শাক্য জেঠু আমাদের খুব আপনজন।
ছোটবেলাতে মা বাবা ছাড়া যে ক’জনের ছত্রছায়ায় আমরা বেড়ে উঠেছি শাক্য জেঠু তাঁদের মধ্যে অন্যতম। আরও যাঁদের কথা খুব মনে আছে তারমধ্যে ছিলেন তপন কাকু, পঙ্কজ কাকু, আব্বাস কাকু, হক জেঠু, জনার্ধন কাকু এরকম বাবার সব প্রতিভাবান বন্ধুরা। এরা অনেকেই ছুটি-ছাটার দিনে একত্রিত হতেন আর নানা রকম আলোচনা, কবিতা, আবৃত্তি, গান ইত্যাদিতে আমাদের বাড়িটা প্রাণোচ্ছল করে তুলতেন। মাঝে মাঝে রাজনৈতিক বিতর্কে চেঁচামেচিও হতো। মা তখন তাঁদের সামলাতেন। কখনও কখনও মানোরঞ্জনের তাগিদে তাস খেলাও হতো। বাবার সাথে তো পঙ্কজ কাকুর খুব ঝাগড়া লাগতো তাস খেলতে গিয়ে ভুল লিড দিয়ে দিলে। পঙ্কজ কাকু ছিলেন এক কলেজের অধ্যাপক।
যাই হওক, শাক্য জেঠু ছিলেন বহুমুখী প্রতিভাধর এক মানুষ। হাতের লেখা ছিল মুক্তোর মত। আমরা সেই লেখাকে অনুকরণ করে অক্ষর লেখার অভ্যাস করতাম।
অসম্ভব ভাল ছিল তাঁর আবৃত্তি। মনে আছে উনার মুখেই প্রথম শুনেছিলাম তোতা কাহিনী, পুরাতন ভৃত্য এসব। নাটকীয় ভঙ্গিতে উপস্থাপন অসম্ভব মনোগ্রাহী করে তুলতো সেসব কবিতাগুলি।
তাঁর অংকন এতো ভাল যে আমরা স্কুলের আঁকার কিছু থাকলে আকুলভাবে অপেক্ষা করতাম কবে শাক্য জেঠু বাড়ি আসবেন। দাদা তো আঁকতে শিখেছে জেঠুর অনুপ্রেরণায়।
শাক্য জেঠু এমনি ছিলেন আমাদের নির্ভরতার, ভালবাসার জায়গাতে।
মাঝারি একহারা চেহারা, একমুখ দাড়ি যা কিনা খুবই অবিন্যস্ত। পাঞ্জাবী ধুতি পরতেন। সেটাও অমলিন। কাঁধে থাকতো একটা শান্তিনিকেতনি ব্যাগ। তাতে একটা পায়জামা একটা গামছা আর কিছু বই ও পত্রিকা।
রেলে চাকরি করতেন। অফিস বন্ধুদের সাথে মেসে থাকতেন। মাসে একবার করে বাড়ি যেতেন।
দুই মেয়ের পরে এক ছেলে। পরে আরেকটি ছেলে হয়েছিল, বকুল, বাল্য বয়েসেই সে মারা যায়। ছেলে প্রদীপ আমার বয়েসিই হবে।
খুব ট্রেড ইউনিয়ন করতেন। বামপন্থী ইউনিয়ন। নিষ্ঠার সাথে। ফলে অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কু-নজরে পড়ে যান। তাই বোধকরি কোনওদিন প্রমোশন হয়নি। উনার সহকর্মীকে রেলের বোর্ড সদস্য পর্যন্ত উত্তরণ হতে শুনেছি। নির্লোভ, নিরহংকারী, আপোষহীন শাক্যপদ বড়ুয়ার মেরুদণ্ড ছিল খুবই ঋজু।
শাক্য জেঠুর এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য বাবাদের কাছে তিনি একজন আদর্শ লোক। দারিদ্রতা উনাকে ত্যাগ করতে পারেনি আমৃত্যু। তখনকার দিনে, অর্থাৎ ষাটের দশকে তো রেলে বেতন খুব সামান্যই ছিল। তার উপর নিচু স্তরের কর্মচারী হলে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা।
আমাদের বাড়ি যখন আসতেন মা খুব যত্ন করে খাওয়াতেন। যাওয়ার সময় একটা ব্যাগ জোর করে হাতে ধরিয়ে দিতেন তাতে থাকতো প্রয়োজনীয় কিছু মুদিখানার সামগ্রী আর কাপড়। সলজ্জে তিনি তা গ্রহণ করতে বাধ্য হতেন মায়ের অনুনয় আবেদনে।
একবার শাক্য জেঠু অনেকদিন আমাদের বাড়ি আসছেন না। ৫-৬ মাসের বেশী হবে। বাবা খবর নিয়ে জানলেন তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। যক্ষ্মা হয়েছে। বাড়ি গেছেন আগের সপ্তাহে।
মা আমাকে নিয়ে রওনা হলেন সীতাকুণ্ড। বাস থেকে নেমে মেঠো পথ দিয়ে আধা মাইল গেলেই জেঠুর বাড়ি। মায়ের আর আমার হাতে ব্যাগ। তাতে ডাল, তেল, কিছু মসলা, ফল, মিষ্টি। প্রদীপ ও দিদিদের জন্য কিছু নতুন জামা কাপড়। জেঠিমার জন্য শাড়ি, ছায়া, ব্লাউজ। জেঠুর জন্য গেঞ্জি, পাঞ্জাবী। সামনেই ওদের প্রিয় উৎসব বৌদ্ধ পূর্ণিমা। জেঠুর কোনও বিশেষ ধর্মীয় আবেগ নেই। সন্তানরা কেন উৎসবে নিরাশ হবে! মায়ের সেটাই যুক্তি।
বেড়ার ঘর। টিনের ছাউনি। মাত্র দুটো রুম। পিছন দিকে লাগোয়া রান্নাঘর। মাটির তৈরি। একদিকের দেওয়াল ধস নেমে অর্ধেকের মতো ভেঙে পড়েছে। খড়ের ছাউনি। তাও জীর্ণ দশা। দুপুরের রোদ রান্নাঘরের ভিতরেই পর্যাপ্ত। পাশেই একটা এঁদো পুকুর। পুকুরের ওপারে তিনপাশ বেড়া দিয়ে ঢাকা কাঁচা পায়খানা। তাতে দরজা নেই, প্লাস্টিকের পর্দা লাগানো। সামনে বিশাল উঠোন। হাডুডু, কানামাছি এসব খেলা হতো প্রতিদিন বিকেলে। পাড়ার সব বাচ্চারা এসে জড়ো হতো।
আমাদের আসতে দেখে জেঠিমা উঠোনে এগিয়ে এসে মাকে জড়িয়ে ঘরে নিয়ে ঢুকলেন। অসুস্থ জেঠু বিছানায় হেলান দিয়ে বসে। মা উনাদের প্রণাম করে জামা কাপড়গুলি দিলেন। তা দেখে জেঠু কান্নায় ভেঙে পারলেন।
‘রাণী তুমি বুঝি সত্যিই পূর্বজন্মে আমার মা ছিলে!’
একঘন্টার মত হতে চলল উনারা গল্প করছেন। আমি এদিক ওদিক ঘুরছি। প্রদীপ নাকি ওর পিসির বাড়ি গেছে আর দিদিরা স্নানে l দিদিদেরও দেখছি আসার নাম নেই এখনও। আমি একা একা কতক্ষণ আর বসে থাকবো! বেড়িয়ে ঘুরতে ঘুরতে রান্নাঘরে চলে এলাম। ভাঙ্গা দেওয়াল দিয়ে নজর পড়লো পুকুরের জলে দুই বোন দাড়িয়ে আছে। আমাকে দেখতে পেয়েই জলে গা ঢাকা দিল গলা পর্যন্ত। দুজনেই খুব ফরসা আর সুন্দর মুখশ্রী। আমি কাছে গিয়ে ডাকলাম। আমাকে বললো – ভাই তুমি ঘরে গিয়ে বসো, আমরা আসছি। আমি ঘরে চলে গেলাম। টের পেলাম, লজ্জা নিবারণের কারণেই পুকুরের জলে গা লুকিয়ে রাখা ছিল ওদের উদ্দেশ্য। পরিহিত জামা কাপড়ের ছিন্ন দশা। উঁকি দিচ্ছে ফরসা শরীরের কিছু অনাবৃত অংশ। শহুরে মানুষের সামনে এ পোশাকে আসা যায় নাকি!
দুপুরে খেতে বসলাম। তরকারি বলতে পুকুর পাড় থেকে তোলা কলমি শাকের ঝোল। আমরা এলাম বলে পাশের বাড়ি থেকে দুটো ডিম চেয়ে চিন্তে এনে অমলেট করে দিল। এ খাবার ওদের নিত্য সাথী।
অভাবের তাড়নায় খুশি এখানে থেকে উবে যায়নি। দিদি গান শুনিয়ে, গল্প করে আমাকে মোহিত করে দিয়েছিল। বড়দিদির গলায় শুনেছিলাম – এই মণি হার আমায় নাহি সাজে….। চল্লিশ বছর আগের কথা। এখনও চোখে ভাসছে সেসব দিনগুলির কথা।
সেটাই আমার শেষ দেখা জেঠুদের। এক বিশেষ রাজনৈতিক কারণে আমাদের চলে যেতে হলো অন্য শহরে। অনেক দূরে।
চিঠিতে বাবার সাথে যোগাযোগ রক্ষা হতো। আমি তখন কলেজে পড়ি। একদিন সকালে মাকে ডেকে বাবা বললেন, ‘রানী কাল শাক্য’দার একটা চিঠি এসেছে।’
‘কী খবর উনাদের?’
‘শোনো চিঠিটা পড়ছি।’ বাবা চিঠিটা পড়তে শুরু করলেন । ভূমিকা শেষ করে করে বাবা পড়তে লাগলেন চিঠির দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ ….
‘……আমার শরীর মোটামুটি একরকম আছে। বড় মেয়ে সন্তান সম্ভবা। পাঁচ মাস হল। সে-ই ছোট বোনের বিয়ে নিয়ে ভাবছে। ছেলে সীতাকুণ্ড কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে।
তোমার বৌদিকে অনেকদিন কোনও কাপড় কিনে দিতে পারিনি আমার অক্ষমতা জন্য। তাকে সুখী করতে পারিনি বলে আফসোস আমার এই জীবনে যাবেনা। গতমাসের ২৮ তারিখ তোমার বৌদিকে একটা নতুন কাপড় দিয়ে শেষ বিদায় দিলাম।’
ইতি –
তোমার গুণমুগ্ধ
শাক্য
লেখক পরিচিতি : ডঃ শ্রীকান্ত চৌধুরী