গল্প লেখার গল্প -পর্ব ২

2
799

<< পর্ব ১

মাকে দুঃখ পেতে দেখে দুলকি খেতে খেতে হেসে ফেলল। বলল ,” আচ্ছা মা মানুষ এইরকম একটা নিশ্চিন্ত জীবন কাটাতে পারলে ধন্য হয়ে যায় আর তুমি দুঃখ পাচ্ছ ?”

প্রমিতা দেবীও হেসে ফেললেন , ” নারে । তুই গল্পের রসদের কথা বললি তো তাই বলছি। তবে কি জানিস যেকোনো সম্পর্কের একটা ওঠা পড়া থাকতে হয়। তবেই তো সম্পর্কের মাধুর্য তৈরী হয়।স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কও তাই। অভিযোগ, অভিমান এগুলো স্বামী স্ত্রী সম্পর্ককে সম্পূর্ণতা দেয়। দুলকির খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। রাতে খাওয়ার পর এঁটো টেবিল পরিষ্কার করার কাজটা দুলকিই করে। আজ এঁটো থালা বাসন গুলো রান্নাঘরে নিয়ে যেতে যেতে শুনল মা বলছে , ” মাঝে মাঝে মনে হয় তোর বাবা যদি একটু রাগী হত তাহলে বেশ ভালো হত । মারধোর না করুক অন্তত পক্ষে যদি এক্তু ঝগড়াও করতেন তাহলেও বুঝতাম মানুষটা আছে। সত্যি বলব দুলকি তোর বাবা মরে যাওয়ার পর বুঝেছিলাম তিনি ছিলেন। মেয়েরা শিবরাত্রি করে শিবের মতো বর পাওয়ার জন্য । কিন্তু সেই শিবেরও দ্যাখ দোষ আছে। নেশা ভাঙ করে। নিখুঁত সুন্দরীকে যেমন সুন্দরী বলা যায় না নিখাদ জীবনকেও কি জীবন বলা যায় ? প্রমিতা দেবী আপন খেয়ালেই কথাগুলো বলে যাচ্ছিলেন। হঠাৎই খেয়াল করলেন দুলকি এঁটো তোলার কাজ বন্ধ করে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে।  তড়িঘড়ি করে বলে  উঠলেন, “দ্যাখ আমি জানি আমি ভাগ্য করে শ্বশুরবাড়ী পেয়েছি। তুই গল্পের কথা বলছিলিস না তাই।”

রাত্রিবেলায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে খেতে দুলকি মায়ের কথাগুলোই ভাবছিল। রোজ রাত্রেই দুলকি এই সময়ে কিছুক্ষণ বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। মাঝে মাঝে প্রমিতা দেবীও আসেন মেয়েকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য। মা মেয়ের নানা রকম কথাবার্তা হয়। আজ মা একটু তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে গেছে।” সত্যিই তো বাবা মায়ের মধ্যে কোনোদিন ঝগড়া হতে দেখেনি ” দুলকি ভাবছিল। “বাবার মধ্যে বরাবরই একটা বিনা প্রতিবাদে
আত্মসমর্পণ করার মানসিকতা কাজ করত। উল্টোদিকে মাকেও কোনোদিন কোন কিছুর জন্য জোরাজুরি করতে দেখেনি দুলকি। তার দরকারও অবশ্য ছিল না। বাবা সবকিছুই নির্বিবাদে মেনে নিতেন।দুলকির বাবা মাকে সবাই বরাবরই আইডিয়াল কাপল বলে জানত। বাবা মায়ের এই অদ্ভ ুত আন্ডারস্ট্যান্ডিং দুলকির বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেও বিখ্যাত ছিল। আদর্শ বৈবাহিক সম্পর্কের কথা উঠলেই তারা দুলকির বাবা মায়ের প্রসঙ্গ টানত। অথচ আজকে মায়ের কথা শুনে দুলকির মনে হল কোথায় যেন একটা অস্বাভাবিকতা ছিল। ভাবতে ভাবতে বারান্দা থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে দুলকি দেখল মায়ের ঘরের আলো তখনো জ্বলছে।

শীতের রাতগুলো যেন বড় বেশী নিস্তব্ধ হয়। রাত সাড়ে দশটা বাজতে না বাজতেই মানুষের সঙ্গে সঙ্গে পশুপাখি গাছপালা গুলোরও যেন ঘুমোতে যাবার তাড়া পরে যায়। অন্য বছরগুলোর তুলনায় এই বছরে ঠাণ্ডাটা একটু কমই পড়েছে । তবুও আজ রাতে প্রমিতা দেবীর যেন একটু বেশিই শীত শীত করছে। চারিদিক বড় চুপচাপ। বড় রাস্তায় একটা অ্যাম্বুলেন্স সাইরেন বাজাতে বাজাতে চলে গেল। ঠিক এই রকম একটা অ্যাম্বুলেন্স আজ থেকে পনেরো বছর আগে প্রমিতা দেবীর বাড়ীর দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছিল। তারিখ ছিল তিরিশে জুলাই। বাঁচানো যায়নি নিশিথরঞ্জনকে। মেজর হার্ট অ্যাটাক ছিল। সময় দেননি , বা হয়তো দিতে
চাননি নিশিথরঞ্জন। সঠিক জানেন না প্রমিতা দেবী। দেওয়ালে টাঙানো স্বামীর ছবির দিকে একবার তাকালেন প্রমিতা দেবী। কলেজে থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় প্রমিতা দেবীর বাবার এক বন্ধু এই সম্বন্ধটা এনেছিল। তিন বোন ! কোন রকমে গ্রাজুয়েশনটা করিয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়াটাই দস্তুর তাদের মতো পরিবারের। এর আগেও যে দু তিনটে সম্বন্ধ এসেছিল। কিন্তু এই সম্বন্ধটাই সবচেয়ে ভালো ছিল। ছেলে ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টে
ভালো পোস্টে চাকরি করে। মা বাবার একমাত্র ছেলে। মাথা গোঁজার জন্য একটা বাড়ী আছে। মধ্যবিত্ত সংসারে আর কিইবা চাহিদা থাকতে পারে ? তাই এই সম্বন্ধটা আসতে প্রমিতা দেবীর বাবা মা সেটাকে লুফে  নিয়েছিল।

কিন্তু না , প্রমিতা দেবীর একটা চাহিদা ছিল। ঠিক চাহিদা নয় । বরং শখ বলা যেতে পারে। এমন একটি শখ যেটা কিনা  কিশোরী বয়েসে তৈরী হয়েছিল। কিন্তু বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শখটা অবসেশনে পরিণত হয়েছিল। এমনিতে ভবিষ্যৎ স্বামী বা শ্বশুরবাড়ী কেমন হবে সেটা নিয়ে প্রমিতা দেবীর খুব একটা মাথা ব্যথা ছিল না। বাবা মা যার গলায় ঝুলিয়ে দেবে তার সঙ্গেই চলে যাবে । বাকি বোনেদের যা হয়েছে তারও
তাই হবে। কিন্তু  কিশোরীবেলায় দ্যাখা একটি ছবি প্রমিতা দেবীর  মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। ছবিতে একজন পুরুষ হাতের দু আঙ্গুলের ফাঁকে জ্বলন্ত একটা সিগারেট নিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলছে । কে সেই লোকটি আজ আর প্রমিতা দেবীর মনে নেই। সেই সময় হয়তো লোকটিকে তিনি চিনতেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই লোকটির মুখ অস্পষ্ট , চেহারা ঝাপসা হয়ে গেছে।শুধু জ্বলজ্বল করছে দু আঙ্গুলের ফাঁকে ধরা জ্বলন্ত সিগারেটখানা আর সেই সিগারেট হাতে নিয়ে কথা বলার ভঙ্গিটা। শরীরের খাঁজ গুলো ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে ওঠার সাথে সাথে , বুকে নতুন কুঁড়ি পাপড়ি মেলার সেই বেলায় ছবির সিগারেট ধরা হাতটা প্রমিতা দেবীর শরীরে মনে দাবানল জ্বালিয়ে দিয়েছিল। সেই আগ্রাসী দাবানলের আঁচ প্রমিতা দেবী আজও টের পান। জ্বলন্ত সিগারেট আজ এই পড়ন্ত বেলায় জ্বালা হয়তো আর ধরায় না তবে ছ্যাঁকা এখনো লাগায়। কে ছিল পুরুষমানুষটি ? প্রমিতা দেবী চেষ্টা করলেও মনে করতে পারেন না। আসলে মনের ক্যানভাসে দু আঙ্গুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেটই ছিল একমাত্র সত্যি। মুখটা যে কারুর একটা হতে পারত। তাই কিশোরী থেকে যৌবনের সিড়িতে উঠতে উঠতে তিনি মনে মনে তার না দ্যাখা স্বামীকেই সেই ছবির মুখ করে নিচ্ছিলেন। শরীর বেড়ে ওঠার সাথে সাথে শরীরের চাহিদা যত বাড়ছিল ততই ক্রমশ একটা আকাঙ্খা যেন তীব্র হয়ে উঠছিল। দু আঙ্গুলে সিগারেট ধরা একটা হাত রাতে স্বপ্নে তার শরীর জড়িয়ে ধরত। শারীরিক মিলনের সঙ্গে তামাকের পোড়া গন্ধ অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে গেছিলো। যেন কোন পুরুষমানুষ নয় তাকে শারীরিক তৃপ্তির আস্বাদন দিতে পারবে কেবল একটা জ্বলন্ত সিগারেটের ।

 

পর্ব ৩>>

 

কলমে অদিতি দে

2 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here