ভার্সিটি গ্রীষ্মের বন্ধ ঘোষণা করেছে দেড় মাসের জন্য। অরুণিমা তো বেশ খুশি। সে প্ল্যান করেছিল এইবারের ছুটিতে সে বন্ধুদের সাথে ঘুরবে, অনেক মজা করবে। কিন্তু সেসব কিছুই আর হল না। অরুণিমার বাবা একমাসের জন্য বিদেশ যাচ্ছে অফিসিয়াল কিছু কাজে। অরুণিমার মাও বেচে নেই, তাই মেয়ের ভালো চেয়ে দেড় মাসের জন্য চট্টগ্রামে পিসির বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল তার বাবা। যদিও প্রথমে অরুণিমার মত ছিল না, কিন্তু পরে সে রাজি হয়ে যায়, কারণ সে জানতো চট্টগ্রামে বেড়ানোর অনেক জায়গা আছে।  

অরুণিমা চট্টগ্রাম এসে পোঁছাল। রেল স্টেশন থেকে তাকে নিতে এসেছিল তার পিসিত বোন বৃষ্টি। এরপর রেল স্টেশন থেকে নিয়ে ঘরে পৌঁছানো পর্যন্ত বেশ আপ্যায়ন হয় তার। পিসি, পিসা আর বোনের সাথে অনেক আড্ডা হয় সে দিন। সে দিন বিকেল বেলায় অরুনিমা আর  বৃষ্টি ছাদে গিয়ে কথা বলছিল। হঠাৎ সে দেখতে পেল বৃষ্টিদের বাড়ির নিচে রুমের দরজা খুলে একটা ছেলে ঘরে ঢুকছে। সে বৃষ্টিকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারল ছেলেটার নাম অর্ক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বৃষ্টির বাবা রুমটা পরে থাকায় অর্ককে ভাড়া দেয়। অর্ক অবশ্য একা থাকতে পছন্দ করত, তাই সে অনেক খুঁজে এরকম কমদামে একটা পুরনো সিংগেল রুম পেয়েছিল। প্রথম দেখাতেই অর্ককে ভালো লেগে গিয়েছিল অরুণিমার।   

এর পরের দিন সকাল বেলায় অরুনিমা কাউকে না জানিয়ে অর্কর রুমে চলে আসে। দরজায় নাড়া দিতেই অর্ক দরজা খুলে দেখতে পেল অরুনিমাকে। প্রাই ১০ সেকেন্ড হা করে তাকিয়ে ছিল অর্ক, কারণ ওর রুমে এই প্রথম কোন মেয়ে এল, তাও অচেনা। অরুণিমাও একটু লজ্জা পেল। পরে সে বলল ‘হেলো, আমি অরুণিমা। এখানে বেড়াতে এসেছি।‘ অর্ক একটু লাজুক স্বভাবের ছেলে ছিল, তাই ওর উত্তর দিতে একটু সময় লাগল। ওইদিন প্রায় ১৫ মিনিটের মতো কথা হয় ওদের। অরুণিমা পায়ে নূপুর পড়ত, সেটা অর্ক লক্ষ করেছিল। অর্ক বলে ‘আপনার নূপুর গুলো তো খুব সুন্দর। বেশ মানিয়েছে কিন্তু।’ অরুণিমা বলে ‘থ্যাংক ইউ, এই নূপুর জোড়া আমার খুব পছন্দের।‘ অর্ক শুরু থেকেই অরুনিমাকে আপনি বলে সম্বোধন করছিল। বেপারটা অরুণিমার কাছে অস্বস্তিকর মনে হচ্ছিল। তাই অর্ককে সে বলে তাকে তুমি করে বলতে। ওই দিনের আলাপে অরুনিমা অর্ককে বলে সেও অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। 

এভাবে বেশ কয়েকদিন কথা হতে থাকে তাদের দুজনের। অরুণিমা লুকিয়ে লুকিয়ে প্রায় বিকেলে অর্কের সাথে কথা বলতে আসত। অর্কেরও ভার্সিটি বন্ধ ছিল, তাই বেশির ভাগ সময় সে ঘরেই থাকত। শুধু দিনে দুটো টিউশন করাতে যেত অর্ক, এছাড়া তেমন কোন কাজ ছিল না ওর। রোজ কথা বলতে বলতে অরুণিমার অর্ককে ভালো লাগা যে কখন ভালোবাসাতে রুপান্তরিত হয়ে যায় সে নিজেও বুঝতে পারে নি। ওদের এই ব্যাপারটা শুধু মাত্র বৃষ্টি ছাড়া আর কেউ জানত না। একমাত্র ওকেই বলেছিল অরুণিমা। 

পুরো ছুটি জুড়ে অরুণিমা অনেক ঘুরাঘুরি করে বৃষ্টির সাথে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন টুরিস্ট স্পট গুলো ঘুরে। এইভাবেই একদিন বিকেল বেলা মার্কেট থেকে ঘুরে এসে, অরুণিমা অর্কের সাথে কথা বলতে এসেছিল। অরুণিমার অজান্তেই ওর ডান পায়ের নূপুরটা খুলে পরে যায়। অর্ক সেটা খেয়াল করে, কিন্তু সে অরুণিমাকে কিছুই না বলে বিষয়টা এড়িয়ে গেছে। কথাবার্তা শেষ করে যখন অরুণিমা চলে যায়, তখন অর্ক হাতে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দেখছিল নূপুরটা। এর পর হেঁসে মনে মনে বলছিল ‘আহারে বেচারি! তোমার নূপুরটা এখন আমার হয়ে গেল। ‘ 

এদিকে অরুণিমা এই ব্যাপারে কিছুই জানে না। সে স্বাভাবিক ভাবেই পুরো দিনটা কাটালো। পরের দিন সকালে মুখ ধোয়ার সময় অরুণিমা খেয়াল করল, তার ডান পায়ের নূপুরটা নেই, চমকে উঠল সে। তাড়াতাড়ি বাথরুম থেকে বেরিয়ে নূপুরটা খোঁজা শুরু করল অরুণিমা। বেশ বিভ্রান্ত ছিল সে, তার সখের নূপুর জোড়ার একটা হারিয়ে গেছে। বৃষ্টিও ওকে বেশ সাহায্য করল নূপুরটা খোঁজার জন্য, কিন্তু কোন লাভ হয় নি। পুরো ঘর তন্ন তন্ন খুঁজেও পাওয়া যায় নি। এরপর অরুণিমার মনে পড়ল যে এর আগের দিন ও অর্কের রুমে গিয়েছিল। সে জলদি অর্কর ঘরে দৌড়ে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে ‘তুমি কি কোন নূপুর দেখেছ এখানে। আমার একটা নূপুর হারিয়ে গেছে।‘ অর্ক একটু শ্বাস নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল ‘কই আমি তো কোন নূপুর দেখি নি এখানে।‘ এরপর বৃষ্টি আর অর্ক অনেক শান্তনা দিয়ে অরুণিমাকে বুঝাল যে ওটা হয়তো মার্কেটে কোথাও খুলে পড়ে গেছে। 

দুই দিন অরুণিমার মন খারাপ ছিল। অর্ক ওকে তখন বলেছিল মন খারাপ কোরো না ‘এক পায়ে নূপুর পরাটাও কিন্তু মন্দ নয়, বরং এটা একটা নতুন ফ্যাশন বলতে পারো। ‘এটা শোনার পর অরুনিমা একটু লজ্জা পেয়ে বলেছিল ‘এমনিতেই আমি আরেক জোড়া নূপুর কিনার প্ল্যান করছিলাম। এখন আর কিনব না। তুমি বলছ যখন একটায় থাকুক’। অর্ক আর কিছু বলল না সেও একটা হাসি ফিরিয়ে দিল অরুণিমাকে।

এরপর সব আবার স্বাভাবিক হতে লাগল। অরুণিমাও আবার নিয়মিত কথা শুরু করল অর্কের সাথে। নূপুরের কথাটাও ভুলে গেছে অরুণিমা। অর্ক ওই নূপুরটাকে নিয়মিত দেখত আর অরুণিমার কথা ভাবত। সেও অরুণিমাকে ভালোবেসে ফেলেছে। একবার অরুণিমা অর্ককে প্রপোজ করার জন্য একটা চিঠি লিখেছিল। কিন্তু সাহস করে আর দেয়া হয়নি অর্ককে। 

সবকিছুই ঠিক ঠাক যাচ্ছিল। কিন্তু একদিন বিকেলে অরুণিমা আর অর্কের কথা আড়াল থেকে শুনতে পারে তার পিসি। ওদের কথাবার্তা শুনে উনি বেশ বুঝতে পারে যে ওদের অনেক আগে থেকেই আলাপ আছে। এরপর অনেক কথা শুনালো অর্ককে অরুণিমার পিসি, সব দোষ ওর ঘাড়েই চাপিয়ে দিল। অরুণিমা আটকানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তার পিসি তাকে থামিয়ে বলল ‘তুই চুপ থাক একদম। একটা কথাও বলবি না তুই।‘ তারপর আর কি, ওকে ঘর ছেড়ে দিতে বলল পিসি। অরুণিমার অনুরোধে ওর পিসি ওনার বর আর অরুণিমার বাবাকে এই বিষয়ে কিছু বলে নি। তার ঠিক দুই দিন পরেই অর্ক ঘর ছেড়ে দেই, অন্য একটা রুম পেয়েছিল সে। অরুণিমার পিসা জানতে চাইলে সে বলে ‘আমার একটা জরুরি কাজ আছে, তাই চলে যাচ্ছি আঙ্কেল’ সত্যিটা ভয়ে বলে নি অর্ক। 

দেখতে দেখতে অরুণিমার চলে যাওয়ার সময় এল। যাওয়ার দিন শুধু বৃষ্টি অরুণিমার সাথে রেল স্টেশনে এসেছিল। ওর পিসি আর পিসাও আসতে চেয়েছিল কিন্তু অরুণিমা বারন করে তাদের আসতে। অরুণিমা ট্রেইনে উঠবে এমন সময় অরুণিমা শুনতে পেল ‘দাড়াও অরুণিমা। আমাকে চিঠিটা না দিয়েই চলে যাচ্ছ? বলল অর্ক। ‘এটা তুমি কোথায় পেলে?’ বলল অরুণিমা। ‘বৃষ্টি আমাকে ফোনে সব বলেছিল। ও তোমার ব্যাগ গুছানোর সময় এই প্রপোজের চিঠি টা পায়।‘ তারপর অরুণিমা বৃষ্টির দিকে তাকেলে বৃষ্টি হেসে বলে ‘হ্যাঁ আমি তোর বাগে এটা পেয়েছি।’ তারপর অরুণিমা অর্ককে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। ‘ও হ্যাঁ তোমার একটা জিনিস আমার কাছে রয়ে গেছে। দাড়াও দেখাচ্ছি’ এটা বলে পকেট থেকে নূপুরটা বের করে অরুণিমাকে দেখাল অর্ক। ‘তার মানে তুমি…’ বলল অরুণিমা ‘হ্যাঁ ওটা তোমার ডান পা থেকে খুলে পরেছিল আমার ঘরে। তুমি যখন থাকতে না তখন এই নূপুরটা দেখলে মনে হতো তুমি আমার কাছেই আছো………’

নিবিড় বিশ্বাস , চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here