একান্নবর্তী পরিবার বর্তমানে একটি প্রাচীন কনসেপ্ট এ পরিণত হয়েছে l কেবলমাত্র টিভি সিরিয়ালে আর কিছু বিশেষ মূল্যবোধযুক্ত বাড়ীতে এখনো টিকে আছে l
আমিও একটি একান্নবর্তী পরিবারে বড় হয়েছি l ঠাকুরদা ঠাকুমা জ্যাঠা কাকাদের সাথে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল l
আমাদের বাড়ির সাবেক রান্নাঘরটা ছিল অনেকটা কফিহাউস এর মতো ….আড্ডার পীঠস্থান , ঘরটা ছিল বেশ বড় l একদিকে কয়লার উনুনে রান্না হতো , আরেকদিকে একটা লম্বা মস্ত খাবারটেবিল …. টেবিলের দুপাশে বেঞ্চ পাতা l
সকালে চায়ের আসরে একচোট আড্ডা আবার সন্ধ্যাবেলা একচোট….. বাড়িতে কোনো অতিথি এলে তো কথাই নেই , শুধুই কি আড্ডা ?..তর্ক…. ঝগড়া. সবই চলতো সমানতালে l এমন অবস্থা হয়েছে যে গোলমালের চোটে রাঁধুনিরা অর্থাৎ আমার মা কাকিমারা ওয়াকআউট করতে বাধ্য হয়েছেন , অবশ্য শুধু স্থায়ী সদস্যরা থাকলে অতটা জমতো না, আমার কাকা ও পিসিরা এলে পাশের বাড়িরও ঘুম ছুটে যেত , রান্নাঘর তো নয় ,যেন বিধানসভার অধিবেশন চলছে l
এই মেগা আড্ডায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আবার তিন সিনিয়র মেম্বার কানে শুনতেননা ভালো করে, লিপ রিড করে উত্তর দিতেন, অবস্থা সহজেই অনুমেয় , পর্যাপ্ত আলোর অভাব হলেই , ভুল উত্তর আসবে l এনাদের সাথে আমরা যখন কথা বলতাম ,তখন অন্য কেউ শুনলে ভাববে ফোনে কথা বলছে , কারণ ওনাদের স্বর নিচু আমাদের যথাসম্ভব উঁচুতে থাকতো l রান্নাঘরের এই আড্ডা সর্বোচ্চ গরিমা লাভ করতো পুজোর সময় , যখন কাকারা সব পুজোর ছুটিতে বাড়ি আসতো. l এই রান্নাঘরে অনেক ঐতিহাসিক সলা পরামর্শ সম্পাদিত হয়েছে , অনেক বিয়ের সম্বন্ধ পাকা হয়েছে, আরো কত কি…..
যাক ওসব কথা আরেকদিন হবে ,
এহেন রান্না ঘরে নতুন অতিথি হয়ে এলো একটি প্রেসার কুকার , তখন খুব কম বাড়িতেই দেখা যেতো এটা l অপারেশনও সবাই ঠিকঠাক জানতো না
রাঙাকাকিমার বিয়ের উপহার সামগ্রীর মধ্যে অন্যতম এই প্রেসার কুকার কিভাবে ব্যবহার করা হবে সেই নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে, l বিয়ে উপলক্ষ্যে বাড়িতে অনেক আত্মীয়স্বজন l কোন মেনু দিয়ে কুকার এর শুভ উদ্বোধন হবে , সেটা ঠিক করতেই এক ইউনিট আড্ডা আর কুড়ি বাইশ কাপ চা খরচ হয়ে গেলো l
পরদিন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুকে
বাক্স থেকে বার করে রান্নাঘরে নিয়ে আসা হলো l
পাড়ার এক সবজান্তা মাসিমা বলে
গেলেন, “খুব সাবধান বৌমা, বুঝেশুনে
ব্যবহার করো, কুকার ফেটে নাকি অনেক
দুর্ঘটনা হয়।” আমরা ভাবলাম বলে কি? এটা ফেটেও যেতে পারে নাকি ? বাবা শুনলেন হাত থেকে পড়লেও ফেটে যেতে পারে , যাক, তাঁকে আশ্বস্ত করা হলো সেরকম কোনো ভয় নেই l পাশের বাড়ির এক কাকিমাকে ডাকা হলো ঢাকনাটা খুলে দেবার জন্য , কিন্তু আধা ঘন্টা চেষ্টা করেও তিনি ঢাকনাটাকে কুকারের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলেন না , আমরা হতাশ ….. l
অবশেষে আমার বন্ধু ধ্রুব – শুভর বাবা এলেন পরিত্রাতা হয়ে, ভদ্রলোক বেশ ডাকাবুকো টাইপের, রাস্তার ধারে বান্দোর নাচ দেখতে যেমন সবাই ভিড় জমায়, তেমনি করে আমরাও ওনাকে ঘিরে ধরে মজা দেখতে লাগলাম….
উনি কুকারের ঢাকনাটা অত্যান্ত মুনসিয়ানার সঙ্গে খুলে ফেললেন…আমরা হাততালি দিয়ে উঠলাম l মনিকাকা বললেন, “যাক, ফাটেনি তাহলে l”
বন্ধুর বাবা বললেন, “ফাটবো ক্যান? ইটা কি বোমা?…. আনেন….কি রাইন্ধবেন সেইটা আনেন।”
আনা হলো..পাঁঠার মাংস মসলা দিয়ে মাখা….
কুকারটা ধুয়ে নিয়ে, উনি মাকে বললেন, ” এ্যর মধ্যি ঢালেন দেখি বৌদি। ” বাবা বললেন, “সাবধানে ঢালো….ফা..” বলেই চুপ করে গেলেন, l বন্ধুর বাবা বললেন, “ভয় নাই ইয়ার মধ্যি পোইরা পাঁঠা জ্যান্ত হইবো না।”
জ্যাঠা কানে কম শোনেন, বলে “কি.!,..ফাটলে কেউ জ্যান্ত থাকবে না ?” ঐ মাসিমা ঠিকই বলেছেন তাহোলে l
ঢাকনা বন্ধ করে কুকার টিকে কয়লার উনুনে বসানো হলো l একজন বললো, “যাই আমার আবার কাজ আছে l”
“কাজ আছে না ভয় পাইতাসো?” , বন্ধুর বাবা বললেন l উপস্থিত সবার মনেই তখন ভয় মিশ্রিত কৌতূহল , ক্লোজ ফিল্ডিং এর রিস্ক আর কেউ নিতে চাইছিলনা l
মিনিট দশেকে পর …..কুকারের হুইসেল বেরোবার ছিদ্র দিয়ে ফুস ফুস শব্দ তৎসহ ধোঁয়া বের হতেই দর্শক বৃন্দ সোজা বাউন্ডারি লাইনে , আর দু তিন মিনিটের মধ্যেই যখন নজলের ওপরের টুপি ঠেলে বাষ্প সজোরে শব্দ করে বেরিয়ে আসতে লাগলো ….স্টেডিয়াম ফাঁকা , যেন পুলিশ লাঠি চার্জ করেছে ,
তিন চারটে সিটির পর …বন্ধুর বাবা বললেন , “ন্যান, আপনাগো মাংস রেডি , সব গেলো কই ?” পাশের বাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে সেজো কাকিমা বললো , “আমরা এখানে” …..বন্ধুর বাবা একা ঘরেই হো হো করে হাসতে লাগলেন।
লেখক পরিচিতি: অরূপ ডিউক চক্রবর্তী