রাতুল যখন শিয়ালদহ স্টেশন এ পৌছালো তখন 5.30 টার নৈহাটি লোকাল টা চলে গেছে, আজ অফিসে কাজ থাকাতে এত দেরি হয়ে গেল ।
রাতুল কলকাতা হাইকোর্টে office assistantপদে কাজ করে ।পড়াশুনো য় খুবই ভালো ছিল রাতুল । ভূগোল এ সম্মানিক( hons.) নিয়ে B.sc পাশ করার কিছু দিন পরেই চাকরির পরীক্ষা দেয় রাতুল, রাতুলের ইচ্ছা ছিল এম. এসসি পাশ করে পি. এইচডি করার কিন্তু গাড়ি দুর্ঘটনাতে রাতুলের বাবা অমিতাভ বাবু হঠাত্ মারা যাওয়ায় মা ও বোনের দায়িত্ব রাতুলের কাঁধে এসে পরে ।অমিতাভ বাবু একটি বেসরকারি সংস্থাতে নিচু পদে কাজ করতেন বলে সংসার চালিয়ে সেই ভাবে টাকা জমাতে পারেননি ।তাই সেই সময় অনেক টিউশনি শুরু করে রাতুল ।কিছু দিন পর কলকাতা হাইকোর্টের চাকরির নিয়োগ এর খবর পরে, পরীক্ষায় বসে । পরীক্ষাতে পশ্চিমবঙ্গে চতুর্থ হয় রাতুল । জেঠু শৈল বাবু রাতুলকে বোঝায় আর বলে ” আমি জানি তোর জীবনের লক্ষ্যে অন্যরকম ছিল, কিন্তু বাবা এখনের সময় একটা সরকারি চাকরি পাওয়া অনেক কঠিন আর তুই এত ভালো ফল করেছিস; তোর মা- বোনোও তাদের দায়িত্বও তো রয়েছ তাই তুই চাকরি টা ছাড়িসনা আরও পড়াশুনো তুই পরেও করতে পারবি”। এর পরেই রাতুল হাইকোর্টের চাকরিতে জয়েন করে।কাজের আর সংসারের চাপে পড়াশুনো আর এগোয়নি ।
রাতুল স্টেশন এ পরবর্তী ট্রেন এর জন্য দাঁড়িয়ে ছিল । 6 টার সময় নৈহাটি লোকাল ঘোষণা করা হয় । রাতুল ধীরে ধীরে রেল গাড়ি তে গিয়ে ওঠে । জালনার ধারের একটা সিট ফাঁকা পেয়ে রাতুল সেখানে গিয়ে বসে।গাড়ি ছাড়বে তারকিছু সময় আগে একটি মহিলা তারা তারি ওঠে এসে রাতুলের পাশে ফাঁকা সিট পেয়ে ওখানেই বসে । রাতুল এক বার মহিলাটিকে দেখে আবার জালনা দিয়ে বাইরের দিকে তাকায় ।মহিলাটিও সিটে বসে একটু জিরিয়ে নিয়ে জল খেতে শুরু করে , রাতুলও সেই সময় মোবাইল বার করে কিছু একটা দেখছিল, জল খেতে খেতে হঠাত্ মহিলাটির নজর রাতুলের ওপর পরে, নজর পরতেই কিছু সময় এক ভাবে রাতুলের দিকে তাকিয়ে থেকে রাতুল কে জিজ্ঞাসা করে ” আপনাকে চেনা চেনা লাগছে ” রাতুল হঠাত্ করে এক অচেনা মহিলার থেকে একথা শুনে অবাক হয়ে যায় “।মহিলা টি আবার বলে ” আরে তুই রাতুল না? আমাকে চিনলিনাতো? যা মোটা হয়েছি চেনার কথাও না! আরে আমি বারাকপুর কলেজের ভূগোল এর ছাত্রী তোর বন্ধু পূজা। তুই B.sc ফাইনাল ইযারে ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট আর আমি ফাস্ট ক্লাস সেকেন্ড হয়েছিলাম।কিরে কিছু মনে পরলো?”
কিছুসময় একভাবে চেয়ে এত দিন পর কলেজের বন্ধু পূজা কে দেখে রাতুল লাফিয়ে ওঠে । আশে পাশের লোক তাদের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে রাতুল নিজেকে সামলে নিয়ে বলে “আরে তোকে তো চেনাই যাচ্ছেনা। ” পূজা , রাতুল কে বলে ” আমি তো এই 6 টার গাড়ি তে রোজ যাই তোকে তো কোনোদিন দেখিনি?” রাতুল জানায় আমি 5.30 এর নৈহাটি লোকাল এ যাই কিন্তু আজ অফিসে কাজ থাকা তে বেরোতে দেরী হওয়ায় ওই গাড়িটা মিস করেছি।” এই শুনে পূজা বলে “তুই তো হাইকোর্টের চাকরি টা করছিস তাই না ?রাতুল বলে “পরিবারের জন্য , আমার মা ও বোনের জন্য, ওদের ভালোর জন্য, বাবা মারা যাওয়ার পর ওদের সব দায়িত্ব আমার ওপর থাকাতে আমি তখন চাকরি টা নিয়ে নিয়েছিলাম।”রাতুল এবার পূজা জিজ্ঞাসা করে “তুই বুঝি রোজ এই 6 টার গাড়িতে বাড়িতে ফিরিস? আরও বলে তুই এখন কি করছিস?” রাতুলের এতগুলো জিজ্ঞাসা একসাথে শুনে পূজা হেসে বলে ” হ্যাঁ, আমি এই গাড়িতেই রোজ বাড়িতে ফিরি আর এখন আমি একটা স্কুলে চাকরি করছি। “রাতুল জানতে চায় “মাস্টার র্ডিগ্রি কোথা থেকে করে ছিলি “? পূজা বলে ” কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করেছিলাম M.sc পাশ করে SSC পরীক্ষা দিয়ে স্কুলের চাকরিটা পেয়েছিলাম”।
সেই সময় রাতুলের কলেজের অনেক পুরানো কথা মনে পড়ে যায়, পাশে বসে থাকা এই পূজা রাতুল কে ভীষণ ভাবে সাহায্য করেছিল; বাবা অল্প মাইনেতে চারজনের সংসার খুব কষ্ট করেই চালাতো, দামি দামি বই গুলো কিনেদিতে বাবার যে অসুবিধা হচ্ছে তা রাতুল খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারতো, রাতুল অনেকবার বাবাকে বলে ” আমি টিউশনি করি না,তাতে অনেক সুবিধা হবে ।”কিন্তু বাবা বলেছিল ” একদম না, টিউশনি করলে তোর পড়াশুনোর অনেক সময় নষ্ট হবে তুই মন দিয়ে লেখা পরা কর”। ঠিক সেই সময় এই পূজাই , নিজের বই রাতুল কে পরতে দিয়ে ভীষণ ভাবে সাহায্য করতো । এমনকি ভূগোল practical করার বিভিন্ন দামি সরঞ্জামও এই পূজাই হাসি মুখে কিনে অবধি দিত ।শুধুমাত্র তাই না ফাইনাল ইযারের পরীক্ষার form ফিলআপের টাকাও পূজাই দিয়েছিল ।
রাতুল কে একভাবে চুপ করে কিছু ভাবতে দেখে পূজা রাতুল কে জিজ্ঞাসা করে ” তুই কি এখনও সোদপুরেই থাকিস?” রাতুল জানায় ” হ্যাঁ, আমি সোদপুরেই নতুন বাড়ি কিনেছি”। পূজা বলে ” কাকুর কথাতো B.sc পাশ করতেই জেনেছিলাম, উনি মারা যাওয়ায় পরপরই তো তুই চাকরি পেয়ে পড়াশুনো ছেড়ে দিলি, কাকিমা আর তোর বোন কেমন আছে সবাই ?” রাতুল উত্তর দেয় ” মা মারা গেছে তিন বছর হয়েছে আর বোনের অনেক দিন আগেই বিয়ে হয়ে গেছে, ও এখন দিল্লিতে থাকে ।”
এরই মাঝে কখন যে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে দুজনের কেউই খেয়াল করলোনা। এবার পূজা রাতুল কে বললো অনেক দিন পর দেখা হলো বাড়িতে ফেরার আগে ” চল একবার বারাকপুরে নেমে কলেজের সামনের চায়ের দোকান এ দাঁড়িয়ে এককাপ করে চা খাওয়া যাক।”
রাতুল ও পূজার কথাতে রাজি হয়ে গেল । বারাকপুর এ ট্রেন থেকে নেমে দুজনে একসঙ্গে চায়ের দোকান এ গিয়ে দারালো। চায়ে চুমুক দিতে দিতে রাতুল , পূজা কে জিজ্ঞাসা করলো ” তুই তো নৈহাটি থাকতিস না, এখনও কি ওখানেই থাকিস? ” পূজা বলে ” এখনও ওখানেই থাকি। স্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে সারাটা দিন আর রাতে স্কুলের বাচ্চা দের খাতা চেক করেই সময় কেটে যায় ।” রাতুল বলে “কেন তুই বিয়ে করিসনি?” পূজা বলে “আমার পর দুটি বোনের বিয়ে দিতে গিয়ে আমার আর ওটা করা হয়নি এ ছাড়াও আমার মা রয়েছে , আর ওনার বয়সও হয়েছে আমি বিয়ে করলে কেই বা দেখবে ওনাকে?”
পূজা এরপর রাতুলের কাছে জিজ্ঞাসা করে ” কিরে তুই বিয়ে করেছিস তো”? রাতুল বলে ” হ্যাঁ, বিয়ে করেছি। ” শুনে পূজা জানতে চায় কি নাম তার?”ওর নাম সংঘমিত্রা । এক ছেলেও আছে নাম সোহম। এখন ও পি. এইচ. ডি করছে, জানায় রাতুল “।
সব শুনে পূজা, রাতুল কে বলে “তোর তো পুরো ভরা সংসার । আমি তোকে আজকে একটা কথা বলতে চাই যে কথাটা আমি কলেজে থাকতে অনেক বার চেয়েও বলতে পারিনি। আজকে বলছি কারণ এখন আমরা আমাদের জীবনের অনেকটাই পথ পেরিয়ে এসেছি, আর এখন তুই বন্ধনেও জরিযেছিস; আচ্ছা কলেজে পরার সময় আমি যে তোকে খুব ভালোবাসি একথা যানাতাম তাহলে কি তুই আমার ভালোবাসা মেনেনিটিস? ”
হঠাত্ করে এরকম কথাটা শুনে রাতুল অবাক হয়ে গেল । কিছুক্ষণ পূজা র দিকে চেয়ে থেকে বললো ” আমিও তোর অনেক অনেক ভালো গুনের জন্য তোকেও ভালোবেসে ফেলেছিলাম । তুই ভীষন ভাবে কলেজে পরার সময় আমার পাশে ছিলি , তুই না থাকলে আমি B.sc টা কোনো ভাবেই শেষ করতে পারতাম না। আমিও তোকে মনে মনে ভালো বেসেছিলাম কিন্তু পরিস্থিতির ফলে সাহস করে কোনদিন বলতে পারিনি। ” এই কথাটা শুনে পূজার চোখ দিয়ে জল ঝরতে শুরু করে । অনেক চেপে ও অশান্ত নদীর মতো তাকে আটকেতে পারেনা ।
পূজা চোখের জল মুছতে মুছতে বলে কালকে আমার জন্মদিন । আর এবছরের জন্মদিনে এটাই আমার সবচাইতে বড় উপহার । দীর্ঘদিন মনে জমে থাকা এক না জানা কথার উত্তর আজ আমি পেলাম ,তোর সাথে আমার আর কোনোদিন দেখা হোক বা না হোক, সত্যিই আমি আজ খুব খুশি”। রাতুল বলে ” তাহলে তোর ফোন নম্বরটা দে যোগাযোগ করা যাবে ।” শুনে ধরা গলায় পূজা জানায় ” ফোনের ওই দশটা নম্বর দ্বারা আর তোর সাথে যোগাযোগ রাখতে চাইনা, তুই সারাজীবন আমার মনের মণিকোঠায় থাকবি; সেখান থেকে তুই কোনোদিন হারিয়ে যাবিনা।”এরই মাঝে স্টেশন এ নৈহাটি লোকাল এসে ঢুকেছে। পূজা , রাতুলের দুটি হাত ধরে বলে ” খুব ভালো থাকিস, সুখী থাকিস;আজ বাড়িতে ফিরি তাহলে, মা নাহলে আবার খুব চিন্তা করবে “।তারপর চায়ের দোকানে দুইজনের টাকা মিটিয়ে দিয়ে পূজা রাতুল কে বললো ” তারা তারি বাড়ি যা বউ তোর জন্য অপেক্ষা করছে ।” এই বলেই পূজা নৈহাটি লোকালে ওঠে পরে ।
পূজা র চলে যাওয়ার পথের দিকে এক ভাবে তাকিয়ে রাতুল মনে মনে ভাবছিল এটা ঠিক যে নৈহাটি তে পূজার বাড়ি আমি চিনতামনা, আর তখন এখনকার মত অত ফোনেরও সুবিধা ছিলনা। কিন্তু যে মেয়েটাকে আমিও ভালোবেসেছিলাম আর যার অনেকটা অবদানের জন্যই B.sc পাশ করে সরকারী চাকরি টা পেয়েছিলাাম, ঠিক চাকরি টা পেয়েই তাকে ভুলে গিয়ে , তার একবারও কলেজ থেকে ঠিকানা জোগাড় করে খবর না নিয়ে বিয়ে করে সুখে জীবন কাটাচ্ছি।ও কিন্তু যখন জেনেছিল আমার বাবা মারা গেছে ঠিক বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে এসে খবর নিয়ে গেছে । আমি চাকরি পেয়েছি শুনে তখনও এসেছিল মিষ্টি নিয়ে, আমাকে congratulations জানাতে।আমি জীবনের গতিতে এগিয়ে চললেও , পূজা কিন্তু নিজের দুই বোনের বিয়ে দেওয়ার পরও নিজের মার কথাা ভেবে বিয়েটাও করেনি। রাতুল নিজেই নিজেকে বলে কতটা স্বার্থপর আমি!!
এমন সময় রাতুলের পকেটে থাকা ফোনটা টুং টাং শব্দ করে বেজে ওঠে । ফোনের দিকে চেয়ে রাতুল দেখে সংঘমিত্রা ফোন করছে । ফোন রিসিভ করতেই সংঘমিত্রা বলে ” কি গো এত দেরি করছো? শরীর ঠিক আছে তো? ” রাতুল বলে “আমি ঠিক আছি , আমি বারাকপুর পরে এসেছি ।” সংঘমিত্রা বলে “তুমি ওখানে কি করছো? ” রাতুল জানায় “এসেছিলাম এক বন্ধুর খবর নিতে, আর এখানে এসে জানলাম আমার সেই বন্ধুটা আজই মারা গেছে”। এরপরই রাতুলের চশমার ফাঁক দিয়ে জল ঝরতে শুরু করে আর চশমাটা ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে যায় ।।
কলমে শুভঙ্কর ভট্টাচার্য, ইছাপুর
একজন ছাত্র ।লেখালিখি করা আমার নেশা।