর প্রপিতামহর হাতে এল? সেটাই বড়ো প্রশ্ন। বক্সীকাকু আরও জানালেন, “মিঃ জেকবস যুদ্ধের পর East India Company থেকে অবসর নেন এবং তারপর উনি এখানেই পাকাপাকিভাবে থেকে যান। আমার প্রপিতামহ ছিলেন ওঁরই বাড়ির এক সাধারণ কর্মী। উনি ভালো ছবি আঁকতে পারতেন বলেই মিঃ জেকবস ওঁকে দিয়ে নানা সময় বিভিন্ন ছবি আঁকাতেন এবং একদিন ওঁর আঁকা এক ছবি দেখে উনি মুগ্ধ হয়ে নবাবের সেই ঐতিহাসিক ছবি তুলে দেন ওঁর হাতে। ব্যস, সেই থেকেই ওই ছবি হয়ে ওঠে আমাদের পরিবারের ঐতিহ্য এবং গর্ব।”

সব শুনে মনে হল, বক্সীকাকুদের পরিবার সত্যি ঐতিহ্যশালী এবং এমন এক পরিবারের সম্মুখীন হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে হল। কিন্তু সমুদা? তাকে দেখে মনে হল, রহস্য যেন তখনও রয়ে গেছে ওই ঘরে।

এবার আসা যাক মিঃ মিত্রর কথায়। উনি আজ আমাদের যেন কেমন এড়িয়ে চলছেন। কোথাও যেন ওঁকে আগের দিনের সঙ্গে একদমই মেলাতে পারছিলাম না। মিঃ মিত্রর সম্বন্ধে জানতে চাওয়ায় বক্সীকাকু বললেন, “ওঁর সঙ্গে আমার আলাপ বহুদিনের। আমাদের প্রথম দেখা হয় এক প্রদর্শনীতে যেখানে প্রধান অতিথি হয়ে গেছিলেন মিঃ মিত্র।”

সেই শুনে সমুদা মিঃ মিত্রকে বলল, “তার মানে আপনার আর্ট অ্যান্ড পেইন্টিং সম্বন্ধে বেশ ভালোই দখল আছে দেখছি।”

শুনেই মিঃ মিত্র বলে উঠলেন, “হ্যাঁ, না মানে, ওই সামান্য আর কী।”

এই লোকটিকে সমুদার বেশ ইন্টারেস্টিং লাগল।

সেদিন আমরা রাতে ফিরে এলাম গেস্ট হাউসে। বাবা তো নিজের ঘরে শুয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুম এল না আমাদের চোখে। সমুদা মগ্ন গভীর চিন্তায় আর আমি তখন ভাবছি সেই পলাশী যুদ্ধের কথা, যে যুদ্ধে নির্মমভাবে মরতে হয়েছিল নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে শুধুমাত্র বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের জন্য। আজ এতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু মীরজাফরের মতো কিছু মানুষ এই সমাজে এখনও রয়ে গেছে। ফলে আজও নবাব সিরাজের মতো অনেক মানুষকেই হতে হচ্ছে শিকার এই বিশ্বাসঘাতকতার।

সকাল হতেই সমুদার সঙ্গে আমি বেরিয়ে পড়লাম সরকারি কার্যালয়ের উদ্দেশে। সেখানে পৌঁছে অনেক দৌড়াদৌড়ির পর অবশেষে সমুদা এক কর্মীকে এই তদন্তের স্বার্থে সাহায্য করতে রাজি করাল।

লোকের থেকে কাজ আদায় করতে সমুদা ভীষণ পটু। সেই ব্যক্তি আমাদের সিঁড়ি দিয়ে উপরে নিয়ে গেলেন এবং একটা ঘরে বহু কাগজপত্র খুঁজে তিনি একটা রেজিস্টার এনে সমুদার হাতে তুলে দিলেন। সেই রেজিস্টারের পাতাগুলো বেশ অনেকক্ষণ উলটেপালটে দেখার পর সমুদা এক মৃদু হাসির সঙ্গে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এল ওই সরকারি কার্যালয় থেকে। সমুদার মুখের সেই হাসি বলে দিচ্ছিল যে তার এই কার্যালয়তে আসার সিদ্ধান্ত একেবারেই সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। আমি তাকে সেই বিষয়ে প্রশ্ন করতেই সমুদা বলল, “বুঝলি বঙ্কু, বাস্তবে মিঃ জেকবস উইজে নামে কেউই কোনওদিন ছিল না। কারণ, যদি থাকত তাহলে তার নিশ্চয়ই কোনও প্রমাণ এখানে পাওয়া যেত।”

তারপর সে যেটা বলল তা আমাকে আরও স্তম্ভিত করল।

“রেজিস্টার ঘেঁটে দেখলাম, সেখানে নাম রয়েছে জেকবস স্টারলিং আর দাভিদ উইজে। এঁরা দু’জনেই গোরাবাজারে থাকেন, কিন্তু সরকারি তথ্য অনুযায়ী এই দু’জনের সঙ্গে East India Company-র কোনও যোগাযোগ নেই। East India Company ছিল স্বাধীনতার আগে। সুতরাং স্বাধীনতার পর কোনওভাবেই তাদের ব্যাপারে জানা সম্ভব নয় যদি না তারা কোনও ঐতিহাসিক চরিত্র হন।”

কথাগুলো শুনে আমার বেশ এক্সসাইটিং লাগল। তবে সমুদার মনে তখন এক নতুন সন্দেহ দানা বাঁধল। তার এই ছবি হারানোর পুরো ঘটনাটাই নিছক এক সাজানো পরিকল্পনা বলে মনে হচ্ছে। তবে সমুদা আমার সামনে সেই সন্দেহের কথা প্রকাশ করল না। আমরা দু’জনে দুপুরের খাওয়া সারতে গেলাম এক রেস্তোরাঁয় আর ওখানেই সমুদার এক বন্ধুর সঙ্গে আমাদের দেখা হল।

সে Archaeological Survey Of India-র এক কর্মী, দু’বছর হল তার এখানে বদলি হয়েছে। কথায় কথায় সমুদা তাকে একটা কাজের দায়িত্ব দিল এবং সেটা যে খুবই গোপনীয় তা জানাতে সে ভুলল না। সেই বন্ধু সমুদাকে কথা দিয়ে গেল যে সে ওই কাজ খুব শীঘ্রই শেষ করে সমুদার সঙ্গে দেখা করবে। আমরাও তারপর ফিরে এলাম গেস্ট হাউসে।

রাতে আমি আর সমুদা খাটে শুয়ে। বেশ মনোরম পরিবেশ। কিন্তু হঠাৎ আমাদের ঘরের উত্তরের জানালার কাচ ভেঙে একটা কাগজমোড়া পাথর এসে ঢুকল। আমি তো খুব ভয়ে চমকে উঠেছিলাম, কিন্তু সমুদা ওই কাগজমোড়া পাথরটা হাতে তুলে নিয়ে ভালো করে দেখল এবং সেটা খুলতেই চোখে পড়ল তাতে লেখা রয়েছে – ‘বেশি বাড় বেড়ো না, মৃত্যু হইতে সাবধান’।

সমুদা বুঝতে পারল, কেউ নিশ্চয়ই আমাদের গতিবিধির উপর লক্ষ রাখছে এবং সে যে সঠিক পথেই এগোচ্ছে তা নিয়ে তার কোনও দ্বিধা নেই মনে। ওই কাগজটা সমুদা নিজের কাছেই রেখে দিল এবং পরদিন ভোর হতেই সে গেস্ট হাউসের সেই উত্তরদিকে অনুসন্ধান করতে বেরিয়ে পড়ল।

সমুদা ফিরে এসে আমায় এক আধা জ্বলা সিগারেট দেখিয়ে বলল, “বঙ্কু, ওই জানালার নিচে এই আধা জ্বলা সিগারেটটা পেলাম।” কথা শেষ করেই সে আবারও আমায় ওই সিগারেটের নিচের অংশটা দেখিয়ে বলল, “ওই দেখ, এর ফিল্টারে পানের কিছু ভাগ এখনও লেগে রয়েছে।”

আমি কিছুই তেমন বুঝতে পারছি না দেখে সমুদা বলল, “আমার বিশ্বাস, এই কাজ যে করেছে তার মুখে ওই সময় একই সঙ্গে পান ও সিগারেট দুটোই ছিল। এই কাজ যে বাইরের কোনও লোকই করেছে, তা নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। কারণ, গেস্ট হাউসে যারা রয়েছে তারা কেউই এই দুটো জিনিস ব্যবহার করে না।”

সব শুনে আমি তাকে বললাম, “আমি কি বাবাকে এই ব্যাপারে বলব, সমুদা?”

সমুদা আমায় বারণ করল বাবাকে জানাতে। তার কথা অনুযায়ী, এতে নাকি তার তদন্তের কাজে সমস্যা হতে পারে।

সেদিন বাবার সঙ্গে আমরা আবার বক্সীকাকুর বাড়ি গেলাম। কিন্তু ওঁকে দেখামাত্রই আমার কেমন যেন ওঁর প্রতি রাগ হচ্ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম না কেন বক্সীকাকু আবার আমাদের মিথ্যে বলল, তাও আবার এমন একজন ব্যক্তির নামে যার অস্তিত্ব কোনওদিনই ছিল না। ওঁর ছেলে ও বউমা দু’জনেই আমাদের আগের মতো সেই একইভাবে আপ্যায়ন করল এবং দুপুরে ওখানেই খেয়ে যেতে অনুরোধ করল।

বক্সীকাকুর মুখে শুনলাম, সেদিন নাকি মিঃ মিত্রও এক কাজের স্বার্থে ওঁর বাড়ি আসছেন এবং বলতে না বলতেই এসে হাজির হলেন মিঃ মিত্র। আমি সমুদার কথামতো ওঁকে দেখামাত্রই খুশি হওয়ার মিথ্যে অভিনয় করলাম।

আমরা সবাই একসঙ্গেই দুপুরে খেতে বসলাম এবং খেতে খেতে মিঃ মিত্র ওঁর বাড়ি যাওয়ার জন্য বাবাকে বললেন, “চলুন, আজ বিকেলে আমার বাড়ি সবাই মিলে ঘুরে আসবেন। ঘুরতে এসে আপনাদের এখানে বড়োই সমস্যার মধ্যে ফেলে দিল দেখছি বক্সী।”

আমরা ওঁর আমন্ত্রণে সাড়া দিলাম। কারণ, সমুদার কথায়, ‘When opportunity comes at your feet, you must grab it with your both arms wide open.’

তারপর বিকেলে আমরা সবাই মিলে মিঃ মিত্রর বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম। মিঃ মিত্র বহরমপুরেই থাকেন। ওঁর বাড়ি আর পাঁচটা বাড়ির মতো একদমই নয়। রাস্তায় যেতে যেতে সেই বিষয় উনি আমাদের বললেন, “আমার ছোটো থেকেই পাখির খুব শখ। তাই বাড়ির একটা ঘর ওদের জন্যই ছেড়ে দিয়েছি।”

বাবা ওঁকে জিজ্ঞেস করল, “পাখি মানে, ক’টা পাখি রয়েছে, মিঃ মিত্র?”

উত্তরে উনি বললেন, “বিভিন্ন জাতের অনেক পাখিই রয়েছে সেই ঘরে। তবে তাদের দেখাশোনার জন্য একজন ছেলেও রয়েছে আমার বাড়িতে।”

মিঃ মিত্র আরও জানালেন যে সেই ছেলেটির নাম সোমনাথ এবং সে ছোটোবেলা থেকেই ওখানে রয়েছে।

কথা বলতে বলতে এসে পৌঁছোলাম মিঃ মিত্রর বাড়ি। উনি সোমনাথকে আগেই আমাদের আসার কথা বলে রেখেছিলেন। সুতরাং বাড়িতে ঢোকামাত্রই সে আমাদের জন্য মিষ্টি আর সরবত নিয়ে এসে হাজির। সোমনাথের সঙ্গে আলাপ করে সমুদার যেন তাকে কেমন সন্দেহজনক মনে হল। সোমনাথের ব্যাপারে বলতে গেলে বলতেই হয় তার ছিপছিপে চেহারার কথা। তার গায়ের রঙ বেশ কালো, ঠোঁট ছিল টকটকে লাল। মনে হয় যেন সে সর্বদাই পানে অথবা খৈনিতে ডুবে থাকে আর তার স্বভাব ছিল খুবই বিকট ধরনের। কথায় কথায় জানতে পারলাম, তার ধূমপানেরও নেশা রয়েছে।

মিঃ মিত্র আমাদের খুবই খাতির করলেন। এর মাঝেই বাবার ইচ্ছা হল ওঁর বাড়িটা একটু ঘুরে দেখবেন, বিশেষ করে ওই দোতলার সেই ঘর যেখানে রয়েছে বিভিন্ন পাখির বাস। মিঃ মিত্র আমাদের ওঁর বাড়ি ঘুরে দেখাতে লাগলেন। প্রথমে উনি আমাদের নিচের দুটি ঘর দেখালেন যার মধ্যে একটি ছিল ওঁর প্রদর্শনীর জন্য রাখা এবং অপরটি রয়েছে বন্ধ। সমুদা ওই বন্ধ ঘরের বিষয়ে জানতে চাইতেই উনি বললেন, “এটা আমার বাড়ির স্টোর রুম বলতে পার। বহুদিন ধরে বন্ধ পড়ে রয়েছে।”

ওঁর কথায় সমুদার বিশ্বাস হল না। তার মনে জাগল প্রশ্ন, যদি সেই ঘর অনেকদিন ধরে বন্ধই থাকে তাহলে কীভাবে ওই ঘরের তালার মধ্যে দিয়ে রঙের গন্ধ ভাসছে? যা বোঝায়, সেই ঘর নিশ্চয়ই কিছুদিনের মধ্যে খোলা হয়েছিল।

আমরা এবার গেলাম দোতলায়। সেখানে রয়েছে দুটি ঘর। একটি হল মিঃ মিত্রর এবং অপরটি ওঁর সেই বিশেষ প্রাণীদের জন্য। হ্যাঁ, সেই ঘর জুড়েই রয়েছে বিভিন্ন জাতের নানা পাখি। লাল, নীল, হলুদ, আরও অনেক রঙের। সেখানে যেমন রয়েছে নানা ধরনের টিয়া, তেমনই রয়েছে কাকাতুয়া, ময়না আরও কত কী। বাবা তো হকচকিয়ে গেছিলেন এত পাখি দেখে। তারপর ধীরে ধীরে সেই পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিলেন। কী সুন্দর মনোরম পরিবেশ সেখানে বলে বোঝানো যায় না। শুধু অনুভব করা যায়। নানা পাখিদের ডাক একসঙ্গে একই ঘরের মধ্যে শুনে মনে হচ্ছিল এ যেন এক অন্য জগতে এসে পড়েছিলাম আমরা। এক মুহূর্তের জন্য হলেও আমি ভুলে গেছিলাম আমাদের আসল লক্ষ্যের কথা। কিন্তু সমুদা? সে কখনওই ভোলেনি। তাই ফিরে আসার সময় সে আমায় শুধু বলল, “বঙ্কু, খুব সজাগ থাকিস। বিপদ যে কোনও দিক থেকে আসতে পারে।”

সেই শুনে আমার ভয় লাগল ঠিকই, কিন্তু আমি জানি সমুদা থাকতে আমার কিছু হবে না। সেই বিশ্বাসটা আমার সর্বদা ছিল তার উপর।

রাতেই সমুদার ওই বন্ধুর ফোন এল এবং আমার বুঝতে দেরি হয়নি যে সে সমুদার ওই কাজ সফলভাবে সম্পূর্ণ করেই তাকে ফোন করেছে। সমুদা ফোন রাখার পর জানতে পারলাম তার বন্ধুর পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, যে ইংরেজ সৈনিক পলাশী যুদ্ধের পর East India Company থেকে অবসর নিয়েছিলেন তিনি হলেন দাভিদ স্টারলিং। স্টারলিং সাহেব অবসর নেওয়ার পর এখানে পাকাপাকিভাবে থেকে গেলেও ওঁর বংশের কারওরই আর কোনও খবর নেই। ওই রাতেই সমুদা ঠিক করল পরদিন সকালের মধ্যেই স্টারলিং সাহেবের বাকি খবর সে যে করেই হোক বের করবে আর তাই আমাদের আবারও ছুটতে হবে ওই সরকারি কার্যালয়ে এবং সাহায্য নিতে হবে সেই কর্মীটির।

কথামতোই আমরা সকালে উঠে সেই সরকারি কার্যালয়ের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম এবং সেখানে পৌঁছে ওই কর্মী মারফৎ রেজিস্টার ঘেঁটে জানতে পারলাম যে স্টারলিং নামের আরও একজন ব্যক্তির ঠিকানা সেখানে উল্লেখ রয়েছে যার পরিবারের বসবাস সেই প্রাক-স্বাধীনতা যুগ থেকেই। সমুদা আর আমি বেরিয়ে পড়লাম ওই ঠিকানায় সেই অচেনা ব্যক্তির সন্ধানে।

স্টারলিং সাহেব থাকতেন মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জে। জিয়াগঞ্জ পৌঁছে আমরা অনেকজনকেই ওঁর কথা বললাম, কিন্তু কেউই ওঁকে ঠিকভাবে চিনে উঠতে পারল না। শেষে একজন বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করতেই উনি নিজের পরিচয় দিলেন সাভিও স্টারলিং হিসাবে এবং আমাদের দু’জনকে ওঁর বাড়ি নিয়ে গেলেন।

সেখানে গিয়ে যা জানতে পারলাম তা বেশ চমক দেওয়ার মতো। এমন চমক হয়তো সমুদাও কল্পনা করেনি। এই তদন্তে এল এক নতুন মোড়। সাভিও সাহেবের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দাভিদ স্টারলিং অবসর নেওয়ার পর এখানেই থেকে যান জিয়াগঞ্জে। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে নানা অসুস্থতার কারনে ওঁর বড়োছেলে অর্থাৎ জোসেফ স্টারলিং ওঁকে ইংল্যান্ডে নিয়ে চলে যান ১৮২০ সালে। সমুদা সেই বৃদ্ধ সাভিও সাহেবকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে আপনি?”

উত্তরে উনি বললেন, “হ্যাঁ, আমি হলাম দাভিদ স্টারলিং-এর ছোটোছেলে টমাস স্টারলিং-এর বংশধর। আমার গ্রেট গ্রেট গ্র্যান্ড ফাদার ছিলেন দাভিদ স্টারলিং।”

কথা বলতে বলতে ওঁর বউমা মারিয়া এসে আমাদের চা ও বিস্কুট দিয়ে গেলেন। সমুদা চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ামাত্রই ওঁকে সেই ছবির বিষয় জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, মিঃ সাভিও, আপনার কি এমন কোনও ছবির কথা মনে আছে যা ছিল এখানকার নবাব আলিবর্দি খাঁর?”

প্রশ্ন শুনেই সাভিও সাহেব চটে গেলেন। উনি বললেন, “উফ্‌ মিঃ দত্ত, আপনারা সবাই এক। খালি ছবির কথাই ask করেন। No! নেই আমার কাছে, নেই সেই পেইন্টিং। ওটা জোসেফ স্টারলিং ইংল্যান্ডে নিয়ে চলে গেছে।”

সমুদা সাভিও সাহেবের কথা শুনে জানতে চাইলেন যে আর কে এই ছবির বিষয় ওঁকে বিরক্ত করেছেন এবং এই প্রশ্নের উত্তর যে আমাকে এতটাই চমকে দেবে তা আমি একদমই কল্পনা করিনি।

“Yes,” উনি বলে উঠলেন, “Many years ago, one man came asking for that painting.  His name was some Bakshi.”

কথা শেষ হতে না হতেই সমুদার আর কোনও সন্দেহ রইল না যে এই বক্সীই হল আমাদের পরিচিত মিঃ বক্সী অর্থাৎ বক্সীকাকু। সাভিও সাহেবের কিছু সময় আমাদের দেওয়ার জন্য ওঁকে আমরা ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে এলাম গেস্ট হাউসে।

রাতে শুতে যাওয়ার আগে দেখি সমুদা গেস্ট হাউসের টেলিফোনটার মাধ্যমে তার এক কলকাতার পরিচিতকে কিছু নির্দেশ দিচ্ছিল এবং পরে তাকে সেই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই সে আমায় জানাল, “কলকাতার একজনকে আমি মিঃ বক্সীর ব্যাবসার সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতে বলছিলাম।”

আমি তাকে বললাম, “সে কী বলল, সমুদা?”

এর উত্তর সে আমায় না দিয়ে বরং বলল, “বঙ্কু, মুর্শিদাবাদের রাস্তাঘাট আর নিরাপদ রইল না রে।”

সেই শুনে আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, “কেন সমুদা? তুমি কী দেখে বুঝলে?”

উত্তরে সে আমায় বলল, “আমরা যখন জিয়াগঞ্জে গেছিলাম তখন আমাদের ওপর কেউ নজর রাখছিল, বুঝলি? সেই প্রমাণ আমি বহুবার পেয়েছি। যার মধ্যে অন্যতম হল ওই নীল রঙের গাড়ি, যেটা সবসময় আমাদের পিছনেই পড়ে ছিল। যেখানে যাচ্ছি সেখানেই পৌঁছে যাচ্ছে ওই গাড়ি।”

সমুদার কথায় মনে হল রহস্যের অনেকটাই সে সমাধান করে ফেলেছে। ফলে শত্রুপক্ষ এখন তার উপর সর্বদাই নজর রাখছে।

সমুদা যে রহস্যের সমাধান প্রায় করেই ফেলেছে সেই বিষয় আমাকে জানাতে সে দ্বিধাবোধ করল না। সে বলল, “বঙ্কু, সেদিন মিঃ মিত্রর দেওয়া যে মিষ্টিটা খেলি, সেটায় কি কোনও গন্ধ পেয়েছিলিস?”

আমি বললাম, “সমুদা, আমি তো অতশত না বুঝেই খেয়ে ফেলেছিলাম। তাই কোনও গন্ধ টের পাইনি।”

সমুদা আমার কথা শুনে একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “ওরে, তোকে কতবার বলেছি নিজের সিক্সথ সেন্স সবসময় সচল রাখবি! সেই মিষ্টির প্যাকেটের মধ্যে দিয়ে আসছিল রঙের গন্ধ, যে রঙ সাধারণত কোনও ছবি আঁকার জন্য ব্যবহার করা হয়। আর তুই যে মিঃ মিত্রর পাঞ্জাবিতে সাদা ডিজাইন দেখেছিলিস সেটা আসলে কোনও ডিজাইন নয়, ওটা হল রঙের দাগ। সম্ভবত ছবি নিয়ে নড়াচড়া করতে গিয়েই সেই রঙ লেগে যায় ওঁর পাঞ্জাবিতে। সুতরাং এটা হতেই পারে যে ওই ছবি মিঃ মিত্রর বন্ধ তালা দেওয়া ঘরেই রয়েছে। হয়তো সেইজন্য মিঃ মিত্র ওই ঘরকে স্টোর রুমের আখ্যা দিলেন। উনি হয়তো ভাবেননি যে কেউ ওঁর ওই ঘরের তালা বদলের খেলার মধ্যে দিয়ে খুঁজে পেয়ে যাবে এই রহস্যের সমাধান।”

আমি সমুদাকে কিছু বলার আগেই সে আমায় বলল, “আমি জানি তোর মনে প্রশ্ন উঠবে যে আমি কী করে এতসব ধরলাম, যেখানে আমি অন্যকিছু নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু তোর সেই প্রশ্নের উত্তরে এখন আমি শুধু এইটুকুই বলব যে একজন গোয়েন্দা হতে গেলে চারদিকে কী হচ্ছে সবকিছুর উপরই সমানভাবে নজর রাখতে হয়, না হলে কোনও তদন্তই সঠিকভাবে করা যায় না।”

সমুদা তারপর সেদিন রাতের ঘটনার সূত্র ধরে বলল, “আরেকটা কথা বলে রাখি তোকে, আমাদের উপর যে নজর রাখছে আর ওই রাতে আমাদের ঘরে যে কাগজ ছুড়েছিল সে একই লোক। সে আসলে সোমনাথ, মিঃ মিত্রর অনুচর। সোমনাথকে মিঃ মিত্রই পাঠিয়েছিলেন আমাদের সাবধান করে দেওয়ার জন্য। কারণ, উনি বুঝে গেছিলেন সমরেশ ক্রমশই ওঁর জন্য বিপদ হয়ে উঠছে।”

সমুদার কথা শেষ হতেই বুঝলাম, সেদিনের সিগারেটের ফিল্টারে পানের কিছু ভাগ লেগে থাকা থেকে শুরু করে ওইদিন মিঃ মিত্রর বাড়িতে সোমনাথের সঙ্গে আলাপ এবং তার বিভিন্ন স্বভাবের কথা জানার পর সবকিছু মিলিয়ে সে সোমনাথকে ধরে ফেলল। সত্যি! সমুদার কোনও জবাব নেই। জবাব নেই তার দৃঢ় বুদ্ধির। রাত অনেক হল তাই সমুদা আমাকে শুয়ে পড়তে বলল এবং সেও গেল শুতে।

পরদিন সকালে উঠে দেখি প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে এবং চারদিকে আকাশ কালো হয়ে আছে। ঠিক মনে হচ্ছে যেন কোনও নতুন বিপদ এসে হাজির হবে আমাদের দোরগোড়ায়। সারাদিন ঘরবন্দি আমরা সবাই। সমুদা খবরের কাগজ নিয়ে বসে রইল আর আমি গেলাম বাবার কাছে নানা দেশের সম্বন্ধে নানা তথ্য সঞ্চয় করতে।

দুপুরে খাওয়ার সময় বাবা সমুদার কাছে তার তদন্তের বিষয় জানতে চাইল এবং সমুদার মুখে সবটা শুনে উনি অবাক হয়ে গেলেন। কিছুতেই তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে মিঃ মিত্রর মতো একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি এরকম একটা কাজ করতে পারেন। বাবা তো কিছু না বুঝেই বলে দিল যে তিনি তৎক্ষণাৎ বক্সীকাকুকে ফোনের মাধ্যমে এই ব্যাপারে সবকিছু জানাবেন। কিন্তু সমুদার আপত্তিতে পড়ে নিজের মত পালটালেন।

সন্ধ্যাবেলা সমুদার কাছে কলকাতা থেকে ফোন আসে এবং ফোনে কথা বলার পর সমুদার দ্বিতীয় রহস্যও যে সমাধান হয়ে গেল সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সমুদার কাছে সেই বিষয়ে জানার জন্য কৌতূহল দেখাতেই সে আমায় স্পষ্ট বলে দিল, “বঙ্কু, এই বিষয়ে জানতে গেলে তোকে গল্পের শেষদিনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।”

আমি তার কথামতোই অপেক্ষায় রইলাম আগামীকালের দিকে চেয়ে।

পরের দিন ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়ে গেছিল এবং উঠে দেখি মাথার কাছে একটা চিঠি রাখা রয়েছে। সেটা পড়ে বুঝলাম ওই চিঠি সমুদার লেখা। আমার উদ্দেশেই রেখে গেছে। চিঠিতে সে আমায় নির্দেশ দিয়েছিল যাতে বারোটার মধ্যে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে আমি বক্সীকাকুর বাড়ি চলে আসি আর সেখানেই সমুদা আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। সমুদা অত ভোরে উঠে কোথায় গেছে সে বিষয়ে কোনও কিছুই চিঠিতে উল্লেখ ছিল না। আমি বাবাকে চিঠির বিষয়টা জানালাম এবং তারপর আমরা দু’জনে বক্সীকাকুর বাড়ির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম।

রাস্তায় বিপদের সম্মুখীন হতে হল! আমাদের গাড়িতে হঠাৎ কিছু লোক উঠে আমাদের জোর করে ধরেবেঁধে নিয়ে এসে হাজির করল মিঃ মিত্রর বাড়ি। ভিতরে গিয়ে দেখি আমাদের মতো ঠিক একইভাবে বৃদ্ধ সাভিও সাহেবকেও ওইভাবে বেঁধে আনা হয়েছে। আমাদের তিনজনকে তারপর চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে মাথার কাছে পিস্তল ঠেকিয়ে বহু জেরা করা হল। ওই লোকগুলোকে নেতৃত্ব দিচ্ছিল সোমনাথ এবং অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর সেখানে এসে উপস্থিত হলেন মিঃ মিত্র। বাবা তো ওঁকে দেখামাত্রই চিৎকার করে উঠলেন। কিন্তু মিঃ মিত্র তাতে মাথা না ঘামিয়ে এগিয়ে এলেন আমার দিকে এবং সমুদার বিষয়ে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। আমি তো কিছুই বলব না বলে ঠিক করে নিয়েছিলাম। সেইজন্য অবশ্য দু-তিন ঘুসিও খেতে হয়েছে আমায় সোমনাথের হাতে।

এদিকে মিঃ মিত্র ক্রমশ ওঁর ধৈর্য হারাতে লাগলেন এবং আরও আগ্রাসী হয়ে উঠলেন। আমার সামনে উনি বাবা আর বৃদ্ধ সাভিও সাহেবকে বেশ কয়েকবার ইলেকট্রিক শক দিতেও ছাড়লেন না যাতে সেই দেখে আমার মুখ থেকে সমুদার বিষয়ে কিছু বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু আমি আমার জেদ বজায় রেখেছিলাম। আমার বিশ্বাস ছিল সমুদা নিশ্চয়ই এখানে আসবে এবং এই শয়তানরা নিশ্চয়ই সাজা পাবে।

এমন সময় দরজায় আওয়াজ শোনা গেল। সেই আওয়াজ শুনে মিঃ মিত্র সোমনাথকে গিয়ে দেখতে বললেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে ওই ঘরে এসে উপস্থিত হল পুলিশ ও তাদের সঙ্গে এল সমুদা আর তার সেই বন্ধু। সোমনাথ সহ বাকি লোকগুলো নিমেষের মধ্যে পুলিশের হাতে বন্দি হয়ে গেল এবং সমুদা ও তার বন্ধু দু’জনে মিলে আমাদের সব বাঁধন খুলে দিল। মিঃ মিত্র সেই দৃশ্য দেখে একেবারে হকচকিয়ে গেলেন।

সমুদা ওঁর দিকে তাকিয়ে বলল, “মিঃ বিভু মিত্র, আপনার খেলা শেষ। আপনিই তো সেই ছবি চোর। এবার তাই তাড়াতাড়ি বলুন ছবিটা কোথায় রেখেছেন।”

মিঃ মিত্রর তখন আর কিছুই করার নেই। সুতরাং উনি সমুদার কথামতো সেই স্টোর রুমের দিকে হাত দেখিয়ে বললেন, “ছবি ওই ঘরে আছে।”

সমুদা যে একদম সঠিক অনুমান করেছিল তা আবারও প্রমাণ হল এবং সোমনাথের হাত থেকে আমি চাবি নিয়ে ওই ঘর খুলে সেই ছবি বের করে আনলাম।

ছবিটা একবার দেখার জন্য বাবার কৌতূহল হচ্ছিল এবং সেই ছবি হাতে পেয়ে বাবা যেন সবথেকে খুশি হলেন। কিন্তু কথা হল, এটাই কি সেই আসল ছবি?

না, একদমই নয়। কারণ, সাভিও সাহেব আবারও মনে করিয়ে দিলেন যে আসল ছবি বহুবছর আগেই ইংল্যান্ডে চলে গেছে। সুতরাং এটার আসল হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। বাবা সে শুনে বলে উঠল, “কিন্তু বক্সী যে বলল, এটাই আসল? তাহলে কি ও আমাদের সঙ্গে ছলনা করল?”

এর উত্তরে সমুদা বলল, “হ্যাঁ, দাদা। শুধু আমাদের সঙ্গেই নয়, উনি বছরের পর বছর সারা মুর্শিদাবাদের মানুষের সঙ্গেই ছলনা করে আসছেন এবং ওঁকে এই কাজে মদত দিত, এই মিঃ মিত্র।”

সমুদার কথা শেষ হতেই মিঃ মিত্র সহ সোমনাথ ও বাকিদের পুলিশ ধরে নিয়ে গেল আর আমরাও চললাম গল্পের শেষ স্থান অর্থাৎ বক্সীকাকুর বাড়িতে।

রাস্তায় যেতে যেতে বাবা সমুদাকে জিজ্ঞেস করল, “অত ভোরে কোথায় গেছিলিস রে, সমু?”

সমুদার হয়ে এই প্রশ্নের উত্তর আমিই দিলাম, “বাবা, সমুদা কিছুদিন আগে আমায় যে বিপদের কথা বলেছিল, সেটা যে এটা, তা আমি এখন বুঝতে পারছি। সমুদা অনেক আগেই আঁচ করতে পেরেছিল এরকম বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সে সকাল হতেই সাহায্যের জন্য ছুটে গেছিল তার বন্ধু এবং পুলিশের কাছে যাতে মিঃ মিত্র ও বক্সীকাকুর মতো দোষীরা খুব তাড়াতাড়ি আইনের হাতে ধরা পড়েন।”

আমার কথা শেষ হতেই বাবা বলে উঠল, “সমু রে, তোর জন্য আজ গর্ব হচ্ছে।”

সত্যি! সমুদার মতো লোক আছে বলেই এরকম দিনের পর দিন ঘটে চলা অপরাধ আইনের চোখে ধরা পড়ে।

আমরা অবশেষে বক্সীকাকুর বাড়ির লোহার গেটের সামনে এসে উপস্থিত হলাম। আমাদের দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখে বক্সীকাকুর চোখ যেন ছানাবড়া হয়ে গেল, বিশেষ করে সাভিও সাহেব ও সমুদার হাতে ওই ছবি দেখে। উনি বুঝতে পারছিলেন না কী করলে এই অবস্থা থেকে উনি বেরোতে পারবেন।

সমুদা ওঁর সম্মুখে গিয়ে বলল, “মিঃ বক্সী, দেখুন তো এটাই আপনার ওই ছবি কি না।”

বক্সীকাকু তো হতবাক। ওঁর গলা দিয়ে তখন স্বর বের হচ্ছিল না। ওঁর ছেলে অরুণবাবু অদ্ভুতভাবে বলে উঠলেন, “না না! সমরেশবাবু, এটা আসল ছবি হতেই পারে না। বাবা গতকাল রাতেই আসল ছবিটা নিয়ে এসেছে। এখন সেই ছবি আগের জায়গাতেই রাখা রয়েছে।”

সমুদার কথামতো অরুণবাবু সেই ছবির প্রমাণ দিতে আমাদের সবাইকে ওই ঘরে নিয়ে গেলেন এবং ওই ঘরে গিয়ে দেখি ঠিক একইধরনের আঁকা একটি ছবি সেখানে রাখা রয়েছে। সমুদা বক্সীকাকুকে ওই ঘরে ডেকে পাঠাল। সেই সঙ্গে বলল, “আপনার এই ছবির গল্পটা এবার সবার সামনে আসার সময় হয়ে গেছে, মিঃ বক্সী। তাই সেই বিষয়ে এবার আপনি বলবেন নাকি আমি বলব?”

বক্সীকাকু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিন্তু অরুণবাবু তার বাবার অপমান হচ্ছে দেখে একটু রেগেই বললেন, “মিঃ দত্ত, আপনি আমার বাবাকে এরকমভাবে অপমান কেন করছেন জানতে পারি? কী করেছেন উনি যার জন্য ওঁর মতো একজন ব্যক্তিকে নিজের বাড়িতে দাঁড়িয়ে অপমানিত হতে হচ্ছে?”

উত্তরে সমুদা বলল, “আপনি কিছুই জানেন না, অরুণবাবু। আপনার বাবা এই ছবিকে কেন্দ্র করে যে গল্প রটিয়েছেন সেটা আসলে একেবারেই মিথ্যে। তদন্ত করতে গিয়ে আমি জেনেছি, আপনার বাবার কথা অনুযায়ী যে ছবিটি ওঁর প্রপিতামহ পেয়েছিলেন সেটি কখনওই নবাবের আসল ছবি ছিল না। কারণ একটাই, আমার হাতে যেই ছবিটি রয়েছে আর যেটা আপনি দেওয়ালে দেখছেন দুটোর মধ্যে দিয়ে কেমন যেন একইরকম রঙের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। একটু ভালো করে লক্ষ করলে বুঝবেন, এই দুটো ছবিরই একই ভুল রয়েছে। আর সেটা হল নবাবের দাড়ির কালো রঙ। ওটা কোনও প্রকারে ঘেঁটে গেছিল বলেই সেটা ঠিক করতে গিয়ে দাড়ির কিছুটা ভাগ বেশি কালো হয়ে গেছে। এটা দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে দুটো ছবি একই ব্যক্তির দ্বারা আঁকা হয়েছে, না হলে একই ভুল দু’জনের পক্ষে করা অসম্ভব। আর এই আঁকার কাজটি করেছেন আপনারই বাবার পরম বন্ধু মিঃ মিত্র যিনি এখন পুলিশের হেফাজতে।”

সমুদার কথা শুনে অরুণবাবু এবং তার স্ত্রী দু’জনেই অবাক হয়ে গেলেন। তারপর সমুদা আরও জানাল, “আমার সন্দেহ হয় যখন মিঃ বক্সী ছবি হারানোকে কেন্দ্র করে প্রথমে এক গল্প বললেন, পরে সেটা ভুল প্রমাণ হতেই বানিয়ে ফেলেন আরেকটা গল্প। কিন্তু সেই গল্প ছিল খুবই আকর্ষণীয়। কারণ, উনি সুন্দরভাবে দু’জন ব্যক্তির নাম মিলিয়ে এক ভুয়ো নাম তৈরি করে ওঁর পরিচয় দিলেন East India Company-র সেই সৈনিক হিসাবে। পরে ওই নামদুটো থেকেই আমি আমার বন্ধুর সাহায্যে খুঁজে বার করলাম সেই আসল ব্যক্তিটির নাম, যিনি দাভিদ স্টারলিং। উনি সেই ছবি সত্যি পেয়েছিলেন, তবে বর্তমানে সেটা ইংল্যান্ডে ওঁর বড়োছেলে জোসেফ স্টারলিং-এর পরিবারের কাছেই রয়েছে। এই ছবির জন্য মিঃ বক্সী বৃদ্ধ সাভিও সাহেবকেও বহুবার বিরক্ত করেছেন। কারণ, উনি হলেন স্টারলিং সাহেবের বংশধর। সেই ছবির বিষয়ে ওঁর থেকে কোনও খবর না পাওয়ায় উনি মিঃ মিত্রকে দিয়ে আঁকিয়ে ফেললেন একইরকমের আরেকটি ছবি আর সেই থেকেই শুরু হল ওঁর লোক ঠকানোর ব্যাবসা।”

এইসব শুনে অরুণবাবু খুবই ব্যথিত হলেন এবং তার মনে জাগল এক প্রশ্ন। “ওই ছবি কি তাহলে একদিনের জন্যও আমাদের পরিবারের ঐতিহ্য ছিল না?”

না। সত্যিই ছিল না। বক্সীকাকু শুধু প্রতারকই ছিলেন না, উনি ছিলেন একজন অসফল বাবা যিনি নিজের স্বার্থের জন্য নিজের ছেলেকেও দিনের পর দিন ঠকিয়ে গেছেন।

অরুণবাবু নিজের দুঃখ চেপে রেখে সমুদার থেকে তার বাবার কুকীর্তির সম্বন্ধে আরও জানতে চাইলেন এবং সমুদাও তাকে বলল, “মিঃ বক্সী চেয়েছিলেন কলকাতায় কোনও বিদেশি পর্যটককে এরকমই এক নবাবের ছবি মিঃ মিত্রকে দিয়ে আঁকিয়ে আসল বলে বিক্রি করবেন যাতে সেখান থেকে এক মোটা অঙ্কের অর্থ লাভ করা যায় আর এটাই ছিল ওঁর এবারের বহরমপুরে আসার অন্যতম এক কারণ। উনি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন এই ছবি চুরি হওয়ার ঘটনাটা উনি ঘটাবেন যাতে মিঃ মিত্রকে সেই ছবি আঁকার জন্য সময় করে দেওয়া যায়। আর সেই সঙ্গে উনি চেয়েছিলেন কোনও এক প্রাইভেট এজেন্সিকে এই ভুয়ো চুরির ঘটনার তদন্তের কাজে লাগিয়ে এই আসল ঘটনাটা সবার আড়ালেই রেখে দিতে। যার ফলে ওঁর নিজের স্বচ্ছতাও বজায় থাকবে আর ওই কাজও হাসিল হয়ে যাবে। কিন্তু মিঃ বক্সী যখন দেখলেন আমি সব ঘটনাই প্রায় ধরে ফেলেছি ঠিক তখনই মিঃ মিত্রর দ্বারা উনি তুলে নিয়ে গেলেন আমার দাদা, ভাইপো আর অবশ্যই সাভিও সাহেবকে। ওঁরা ভেবেছিলেন বল প্রয়োগ করে বঙ্কুর থেকে আমার ব্যাপারে সব খবরই পেয়ে যাবেন আর আমাকে শায়েস্তা করতে সফল হবেন। কিন্তু ওঁদের সেই পরিকল্পনা একেবারেই ভুল প্রমাণিত হল।”

সব শুনে অরুণবাবু নিজের বাবার ওপর খুব রেগে গেলেন এবং ওই ছবি তার বাবার হাতে তুলে দিয়ে তিনি ওঁর থেকে কৈফিয়ত চাইলেন কেন উনি এই কলঙ্কের কাজ করে তাদের পরিবারের মাথা নিচু করলেন। কিন্তু বক্সীকাকুর মুখ থেকে তখন কোনও কথাই বের হল না। ওঁকে দেখে তখন সত্যি খারাপ লাগছিল। কিন্তু পরের মুহূর্তে ওঁর এই কুকীর্তির কথা চিন্তা করলেই ওঁর প্রতি রাগ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছিল।

এরই মধ্যে বক্সীকাকুর বাড়িতে পুলিশের ভ্যান এসে হাজির। অফিসার সমুদার থেকে পুরো বিষয়টা আগেই শুনেছিলেন। সুতরাং আর সময় নষ্ট না করে ওই ছবিসমেত বক্সীকাকুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেলেন। ওঁর ছেলে ও বউমা দু’জনেই লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। অরুণবাবু তো বলেই দিলেন তিনি আর এরকম বাবাকে তাদের জীবনে কখনওই চান না, সেদিন থেকে তার কাছে তার বাবা মৃত। হ্যাঁ, এটাই হয়তো সবচেয়ে বড়ো শাস্তি একজন বাবার কাছে যখন তার নিজের ছেলে সারাজীবনের জন্য তাকে পরিত্যাগ করে। আমার বাবা অরুণবাবুকে ভেঙে না পড়ার পরামর্শের সঙ্গে তাদের পাশে থাকার আশ্বাস দিলেন।

তারপর সমুদা সাভিও সাহেব ও তার বন্ধুকে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আমাদের পাশে থাকার জন্য আবারও ধন্যবাদ জানাতে ভুলল না। সবশেষে রয়ে যাওয়া ওই একটা ছবি সমুদা আমার সাহসের পরিচয় দেওয়ার জন্য সেটা আমার হাতে তুলে দিল। ওই ছবি আসল না হওয়া সত্ত্বেও আমার কাছে এটার মূল্য ছিল অসীম। কারণ, এটা হল আমার সমুদার দেওয়া তার প্রথম কোনও বড়ো তদন্তের প্রধান এক অঙ্গ যেটাকে কেন্দ্র করে বিগত কিছুদিনের মধ্যে গড়ে উঠেছিল নানা রোমাঞ্চকর পরিস্থিতি। আর সেই সকল ঘটনাকে উপেক্ষা করে নিজের লক্ষ্যে সফল হতে পেরেছিল গোয়েন্দা সমরেশ, আমার সমুদা।

আমরা অবশেষে গেস্ট হাউসে ফিরলাম এবং ঠিক করলাম পরদিনই কলকাতা ফিরব। কথামতোই পরের দিন দুপুরে খেয়ে আমরা স্টেশনের উদ্দেশে রওনা দিলাম। রাস্তায় বাবা সমুদার কাছে তার এই রহস্যময় গল্পের শেষ ভাগটির বিষয়ে জানতে চাওয়ার সমুদা আমাদের বলল, “আমি আগেই বুঝে গেছিলাম, এই ছবিকে কেন্দ্র করে অনেক ঘটনাই লুকিয়ে রয়েছে। তবে সাভিও সাহেবের সম্মুখীন হয়ে ওঁর থেকে সব জানার পর ঠিক করি মিঃ বক্সীর ব্যাবসার সম্বন্ধে জানতে হবে। সুতরাং ফোন করি কলকাতায় আমার এক ব্যবসায়ী বন্ধুকে যার দোকান ওই ধর্মতলাতেই এবং তার মাধ্যমেই জানতে পারলাম যে মিঃ বক্সীর দোকানে বিভিন্ন ছবি ও পুরনো ঐতিহাসিক জিনিসের বেচাকেনা হয়। সেখানে বিদেশি খরিদ্দারের সমাগমই বেশি। তারপর বাকিটা তোমাদের সবারই জানা। সেই প্রথমদিনের মিঃ মিত্রর ওই মিষ্টির প্যাকেট থেকে শুরু করে সোমনাথের চালচলন এবং মিঃ বক্সীর বানানো গল্প সবই ছিল আমার মাথায়। তাই সব তথ্যকে একসঙ্গে জুড়ে আমি পেয়ে গেলাম এই রহস্যের শেষ সমাধানটুকু।”

পুরো ঘটনা শুনে বাবা বলে উঠল, “সমু, তুই সত্যি একজন গোয়েন্দা হয়ে উঠলি রে। তোর বুদ্ধির প্রশংসা না করে থাকতে পারলাম না। আমি কলকাতায় ফিরে তোর জন্য চেষ্টা করব যাতে তুই সরকারিভাবে একজন গোয়েন্দার স্বীকৃতি পাস।”

কিন্তু সমুদা এতে নারাজ। সে চায় একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর হয়েই থাকতে এবং সমাজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এরকম নানা অপরাধকে টেনে বের করে অপরাধীদের প্রশাসনের হাতে তুলে দিতে যাতে এই সমাজ হয়ে ওঠে বসবাসের পক্ষে এক সুস্থ স্থান।

আমরা এসে পৌঁছালাম স্টেশনে এবং ট্রেনে ফিরে এলাম আমাদের নিজের শহর কলকাতায়। বাড়ি ফিরে আমরা সকলেই ব্যস্ত হয়ে গেলাম দৈনন্দিনের কাজে। আমার বারো ক্লাসের পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল, বাবাও নিজের ব্যাবসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এখন সমুদার কথা বলতে গেলে বলতেই হবে তার নতুন পরিচয়ের কথা। তিনি এখন একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। তার নামডাক সবে হতে শুরু করেছে এবং কিছুদিনের মধ্যেই সমুদা হয়ে উঠল এই সমাজের বুকে এক মোক্ষম চরিত্র।

বেশ কিছু মাস পর একদিন আমাদের বাড়ির ঠিকানায় সমুদার নামে এক রেজিস্ট্রি চিঠি এসে উপস্থিত। সমুদা ওই চিঠি খুলতেই অবাক হয়ে গেল। ওই চিঠি এসেছিল পলাশীর বাসিন্দা সেই বক্সীকাকুর বাড়ির ঠিকানা থেকে। হ্যাঁ, সেই চিঠি পাঠিয়েছিলেন অরুণবাবু সমুদাকে ধন্যবাদ জানাতে। কারণ, তাদের চোখের সামনে যে মিথ্যের মায়াজাল তার বাবা দিনের পর দিন বুনে গেছিলেন সেটি একমাত্র সমুদাই পেরেছিলেন সরাতে। তিনি সেই চিঠি মারফত আরও জানালেন যে তারা বহরমপুরের বাড়ি ও সেখানকার সব সম্পর্ক মিটিয়ে পলাশীর বাড়িতে ফিরে গেছেন। ওই চিঠির সঙ্গে অরুণবাবু কিছু টাকাও পাঠিয়েছিলেন সমুদার নামে। কারণ, তার বাবা অর্থাৎ বক্সীকাকু সমুদাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে যদি সে ওই ছবি হারানোর তদন্তে সফল হয় তাহলে সমুদাকে উনি কিছু টাকা পারিশ্রমিক হিসাবে দেবেন। সুতরাং তার বাবার দেওয়া সেই কথা অরুণবাবু রাখলেন।

সমুদা ওই টাকা বাবার হাতে তুলে দিল এবং সেই মুহূর্তে তার মুখে ছিল বহুমূল্য হাসি, যে হাসি বলে দিচ্ছিল ওই টাকা পেয়ে সে কতটা খুশি হয়েছে। ওই টাকা হল সমুদার জীবনে তার প্রথম তদন্তের ফসল, যে তদন্ত দিয়ে শুরু হয়েছিল তার নতুন পথচলা একজন গোয়েন্দা হিসাবে। তাই সেই তদন্তকে খুব সহজেই বলা যায়, ‘সমু গোয়েন্দার হাতেখড়ি’।

(সমাপ্তি)

লেখক পরিচিতিরণিত ভৌমিক

বিঃ দ্রঃ লেখাটি জানুয়ারি, ২০২০ ত্রিমাসিক লেখনী প্রতিযোগিতার অন্তর্ভুক্ত।

SOURCEরণিত ভৌমিক
Previous articleবিল্টুর বিটলামি
Next articleঅডিশন
Avatar
Disclaimer: Monomousumi is not responsible for any wrong facts presented in the articles by the authors. The opinion, facts, grammatical issues or issues related sentence framing etc. are personal to the respective authors. We have not edited the article. All attempts were taken to prohibit copyright infringement, plagiarism and wrong information. We are strongly against copyright violation. In case of any copyright infringement issues, please write to us. লেখার মন্তব্য এবং ভাবনা, লেখকের নিজস্ব - কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত..................

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here